“শিল্পসৃষ্টির এক মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের নাম যদি কোনওদিন হারিয়েও যায় তা হলেও চ্যাপলিনের নাম বেঁচে থাকবে। চ্যাপলিন অমর।”
— সত্যজিৎ রায়
এক
এক বিরাট বুটজোড়া,গোল হ্যাট ও একখানি বাঁকানো ছড়ি এই (অ)সাধারণ তিনটি প্রতীকের মধ্য দিয়ে যে মানুষটি বিশ্বের ছেলেবুড়ো সবার কাছে এখনও অমর হয়ে আছেন তিনি নিঃসন্দেহে আর কেউ নন, বিশ্ব চলচ্চিত্রের মহান(বা জনপ্রিয়তম)কিংবদন্তী চার্লি চ্যাপলিন (১৮৮৯-১৯৭৭)। এই মানুষটিকে ও তাঁর চলচ্চিত্র নিয়ে এ পর্যন্ত অনেক কিছুই লেখা হয়েছে,এখনও হচ্ছে; লেখা হচ্ছে তার জীবনী, তার চলচ্চিত্রের বিশ্লেষণ, এমনকি তার চলচ্চিত্রের কাহিনীও সংকলন করা হচ্ছে । এত সব লেখার ভিড়ে প্রখ্যাত-বিদগ্ধ চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনের চার্লি চ্যাপলিন বইটি বেশ খানিকটা আলাদা ধরনের,ভিন্ন বিন্যাসের ও কিছুটা স্বতন্ত্র মেজাজের। মূলত দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটি একই সঙ্গে বড় প্রেক্ষাপটে চ্যাপলিনের জীবনী,স্মৃতিকথা,নানা তথ্যের সম্ভার,তাঁর কয়েকটি চলচ্চিত্রের সংক্ষিপ্ত কাহিনী, সমালোচনা,তাঁর শিল্পী জীবনের তাত্ত্বিক আলোচনা এবং অভিনীত সকল ছবির তালিকা। বলা যায় সবকিছুর এক সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটেছে এ বইয়ে। উপরি পাওনা হিসেবে আছে চ্যাপলিন,তাঁর সিনেমার সহশিল্পীদের ও পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন সময়ের ছবি,তাঁর সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যের কিছু স্থির চিত্র,বিজ্ঞাপন ও পোস্টারের এক রঙিন সংকলন। এগুলি বইয়ের ভিস্যুয়াল বা দেখনদারির মূল্য বেশ বাড়িয়েছে। এক কথায় বলা যায় বইটির উদ্দেশ্য হল চ্যাপলিন ও তাঁর পরিপার্শ্বের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্রায়ন করে পাঠকের মনে তাঁর সর্ম্পকে একটি সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান।
বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। এই নতুন সংস্করণ কলকাতার নিউ এজ প্রকাশনী থেকে বের হলো ২০০৭-এ। এ সংস্করণে ‘চ্যাপলিননামা’ (নামটি তপন রায়চৌধুরীর সম্প্রতি প্রকাশিত আলোচিত আত্মজীবনী ‘বাঙালনামা’ থেকে ধার করা বলে লেখক জানিয়েছেন) শীর্ষক একটি নতুন বিভাগে সংযোজিত হয়েছে মৃণাল বাবুর গত কয়েক বছরে প্রকাশিত চ্যাপলিন সংক্রান্ত উঁচু মানের দুটি বাংলা ও পাঁচটি ইংরেজি প্রবন্ধ। এসবকিছু মিলেই বইটির পরিমার্জিত-পরিবর্ধিত এই নতুন সংস্করণ ।
দুই
