বিলুপ্তপ্রায় প্রেক্ষাগৃহ ও একটি আশঙ্কা
ছোটবেলা একবার বাবা মায়ের সাথে প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম । ছবিটার নাম ছিল ‘ভেজাচোখ’। ছবি কেমন ছিল বা কতটুকু শৈল্পিক বিনোদন আমি পেয়েছিলাম তা ঠিক বোঝার মতো বয়স তখনও আমার হয়নি। কিন্তু সপরিবারে একটি সুন্দর সন্ধ্যা যে সেদিন পার করেছিলাম তা কিন্তু আজও মনে পড়ে। আমার বয়সী অনেক ছেলেমেয়েকে সেদিন দেখেছিলাম তাদের বাবা মায়ের সাথে তারাও এসেছে নিরালা প্রেক্ষাগৃহে। এরকম ঘটনা যে ওই প্রথম তা কিন্তু না । এরপর ‘মরনের পরে’ , ‘নীতিবান’ এর মতো আরও অনেক ছবি প্রেক্ষাগৃহে বসে আমরা সপরিবারে দেখেছি ।আত্মীয়স্বজন অনেকের সাথেই দেখা হত সেখানে। যাদের সাথে সারামাস দেখা হত না সেইসব মানুষদের সাথে মাসে একবার প্রেক্ষাগৃহে দেখা হত। একতা সামাজিক কালচার ছিল সেটা। আজও মনে আছে মাসের সাংসারিক খরচের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকতো প্রেক্ষাগৃহে যেয়ে ছবি দেখার জন্যে। প্রেক্ষাগৃহের ভেতরের একটা অংশ থাকতো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সেই ঠাণ্ডা পরিবেষ্টিত জায়গায় ছড়িয়ে থাকা একটা ঘ্রাণ আজও নাকে লেগে আছে যা আর অন্য কোথাও পায়নি। সিনেমার বিরতিতে বাইরে যেয়ে ক্যান্টিন থেকে কিছু খাবার কিনে এনে একেবারে শেষ অবধি বসে সবাই মিলে বসে খাবার যে মজা তা আজ আর কোথাও পায়না। কারণ এখন আর সপরিবারে সিনেমা দেখতে যাওয়া হয় না। এর জন্য আমি খারাপ ছবির দোষ দেবোনা বরং প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশকেই বেশী দায়ী করবো। আমাদের দেশে কম করে হলেও আজও ভাল ছবি তৈরি হচ্ছে । কিন্তু সপরিবারে একসাথে একটি জায়গায় বসে তা দেখার পরিবেশ আজ আর নেই। আমার বিশ্বাস ‘গেরিলা’ বা ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ যারা দেখেছেন তারা আমাদের দেশে ভাল ছবি যে আজও তৈরি হয় সে কথাটি স্বীকার করবেন।
ভাল সিনেমা হল বা প্রেক্ষাগৃহ বলতে অনেকে সিনেপ্লেক্স এর কথা বলতে পারেন । এখানে বলে রাখা দরকার শুধু ঢাকার এক সিনেপ্লেক্স কে যদি আমরা বিবেচনায় আনি তাহলে ভুল হবে । কারণ ঢাকা ছাড়া বাইরের জেলাগুলতে কিন্তু ওই ধরনের সিনেমা হল নেই। এখনকার অভিভাবকদেরও নিশ্চয়ই ছেলেমেয়েদের সাথে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার ইচ্ছা হয় শুধু ভাল একটি ব্যবস্থা , ভালো একটি পরিবেশের অভাবে তারা ঘরে বসেই ছবিটি উপভোগ করছেন। আর এভাবে দর্শকশুন্যতার কারনে সিনেমা হলগুলো আজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমার ছোটবেলায় অনেকবার সপরিবারে গিয়ে দেখা ‘নিরালা’ সিনেমা প্রেক্ষাগৃহটি আজ আর নেই। সেখানে আজ গড়ে উঠেছে শপিং মল ।
আর এভাবেই ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক মিলনমেলার একটি বড় সুযোগ। বিনোদনের এই স্থানটিকে আবারও যদি আমরা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে না পারি তাহলে অনেক কিছুর মতই এই প্রেক্ষাগৃহটিও আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রেক্ষাগৃহ নামটি কেবল একটি সমার্থক শব্দ হিসেবেই থেকে যাবে।
লেখকঃ ami_bonna
মন্তব্য
লেখা ভালো লেগেছে।
আপনার সাথে সহমত। সিনেমাহলের পরিবেশই সমস্যা। বর্তমানে অনেক ভালো ছবিই হচ্ছে (যা টেলিভিশনে দেখলেও ঠিক সিনেমা সিনেমা অনুভূতি হয় না আমার।) সিনেমাহলে যেয়ে দেখার মত। তবে সিনেপ্লেক্সকে আমার ঠিক 'আপন' মনে হয় না, কেমন জানি। আর টিকেটের দাম ও খাবারের দাম অত্যাধিক বেশি মনে হয়ে হয়েছে আমার কাছে।
