রূপলাল হাউজ। কিছুদিন আগে ঢাকার ইতিহাস পড়তে গিয়ে নামটা চোখে পড়ে। আর, তখন থেকেই ইচ্ছা ছিলো নিজে গিয়ে বাড়িটা দেখার। খোঁজাখুজির পরে জানলাম, এটা ফরাসগঙজের শ্যামবাজার এলাকায় অবস্থিত। অবশেষে, হাজির হয়ে গেলাম শ্যামবাজারে। কিন্তু সমস্যা হল....কেউই সঠিক করে রূপলাল হাউজের অবস্থান বলতে পারে না। দু’ একজন যাও বা বলছে তা নিয়েও তৈরী হতে থাকে বিভ্রান্তি। কারন, এক একজন এক এক দিকে দেখিয়ে দিচ্ছিলো। যাই হোক অবশেষে খুঁজে পেলাম রূপলাল হাউজ। গিয়ে মনে হল....আমি কোন পুরাতন বাড়িতে আসিনি। এসেছি, কোন মসলার আড়ৎ এ।
যাই হোক, বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গিয়ে হল আর এক বিপত্তি। কেন আসছে? কোথা থেকে আসছেন? কেন ছবি তুলবেন ? এমন হাজারো প্রশ্ন। শুনে মাথা গরম হচ্ছিলো ঠিকই.... কিন্তু বাধ্য হয়ে হাসিমুখে সব কথার উত্তর দিচ্ছিলাম। (বেশীরভাগ উত্তরই ছিলো আজগুবি)। অবশেষে, বাড়ির দারোয়ার সাথে কথা বলে ঘুরে দেখার সূযোগ বের করতে হল।
রূপলাল হাউজের পেছনের কথা....
প্রতিপত্তি আর আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশের প্রতীক হিসেবে রূপলাল দাশ নির্মাণ করেছিলেন রূপলাল হাউজ। রূপলালের আদি নিবাস বুড়িগঙ্গার অপর পারে শোভড্যা গ্রামে। তার দাদা মথুরানাথ পোদ্দার ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে শুরু করেন পোদ্দারি ব্যবসা। তিনি তখন বাট্টা দিয়ে টাকা, আধুলি, সিকি ইত্যাদি মুদ্রা ভাঙ্গিয়ে দিতেন। মথুরানাথ তখনকার দিনে প্রতিদিন বাংলা বাজারে রাস্তার উপর চট পেতে টাকা ভাঙানোর দোকান সাজিয়ে বসতেন। তৎকালিন পূর্ববঙ্গে বাংলাবাজার ছিল পয়সা লগ্নি ও টাকা বিনিময়ের কেন্দ্র। মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে মথুরানাথ খুব অল্প সময়ে অসম্ভব সফলতা অর্জন করেন। তখন তিনি রাস্তার দোকান উঠিয়ে বাংলা বাজারে জমি কিনে নিজস্ব দোকান দিয়ে বসেন । পরে তিনি মুদ্রা ভাঙানোর কাজ ছেড়ে দিয়ে লগ্নী ও হুণ্ডীর কারবারে নামেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মথুরানাথ তৎকালিন এক টাকায় বছরে ৫৭০ টাকা শোধ নিতেন[সূত্র]। ব্যবসার ধারাবাহিক উন্নতির ফলে ক্রমেই মথুরানাথ ঢাকার শ্রেষ্ঠতম ধনাঢ্য হিন্দু ব্যবসায়ীতে রূপান্তরিত হন। ১৮৬০ এর দশকে সামাজিক প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্যে মথুরানাথের পুত্ররা জমিদারিও কিনতে শুরু করেন। মথুরানাথের ছিল দুই পুত্র। স্বরূপ চন্দ্র দাস এবং মধুসূদন দাস। স্বরূপচন্দ্রের পুত্র (মথুরানাথের পৌত্র) রূপলাল দাস ফরাসগঞ্জে ভিক্টোরিয়ান স্টাইলে একটা বিশাল জমকালো বাড়ি নির্মাণ করেন।
তিনি নিজের নামে এর নাম দেন রূপলাল হাউজ। অধিকাংশ ইতিহাস বেত্তাদের মতে, ঊনিশশতকের ষাটের দশকে রূপলাল আরাতুন নামের এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটি পুরনো ভবন ক্রয় করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এ ববনটি মার্টিন এন্ড কোং কোম্পানির একজন স্থপতিকে দিয়ে পুনঃনির্মাণ করেন এবং এর নাম দেন রূপলাল হাউজ। রূপলাল হাউজ সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থাপত্যরীতির দুটি অসমান বস্তুকে বিভক্ত একটি দ্বি-তল প্রাসাদ। এটি প্রায় ৯১.৪৪ মিটার দীর্ঘ। বাড়িটির পেছনে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গা নদী থেকে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা যেত। রূপলাল হাউজ ঔপনিবেশীক আমলে প্রবর্তিত পরবর্তী রেঁনেসা যোগের ইউরোপীয় স্থাপত্যের এক চমৎকার উদাহরণ। এর গঠন কাঠামো আলফাবেট ‘E’ আকৃতির। যার তিন বাহু নগরের দিকে প্রসারিত। মাঝের বাহুটি সবচেয়ে বড়। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮.৩৩ মিটার।