এ বইতে লেখক চ্যাপলিনের জীবনকথা বেশ যত্নের সাথে একেবারে দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন। ছোটবেলা থেকে জীবনসায়াহ্ন পর্যন্ত চার্লির জীবন ও মানসের নানা তথ্য-প্রসঙ্গ এসেছে এখানে। বিচিত্র অম্লমধুর ঘটনা হতে শুরু করে তাঁর জীবনের উত্থান-পতন,চলচ্চিত্রজীবন,দাম্পত্য এমনকি হিসেবিপনার কথাও বাদ পড়েনি। আরেকটি বিশেষত্ব হলো এ বইতে কখনো চলচ্চিত্র শিল্পী চ্যাপলিন মানুষ চ্যাপলিনকে ছাপিয়ে যায়নি;উভয় দিকই এখানে সমানভাবে আলোচিত হয়েছে।
কোন ব্যক্তির জীবন ও কর্মকে ভালভাবে বুঝতে চাইলে তাঁর চরিত্রের সব দিকের কথা জানার কোনো বিকল্প নেই । মৃণাল বাবু এই কাজটি বেশ ভালভাবেই এ বইতে করেছেন। তিনি নানা রকমের শ্রুত-অশ্রুত তথ্য বিভিন্ন্ র্নিভরযোগ্য সূত্র হতে খুঁজে এনে স্বাভাবিক বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে ব্যাপকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন চ্যাপলিনের চরিত্রের সব দিককেই। চ্যাপলিনের জীবন সম্পর্কে কোন রকমের অসচ্ছতা নেই এই বইতে,নেই তাঁর জীবনের কোন তথ্য-ঘটনা অতিরঞ্জনের বা লুকোবার চেষ্টা । এখানে পাই তাঁর দুই বছরের কেতাবি শিক্ষার কথা, দারিদ্র্যের তাড়নায় নানা বিচিত্র পেশা গ্রহণ, চলচ্চিত্রের মাঠে প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়,বহু প্রণয়িনীর সঙ্গে প্রণয়-বিবাহ-বিচ্ছেদ,রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তা-আদর্শ, পুঁজিবাদী শক্তির সঙ্গে তাঁর মানবতাবাদী চেতনার লড়াইয়ের ঘটনা হতে ব্যবসায়ী চ্যাপলিনের কথাও─যার কাছে সব ঠিক কিন্ত "বিজনেস ইজ বিজনেস"; চার্লির সব দেখা-অদেখা রূপই সফলভাবে (সত্যতার কষ্টিপাথরে ঘষেও বটে) আবিস্কৃত এখানে।
বইয়ের গোড়াতে পাই চ্যাপলিনের জন্মবৃত্তান্ত ও ছোটবেলার জীবনযুদ্ধের কাহিনী। তাঁর মদ্যপ বাবা,ছোটখাটো অভিনেত্রী মা ও এক বৈমাত্রেয় বড় ভাই সিডনির সঙ্গে দক্ষিণ লন্ডনের এক অতি সাধারণ বস্তিতে এলোমেলো আয়ের অসচ্ছল সংসারে অশান্তির জীবনের কথা। যেখানে নিতান্তই অনাদরে অবহেলায় রাস্তায় রাস্তায় বাউন্ডুলের মতো এদিক-ওদিক ঘুরে কাটতো তাঁর দিন। আশা-আকাক্সক্ষা,হাসি-আনন্দ কোনোকিছুরই দেখা মিলতো না,যেন এক আশাহত লাঞ্ছিত মানুষ।
চ্যাপলিনের ছেলেবেলার জীবন যে কতটা দুঃখ-কষ্টের ছিল,তা বোঝা যায় বইতে উল্লেখিত একটি ঘটনা থেকে। চ্যাপলিন ও তাঁর ভাই সিডনি গেছেন এক শহরে কাজ খুঁজতে। পকেটে পয়সা নেই ফলে তাদের উঠতে হল সস্তার সরাইখানায়। সেখানকার মালিকের নির্দেশ— ঘরে রান্না করা যাবে না, কিন্ত তাদের অত পয়সা নেই যে বাইরে থেকে খাবার কিনে খাবেন। তাই তাঁরা এক বুদ্ধি করলেন,সিডনি ঠিকই ঘরে রান্না করবেন তবে যাতে মালিক রান্নার শব্দ শুনতে না পারেন সে জন্য চ্যাপলিন বেহালা বাজাবেন উচ্চৈস্বরে। ঠিক চ্যাপলিনের ‘গোল্ড রাশ’ সিনেমার জুতো খাওয়ার সেই বিখ্যাত দৃশ্যটির মতোই জীবনের বেশ হাস্যদায়ক ব্যাপার অথচ কী নিষ্ঠুর-নির্মম পরিহাস!
