দৃষ্টি প্রতিবন্ধির অন্তর্দৃষ্টি
মানুষের দুটি চোখ ছাড়াও আর একটি চোখ নাকি আছে। যার নাম মনের চোখ। চোখ বন্ধ করলে সবকিছু অন্ধকার কিন্তু তারপরও অনেক কিছু অনুভব করা যায়। আর এই অনুভুতি ক্ষমতার প্রখরতা যার দৃষ্টি নেই মনে হয় তারই সবচাইতে বেশি। আমি দৃষ্টি প্রতিবন্ধিদের কথা বলছি।
২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুবাদে একটি হলে আবাসিক ছাত্র হিসেবে থাকার সুযোগ পায়। ছয় তলা বিশিষ্ট হলের ষষ্ঠ তলাতে আমি থাকতাম। প্রত্যেক বেলা খাবার জন্য নিচ তলায় নামতে হত। নিচতলায় ছিল ক্যান্টিন। যখনই খেতে আসতাম পিছন থেকে লাঠির খট খট একটা আওয়াজ পেতাম। প্রথম দিন শব্দের উৎসের খোজ করতে গিয়ে দেখলাম একজন লোক চোখে কালো সানগ্লাস একটা ষ্টীলের ইষ্টিক হাতে নিয়ে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে। পাশের একজনের কাছ থেকে জানলাম উনি এই হলের নিচ তলার ১০১ নং রুমের মহসিন ভাই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। আমি খুবই অবাক হয়ে শুধু তাকে দেখছিলাম। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাবলীলভাবে যেভাবে হেঁটে টেবিলের দিকে আসছিলেন তাতে বোঝার উপায় ছিলোনা যে সে চোখে দেখে না। ওইদিনই মনে পড়েছিল মনের চোখের কথা যার দেখার ক্ষমতা মনে হয় অনেক বেশি।
এরপর প্রায়শই তাকে দেখতাম । তার একা একা পথচলা। অনেক সময় ইষ্টিক ছাড়ায় তিনি হেটে হলের গেট থেকে বের হয়ে যেতেন। বাইরে মামাদের দোকান থেকে কলা পাউরুটি কিনে আবার ১০১ নং রুমে ফেরত আসতেন। কারো কোন সাহায্য ছাড়ায় তিনি দোকানি মামাকে তার পাওনা টাকার পরিমাণটা যেনে সেখানেই চুকিয়ে দিয়ে আসতেন। সত্যি বিধাতার এক অদ্ভুত খেলা। অবাক লাগতো যখন তিনি ১০ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বলতেন ৭ টাকা রেখে ৩ টাকা ফেরত দাও। বিশ্বাস করতে পারতাম না মনে হত তিনি বোধহয় সব দেখছেন।
বেশ কিছুদিন হলে থাকার ফলে মহসিন ভাইয়ের সাথে আমার একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে। ক্যান্টিনে খাবার খেয়ে উপরে ওঠার পথে তার রুমে একটু ঢু মেরে যেতাম। দরজায় কড়া নেড়ে আমি প্রায়শই তার রুমে ঢুকে যেতাম। তিনি আমাকে ছুয়ে আমার নাম বলে দিতেন। বলতাম ভাই ‘আপনি আমাকে চিনলেন কিভাবে’। সদাহাস্য মুহসিন ভাই কোন উত্তর না দিয়ে আবারও মুচকি আসতেন।
একদিন দুপুরে তার রুমে অনেক ছাত্ররা এসে জড় হল তার সাথে গল্প করার জন্য। হলের প্রায় সবায় তার রুমের কাছে আসলে একটু নক করে যেত। আসতেই দেখলাম অনেক স্যান্ডেল দরজার সামনে। আমি ওইদিন একটু দুষ্টামি করে তার স্যান্ডেল জোড়া দুইপাশে সরিয়ে রাখি। ভাবছিলাম তিনি আমাদের কারো সাহায্য নেবেন। কিন্তু না তিনি তার স্যান্ডেল ঠিকই খুজে বের করেছিলেন মুহূর্তের মধ্যে তার মনের চোখ দিয়ে। আমার কাছে বিষয়টি সেদিন একটু অলৌকিক মনে হয়েছিলো।
