[justify][justify][left][center][justify]আজকাল মেয়েটি একদম চুপচাপ থাকে। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর টুকটাক কিছু কথাবার্তা বলার পরেই হটাত করেই চুপ হয়ে যায়। কেমন যেন একটা অদ্ভুত নিরব অন্ধকার এসে গ্রাস করে নেয় তাকে। ছেলেটি বুঝতে পারে তার মনের মধ্যে একটা ঝড় উঠবে যে কোন মুহূর্তে। কিছুক্ষন চেষ্টা করে একটু ভাল রাখার, কিন্তু যখন দেখে মেয়েটি তাকে বুঝতে দিতে চায় না, তখন আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, সময় দেয় মেয়েটিকে সামলে উঠার।
এইরকম ছিল না মেয়েটি, অনেক কথা বলতে পছন্দ করে, পছন্দ করে অনেক হাসতে আর গুনগুন করে গান গাইতে। গত সপ্তাহে ঘটে যাওয়া ঘটনার ই প্রতিফলন এটা। গেল শুক্রবার তার অসুস্থ ছোট বোন কে দেখতে গিয়েছিল হাসপাতালে, সাথে ছেলেটিকেও নিয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল ছোট বোনটা হয়ত দুজনকে একসাথে দেখে অনেক খুশি হবে। খুশি হবেই না কেন? কিছুদিন আগে মেয়েটিকে বলেছিল, আপু আমি অনার্স শেষ করে তোমাদের সাথে থাকব। তোমাদের বাচ্চা হলে তার দেখভাল করব। তোমরা শুধু আমাকে সাথে রেখো, যদি দেশের বাইরে যাও তাহলে আমাকেও সাথে নিয়ো। সেসব কথা শুনে দুজনেই হাসছিল। ভেবেছিল কি পাগল ছোটটা! সেই ছোট বোনটাই কিনা সেইদিন মুখের উপর বলে বসলো, ‘তোমরা কেন হাসপাতালে এসেছ, আমি তোমাদের সম্পর্কটা মানি না, গ্রহণ করতে পারি না, তোমাদের কারণে আমার কখনো পরহেজগার পরিবারে বিয়ে হবে না, বিয়ে হবে না কোন পরহেজগার পুরুষের সাথে।’ এরপর থেকেই এইরকম চুপ হয়ে যাওয়া।
সেই ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তি হবার পর থেকেই বন্ধু তারা। ৩য় বর্ষে উঠার পর, সে বন্ধুত্ব থেকেই দুজন একসাথে পথচলার শপথ নিয়েছিল। তারপর পাস করল, চাকুরিতে ঢুকল। দুই পরিবার থেকেই জানাজানি হল। জানার পরেই কেমন যেন হয়ে গেল দুই পরিবারের মানুষগুলু। মেনে নিতেই চাইল না তাদেরকে, উলটো বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হল কিভাবে সম্পর্কটাকে ভেঙ্গে দেয়া যায়। তারপর অনেক যুদ্ধ করে দুইজন ঢাকায় চলে এল। নতুন করে চাকুরি এবং নতুন ভাবে জীবন। তারপর Special Marriage Act No 3 of 1872 এর অধীনে বিয়ে। আস্তে আস্তে করে পাখির বাসা বানানো হয়ে গেল। দুই পরিবারের মধ্যে একজন ই কাছের মানুষ ছোট বোনটি। মাঝে মাঝে আসতো বাসায়, হাসিঠাট্টা, গল্পে দিনগুলা কাটতে লাগলো। তাদের মনে স্বপ্নের দানা বাঁধতে লাগলো, এইভাবেই হয়তো দুই পরিবার মেনে নিবে দুইজন কে। কিছুদিন পর সাহস করে ছেলেটা তার শ্বশুরের কাছে গিয়ে সবকিছু খুলে বলল। বলা যায় কোন নাটকীয়তা সেইদিন ঘটে নি। তিনি কিছুটা সামলে নিয়ে বলেছিলেন, তুমি বাবা মুসলিম হয়ে যাও, অন্যথায় তোমরা দেশ ছেড়ে চলে যাও। এইখানে আমি কখনই তোমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিতে পারব না। উত্তরে ছেলেটি বলেছিল ‘আপনারা আমাদের সাথে অন্তত যোগাযোগ রেখেন, যাতে কখন মনে না হয় যে আমাদের পাশে কেউ নেই।’ এই সময়গুলুতে ছোটবোনটি কিভাবে যেন একটি গ্রুপের সাথে মিশতে শুরু করে যারা ছহি ইসলাম এর পথে নিয়ে যায় মানুষ কে। এরপর ই তার বদলে যাওয়া এবং এইরূপ আচরণ। এরপর আর কি, দুইপরিবারের সাথে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ বলা যায়। এই দেশে থাকা র অন্যকোন দেশে থাকার মধ্যে কোন তফাৎ আজকাল খুজে পায় ওরা। এইদিকে একের পর এক স্কলারশিপ থেকে বাদ পড়তে গিয়ে আরও বেশি নিশ্চুপ হয়ে যায় মেয়েটা।