বইটিতে চ্যাপলিনের দুঃখময় জীবনকথার সাথে কিছু মজার ঘটনারও উল্লেখ আছে। যেমন―একবার চ্যাপলিন গেছেন মহাত্মা গান্ধীর(চ্যাপলিন প্রথমে তাঁকে দেখে ভেবেছিলেন একজন ‘অর্ধ-উলঙ্গ ফকির’!) সঙ্গে দেখা করতে। আলাপচারিতা চলছে দুজনের মধ্যে। চ্যাপলিন তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন যন্ত্র সভ্যতার জন্য বড় উপকারী জিনিস। গান্ধীজী বললেন, যন্ত্র জিনিসটা পাশ্চাত্যের মানুষের কাজে আসতে পারে,কিন্তু প্রাচ্যের মানুষের জন্য তা অবশ্যাই বর্জনীয়। চ্যাপলিন এ কথার জবাব দিতে যাবেন ঠিক সে সময় মহাত্মা উঠে দাঁড়িয়ে ট্যাঁক থেকে ঘড়ি বের করে দেখে বললেন,‘আমার প্রার্থনার সময় হয়ে গেছে,আমি চললুম।’ গান্ধীজী এখন নিজেই যন্ত্র ব্যবহার করছেন!
আবার যখন চ্যাপলিন বেশ প্রতিষ্ঠিত ও বিখ্যাত,সেই সময়ে একবার আমেরিকা হতে ইউরোপ যাওয়ার পথে এক রুশ ভদ্রলোক নাকি তাকে প্রশ্ন করেছিলেন যে তাঁর মতে কে বড়─লেলিন না লয়েড জর্জ (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী),চ্যাপলিনের ছোট কিন্তু বিস্ফোরক জবাবটি ছিল─ “One works,another plays” জবাবটি হতে বোঝা যায়,তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কতটুকু তীক্ষ্ণ ছিল। চ্যাপলিনের এ ধরনের আরো অনেক জানা-অজানা ঘটনা ও তথ্য এ বইয়ের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
তিন
এ বইতে চ্যাপলিনের জীবনকথার সঙ্গে লেখক যেভাবে তাঁর বেশ কয়েকটি বিশ্ববিখ্যাত ও নানা কারণে বিশিষ্ট চলচ্চিত্রের সংক্ষিপ্ত অথচ চমৎকার কাহিনী কালানুক্রমিকভাবে বর্ণনা করেছেন তা সত্যিই উপভোগ্য। তাঁর ‘মডার্ন টাইমস’,‘গোল্ড রাশ’,‘সিটি লাইটস্’,‘দি কিড’.‘দি গ্রেট ডিক্টেটর’ সহ আরও কয়েকটি অসাধারণ চলচ্চিত্রের কাহিনীর সুনিপুণ বর্ণনা লভ্য এখানে। কাঠখোট্টা নীরস বর্ণনা নয়, যেহেতু মৃণাল সেন নিজেও একজন প্রজ্ঞাবান চলচ্চিত্রকার তাই তিনি বেশ রসসহযোগে চলচ্চিত্রগুলির মূলভাব এতটুকুও নষ্ট না করে এমনভাবে কাহিনীর বর্ণনা দিয়েছেন যে পাঠক পড়তে পড়তে যেন ওই চলচ্চিত্রের দৃশ্যগুলি নিজের চোখের সামনে দেখতে পাবেন। বলা দরকার,লেখক শুধু এখানে চলচ্চিত্রগুলির কাহিনীই শোনাননি,প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রকে ঘিরে চার্লির জীবনের নানা ঘটনা এবং পর্দার পেছনের কথাও তুলে ধরেছেন। এমনকি চলচ্চিত্রটি তৈরির সময়কার রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির বর্ণনা, চলচ্চিত্রশিল্পের প্রেক্ষাপট,চলচ্চিত্রটিকে নিয়ে চ্যাপলিনের ভাবনা,কুশীলব নির্বাচনের বিবরণ তুলে ধরেছেন ও তার বস্তুনিষ্ঠ আলোচনাও করেছেন। লেখকের লিখনশৈলির মুন্সিয়ানা বোঝাতে ‘মডার্ন টাইমস’ চলচ্চিত্রের বিবরণ থেকে কিছুটা তুলে দেওয়া হল:
