মানব জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা হলে আমরা জানতে পারি যে মানব গোষ্ঠী আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ হাজার বছর পূর্বে যাযাবর জীবন ছেড়ে গ্রামীণ আর কৌম সমাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে মানুষ।কিন্তু এটা ঠিক কোথায় হয় সেটা আমাদের জানা ছিল না পুরোপুরি ভাবে। যেকোন বিজ্ঞানী বা ইতিহাসবিদকে এটা জিজ্ঞেস করলে তিনি দেখিয়ে দিতেন দুইটি এলাকা এক,মেসোপটেমিয়া দুই,মিশর তবে আজকাল আরেকটা অপশন যথেষ্ট জনপ্রিয় গবেষক দের কাছে আর সেটা হচ্ছে তুরস্ক বা অ্যানাতোলিয়া। ঠিক এখানেই কোনিয়া সমভূমির মধ্য-পশ্চিম অঞ্চলের থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে সাটালহইয়ুক নামের এক ছোট্ট শহরের তৃণভুমি এর মধ্যে জেগে থাকা দুইটি বিশাল ঢিবির মধ্যে পাওয়া গেছে সেই প্রশ্নের উত্তর।
সাটালহইয়ুক আজকে সেই মহা প্রশ্নের সন্ধান দানের ক্ষেত্রে রাখছে এক বিশাল ভূমিকা যে আমরা কবে থেকে গ্রামীণ কৃষিজীবী হয়ে উঠলাম!
এইসাইট টা সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৫০ সনের দিকে প্রায় ১১৫০০ বছরের পুরনো এই সাইট টাকে সর্বপ্রথম আবিস্কার করা হয় এরপরে ১৯৬১ সন থেকে ১৯৬৫ সন পর্যন্ত জেমস মেলার্ট নামের একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ এখানে খনন কার্য চালান। কিন্তু ১৯৬৫ সনের শেষের দিকে তিনি তুর্কি সরকারের দ্বারা অপসারিত হন তার রিসার্চ থেকে ডোরাক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে, এটা ধারণা করা হয়েছিল যে তিনি মুল্যবান ব্রোঞ্জ এর প্রত্ন তাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহকে পাচার করছেন বিদেশে।
পরে ১৯৬৯ সনে তিনি যদিওবা এই অভিযোগ থেকে মুক্ত হন কিন্তু এরপরে আর ফিরে আসেন নি তিনি এখানে।যদিওবা এই সাইটটা ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তার সময়ে এর অস্বাভাবিক রকমের বৃহৎ আকৃতি এবং এর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের প্রাচুর্যের কারণে।
এরপরে ১৯৯৩ সনের দিকে হেডার নামক একজন ৫৬ বছর বয়স্ক ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ এই সাটালহইয়ুক এ আবারও অনুসন্ধান শুরু করেন
তিনি মূলত ছিলেন জেমস মেলার্ট এর একজন পুরনো ছাত্র। ১৯৬৯ সনে তিনি এই বিষয়ে সর্বপ্রথম শুনেন তার গুরুর কাছ থেকে
এরপরে প্রায় ১২০ জন প্রত্নতত্ত্ববিদ,নৃতত্ত্ববিদ, জীব বৈচিত্র গবেষক, উদ্ভিদবিদ এবং ভূতাত্ত্বিক দেরকে তিনি নিয়ে আসেন এখানে।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত তারা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এই সাটালহাইয়ুক এর বিভিন্ন রহস্য উদ্ধার করার জন্য। এবং তারা বের করে এনেছেনও বহু তথ্য
হেডার এবং তার দল এই সাইটে কাজ করার আগেও মেলার্ট ১৯৬২ সালের দিকে এর ভিত্তির নিচে প্রায় ৪০০ কঙ্কাল খুঁজে পান। এটাকে একটা স্বাভাবিক আবিস্কার হিসেবেই ধরা হয়, কেননা পূর্ববর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন কৃষিজীবী গ্রামে গৃহের নিচে কবর দেবার রীতি ছিল। তবে তাদেরকে আশ্চর্য করে প্রায় ৪০০ কঙ্কাল এর একসাথে প্রাপ্তিকে।এই কঙ্কাল সমূহ ছিল মাটির নিচে একধরনের মৌচাক সদৃশ প্রকোষ্ঠের ভিতরে। সেই সময় থেকেই জেমস মেলার্ট এর এই ধারণা হয় যে এটাই নব্যপ্রস্তর যুগের অন্যতম প্রধান এবং বৃহৎ একটা বসতির উদাহারন।
আজকে আমরা জানি যে সাটালহইয়ুক এ প্রায় আট হাজার মানুষের বাস ছিল এবং তারা প্রায় এক হাজার বছর ধরে এখানে একত্রিত অবস্থায় বসবাস করত। তবে হেডার এর এই প্রশ্নটা আমাদেরকে সত্যই ভাবায় যে সাটালহইয়ুক এ এত বছর পূর্বে এমন সভ্য চিন্তা আর সমাজ এর ধারণা কেমন ভাবে গড়ে উঠল?