সিনেমাহলের বিনোদন এখন রূপ নিয়েছে রেস্টুরেন্ট এ যাওয়াতে। ঢাকার বাইরের অধিকাংশ সিনেমাহল এখন ধুঁকছে, অনেকগুলোই শপিং কমপ্লেক্সে পরিনত হয়েছে। আর ঢাকার বিখ্যাত গুলিস্তান সিনেমা হলের গল্প তো সবাই জানেন। ফুল্বাড়িয়া নামটি এখনো আমার কাছে অপরিচিত লাগে।
পরিবেশ ভালো না কারণ হলমালিক ও পরিচালকেরা বাজে ছবি দেখিয়ে দর্শকদের অভ্যেস করিয়ে ফেলেছে।
খাইছি তোরে কিংবা এ রকম ছবি যেখানে চলে অভ্যস্থ সেখানে গেরিলা কিংবা
আমার বন্ধু রাশেদ দেখানোর মত দর্শক পাওয়া যাবে না।
সৃজনশীল ছবি দেখার জন্য সৃজনশীল দর্শকের গুরুত্ব অপরিসীম।
দুই-ই একে অন্যের সাথে উতপ্রোৎভাবে।
আমার বিশ্বাস হলের পরিবেশ ভাল হলে আজও দর্শকরা উন্মুখ হয়ে আছে হলে যাওয়ার জন্যে। আপনার ৪র্থ ও ৫ম লাইনের সাথে একমত।
আসলে সমস্যাটা হল এইসকল ক্ষেত্রে এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর দোষ চাপিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
আমি এটুকুই বলব, ছোটবেলার স্মৃতিগুলোকে উসকে দেবার জন্যে ধন্যবাদ।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
পদ্মা নদীর মাঝি থেকে শুরুক্রএ শংখনীল কারাগার, দীপু নাম্বার টু, আগুনের পরশমনি, পরিবারের সবাই মিলে দেখা যায় এমন অনেক ছবিই বাবা মা চাচা চাচি খালা আর কাজিনদের সঙ্গে হলে গিয়ে দেখেছি। যে হলে দেখিয়েছে সেখানেই, মধুমিতা, বলাকা, বিডিআর এর মধ্যে একটা হল ছিল, নাম মনে নাই, সেই হলে। সিনেপ্লেক্সে বরং কম সিনেমা দেখা হয়েছে। সবাইকে নিয়ে দেখা যায় এরকম সিনেমা প্রদর্শিত হলে মানুষ এটাকে পারিবারিক সময় কাটানোর উপায় হিসেবে অবশ্যই বেছে নেবে।
বাবা মার মুখে শুনেছি তারা ছোটবেলায় অনেক ক্লাসিক ইংরেজি ছবি যেমন রবিন্সন ক্রুসো, সাউন্ড অফ মিউজিক এইরকম সিনেমা মফস্বল শহরের সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছেন। বাংলা সিনেমার পাশাপাশি অন্যান্য সময় হল চালু রাখতে এইসব সিনেমা দেখানো হত। এখন কেন এইরকম রুচিশীল ইংরেজি ছবিগুলো চালানো হয় না জানি না। ইংরেজি ছবি বললেই এক টিকিটে দুই ছবির কথা মনে হয়। সেন্সর বোর্ডে হয়ত তখন রুচিশীল ব্যাক্তিরা ছিলেন, হল মালিকেরাও জানতেন ভালো ছবির সন্ধান। দুষ্টচক্র ভাংতে হলে হল মালিকদেরকেই প্রথম ঝুকিটা নিতে হবে।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
ঢাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য জেলা শহরগুলোত অনেক টাকাওয়ালা মানুষ আছে যারা চাইলেই ভাল সিনেমা হল তৈরি করতে পারেন এবং সেখানে ভালো ছবির প্রদর্শনীর ব্যাবস্থা করতে পারেন। এসব মানুষদের ভালো রুচি জেগে উঠুক সেই প্রত্যাশায় করছি।
লেখকের সাথে একমত। আমাদের দেশে হলে যেয়ে ছবি দেখতে চাইলে প্রথমে সিনেমা হলের পরিবেশ ঠিক করতে হবে।
সিনেমা হলে যেয়ে ছবি দেখার মজা আর কিছুতে পাওয়া সম্ভব না-কিন্তু সপরিবারে ছবি দেখার চলটাই উঠে গেছে বাজে ছবির ভিড়ে-যারা পরিচালক তারা যদি জেলায় জেলায় প্রোমোশনাল কাজ কর্ম চালাতে পারেন তাহলে আগ্রহ বাড়ান সম্ভব। আর লোকজন আসা শুরু করলেই হলের পরিবেশ উন্নতি হবে তার আগে নয় আমার ধারনা। হলে এক টিকিটে দুই ছবি চালিয়ে ভাল পরিবেশ আশা করা ঠিক নয়।
সপরিবারে ছবি দেখার এই পুরানো প্রথায় আবার নতুন করে চালু হউয়া উচিৎ। এজন্য হল মালিক থেকে পরিচালক সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।
নতুন মন্তব্য করুন