শুরুতেই দেখা গেল এক দঙ্গল ভেড়া। নিতান্তই নিরীহ, অভাগা। ভেড়ার দলটিকে ঠেঙিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মস্ত এক ফাটকের ভিতরে। পরক্ষণেই দেখানো হল, বিস্তর মজুর ঢুকছে কারখানায়। তাদেরই সঙ্গে টুকটুক করে ঢুকছে ভবঘুরে চার্লি। অর্থাৎ চার্লি পুরোদুস্তর মজুর বনে গেছে । কারখানায় চার্লির কাজের অন্ত নেই। চারপাশে যন্ত্রের গতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সে। ....কারখানার মালিকের একমাত্র নজর, কেমন করে বেশি খাটানো যায় মজুরদের,কেমন করে কাজ বাড়ানো যায়। দুপুরে মানুষদের টিফিনের সময়টাকে কমিয়ে না দিলেই নয়। ভেবেচিন্তে খেটেখুটে মালিক এক অভিনব যন্ত্র আবিষ্কার করল যে যন্ত্রের সাহায্যে খেতে গিয়ে মজুরদের এতটুকু কায়িক শ্রম করতে হবে না এবং খাওয়াটাও হয়ে যাবে মুহূর্তের মধ্যে। টিফিনের সময় মজুর-চার্লি যন্ত্রের সামনে এসে দাঁড়াতেই এমনি যান্ত্রিক কসরত শুরু হলো যার ফলে চার্লিকে হতে হল নাকালের একশেষ। খাওয়া তো হলই না,যন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে কায়িক পরিশ্রম বেড়ে গেল শতগুণ।
এর পরই পাচ্ছি লেখকের ব্যাখায় ঐ চলচ্চিত্র তৈরির তৎকালীন প্রেক্ষাপট ও পরে দর্শকদের প্রতিক্রিয়ার কথা:
সমস্ত দরদ,আবেগ আর তীব্রতা দিয়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে যা তিনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন তা হল আধুনিক যুগের পর্যুদস্ত মানুষের কথা। ....ভবঘুরের ব্যর্থতায়,বিপর্যয়ে,লাঞ্ছনায় একদিকে যেমন বরাবরের মতো হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হল,অন্যদিকে তেমনি সমাজের চালু মূল্যবোধগুলির অসারতার প্রমাণ পেয়ে সেগুলিকে হেয় প্রতিপন্ন হতে দেখে পৃথিবীর শতকরা নব্বইজন মানুষ প্রাণ খুলে হেসে উঠল।
এভাবেই চ্যাপলিনের এইসব চলচ্চিত্রের কাহিনী বিশ্লেষণসমেত ফুটে ওঠে এ বইতে। লেখকের প্রকাশভঙ্গির স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের গুণে পাঠক এতে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না ।।
চার
বইটি যে শুধু তথ্যবহুল নয়,লেখকের নিজস্ব উপলব্ধির তাত্ত্বিক আলোচনাও এখানে আছে একথা আগেই বলা হয়েছে। মৃণাল সেনের চ্যাপলিন এবং তাঁর চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে নিজস্ব বেশকিছু অভিনব সমালোচনা-বিবেচনা ও মৌলিক চিন্তার সুচারু প্রকাশ ঘটেছে এখানে। যা চ্যাপলিন-গবেষক,তাঁর প্রসঙ্গে উৎসাহী ব্যক্তি, চলচ্চিত্রবোদ্ধা থেকে সাধারণ পাঠকেরও মননকে নাড়া দিতে এবং চিন্তার খোরাক যোগাতে সক্ষম।
বলতে দ্বিধা নেই,এর আগে অনেক লেখকই চ্যাপলিন ও তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয়ে নানান ব্যাখ্যা-তর্ক করেছেন বা এখনও করছেন; কিন্তু আলোচ্য বইটির বিশ্লেষণগুলি বোধ হয় পাঠকের জন্য বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে ও সোজাসাপটা স্পষ্ট করে বলা। এই তাত্ত্বিক আলোচনাগুলি বেশ অন্যরকম, সূক্ষ্ম এবং যুক্তিযুক্ত,যা চ্যাপলিন বিষয়ে পাঠকের মনে নতুন ধ্যান-ধারণা ও সমালোচনামূলক তর্ক সৃষ্টি করতেও সক্ষম। অন্যদৃষ্টিতে দেখলে বিশ্লেষণগুলো ধরন-ধারণে র্নিমোহ আর নিরপেক্ষও বটে,হাসান আজিজুল হকের ভাষায়──‘সকল চশমা খুলে লেখা’। এছাড়া এসব সমালোচনা চ্যাপলিনের ছবিকে সত্যিকার মননশীলভাবে বুঝবার ও তাঁর শিল্পের সার্থকতা কতটুকু তা বিচার করবার জন্য বেশ সহায়ক। চ্যাপলিন বিষয়ে তাত্ত্বিক ধারণা নিতেও এরকম চিন্তার প্রয়োজন হবে। এই তাত্ত্বিক আলোচনাগুলোই যে এ গ্রন্থের মৌলিকতার মূল্য আরও উর্ধ্বমুখি করেছে এ কথা সচেতন পাঠকমাত্রই বুঝবেন।
