এই গল্পের ঘটনাস্থল বহু বহু দূরের একটি দেশ।
এবং সময় কোনও এক সুন্দর সোনালী সন্ধ্যাবেলা।
এখনও আকাশে সূর্যের আলো কিছুটা আছে। শহর হলে কী হবে, অস্তগামী সূর্যের স্বর্ণালী আলোকচ্ছটা দিগন্তে যে সৌন্দর্যের পসরা বসিয়েছে তা পশ্চিম আকাশের দিকে তাকালে ভালোই বোঝা যায়। রোদ পড়েছে খুব, শহর বলেই কিনা ভ্যাপসা গরম আর ধূলো। এখানকার ধূলো কেমন যেন লালচে লালচে দেখতে। একটা ভারী আবহাওয়া বাতাসে যেন সব সময়ের জন্য ঝুলে থাকে।
বিকেলের দিকে একটু মিহি ঠান্ডা বাতাস পাওয়া গিয়েছিলো, এখন তা-ও নেই। এই পরিবেশ ভালো লাগছেনা কারো।
**
কামাল স্যার আমাদেরও একদিন আগে এসেছেন, এদেশের কর্মকর্তারা তাঁর উপর দারুন সন্তুষ্ট। আমাদের আপ্যায়নের কোনও ক্লান্তি নেই কারও। অন্তত এখনও তেমন দেখিনি। এদিক ওদিক থেকে জল-খাবার আসছে, নিরাপত্তা কর্মকর্তারা দরকারের চেয়ে বেশিই কাছাকাছি থাকছেন যেন।
আগে যে ক'বার এদেশে এসেছি ঘুরে দেখার তেমন একটা সুযোগ হয়নি। সত্যি কথা বলতে কী, এই দেশ ঘুরে দেখার মত খায়েশ আমার নেই, শুধু মাত্র খেলতে আসা বলেই কিনা যতটুকু দেখতে হয় দেখছি। এদেশের লোকজনও আমার তেমন একটা পছন্দ হয় না। এরা কেমন যেন বড় ভাই বড় ভাই ভাব নিয়ে তাকায় আমাদের দিকে। যেন আমরা কোনও অবাধ্য ছোট ভাই যে ভুল করে এখন আর ক্ষমা চাইছে না। আমি আগে একবার এখানে খেলতে এসে হোটলের রেস্টরুমে যাওয়ার পথে এক হোটেল কর্মকর্তাকে বলতে শুনেছিলাম, ইছ ইস্ট পাকিস্তানি প্লেয়ারছে তকলিফ মত্ করো, দে ডোন্ট আস্ক মাচ্ , দে আর নট লাইক জিম্বাবুইয়ানস্।
সেদিন থেকেই এদেশ ঘুরে দেখার সাধ আমার মরে গেছে।
**
হোটেলে পৌঁছেছি দু'ঘন্টার মতো হয়েছে। ফেরার পর শাওয়ার নিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার সময় একটু ঘুম ঘুম ভাব এসে গিয়েছিলো। ডাক শুনে হঠাৎ চমকে উঠে দেখি কৌশিক ভাই রুমে। বললো আমাদের নাকি আজ প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রনে তার খাস মহলে যেতে হবে। আমার গা গুলিয়ে উঠলো। তবে আমাকে বোধহয় খুব বড়জোর পাঁচ-দশটা হ্যান্ড শেক করলেই হবে। আমি তো আর অধিনায়ক নই।
কৌশিক ভাই-র মনটা আজ খুব ভালো, মন ভালো থাকলে এই পাবলিকের কথা থামানো যায় না। সবলে মুখ চালিয়ে যাচ্ছেন, এমন সময় ট্রলিতে হালকা খাবার নিয়ে এক সুদর্শনা ওয়েট্রেস রুমে ঢুকে বললো, 'দিস ইজ এ কমপ্লিমেন্ট ফ্রম মি. জাকা' কথাটা বলে কোমরটা সামান্য ডানদিকে বাঁকিয়ে বাম হাতটা কোমরের উপর রেখে এমন একটা ভঙ্গিতে দাঁড়ালো যে আমি উত্তর দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেললাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য। বাচাল কৌশিক ভাই এগিয়ে এসে বাচিয়ে দিলো এযাত্রা, থ্যাঙক ইউ, উই ক্যান টেক ইট ফ্রম হেয়ার...! বলে পরোক্ষ ভাবে মেয়েটাকে জানিয়ে দেয়া হলো যে রুমে তার উপস্থিতির প্রয়োজন ফুরিয়েছে। বিবাহিত হবার যে একটা দারুন আপসাইড আছে তা ভালই বুঝলাম। তবে যে জিনিসটা বুঝলাম না তা হলো, 'শুধু হালকা খাবার কিভাবে কমপ্লিমেন্ট হয় ?!'
