সালেক খোকন
যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছার কথা শুনে মা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। ছেলেকে তিনি কিছুতেই ছাড়বেন না। যুদ্ধে গিয়ে কি কেউ জীবন নিয়ে ফিরবে! এই তার ভয়। মা আমাকে চোখে চোখে রাখলেন। যদি পালিয়ে যুদ্ধে চলে যাই। মাকে শান্ত করতে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেই। না, কখনোই মুক্তিযুদ্ধে যাব না।
বুড়িতলা আমাদের পাশের গ্রাম। একদিন দিনাজপুর শহর থেকে খানরা ঢুকে পড়ে সে গ্রামে। খানদের ভয়ে গ্রামবাসী লুকায় খেত-খামারে। কাউকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয় খানপাঞ্জাবিরা। তারা জ্বালিয়ে দেয় গোটা গ্রামটি।
আশপাশের গ্রামের সবাই তখন ভয়ে তটস্থ। অন্যদের সঙ্গে পরিবারসহ আমরাও একদিন উতরাইল গ্রাম ছাড়ি। বনতারা ও খানপারের মাঝামাঝিতে ছিল ভারতীয় সীমান্ত । তা পেরিয়ে আমরা চলে আসি ভারতের ফকিরগঞ্জে। সেখানে এক আত্মীয়র বাড়িতেই আশ্রয় নিই আমরা।
খানিক দীর্ঘশ্বাস। অতঃপর আবার বলতে থাকেন সাদেক আলী।
খানদের ভয়ে দেশ ছেড়ে আমরা ভিন দেশে। এভাবে আর কতদিন? দেশটাকে তো মুক্ত করতে হবে। জানটা না-হয় যাবে। তাতে কি! নানা চিন্তা ঘোরপাক খায় মনে। এভাবে কত দিন বসে থাকব! মনে মনে যুদ্ধে যাওয়ার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই। মাকে জানাই না। এক দুপুরে লুকিয়ে বেরিয়ে পরি দেশের টানে। কেউ না জানলেও মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সব পরিকল্পনার কথা জানতেন আমার বাবা মাঈনুদ্দিন সরকার।
ট্রেনিং শেষে আমরা আসি ৭নং সেক্টরের বড়গ্রাম ক্যাম্পে। আমাদের ছিল ৩৮ জনের একটি দল। কমান্ডার বসাদ মাস্টার। আমাদের নির্দেশনা ছিল হিট এন্ড রান। বড়গ্রাম থেকে আমরা অপারেশন চালাই দাইনর,পাতইলশাহ, হাকিমকুড়ি, বড়গ্রাম, ত্রিশুলা, মোহনপুর এলাকাগুলোতে।
অক্টোবর মাস শেষ প্রায়। যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। একটা সাকুর্লার জারি হলো। এখন আর গেরিলা আক্রমণ নয়। ফ্রন্ট ফাইটে যেতে হবে। প্রথম প্রথম কিছুটা ভয় পেতাম। মায়ের কথা খুব মনে পড়ত। আদরের একমাত্র বোন মনোয়ারার কথা মনে হলে বুকটা হু হু করে উঠত।
সাদেক আলী খানিকটা থেমে গম্ভীর কন্ঠে বলতে থাকলেন। তার কথার সুর আমাদের নিয়ে যায় ৪১ বছর আগের ঘটনাগুলোতে।
৬ নভেম্বর ১৯৭১। পরিকল্পনা হয় মোহনপুর ত্রিশুলায় পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণের। ইন্ডিয়ান আর্মিসহ আমরা ২০০জন। কমান্ডে ছিলেন ফজলুর রহমান স্যার (যিনি পরবর্তীকালে বিডিআর মহাপরিচালক হয়েছিলেন) এবং ইন্ডিয়ান আর্মির ক্যাপ্টেন এসএস বাট। বড়গ্রাম ক্যাম্প থেকে আমরা বনতারা সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ি। পরিকল্পনামতো ফকিরগঞ্জ থেকে ত্রিশুলার দিকে আর্টিলারি সেল চালানো হলো। সে সুযোগে আমরাও অগ্রসর হলাম।