পাঁচ
এই সংস্করণে ‘চ্যাপলিননামা’ বিভাগে সংযোজিত বাংলা-ইংরেজি প্রবন্ধগুলি পুরো বইটির মতোই মানসম্পন্ন ও উপভোগ্য। চ্যাপলিন-চর্চার ক্ষেত্রে লেখাগুলি বেশ সহায়ক হবে বলেই ধারণা করা যায়। প্রত্যেকটি রচনার কথা আলাদা ভাবে বলা সম্ভব না হলেও একটির কথা বিশেষ করে বলা দরকার। এই বিভাগের তিন নম্বর (এখানে উল্লেখ্য যে ‘চ্যাপলিননামা’ বিভাগের সাতটি লেখা যখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তখন সেগুলি আলাদা আলাদা শিরোনামেই বের হয়েছিল,কিন্তু এ বইতে সংকলিত করার সময় শুধু সংখ্যানুক্রমিকভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে) লেখাটিতে পাচ্ছি মৃণাল সেনের ভূমিকাসহ তাঁরই অনুবাদ করা স্বয়ং চ্যাপলিন-রচিত একটি ছোটগল্প,যার সর্ম্পকে চ্যাপলিনের মেয়ে জিরালডিনও কিছু জানতেন না (বলা দরকার,ইনিই মৃত্যুর কয়েকদিন পর কবর হতে চুরি হয়ে যাওয়া বাবার মৃতদেহ প্রায় একার চেষ্টাতেই খুঁজে নিয়ে জেনেভা লেকের এক প্রান্ত হতে মাটিঁ খুঁড়ে তুলে এনেছিলেন!)। প্রায় হারিয়ে যাওয়া এই গল্পের নাম Rhythem; বাংলা অনুবাদে মৃণালবাবু নামকরণ করেছেন ‘যন্ত্রছন্দ’।
গল্পটির কাহিনী সংক্ষেপে অনেকটা এরকম : স্পেনের একজন বিখ্যাত হাসির গল্পের লেখক,যে কিনা আবার একনায়ক ফ্রাংকো-বিরোধী লয়ালিষ্টও বটে। এ কারণে স্পেনে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও গৃহযুদ্ধ চলার সময় সে গ্রেপ্তার হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর মাদ্রিদের এক জেলখানায় তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে তাঁকে দাঁড় করানো হলো ফায়ারিং স্কোয়াডে। এমন সময় লয়ালিষ্ট দেখতে পেল যে, স্কোয়াডের লিডার তাঁর এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু; যার সাথে সে একদা কত সময় ধরেই না চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছে,বেড়িয়েছে,পড়েছে,এমনকি কখনও কখনও তুমুল ঝগড়াও করেছে। আজ সেই পরমপ্রিয় বন্ধুই কিনা তাঁকে কিছুক্ষণ পর মারবার নির্দেশ দেবে! যখন সকল সৈনিক বন্দুক উঁচিয়ে গুলি করবার জন্য একেবারে তৈরি,ঠিক তখনই শোনা গেল কয়েকজনের পায়ের শব্দ, লয়ালিষ্টের মনে হঠাৎই আশা জেগে উঠলো;কেউ এলো কি তাঁর মৃত্যুদন্ড মওকুফের পত্র নিয়ে? তবে অবশেষে সে কি ছাড়া পাচ্ছে মৃত্যুদূতের হাত থেকে? গল্পটির শেষ অংশের মিথস্ক্রিয়া ও অদ্ভুতুড়ে চমক নিজের ভাষায় লিখে বোঝানো মুশকিল,তাই অংশটি তুলে দিতে হল :
দুরন্ত অস্থিরতায় চিৎকার করে উঠল স্কোয়াড লিডার, ‘স্টপ!’