এ ভবনটির ছাদ নির্মিত হয়েছিল কোরিনথীয় স্টাইলে। এর উপরে রয়েছে পেডিমেন্ট। যা রেঁনেসাযোগীয় পেডিমেন্টের অনুকরণে নির্মিত, দ্বিতীয় তলায় দুটি বস্নকে বিভিন্ন আয়তনের মোট ৫০টিরও বেশি কক্ষ রয়েছে। কথিত আছে যে সেই সময়কার বিদেশীগন ঢাকায় আসলে রুপলাল হাউজে ভাড়া করে থাকতেন। সেই যুগে রুম প্রতি ভাড়া প্রদান করতেন ২০০টাকা। এ ঘরের মেঝে ছিল কাঠের। পুরো বাড়ি জুড়ে উত্তর দক্ষিণপাশে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা দুটি সেমি-কোরিনথীয় স্তম্ভ বা সমায়ত ইটের থামের উপর স্থাপিত। এ স্তম্ভ বা থামসমূহের উপর বিভাজিত, ত্রিপদ খিলান ছিল। তৎকালীন ঢাকার নবাব বাড়ি তথা আহসান মঞ্জিলের সাথে তুলনা করার মতো একমাত্র বাড়ি ছিল রূপলাল হাউজ। গ্রীক স্থাপত্য শৈলীতে এসেছিল এক অমর নতুনত্ব। তৎকালীন ঢাকার কোনো বাড়িতে ছিল না।
রূপলাল হাউজের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাড়ির উপরে মাঝখানে স্থাপিত একটা প্রকান্ড ঘড়ি, যা ঢাকা শহরের সম্মুখভাগের সমস্ত নদী বা খাল থেকে দেখা যেত। নৌ-পথে চলাচলকারী মাঝি বা নৌকারোহীগণ এ ঘড়ি দেখে সময় নির্ধারণ করতেন। ১৮৯৭ সালের দিকে হঠাৎ ভূমিকম্পে ঘড়িটির চূড়া ভেঙে গেলে পরবর্তী সময়ে তা আর মেরামত করা হয়নি। ১৮৮৮ সালে ভারতের ডাইসরয় লর্ড ডাফরিন ঢাকা সফরকালে রূপলাল হাউজে আসেন। তার সম্মানে রূপলাল বল নাচের আয়োজন করেছিলেন। বাংলা ভাষাভাষীদের গর্বের ধন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রূপলাল হাউজে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। বাউন্ডেলে যাযাবর দুখু নজরুল, নিজ অসম প্রতিভার পরিবেশনায় রূপলাল হাউজ মাতিয়েছিলেন। এক সময় রূপলাল হাউজ থেকে শান্তি নামে একটি পত্রিকা বের হতো। পরবর্তী সময়ে তার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই রূপলাল হাউজের জৌলুস কমতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় রূপলালের উত্তরাধিকারীরা কলকাতায় চলে যান।
এতো গেল রূপলাল হাউজের ইতিহাস। কিন্তু এখন কেমন আছে রূপলাল হাউজ ? ইতিহাসের সাথে বর্তমান রূপলাল হাউজের আকাশ পাতাল ব্যবধান। দিন দিন দেয়াল থেকে চুন সুড়কির আস্তরণ খসে পড়ছে। ভবনের অনেকটা অংশ ভেঙেও গিয়েছে। দেয়ালে গজিয়েছে বটগাছ। উপরে ওঠার সিঁড়িগুলোও ভাঙা। এইরকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়ও সেখানে বসবাস করছে বেশ কিছু পরিবার। কিন্তু, ভবনটি সংস্কারের কোন উদ্যোগ কোথাও চোখে পরলো না। ভবনের নিচে গড়ে উঠেছে মসলার বাজার। সবশেষে একটা তথ্য দিয়েই শেষ করি, রূপলাল হাউজের বর্তমান বাসিন্দারা সাধারণত বাইরের কারো সাথে যোগাযোগ করতে চায় না কিংবা আগ্রহ দেখায় না। কারনটা সহজেই অনুমেয়.....
রূপলাল হাউজের আরো কিছু ছবি.....
--------------------------
অনুপম প্রতীপ
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%61%6e%75%70%61%6d%2e%70%72%61%72%69%70%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%22%3e%61%6e%75%70%61%6d%2e%70%72%61%72%69%70%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))
মন্তব্য
খুব ভালো লাগলো। একদিন দেখতে যেতে হবে।
পুরনো ঐতিহাসিক স্থাপনা ভোগদখল করছে এমন লোকজন বাইরের মানুষ দেখলেই আতঙ্কিতবোধ করে। আপনি তো এতগুলো ছবি তুলে এনেছেন, আমি অনেক জায়গায় যেয়ে ঢোকার অনুমতিই পাইনি (কথায় মিষ্টতার অভাবে সম্ভবত)।
মথুরানাথের সুদগ্রহণের তথ্যসূত্রটি আসেনি।
ফটোগফুর ভাই, প্রতিটা ছবিতে আপনার লোগো দৃষ্টি সেদিকে টেনে নেয়। ছবি আকর্ষন হারায়।
হ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আহারে! আহারে!! এত সুন্দর একটা স্থাপনা বেদখল হয়ে আছে ! ! !