উপরে যে ঘটনাটা বললাম আশেপাশে লক্ষ্য করলেই এইরকম সম্পর্কের ২-১ টা উদাহরণ পেয়ে যাবেন পাঠক। সম্পর্ক, বিয়ে আর ধর্ম তিনটাই আলাদা ব্যাপার। বাবা-মা সাথে ছেলে বা মেয়ের সম্পর্ক এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটা আরেকটার সাথে তুলনা করাটা সম্পূর্ণ বোকামি। আর এর মধ্যে যদি ধর্ম নামক বস্তুটির উপস্থিতি থাকে তাহলে আর কথায় নেই।
এইযে নিজ ধর্মের গণ্ডি থেকে বের হয়ে সম্পর্ক-বিয়ে এইসব তো নতুন না আমাদের দেশে, তাও কেন এমন হচ্ছে! অনেকেই পরিবারের চাপ সামলাতে না পেরে আত্নহত্যার পথ খুজে নেয়। যারা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারেন তাদের একটা অংশ চলে যান দেশের বাইরে আর একটা অংশ নিজেদের পরিচয় গোপন করেন আশেপাশের মানুষের কাছে। আবার অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়ে যান। কেন এরকম হবে? আমাদের দেশে নিজ ধর্মের বাইরে গিয়ে বিয়ে করার জন্য আইন আছে যা সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাশ করা। কিন্তু সেটা শুধুই কাগজে-কলমে, এইটা নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথা নেই। ধর্ম তোমাকে মানতেই হবে। একটা মানুষ যদি কারও কোন ক্ষতি না করে, মিথ্যচার না করে, আইন ভঙ্গ না করে শুধু ধর্মের আচার-বিচার মেনে না নিলে ধর্মের এত লাগে কেন বুঝতে পারিনা। ধর্মের ভিত কি এতই নড়বড়ে যে একজন ধর্মের বাইরে গেলে দেশ-সমাজ-পরিবার রসাতলে চলে যায়!
কিছু অবান্তর চিন্তা সবসময় মাথার আশেপাশে টোকা মারতে থাকে। যেমন-
১. পরিবারের মানুষগুলু যদি এতই ধর্ম পরায়ণ তাহলে এইটা কেন মেনে নিতে পারে না যে, ‘ধর্মের বাইরে গিয়ে যারা বিয়ে করে তাদেরও জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে তিনটাই সৃষ্টিকর্তার হাতে’
২. একটা ছেলে বা মেয়ে জীবনের শুরুর ২২-২৫ টা বছর বাবা-মার সকল আশা-আকাংখা পুরণ করার চেষ্টা করেছে। আর যখন নিজের মত করে ভাবতে চায় তখনি কেন এত খারাপ হয়ে যায়।
৩. সমাজ যতটা না বেশি গুরুত্ব দেয় এই বিষয়গুলাকে তার চেয়ে গুরুত্ব দেয় মা-বাবার মত কাছের মানুষ। তাদের কাছে ব্যাপারটা কেমন যেন অচ্ছুত পর্যায়ের হয়ে পরে। কে বা কারা যেন তাদের কে একঘরে করে দেবে। আর এইদিকে যে ছেলে-মেয়ে দুটো আস্তে আস্তে একঘরে হয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারে না।
উল্লেক্ষ্য যে, আমার এই গল্পের প্রধান দুই চরিত্র কিন্তু কখনই বেছে নেবে না আত্নহত্যার পথ, নিজেদের সম্পর্কের ভিতটাকে কখনই ধর্মের কাছে মাথা নোয়াতে দিবে না আর যতবার স্বপ্ন ভাঙবে ততবার ই নতুন করে স্বপ্ন দেখবে নতুন করে সব কিছু গড়ে তোলার, ফিরে পাওয়ার।
_____রঙ্গিন বেলুন, ২৭ শে বৈশাখ ১৪১৯
মন্তব্য
"নিজেদের সম্পর্কের ভিতটাকে কখনই ধর্মের কাছে মাথা নোয়াতে দিবে না আর যতবার স্বপ্ন ভাঙবে ততবার ই নতুন করে স্বপ্ন দেখবে নতুন করে সব কিছু গড়ে তোলার, ফিরে পাওয়ার।"
আপনার গল্পের প্রধান দুই চরিত্রের এই স্পিরিট অক্ষুন্ন থাকুক।
সবার ওপরে মানুষ সত্য।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ধন্যবাদ শিমুল আপু। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যতদিন না বদলাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এদের স্বপ্ন দেখা থামবে না।