ছজন সৈনিক বন্দুক উঁচিয়ে প্রস্তুত।
ছজন সৈনিক এক যান্ত্রিক ছন্দে আবদ্ধ।
ছজন সৈনিক স্কোয়াড লিডারের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালাল : গুড়ুম!
ছোট্ট একরত্তি গল্প,তেমন কোন নির্দিষ্ট অর্থ এ গল্প হতে পাঠক খুঁজে পান না, তাও যেন আমাদের শ্বাসরোধ করে ফেলে এটি। পাঠকের সামনে ভয়ানক বীভৎসতা ও মানুষের সীমাহীন অসহায়তার চিত্র প্রবল পরাক্রমে উঠে আসে এ গল্প হতে। এ গল্পে ‘স্টপ’-এর অর্থ শেষমেশ হয়ে যায় গুলি চালানো, মানুষের বন্ধুত্ব পর্যবসিত হয় শত্রুতায়। এ ব্যাপারে আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে চ্যাপলিনের যেকোন বস্তু বা শব্দকে দ্বৈত ভূমিকার প্রতীক হিসেবে দেখার ধ্রুপদী দৃষ্টিকোণের কথা । গল্পটি আমাদের স্তব্ধ করে দেয় অল্পক্ষণের জন্য। আবার মেকি আশাবাদবিহীন এক ইস্পাত কঠিন প্রত্যয়েরও খোঁজ দেয়;যা বিশৃঙ্খলার বিপক্ষে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা দেয় এক নির্ভেজাল বিশ্বাসে।
গল্পটি পড়ে চ্যাপলিনের শক্তিশালী লেখকসত্তারও পরিচয় পাওয়া যায়;এমনকি কারও কারও একথাও মনে হতে পারে যে তিনি চলচ্চিত্রকার না হলে হয়তো লেখক হিসেবেই গোটা বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি পেতেন। ধন্যবাদ মৃণাল সেনকে, আমাদের কাছে চ্যাপলিনের এই অজানা গল্প ও তাঁর লেখকসত্তার পরিচয় তুলে ধরবার জন্য।
ছয়
আলোচ্য বইটির প্রচ্ছদ, ছাপা-বাঁধাই বা অঙ্গসজ্জা সন্দেহাতীতভাবে সুরুচিসুন্দর। চ্যাপলিন ও তাঁর চলচ্চিত্রের বেশকিছু স্থিরচিত্র,বিজ্ঞাপন ও পোস্টারের এক রঙিন সংকলন একে শুধু পড়বার নয়,দেখবারও এক মাধ্যাম করে তুলেছে। শেষে সংযোজিত চ্যাপলিনের বিস্তারিত চলচ্চিত্রপঞ্জি প্রশংসনীয়। কিন্তু এত সব গুণ থাকা সত্ত্বেও বইটিতে কিছু কিছু ভুল-ভ্রান্তি শেষ পর্যন্ত রয়েই গেছে। প্রথমত, ছাপাখানার ভূতের ভর হতে এ বইও ছাড় পায়নি। তুলনামূলকভাবে কম মুদ্রণ প্রমাদ থাকলেও বইয়ের মধ্যেকার কয়েকটি অসতর্ক মুদ্রণ প্রমাদ বেশ দৃষ্টিকটু। দ্বিতীয়ত, চ্যাপলিন ও তাঁর চলচ্চিত্রের বেশকিছু স্থিরচিত্র,বিজ্ঞাপন ও পোস্টার এ বইতে সংকলিত হলেও সেগুলো কোন সূত্র হতে নেওয়া হয়েছে তার উল্লেখ অথবা কোনও রকমের কৃতজ্ঞতা স্বীকারও এখানে নেই। তৃতীয়ত, বইয়ের ‘দুই-এক কথা’ নামের ভূমিকার শেষে কোনও সন-তারিখ নেই,এর ফলে বোঝা যায় না ভূমিকাটি এই নতুন সংস্করণ নাকি ১৯৫৩ সালের প্রথম সংস্করণের জন্য লেখা। এবং চতুর্থত, এ বইয়ের এপিগ্রাফে উদ্ধৃত চ্যাপলিন প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলী ও বুদ্ধদেব বসুর উক্তি দুটি তাঁদের কোন বই বা রচনা হতে নেওয়া তার উল্লেখ থাকা দরকার ছিল। তবে এসব ভুল-ত্রুটি নিন্তাতই গৌণ,তেমন গুরুতর কিছু নয়। সেজন্য এগুলো আলোচ্য বইটির কোনও রকম মর্যাদাহানি করে না কিংবা এর গুরুত্বও কমিয়ে দেয় না। আশা করি পরের সংস্করণে লেখক এগুলোকে শুধরে নিয়ে বইটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলবেন।