রাত ২টা । ত্রিশুলা ক্যাম্পের চারপাশে আমরা পজিশন নেই। খানরা আমাদের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। কিন্ত আমাদের চর্তুমুখী আক্রমণের কাছে তারা টিকতে পারে না। ভোরের দিকেই আমরা তাদের ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিই। কিন্ত সে অপারেশনে বুকে গুলি লেগে শহীদ হন প্রফুল্ল নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। খুব কাছ থেকে দেখেছি তার মৃত্যুযন্ত্রণা। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল। তখনও জানি না কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!মোহনপুরে ছিল পাকিস্তানিদের আরেকটি শক্তিশালি ঘাঁটি। ত্রিশুলা দখলের দিনই পরিকল্পনা হয় সেখানটায় আক্রমণের। ক্যাম্পে ফিরেই আমরা আক্রমণের সব কৌশল জেনে নিই।
৭ নভেম্বর ১৯৭১। বড়গ্রাম ক্যাম্প থেকে আমরা যখন আবার ত্রিশুলা ক্যাম্পে পৌঁছাই, তখন রাত প্রায় ২টা। ত্রিশুলা থেকে মোহনপুর যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটি ছিল কাঁচা। রাস্তার মাঝে মাঝে বড় বড় গর্ত। খানরা সেখানে বিছিয়ে রেখেছে এন্টি-ট্যাংক মাইন। কিন্ত তবুও সে পথেই আমাদের এগোতে হবে। আমরা এগোই। হঠাৎ আমাদের সামনে একটি গর্ত পড়ে। সবাই লাফিয়ে পার হয় সেটি। আমি ছিলাম মাঝের সারিতে। গর্ত পাড় হতেই আমার পা পড়ে একটি উঁচু জায়গাতে। অমনি বিকট শব্দ। আমি ছিটকে পড়ি। সবাই শুয়ে পজিশন নেয়। আমি তখনো কিছইু বুঝতে পারিনি। দাঁড়াতে যাব, কিন্ত ডান পা ফেলতে পারছিলাম না। খেয়াল করে দেখলাম, ডান পায়ের কিছু অংশ উড়ে গেছে। পায়ের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে যাই। আজও পায়ের দিকে তাকালে সবকিছু জীবন্ত হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথার পিঠে কথা চলছে। প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে দিনাজপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়ে ৩ নভেম্বর ২০১১ তারিখ দুপুরে কথা বলতে এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোঃ সাদেক আলী।
মাঈনুদ্দিন সরকার ও শমিরুন্নেছার পুত্র সাদেক আলীর বাড়ি দিনাজপুরের কোতোয়ালি থানার গোদাগাড়ী ইউনিয়নের উতরাইল গ্রামে। বর্তমানে বয়স ৬২ বছর। কিন্ত ১৯৭১ এ ছিলেন উদরানি স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র। ফুটবল খেলতে পছন্দ করতেন ছোটবেলা থেকে। আজও তার মনে পড়ে বাল্যবন্ধু শাহজাহান, কিরন, কালিসহ অনেকের কথা। যুদ্ধাহত ভাতা আর ঢাকার ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা করে যা পান, তা দিয়েই চলে তার সংসার।