যেখানে মাত্র এর কিছুদিন আগেও মানুষেরা বিভিন্ন জায়গায় যাযাবর এর জীবন অতিবাহিত করত আর শিকার করত হরিণ, শুকর আর ছোট ছোট প্রাণী
সংগ্রহ করত বিভিন্ন ফল্মুল আর বাদাম এদের মধ্যে এই সাটালহইয়ুক নামক স্থান টা সতিই অসাধারণ কৌতূহল জাগায় এই ব্যাপারে হেডার বলেন
"কিন্তু আমরা এটা নিয়েই বিস্মিত হই যে এতসংখ্যক মানুষ এখানে আদিতে আসলই বা কেন"
১৯৯৩ থেকে বর্তমানে এই ১২০ জনের টিম টা প্রতি বর্গইঞ্চি জায়গা খুঁজে চলেছে সাটালহইয়ুক এর এই প্রমানের জন্য আর যে এখান কার মানুষেরা আসলে কি প্রকৃতির ছিল তাদের খাদ্যভাস কি ছিল তারা কি শুধুই কৃষিকাজ করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করত নাকি এর সাথে শিকারিও ছিল তারা। এই আদিম মানুষদের মাথার ভেতরে উঁকি দেবার জন্যই নিয়ে আসা হয়ছে এক সাইকলজিস্ট এনালিস্ট কে ।
এদের জন্যই এখন আমরা খুঁজে পেয়েছি বহু ওয়াল পেইন্টিং,এর মধ্যে আবার অনেক পেইন্টিং স্থাপনাগুলোর মেঝেতে আর ছাদেও অলংকৃত অবস্থায় আছে
চিত্রঃ উদ্ধারের পরে তাঁবুতে রাখা সাটালহইয়ুক এর দেয়ালচিত্র
এই ছবিগুলোর মধ্যে অনেক গুলো হচ্ছে পশু শিকার করার,যেমন হরিণ,বাছুর
এরপরে শুকুন মাথাবিহিন মানুষ সমূহকে ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে এমন চিত্রও আছে সেখানে,এথেকে আমরা তাদের সামাজিক পরিস্থিতি এর একটা আভাস পেতে পারি।
চিত্রঃ১৯৬০ সনে আবিষ্কৃত একটি দেয়ালচিত্র
যদিওবা মেলার্ট(বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) মনে করেন যে ধর্মই ছিল সাটালহইয়ুক এর বাসিন্দাদের একত্রীভবনের কারণ। এর পিছনের যুক্তি হিসেবে তিনি সেই মাতৃমূর্তির কথা বলেন যেটা তিনি উদ্ধার করেছিলেন তার অভিযানের সময়ে। প্রস্তরীভূত অথবা শক্ত কাদার তৈরি এমন বেশ কিছু মাতৃমূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে এখান থেকে তবে সেগুলকে পুজা করা হত কিনা সেটা নিয়ে এখনও মতবিরোধ আছে হেডার আর মেলার্ট এর মধ্যে।
তবে একটা কথায় সবাই প্রায় একমত যে ভি,গর্ডন,চাইল্ড এর নবপলিয় বিপ্লব অনুধাবনের জন্য এই সাটালহইয়ুক একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। গর্ডন বলতেন যে ১১৫০০ বছর এর কাছাকাছি সময়ে বরফ যুগের অন্ত ঘটতে শুরুকরে এবং বিভিন্ন মানুষ এবং মানব গোষ্ঠী নিজেদের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য নদীসমুহের আশেপাশে অবস্থান গ্রহণ করে যাদের দ্বারাই সর্বপ্রথম সভ্যতা এর সুত্রপাত হয়
তবে এই নবপলিয় বিপ্লবের সবথেকে ভালো ব্যাখা দিয়েছেন অগ্রজ প্রত্নতাত্ত্বিক লুইস বিনফোর্ড ১৯৬০ সালে তিনি তার একটা হাইপোথিসিসে ব্যাক্ত করেন তার মতবাদ
তার মতে মানুষ আদিম যুগে সেখানেই বসবাস করত যেখানে শিকার সহজলভ্য ছিল পরবর্তীতে যখন জনসংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু
করে তখন কিছু মানুষ প্রান্তিক এলাকায় সরে যায় এবং পশুপালন আর কৃষিকাজ শুরু করে। তবে সাতালহইয়ুক তার এই ধারনা কে
বেশ চ্যালেঞ্জ এর মুখে ফেলে দিয়েছে কেননা এর অবস্থান একেবারে মধ্যপ্রাচ্যের ঠিক মধ্যবর্তী এলাকায়। এজন্যই মনে হয় যে এই সাটাল হইয়ুক আমাদের জন্য আরও অনেক চমক নিয়ে আসতে যাচ্ছে।(চলবে)
মন্তব্য
আগেই পড়েছি। এখন মন্তব্য দিয়ে গেলাম। আরো পর্ব আসুক।
ছবিগুলোর সূত্র উল্লেখ করে দিবেন।
পড়া এবং মন্তব্য করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে। তবে ছবিগুলোকে ঠিক করতে হবে। ফেটে গেছে ছবিগুলো
এর কাছের এলাকা নিয়েই একটা পোস্ট করেছিলাম কিছুদিন আগে,
http://www.sachalayatan.com/tareqanu/43813
facebook
দারুণ
আমার ব্রাউজারে ক্যান জানি মাতৃমুর্তির ছবি ছাড়া বাকিগুলো আসছে না, কিন্তু ছবি ছাড়াও খুব ভালো লেগেছে পড়তে।
লেখকের নাম জানতে পারলাম না।
এটা আমি লিখেছি ইমরান হাসান আমার নাম। আর আপনার কথা শুনে আমারও খুব ভালো লাগলো ব্রুনো ভাই আশা করি আর কিছুদিনের মধ্যে আরও ভালো অনেক লেখা এখানে দিতে পারব।
চলুক ......
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
লেখা ভালো লেগেছে। প্যারাগুলির গঠনের দিকে একটু মনোযোগ দিলে হয়তো ভালো হতো। আর 'ডোরাক' ব্যাপারটি কি একটু জানতে ইচ্ছে করছে।
নতুন মন্তব্য করুন