সাত
এত সব আলোচনার পর পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, অঢেল তথ্য ও এন্তার বিশ্লেষণে ভরা থাকলেও বইটি কি শেষ পর্যন্ত কঠিন গদ্যের ও শক্ত তাত্ত্বিকতার একটি মিশেলে পরিণত হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায়─ ‘না’। লেখকের ব্যতিক্রমী গদ্য বেশ প্রাঞ্জল,সতেজ ও স্বাদু ; বৈঠকি আড্ডার ছলে লেখা। বইটির অভিনব (সেইসঙ্গে মৌলিকও) গঠনশৈলির কারণে দ্রুতই ঢুকে যাওয়া যায় এর অন্তরমহলে। লেখকের আমোদিত লেখনীর জন্য বইটি বেশ তরতর করে পড়েও ফেলা যায়;পড়তে পড়তে পাঠককে কোন জায়গায় আচমকা হোঁচট খেয়ে পড়তে হয় না। আর বইটি মোটেও তাত্ত্বিকতার জ্বরে আক্রান্ত নয়,বরং তথ্য ও সোজাসাপটা বিশ্লেষণের যুগপৎ মিশেলের জন্য বইটি পাঠকের কাছে নিশ্চয়ই সহজবোধ্য এবং আদরণীয় হবে একথা বলাই যায়। অন্য একটি কথাও হয়তো পাঠকের মনে ঘুরপাক খেতে পারে,এ বই কাদের জন্য লেখা? এ ব্যাপারে পরিষ্কার করে বলতে হয়,বইটি কোনও বিশেষ পাঠকগোষ্ঠীর জন্য লেখা হয়নি। চ্যাপলিনকে নিয়ে যারা চর্চা-গবেষণা করছেন,তাঁর ছবির অনুরাগী ভক্ত-দর্শক এবং চলচ্চিত্রবিদদের জন্য বইটি যে অবশ্যপাঠ্য তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তেমনই অন্যদিকে যেসব সাধারণ পাঠক প্রামাণ্য, সুবিন্যস্ত ও সর্বোপরি একখানি ব্যতিক্রমী ভালো বই পড়তে ইচ্ছুক তাঁদের এই বইটি পড়া উচিত। এ বই পড়ে পাঠককুল আনন্দও পাবেন সেইসঙ্গে নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধও হবেন বইকি।
আট
এ আলোচনার শুরুতে বলা হয়েছিল চ্যাপলিনকে নিয়ে অনেক কিছুই লেখা হয়েছে,হচ্ছে। এখন শেষে বলি,মৃণাল সেনের ‘চার্লি চ্যাপলিন’ বইটি এই ‘অনেক কিছু’-র মধ্যে দ্রুত হারিয়ে যাওয়ার মতো কোনও জিনিস নয়। এর আগে খুব কম বাঙালি লেখকই তাঁদের বইগুলোতে নানা দৃষ্টিকোণ হতে চ্যাপলিনকে এতটা সবিস্তারে তুলে ধরতে পেরেছিলেন । আর এ বইটিই বাংলাতে প্রথম চ্যাপলিন প্রসঙ্গে একটি সহজ পাঠ প্রদানে সফল হলো এরকম কথা বললেও খুব একটা বেশি বলা হয় না। চ্যাপলিনকে সামগ্রিকভাবে জানতে চাইলে এ বই পড়ার কোন বিকল্প নেই।
মৃণাল সেন। চার্লি চ্যাপলিন। কলকাতা: নিউ এজ, ২০০৭। প্রচ্ছদ: সৌমেন পাল। ১৬৪ পৃষ্ঠা। ১০০ টাকা।
লেখক:
======
দিগন্ত চৌধুরী
======
মন্তব্য
মৃণাল সেনের এই বইটার ১ম প্রচ্ছদটা সত্যজিৎ রায়ের করা।