ফকিরগঞ্জ রিক্রুটিং ক্যাম্পে সাদেক আলীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কেন যুদ্ধে যাবেন ? একই প্রশ্ন আমরাও করি। উত্তর ছিল – দেশকে বাঁচাতে যুদ্ধ করতে চাই। দেশ না বাঁচলে তো আমরা বাঁচব না।
প্রথম প্রাণসাগরে সাতদিন লেফট-রাইট অতঃপর শিববাড়ী, রায়গঞ্জ, তরঙ্গপুর হয়ে শিলিগুড়ির পানিঘাটায় সাদেক আলী ট্রেনিং নেন ২৮ দিনের। ১৪৮৭ ছিল তার এফএফ নং।
সে সময় দেশের অবস্থা নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন এই যোদ্ধা। ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদেরকে মুড়ি, চালভাজা, পানি আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা খবরাখবর দিয়ে সাহায্য করত সাধারণ মানুষেরা। খবর পেতাম রাজাকাররা লুটতরাজ করছে, মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে খানদের ক্যাম্পে। ত্রিশুলা ক্যাম্প থেকে আমরাও উদ্ধার করি বিবস্ত্র অবস্থায় তিনজন মেয়েকে। তাদের সারা শরীর সিগারেটের আগুনে ঝলছে দেওয়া হয়েছিল।’
কোথায় চিকিৎসা নিলেন ? সাদেক আলীর উত্তর, ‘প্রথম ভাবিনি বেঁচে যাব। আমার পাশেই ছিল বগুড়ার ইসহাক, সাবের মৌলভী, রহমান সোনাহার। একটি কাঠের তক্তায় করে তারা আমাকে তুলে নিয়ে পৌঁছে দেয় বড়াহার ক্যাম্পে। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে রায়গঞ্জ হাসপাতাল, শিলিগুড়ি আর্মি হাসপাতাল, উত্তর প্রদেশের এমএস খিরকী হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে কৃত্রিম পা সংযোজনের জন্য আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় পুনা হাসপাতালে। সেখানেই দেড় মাস থেকেছি কর্নেল তাহের স্যারের সঙ্গে।’
কর্নেল তাহেরকে কেমন দেখেছেন?
অসাধারণ মানুষ। অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর থেকে ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন অফিসার্স কেবিনে। কিন্ত খাওয়ার সময় সবাইকে কাছে ডেকে বসাতেন। উৎসাহ দিতেন। দেশের কথা বলতেন। দেশ স্বাধীনের খবরের দিন তিনি বলেছিলেন, চল, দেশে ফিরে যাই যে দেশের জন্য তোমরা ত্যাগ স্বীকার করেছ। আমি কর্নেল স্যারকে বলতাম , দেশ তো স্বাধীন হলো স্যার কিন্ত আমাদের তো পা নেই। আমাদের কী দাম আছে। বিয়ের জন্য তো মেয়েও দেবে না কেউ। কথা শুনে তিনি শুধু হাসতেন।
স্বাধীন দেশ নিয়ে সাদেক আলী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। তার ভাষায়, দেশ তো স্বাধীন করলাম। কিন্ত এ কোন দেশ দেখছি! আমরা তো আগাতে পারছি না। দেশের মধ্যে যত দুর্নীতি, এ দেশকে কি ভালোবাসা যায় ?’