**
কয়টা পাজেরো যে আমাদের গাড়ি বহরে আছে তা আমি ঠিক গুনে উঠতে পারি নি। হোটেল থেকে বেরোনোর পরই একজন নিরাপত্তাকর্মী আমাকে আর কৌশিক ভাই কে এক রকম ঠেলে গুতিয়ে এই পাজেরোটার পেছনে ভরে দিয়েছে। গায়ে হাত দিয়ে টানাটানি আমার একদমই অপছন্দ, কিন্তু বিশেষ কিছু করারও নেই এ পরিস্থিতিতে। অন্যরাও ঠিক ঠাক উঠেছে মনে হয়, তবে তামিম আসতে পারেনি ওর পায়ে চোট লেগেছে, পরের ম্যাচ খেলতে পারবে বলে মনে হয় না।
হোটেলে ঘুমাতে পারিনি ঠিকমতো, তাই থেকে ঢুল আসছিলো। কৌশিক ভাই-র বোধ হয় ঘুম পেয়েছিলো, কারণ গাড়িতে কেউই তেমন কথা বলছিলো না। শুধু আমাদের নিরাপত্তাকর্মীর মোবাইলের রিং হওয়ার আমার ঘুমটা আবার চটে গেল, এবার আর থাকতে পারলাম না, মনে হলো কমপক্ষে দুকথা শোনানো দরকার লোকটাকে। কথা বলার জন্য ডাকতে যাবো এমন সময় হঠাৎ করে মনে হলো যেন প্রচন্ড জোরে ভুমিকম্প আরম্ভ হয়েছে। আমার মাথা ঘাই খেলো গাড়ির ছাদে, চোখের মধ্যে লাল আলো দেখতে পেলাম, গালের ভেতর লোনা অনুভূতি হলো, দাঁত মনে হয় ভেঙে গেছে। তবে বিশ্ময় আরো বাকি ছিলো, হুশ যখন একটু একটু করে ফিরে আসছে তখন আমি উল্টানো গাড়ির জালনা দিয়ে অর্ধেক শরীর বাইরে হয়ে পিচের রাস্তায় শুয়ে, সামনে দিকের প্রায় সবগুলো গাড়িই জ্বলছে, ঘটনা কী তা বুঝতে পেরে ভয়ে আমার পায়ের পেশি গুলো অবশ হয়ে গেলো। তখন দেখতে পেলাম আমার মাথার দিকে দুই বাসা সামনের এক গলিতে একটা লোক অন্ধকারের মধ্যে ছুটে আসলো। তার কাধে জোয়ালের মত কী যেন। আমি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলাম সাহায্যের আসায়। কিন্তু কোনও উত্তর না দিয়ে এক হাটু ভেঙে গলির মুখে বসে পড়ল লোকটা, কাধে এখনও জোয়াল। তারপর দেখলাম সেই জোয়াল থেকে সাই করে ধুমকেতুর মত কী যেন একটা ধেয়ে আসলো আমাদের দিকে। গাড়িতে সরাসরি লাগলো না, রাস্তার উপরই পড়লো, কয়েক মুহুর্ত বিশাল আলো তারপর, কাদাটে অনুভুতিতে রাস্তা ছেয়ে গেছে এখন। মনে হলো যেন জ্ঞান হারাচ্ছি, এমন সময় একটা চিৎকার শুনলাম, মনে হলো এই কথা শুনে মৃত্যুবরণ করা তো ভাগ্যের ব্যাপার।
**
খবরে প্রকাশ বাংলাদেশে শুধু কান্না আর কান্না, কামাল সাহেব স্বদেশে এখনও ফেরেননি। তামিম ফিরেছেন কিন্তু তার অবস্থা পাগলপ্রায়। কারো সাথে কথা বলবেন না জানিয়েছেন। শাহবাগ থেকে রনহুংকার শোনা যাচ্ছে। দেশের অবস্থা শোচনীয়।
-কণাদ
মন্তব্য
স্বপ্নেও এমন কিছু যেন না ঘটে
সমস্ত হৃদয় দিয়ে সহমত
বুক ভরা সাহসী লেখা*****
কষ্ট করে পড়ার জন্য সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
-কণাদ
নিষ্ঠুর ভাবনা
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
নতুন মন্তব্য করুন