এই প্রচ্ছদেই বইটা আমার কাছে ছিল তারপর কোন মার্ক টোয়েন সাহেব নিয়ে আর ফেরত দেন্নাই। তারপর এটা আবার বহুদিন আউট অফ প্রিন্ট ছিল, পরে যখন বের হলো তখন নতুন প্রচ্ছদ দেখে আর কিনিনি।
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
এই সংস্করণের শুরুতেই এই প্রচ্ছদটা দেওয়া আছে । সৌমেন পালের প্রচ্ছদটা সম্ভবত গ্রেট ডিক্টেররের পোষ্টার অবলম্বনে তৈরি করা। অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই সুজনদা ।
======
দিগন্ত চৌধুরী
“আমাকে রাঙাতে পারে তেমন গোলাপ কখনও দেখি না।
তবে কাকে, কখন, কোথায় ধরা দেবো? ”
======
এই সংস্করণের=নতুন সংস্করণের হবে
======
দিগন্ত চৌধুরী
“আমাকে রাঙাতে পারে তেমন গোলাপ কখনও দেখি না।
তবে কাকে, কখন, কোথায় ধরা দেবো? ”
======
সামনে পেলেই কিনে নিবো।
পড়া হয়নি মূল বই তবে আপনার লেখা পড়বার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে ১০০%্১০% অধিক।
পোষ্টের জন্য কৃতজ্ঞতা।
অশেষ কৃতজ্ঞতা জানবেন।
বইটা দ্রুত পড়ে ফেলুন, ভালো যে লাগবেই আমি নিশ্চিত।
======
দিগন্ত চৌধুরী
“আমাকে রাঙাতে পারে তেমন গোলাপ কখনও দেখি না।
তবে কাকে, কখন, কোথায় ধরা দেবো? ”
======
দুর্দান্ত আলোচনা করেছেন। খুবই ভালো লাগল। এই আলোচনার জন্যই বইটি কেনার পূর্ণ বাসনা জাগল মনে। অনেক ধন্যবাদ।
ডাকঘর | ছবিঘর
দ্রুত পড়ে ফেলুন বইটা
======
দিগন্ত চৌধুরী
“আমাকে রাঙাতে পারে তেমন গোলাপ কখনও দেখি না।
তবে কাকে, কখন, কোথায় ধরা দেবো? ”
======
কলকাতার বই এখন আর কিনা হয় না। নো ছাড়-টাড় ত দেয়ইনা, উলটো বইতে যা মুদ্রিত আছে তার ডবল দামে বই কিনতে মন চায় না। একারনে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেখলেই হাত থেকে নামিয়ে রাখি। ভালোলাগা আর বাড়তে দিইনা।
তবে আপনার দুর্দান্ত আলোচনার পরে, সামনে পেলে এই বইটি কিনে ফেলতে একবারও ভাববো না। আপনি এই আগ্রহটা অনায়াসে তৈরি করতে পেরেছেন।
এই বইটার দাম অবশ্য পৃষ্ঠা, ছাপা মানের তুলনায় অনেক কম হয়েছে, প্রচুর রঙিন ছবিও আছে।
======
দিগন্ত চৌধুরী
“আমাকে রাঙাতে পারে তেমন গোলাপ কখনও দেখি না।
তবে কাকে, কখন, কোথায় ধরা দেবো? ”
======
বেশ ভাল লাগল, চ্যাপলিনকে কি কারণে আমেরিকাতে প্রায় বয়কট করা হয়েছিল সেই ঘটনার উল্লেখ আছে কি!
উনার শেষ স্ত্রীর বাবা ইউজেন ওনীল কিন্তু সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী, যদিও জামাইকে খুব একটা ভাল চোখে দেখতেন না !
facebook
আছে তো! খুঁজে জানাবো আপনাকে!
======
দিগন্ত চৌধুরী
“আমাকে রাঙাতে পারে তেমন গোলাপ কখনও দেখি না।
তবে কাকে, কখন, কোথায় ধরা দেবো? ”
======
চমৎকার লাগলো
কৃতজ্ঞতা উদাসদা
======
দিগন্ত চৌধুরী
“আমাকে রাঙাতে পারে তেমন গোলাপ কখনও দেখি না।
তবে কাকে, কখন, কোথায় ধরা দেবো? ”
======
নতুন মন্তব্য করুন