আমি ঠিক জানিনা আশ্রমের মেয়েটাকে এতটা অসাধারণ দেখায় কেন। রোজ সূর্যোদয়ের সময় তাকে দেখি এই বিশালাকার শতবর্ষী গাছটার নিচে এসে দোলনায় দুলতে দুলতে গুনগুন করে গান গাইতে। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি। একটু একটু সুর তুলতে চেষ্টাও করি মাঝেমধ্যে। কিন্তু বুঝি না, তার সুরের অর্থ, তার গানের কথার অন্তর্নিহিত ভাব। তার গানের সুরে মোহিত পল্লবেরা নেচে ওঠে। বাতাস এসে তাতে ঢেলে দেয় অনিঃশেষ মাধুর্য। আমি খুব বিরক্ত হই। মেয়েটার কণ্ঠের সাথে আমার আর কিছুকেই তুলনীয় লাগে না, আর কোনোকিছুকেই এতটা মধুর লাগে না। বাতাসের সুর, পল্লবের মৃদুধ্বনিকে বাহুল্য বলে বোধ হয়। আমার তরুণ চোখ দিয়ে তাকে লক্ষ করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
মাঝেমাঝে তাকে দেখি ভীষণ বিষাদে দোলনায় এসে স্থবির বসে থাকতে। বাতাসেরাও তার বিষাদে স্থবির হয়ে যায়, পল্লবেরা নিশ্চল নুয়ে থাকে। আমি প্রতীক্ষায় থাকি তার সুরের খেলা শুরু করবার। অপেক্ষা করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অবশেষে মেয়েটা একসময় উঠে যায় দোলনা ছেড়ে। আমি তার চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকি, যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। দোলনাটা বহুক্ষণ দুলতে থাকে, তার উপস্থিতির চিহ্ন রেখে।
আজও দোলনায় মেয়েটা স্থবির বসে আছে। মেয়েটার চোখে স্বচ্ছ জলকণা। উজ্জ্বল হীরকখণ্ডের মত, নাকি মুক্তোর মত? নাহ, কোনোকিছুর সাথেই আসলে মেয়েটার কোনোকিছুরই তুলনা হয় না। আমি ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ি। এত অনন্য কেন মেয়েটা?
হঠাৎ মেয়েটা ঝটকা দিয়ে দোলনা থেকে উঠে গিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে, “কেউ কি নেই? কেউ কি নেই, যে আমাকে একটু বোঝে? কেউ কি নেই??” আমি অবাক হয়ে তাকাই মেয়েটার দিকে। “এতদিন ধরে, এতদিন ধরে কি আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না?” প্রশ্ন করি তাকে। সে ফিরেও তাকায় না। আশ্রমের পথে দৌঁড়াতে শুরু করে দুহাতে মুখ ঢেকে। খুব কি কষ্ট দিয়ে ফেললাম মেয়েটাকে…
নীল পাহাড়ের দিকে চলতে শুরু করি। মেয়েটা তিনটে নীল গোলাপ পাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল তার গানে। দেখি, খুঁজে পাই কি না। তার অভিমান ভাঙাতে যে কোনোকিছু করতে পারি আমি।
নীল গোলাপের খোঁজে উপত্যকা চষে ফেললাম আমি। বৃদ্ধ গোলাপচাষী, শহরের ফুলের দোকান, গহীন অরণ্য…তন্নতন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে কিভাবে যে দুটো মাস কেটে গেল…জানিনা। অবশেষে আমি তিনটে নীল গোলাপ যোগাড় করতে পারলাম।
ফিরবার আগের রাতটা আমার স্বপ্নের মত কাটলো। সুরে সুরে পাহাড়ের নীরবতা চূর্ণ করলাম, বাতাসের ঘুম ভাঙালাম, সদ্য ঝরা পাতার দল চারপাশে নেচে নেচে আমার সুরে সুর মেলালো। আমি শোনালাম, মেয়েটার অনন্যতার কথা, অসাধারণত্বের কথা। নির্ঘুম কাটালাম সারাটা রাত। তার জন্যে।
ভোরে কেন যেন বেশ কষ্ট হচ্ছিল। পারছিলাম না একেবারেই। আরও কয়েকজন এসে সাহায্য করতে চেষ্টা করলো, বলল, পৌঁছে দেবে তারা কজন মিলে। কিন্তু, আমি দেখাতে চাইছিলাম যে মেয়েটাকে আমি কতটা ভালোবাসি। প্রাণান্ত চেষ্টা করছিলাম আমি। এক বৃদ্ধ অশ্বত্থ আমার এতদিনের ভুল ভাঙালো সহসা। আমার সব মোহের জাল ছিন্ন করে বলল, “মেয়েটার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা তিনটে নীল গোলাপ তুমি তুলতে পারছ না, তার হাতে তুলে দিতে পারছো না; তোমার ছোট্ট ডানা কি তাকে সারাটা জীবন আগলে রাখতে পারবে, তরুণ নাইটিঙ্গেল?”
[অস্কার ওয়াইল্ডের "দ্য নাইটিঙ্গেল এ্যাণ্ড দ্য রোজ" এর সামান্য ছায়া অবলম্বনে।]
-কাঠপুতুল
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%73%68%61%68%72%69%6e%61%2e%72%2e%61%6c%61%6e%61%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%22%3e%73%68%61%68%72%69%6e%61%2e%72%2e%61%6c%61%6e%61%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))
মন্তব্য
গল্পটা, আমাদের সামনে খুব আয়রনি নিয়ে যেমন হাজির হয় শেষে, বাকি অংশটুকু আবার একটা অন্যরকম স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়...তবু, শেষ অবধি অশ্রুই এখানে প্রধান প্রতিক্রিয়া হয়ে দেখা দেয়, পাঠের শেষে...
লেখার সময়কার অনুভূতি পাঠকের মনে দু এক ফোঁটা ছড়িয়ে দিতে পারলেই সার্থকতা! ধন্যবাদ। শুভ কামনা নিরন্তর।
-কাঠপুতুল
"তাঁর খেয়ালে নাচি, তাঁর খেয়ালে বাঁচি"
বিষন্ন হয়ে বসে রইলাম, হয়তো চোখে কয়েক ফোঁটা জলও চলে এলো।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
কখনও হয়ত জীবন থেকে উঠে আসা গল্প জীবনকেই নাড়া দেয়!
শুভ কামনা নিরন্তর।
-কাঠপুতুল
"তাঁর খেয়ালে নাচি, তাঁর খেয়ালে বাঁচি"
নতুন মন্তব্য করুন