কী করলে দেশ এগোবে? এমন প্রশ্ন করতেই তিনি দৃঢ় কন্ঠে বলেন, ‘দেশের স্বার্থে সবাইকে একতাবদ্ধ হতে হবে। ঝড়গাঝাঁটি, মারামারি, হানাহানি রেখে দেশের জন্য সবাই এক হয়ে কাজ করলে দেশটা অন্য রকম হবে।’
রাজাকারদের প্রসঙ্গে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, একজন রাজাকার সব সময়ই রাজাকার। স্বাধীন দেশে এদেরই তো সবার আগে বিচার হওয়া প্রয়োজন ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, এখন তো রাজনৈতিক ফায়দার জন্য বছর বছর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। তার মতে, তালিকার তৈরির উপযুক্ত সময় ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে। সে সময় ক্যাম্পে ক্যাম্পে ছিল সব তথ্য। ফলে সহজেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি করা যেত।
মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হওয়া প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলী বলেন, এটি ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। এতে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের মেরুদন্ডই ভেঙ্গে পড়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি আর একতা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে আজ আর আমরা জাতির কাছে দাঁড়াতে পারছি না।
স্বাধীন দেশে ভালো লাগার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশটা স্বাধীন, এটাই তো সুখ।
মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলীর নাতি সাব্বির হোসেন। ক্লাস এইটের ছাত্র সে। মাঝে মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা দাদাকে ঘিরে ধরে সে। শুনতে চায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সব কথা। সাদেক আলীও আনন্দ নিয়ে স্মৃতির ভান্ডার উজার করে। মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে সাব্বির গর্বিত হয়। বলে, দাদা এত কষ্টে আমরা দেশ পেয়েছি। দাদা সাদেক আলীও তখন নাতির উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একদিন থাকব না। কিন্ত ভবিষ্যতে তোমরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিবে সবার কাছে।
দেশে আছে নানা সমস্যা তবুও তো কারও গোলাম নই আমরা। তাই মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলী শত আশায় বুক বাঁধেন। পরবর্তী প্রজন্ম কখনো ইতিহাসভ্রষ্ট হবে না। এটিই তার বিশ্বাস।
ছবি : লেখক SALEKKHOKON.ME
মন্তব্য
স্যালুট স্যার ! আপনাদের এই মহান ত্যাগের কারনে আজ আমরা বুক ফুলিয়ে চলতে পারি। আপনার পায়ের বিনিময়ে আমদের এই দেশ।
আর আপনি এত কষ্ট করে সংসার চালান।
রাজাকার রা গারিতে পতাকা উরিয়ে চলে।ক্ষমা প্রার্থী স্যার!!! ক্ষমা করবেন আমদের কে ।
আপনি দেশ দিয়েছেন আমার আপনা কে কিছুই দেই নি। দিতে পারবো কিনা জানি না।।।।।
লেখার জন্য ধন্যবাদ।।।আরক্ম আরঅ চলুক
শত শ্রদ্ধা।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
" দেশে আছে নানা সমস্যা তবুও তো কারও গোলাম নই আমরা। "
শ্রদ্ধা..
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
facebook
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
শ্রদ্ধা।
একজন রাজাকার সব সময়ই রাজাকার, এর উপরে আর কোন কথা থাকতে পারেনা।
আপনার জন্য অনেক শুভকামনা।
মুক্তিযোদ্ধা মোঃ সাদেক আলীর জন্য । যুদ্ধাহত ও বার্ধক্যে উপনীত মানুষটির ছবি লক্ষ্য করতেই একটি বিষয় নজরে এলো, তা হল তার তীক্ষ্ণ চোখ, যা থেকে প্রতিরোধের গনগনে আগুন ঠিকরে বেরুতো ১৯৭১ সনে! সেই চোখ এখনো অমলিন, সমান প্রত্যয়দীপ্ত!
মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠেই মানায় এমন অসাধারণ ইতিবাচকতা। দেশে হাজারো সমস্যা আছে, তবু আমাদের আছে হার না মানার গৌরোজ্জল ইতিহাস।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
শ্রদ্ধা।
শ্রদ্ধা জানাই অন্তরের অন্তস্থল থেকে।
পোষ্টের জন্য কৃতজ্ঞতা।
আপনারাই আমাদের গর্ব, আমাদের গৌরব। আপনাদের জন্যই আজ আমরা বুক ফুলিয়ে চলতে পারি। আজ আর চলার পথে কোন হানাদারের ট্যাংক আমাদের পথরোধ করে না। আপনাদের জন্যই আজ আমরা আমাদের বোনের হাহাকার শুনিনা। শুনিনা ভাইয়ের করুণ মৃত্যুজন্ত্রনা। আপনাকে, আপনাদের লাল সেলাম।
ক্লান্ত কালবৈশাখি।
কড়িকাঠুরে
নতুন মন্তব্য করুন