মহসিন ভাই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হলেও তার অন্তর দৃষ্টির কাছে মাথা নুয়ে যেতো। তার মনের চোখ দিয়ে তিনি পড়তেন। হলের যে কোন ডিবেটে তিনি থাকতেন। তার কথা বলা, চিন্তা করার ক্ষমতা, আত্মসম্মানবোধ দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যেত।
ওই বছরই তার তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার তারিখ পড়লো। একদিন তার রুমে গিয়ে দেখি তিনি একটা শক্ত মোটা কাগজের উপর গর্ত করা কিছু ডটের উপর হাত বুলিয়ে চলেছেন। বললাম কি করছেন। ‘পরীক্ষার পড়া পড়ছি’ –তিনি জানালেন। তার বই দেখে সেদিন খুব অবাক লেগেছিলো। একটা মোটা কাগজের উপর কিছু ডট। দেখে মনে হবে কেউ সুচ দিয়ে সেগুলো খুব যত্ন করে ফুটো করেছে। আমি মানবিকের ছাত্র হউয়ায় তার পরীক্ষায় আমাকে লিখে দিতে অনুরোধ করলেন। আমি শুরুতে বুঝিনি পরে কথা বলে বুঝলাম যে ওনাদের পরীক্ষায় আর একজন লিখে দিতে পারে তবে এক্ষেত্রে তাকে মুখে উত্তর বলতে হবে আর পাশের জন লিখবেন। এটা ছিল আমার জন্য এক দারুন অভিজ্ঞতা। আমি তার ফাইনালের সবগুলো পরীক্ষায় তার পাশে বসে কথা শুনে শুনে প্রশ্নের উত্তর লিখে দিয়েছিলাম। রুমে তার পড়ার শব্দ না পেলেও পরীক্ষার হলে তার উত্তর বলা দেখে মনে হত অনেক দিন ধরে পড়ে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে তিনি পরীক্ষা দিতে এসেছেন।
পরের বছর আমি হল ছেড়ে দেই। ক্যাম্পাসে তার সাথে আর তেমন দেখা হত না। সময়ের সাথে সাথে তার সাথে যোগাযোগও আর হয়নি তেমন। শুনেছি তিনি মাস্টার্স শেষ করে হল ছেড়ে দিয়েছিলেন। একটি চাকরি খুজছিলেন ।এরপর অনেক বছর গেছে।
আজ সচল এ প্রতিবন্ধিদের নিয়ে একটি লেখা দেখে তার কথা মনে পড়লো। কেমন আছেন আজ মহসিন ভাই। কি করছেন মনের আলোয় উদ্ভাসিত এই মানুষটি? মনের চোখ দিয়ে যিনি বিশ্বকে দেখেন সেই বিশ্বজয়ীর জন্য কোন কর্মসংস্থান হয়েছিলো কি? মনের আলো দিয়ে আলোকিত করার অনেক ক্ষমতা রয়েছে এদের। তার মতো অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধি রয়েছে আমাদের দেশে। এদের সবার মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পারলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধিরা তাদের অন্তরদৃষ্টি দিয়ে অনেক কিছু দেখতে পাবে এবং আমাদেরকেও দেখাতে পারবে।
লেখকঃ অমি_বন্যা
মন্তব্য
লেখা ভালো লাগলো...
কিন্তু বানানটা বড্ড ভোগালো...