জানিনা কবে মানুষ ধর্মের চেয়ে জীবনের মূল্য দিতে শিখবে। আমি নিজে ও পরাজিত এই জায়গাটাতে, চাইলেই করতে পারিনি কিছুই। আপনার লিখায় এই বিষয়টা এসেছে, আর ও অনেকের লিখায় ও আসুক। মানুষ এর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসুক এটা যেন দেখে যেতে পারি।
মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হলে আগে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। কারণ আমরাও মানুষের পর্যায়ে পড়ি। লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনার মতামতটা যদি ফুটনোট করে দিতেন তাহলে বোধহয় আরও ভাল হত।
কিন্তু যে যুক্তিগুলো আপনি তুলে ধরেছেন তার জন্যে
এই সমস্যাটাকে নিয়ে লেখার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভাল থাকবেন।
নিয়মিত লিখবেন।
প্রদীপ্তময় সাহা, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পরার জন্য।
আসলে লেখক হিসেবে আমি কিন্তু নিজের মতামতটাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তবে হ্যাঁ, যদি বলেন করণীয় কি আছে তাহলে আমার আরও কিছু বলার দরকার ছিল।
কিছু বিষয় আছে এই আইন এ অন্তর্গত করা দরকার। সেই বিষয় গুলু হচ্ছে-
১. এই আইন এ বিবাহের পরে উত্তরাধিকার সুত্রে ওই দম্পতি কিভাবে তাদের মালিকানা বা অংশিদারিত্ত পাবেন সেই বিষয়ে কিছু বলা নেই। যদিও যারা এইরকম গণ্ডির বাইরে আসতে পারেন তাদের কাছে এইসব বৈষয়িক বিশয়গুলু তেমন গুরুত্ব বহন করে না। তারপরে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর ব্যাপারে কিছুটা প্রভাব থাকবে অবশ্যই।
২. সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টাও আনতে হবে। যখন এই আইন প্রণয়ন করা হয় তখন হয়তো হাতে গোনা কিছু দম্পতি পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আপনি সেই সংখ্যা কে হাতে গুনতে পারবেন না। এরা যেন কোনভাবেই সামাজিকভাবে হেয় হতে না হয় বাড়িওয়ালা, প্রতিবেশি কিংবা এলাকাবাসীর কাছে।
৩. সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়, যখন তাদের সন্তানকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে হয়। কারণ, আমাদের দেশে বাচ্চারা কোন ধর্ম অনুসরণ করবে তা পূর্বনিরধারিত। অনেক সময় ভর্তি করতে চায় বিদ্যালয় কতৃপক্ষ। শিক্ষিত হওয়া জরুরি না ধর্ম অনুসরণ করা বেশি জরুরি এইটা বুঝতে হবে।
৪. আরও একটা সমস্যা আমার জানামতে হয়, সেটা হল দম্পতির কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার আত্নিয়-স্বজনেরা এসে একরকম টানাহ্যাঁচড়া শুরু করে যে কিভাবে তার অন্তশটি বা শে্ষকৃত হবে। দলছুট এর সঞ্জিব দা’র মৃত্যুর পর তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন দাবি করে যে তিনি বিয়ের পর মুসলিম বা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী উলটো দাবি করেন। সুতরাং তাকে কবর দেয়া হবে নাকি পোড়ানো হবে তাই নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। আমি জানিনা শেষমেশ কি হয়েছিল। এক্ষেত্রে সঙ্গি বা সঙ্গিনীর মতামত কে প্রাধান্য দেয়া উচিত।
৫. বিয়ের সময় উল্লেখ করতে হয় যে ‘আমি কোন ধর্মে বিশ্বাস করি না’। কিন্তু ভাল কোন চাকুরীর জন্য আবেদন করতে গেলে আপনি কোন ধর্মের সেটা উল্লেখ করতে হয়। এই ব্যাপারগুলু কিছু দ্বন্দ্ব তৈরি করে বৈকি।
নতুন মন্তব্য করুন