ফটোগ্রাফিগুলো বেশ ভালো লেগেছে। তবেই আপনার লোগো ব্যবহার আসলেই দৃষ্টিকটু লেগেছে।
বাংলাপিডিয়াতে পড়েছিলাম রূপলাল হাউজ বিষয়ে। টেলিভিশনে একটা ফিচার ও দেখেছিলাম। মসলার বাজার হয়ে আছে এত সুন্দর স্থাপনাটি।
সিঁড়ির ছবিটা সবচেয়ে ভাল লেগেছে, আগেই বলেছি।
লোগোসমস্যার কথাও বলেছি অনেকবার।
কিপ ক্লিপিং পুচকা।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
লিখা খুব ভালো লাগল।
..................................................................
#Banshibir.
এই ধরনের ঘটনাগুলো জানলে সরকার বাহাদুরের বেকুবীপনার উপর আমার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। কী ভবনের কী দশা বানিয়ে রেখেছে! কোন্ সম্পদের কোন্ ছিরি !
ছবিগুলো অসাধারণ তুলেছেন।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
লেখা ও ছবি দুটোই ভালো হয়েছে।
একবার আমরা বাদাইম্যা সচল কয়েকজন ঢাকার অন্যান্য স্থাপনার পাশাপাশি রূপলাল হাউসও দেখতে গিয়েছিলাম। বাড়িটার সর্বশেষ অবস্থা দেকে এতো খারাপ লাগলো যে বলে বোঝাতে পারবো না। শেষমেষ ইত্তেফাকেও লেখা দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার পোস্টটা পড়ে মনে হলো আমরা কানে দিয়েছি তুলো পিঠে বেঁধেছি কুলো। রূপলাল হাউসের ভাগ্য হয়তো শেষপর্যন্ত মাটির সাথে মিশে যাওয়াই।
আমরা ঐতিহ্য অপহরক জাতি আসলে।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
রূপলাল হাউজের স্থাপত্যকলা দেখে মনে হচ্ছে এটি আরো একশো বছরের পুরোনো হতে পারে মানে আর্মেনীয়দের তৈরী। বর্তমান অবস্থা দেখে কষ্ট হলো। কোন একটা ভুমিকম্পের জন্য দিন গুনছে বুঝি।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
চরম লাগল।
ডাকঘর | ছবিঘর
আপনার ছবিগুলো দেখে ঝালকাঠি জেলার কীর্তিপাশার জমিদার বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। ক'দিন আগেই ঘুরে এসেছি কিনা, তাই। সে বিশাল প্রাসাদেরও এখন করুণ দশা।
রূপলাল হাউজ দেখতে যেতে হবে একদিন।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
আমি এই ফেব্রুয়ারীতেই গিয়েছিলাম।।। লোকজন তো বলছিল ভাই আপনারা বাড়িটা কিইন্না লন।।। তাতে যদি কিছু হয়।।। তবে এই বাড়ি সংরক্ষণের মত টাকা পয়সা বোধহয় আমাদের প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের নেই।।।
শেষে হানিফ সংকেতের মত বলতে হয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করছি।
হুমম, জটিল অবস্থা, ঠিক জলদি না হলে খবর আছে-
facebook
এভাবেই আমাদের ইতিহাসগুলো বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকবে ক্রমাশ। তদুপরি ঢাকার ইতিহাসের চাকা তো থেমে গেলো, শুরু হলো উত্তর ঢাকা এবং দক্ষিণ ঢাকার ইতিহাস রচনার পালা।
সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এই প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শণগুলো সংরক্ষেনে।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
লোগোটা বেশি বড় দেখাচ্ছে-আর ছবির সাবজেক্ট প্লেসমেন্টের দিকে আর একটু মনযোগ দিলে বোধ হয় ভাল হয়।=)-রূপলাল হাউজ দারুন জায়গা-সকাল ৭ টা থেকে ৮ টার মধ্যে গেলে দূর্দান্ত লাইট আর লাইফ পাবেন।
প্রাচীন নিদর্শনগুলোর এই দুরবস্থা দেখলে খুব মন খারাপ হয়ে যায়। এই দেশটা তার ইতিহাস আর ইতিহাসের অনুষঙ্গ নিয়ে সবচাইতে বেশি অবহেলা আর ছেলেখেলা করলো, কি আজব!
আপনার ছবিতে আলো খুব প্রদীপ্ত, ভালো লাগলো। আরো ছবিব্লগ চাই আপনার কাছ থেকে ভাই। ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা
চমৎকার।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
নতুন মন্তব্য করুন