একটু খেয়াল করে ভাই
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ । বানানের দিকে খেয়াল রাখবো।
লেখাটা পড়ে খুবই ভাল লাগল।
ধন্যবাদ
মঁসিয়্যু, ভাল একটা লেখা লিখেছেন । আমাদেরও এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি বড় ভাই ছিলেন, তাঁর পরীক্ষার খাতায় লিখত আমার এক বন্ধু। উনার কথা মনে পড়ে গেল। জানিনা উনিও কোথায় প্রতিষ্ঠিত এখন।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
লেখাটি আপনার পুরানো সৃতি মনে করিয়ে দিতে পেরে ভালোই লাগছে।
লেখা ছুঁয়ে গেল অমি।
সকল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তাদের সংগ্রামে সফল হোন, এই শুভকামনা।
লেখাটি পড়ে মনে হল, একদম মনের গভীর থেকে লিখেছেন। ভালো লেগেছে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা ব্রেইল পদ্ধতি পড়ালেখা করেন কিন্তু আমাদের দেশে সব শ্রেণীর পাঠ্যবই এখন ও ব্রেইল করা হয়নি, এটা খুবই পীড়াদায়ক লাগে আমার কাছে।
আমি যতদূর জানি টাকায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ চিহ্ন রাখা থাকে যা হাত দিয়ে স্পর্শ করে অনুভব করা যায়।
ধন্যবাদ আপনাকে। আমিও মন্তব্য থেকে নতুন কিছু জানলাম।
ঢাকা শহরে আমার এক কাজিন একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে রাস্তা পার করে দেবার পর তিনি হাত তালি দিতে দিতে ফুটপাথ ধরে চলে গিয়েছিলেন। তালির প্রতিধবনী্র দিকে লক্ষ্য করে নাকি চলাফেরা করা সম্ভব। পরে ন্যাট জিওতে এই নিয়ে একটা প্রোগ্রামও দেখেছিলাম।
আমাদের যাদের চোখ আছে, তারা আসলে অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে উঠতে পারি না।
আমারও তাই মনে হয় যাদের দৃষ্টি শক্তি নেই তাদের ইন্দ্রিয় শক্তি প্রখর। আমরা চোখ দিয়ে যা দেখতে পায় না তারা তাদের মনের চোখ দিয়ে তার চেয়ে আরও বেশী কিছু দেখতে পায়। আমাদের উচিৎ এদের পাশে এসে দাঁড়ানো।
খুব ভালো লাগলো।
আমারও ভালো লাগছে ।
ফেইসবুকে একটা রিকোয়েস্ট দেখেছিলাম, এরকম একজনের হয়ে পরীক্ষায় লিখতে হবে, আমার খুব ইচ্ছে করছিলো কাজটা করতে।
লেখাটা ভাল্লাগলো।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
এই কাজটাতে আনন্দ পাবেন যদি করতে পারেন। মহৎ একটি কাজ করার পর যে আনন্দ তা এখানে অনুভব করা যায় । লেখাটি ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ।
আপনি যার লেখা দেখেছেন তিনি সাবরিনা।
সাবরিনার সাথে আমার দেখা ও পরিচয় খুবই আচমকা। যেমনি আচমকা তাকে দেখা তার থেকে আচমকা জীবন নিয়ে ভাবনার মোড় ঘুড়ে যাওয়া।
সাবরিনা কেবল দুটো আঙ্গুল ছাড়া আর কোন কিছুই নাড়াতে পারেনা। একটি সামান্য পিপঁড়া হেটে গেলেও তাকে সরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা তার শারিরীক ভাবে নেই। কিন্তু যে বিশাল ক্ষমতা নিয়ে সে বসে আছে তার নাম মনের শক্তি। যেটা আমাদের মতো শক্ত সামর্থ দুটো হাত পায়ের চলে ফিরে বেচে থাকার মানুষের অধিকাংশেরই নেই। অনেকবার শারিরীক ছোট্ট যন্ত্রণাকে প্রাধান্য দিয়ে অনেক কাজ থেকে দূরে থেকেছি। আর সাবরিনা কে দেখেছি উলটো।
অনেক ক্ষেত্রেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিয়েছি , যে শক্তির বলে আমরা তাদের থেকে নিজেদের শক্তিমান মনে করি তাদের পিছিয়ে রেখেছি আসলে তা ছাড়াই আমাদের থেকে অনেক উপরে উঠে এসেছেন সাবরিনা কিংবা সালমা আপা কিংবা এই যে মহসীন ভাইদের উদাহরন।
আমাদের শক্তি আমাদের পেশিতে নয় হোউক আমাদের মানসিকতায়।
হাতে হাতে যেন একে অন্যের সাথে সামনে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তায় এক কাতারে দাঁড়াবার মানসিক সহঅবস্থান যেন আমাদের আগামী হয়।
মানবিক সাহায্য নয় বরং মানবিক অধিকার হোক তাদের আগামীর পাথেয়।
আমি মানি আপনি এবং আপনারাও এগিয়ে আসুন সত্যিকার অর্থে
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
মানবিক সাহায্য নয় বরং মানবিক অধিকার হোক তাদের আগামীর পাথেয়।
খুব ভালো লাগলো কথাটা ।
আপনার লেখা মন ছুঁয়ে গেল।
অনেক ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটা লেখার জন্যে।
আমারও ভালো লাগছে । ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন