একটা বায়না পাওয়া গেছে অবশেষে।
চৈত্র মাসটা খুব অকাজের। মাসের একেবারে শেষে চৈত্র সংক্রান্তি ছাড়া কোন পূজা পার্বণ নেই। এই মরা বাতাসের মাসে লোকে বিয়েশাদীর আয়োজনও করেনা তেমন। অগত্যা এমাসটায় ঢোলদুটো খুব আয়েশ করে ঘরের চালার সাথে বাঁধা শিকেয় ঝুলে দোল খায় অবিরাম। মাঝে মধ্যে নেংটি ইদুরের দল দাঁতের ধার পরখ করে দেখে ঢোলের ছাউনি আর সুতোয় কামড় বসিয়ে।
নয়ান ঢুলীর কৃষিকাজ জানা নেই মোটেও। কাজেই ফাল্গুনের মাঝামাঝি কৃষি বিপ্লবের ইরি ধানের রোয়া বোনা আর নিড়ানি দেয়ার বিপুল কর্মযজ্ঞে তার কোন ভূমিকা নেই। তিন পুরুষের বয়েসি ঢোল বাজানোর ছন্দবদ্ধ মন্ত্র ছেড়ে ধান আর পাট তামাক ক্ষেতের আইলে কাঁদামাখা পা মেলে বিড়ি তামুক খাবার চিন্তাও অবশ্য করেনি সে কোনদিন। অগত্যা কেবল ঢোল বাজানোর ফরমায়েশের অপেক্ষায় বছরের অনেকটা নিস্ফলা সময় তাঁকে পার করতে হয়। আজ অসময়ে হঠাৎ একটা বায়না এলে শিকেয় ঝুলানো ঢোলদুটোর ছাউনি টিপেটুপে পরখ করে দেখে সে। নাহ। ঠিকঠাকই আছে সব। দুপুরের তাতানো রোদে একটু উপুর করে রাখতেই টানটান হয়ে উঠে ঢোলদুটো। বাজনাটা আজ ভালই হবে, ভেবে একটু হাসে সে।
২।
রুদ্রেশ্বর হাটে পৌঁছুতে পৌঁছুতে একটু বেলাই হয়ে যায় নয়ান ঢুলীর। দেরীটা অবশ্য নিজ ইচ্ছেয় ঘটেনি। ছোট ছেলেটা এক ক্রোশ দূরের ইশকুলে চলে গিয়েছিল তাকে না জানিয়ে। দশ বছরের ছেলেটা ছোট খোলটিতে ভালোই তাল ঠুকতে শিখে গেছে। বাপে ছেলে মিলে বাজনা ধরলে রোজগারটা মন্দ হয়না। পাড়ার বিজেন ঢুলীকে বাজনার সাগরেদ করলে ফের তাঁকে আবার বায়নার অর্ধেক দিতে হয়। আজ বায়না আছে জেনেও বউটা ছেলেকে ইশকুলে পাঠিয়ে দিয়েছে। ইশকুলে পড়তে গিয়ে কি ইরি ধানের চাল কেনা যায়? এই নিয়ে বউয়ের পিঠে ঢোলের একটা কাঠিও ভেঙ্গেছে সে বাড়ি থেকে বেরুবার আগে আগে।
হাটের ঠিক পূবের সীমানা ঘেঁষেই আজিতন বেওয়ার বাড়ি। এই বাড়িটা উচ্ছেদ হবে আজ। ছমিরুদ্দিন ব্যাপারি জেলা জজ কোর্ট থেকে এই জমি ভিটা তার- এইমর্মে আদেশ পেয়েছে। বাড়ি উচ্ছেদ শেষে ঢোল সহরত বাজিয়ে নতুন মালিকের নাম প্রচার করে দিতে হয়। নয়ান ঢুলী সেই দায়িত্বটি পেয়েছে আজ। ইশকুলের বই ঝেড়ে ফেলে খোল হাতে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটতে থাকা ছেলেটাকে তাড়িয়ে অকুস্থলে পৌঁছে যায় সে।
আজিতন বেওয়ার বাড়ির চারপাশে আজ যেন সার্কাসের দল পড়েছে। চারিদিকে থিকথিকে ভিড়। আশেপাশের তিন গায়ের তামাম ছেলে বুড়ো বাড়ি উচ্ছেদ দেখতে জড় হয়েছে। বড় রাস্তা ধরে একদল পুলিশ বাঁশি ফুঁকে চলেছে অনবরত। পাশের গায়ের জুম্মন কসাই থেকে শুরু করে মাথায় লাল ফিতে বাঁধা অনেকগুলো মুখ দেখতে পায় সে। কোথাও উচ্ছেদ হলেই ওদের ডাক পড়ে। লুঙ্গিতে কাছা মেরে বড় বড় দা খুন্তি হাতে হেঁইয়ো হেঁইয়ো শব্দ তুলে ওরা টেনে ছিঁড়ে ভেঙ্গে ফেলছে আজিতন বেওয়ার বাড়ির একেকটা বাঁশের খুঁটি, টিনের বেড়া। একপাশে ঝুলে আছে পুঁই মাচা। একটা সজনে গাছ। তিন চারটে সুপারির চারাগাছ। মর্তমান কলার ছড়া। তার ওপাশে বড় ঘরটির উপড়ে ফেলা বাঁশের খুঁটি। একটা ভাঙ্গা চৌকি। আলনার রোয়াক। ছড়ানো চৌকাঠ।
বাড়ি ভিটের একটু নীচে এক চিলতে বাড়ন্ত পাটক্ষেত। দক্ষিণ পাড়ার জমশের আমিন জমি মাপার ফিতে হাতে তুমুল মনোযোগে ঐ পাটক্ষেতেও মাপজোখ করছে। ঐ ক্ষেতটাও বুঝি ব্যাপারি দখলে নেবে। ক্ষেতের আইলে দাড়িয়ে ছমিরুদ্দিন ব্যাপারির দুই ছেলে তারস্বরে চেচিয়ে কিসব যেন বলছে। ছেলেকে ভিড়ের বাইরে ছেড়ে নয়ান গুটিগুটি পায়ে ব্যাপারির পাশে গিয়ে দাড়ায়। ব্যাপারি ব্যস্ত ভীষণ। কোর্টে মামলা লড়েছে গত পাঁচ বছর ধরে। তারপর এই রায়। রায় পেয়েই কি শেষ হয়েছে? বাড়ি ভেঙ্গে দখল নিয়ে দেবার জন্য কতোগুলো লোককে আনতে হল। হঠাৎ সে নয়ান ঢুলিকে দেখতে পায়।
-ঢুলি এতো দেরং ক্যানে? মুই তো পুছ করিনু ঢুলীর পো উচ্ছেদ কামে ডরাইলেন কেম্বা? কপালের ঘাম মুছে ছমিরুদ্দিন ফোঁড়ন কাটে নয়ানের মুখে তাকিয়ে।
-ডরাই নাই গো ব্যাপারি। মোর ছাওয়া খান ইস্কুলত গেইছিল। ওক ধরি আসপার গিয়া বেলা পড়ি গেইলো। অয় নেকাপড়া করিয়া বুঝি জজ হইবে- কাঁধে ঢোলের রশিটা ভালমতন পড়িয়ে নিতে নিতে নয়ান জবাব দেয়। তাঁর দেরী দেখে ছমিরুদ্দিন খুব রাগ করেনি ভেবে একটু স্বস্তি পায় সে।
-হইছে। এইবার ভালো করি মোর নামখান সহরত করি দেও দিকিন। ছমিরুদ্দিনের গলায় তাগাদা ফুটে ওঠে ভীষণ।
-তা হইবে। ছটকু! ও ছটকু!! ইদিক আয় দিকিন! ভিড়ের ভেতর উঁকি দিয়ে ছেলেকে ডাকতে থাকে নয়ান ঢুলি।
জজ কোর্টের নাজির সাহেব আর এডভোকেট কমিশনার নয়ান ঢুলিকে সীমানা দেখিয়ে দেন। অনুমতি পেয়ে ঢোলটাকে ভূমি বরাবর একটু হেলিয়ে জুৎ করে ধরে সে। দুহাতে ঢোলের কাঠিদুটো তর্জনি আর অনামিকার উপরে তুলে মধম্যা দিয়ে চেপে ধরে ছেলের দিকে তাকায়। ছেলেও বেশ চালু হয়েছে ইদানিং। বাপের মতই কায়দা করে তৈরি হয়ে গেছে ইশারা পেয়ে। একটু লম্বা বাবরি চুল দুলিয়ে ঢোলের উপর কাঠিদুটো বিচিত্র ছন্দে কুরুতাং কুরুতাং বোল তুলে ফেলে নয়ান ঢুলি। তাঁর বাজনার ফাঁক পেয়ে ঠিকঠাক ঠিকা দিতে থাকে ছেলেটি। উচ্ছেদের সীমানা বরাবর পা ফেলে ফেলে ঢোলে বাড়ি দিতে দিতে নয়ান ঢুলি গলা ছাড়ে।
-একটি ঘোষণা-- একটি ঘোষণা---আজি হইতে -- রুদ্রেস্বর হাটের সীমানাত -- ২৮৪ খতিয়ানের --- ১৫৯৬ দাগের--- দুই দোন মাটির--- মালিক--- ছমিরুদ্দিন ব্যাপারি বলিয়া--- প্রচারিত হইলেন---কুরুতাং কুরুতাং--
ছটকু তাঁর ছোট ছোট পা ফেলে ফেলে বাপের পাশেই হাঁটার চেষ্টা করে। সেইসাথে ঢোলের তালও রাখতে হয়। গলার শিরা ফুলিয়ে বাপের বলা কথাগুলো তার বোধগম্য হয়না তেমন।
আদালতের আদেশে-- আজি হইতে-- এই মাটির-- ভোগদখলের -- ছমিরুদ্দিন ব্যাপারি হকদার থাকিলেন -- কুরুতাং কুরুতাং-- অন্য কাহারো -- কুন দাবী- গেরাহ্য হইবার নোয়ায়--- কুরুতাং-- কুরুতাং---
ওদের পায়ের নীচে কেটে ফেলা কলা গাছের মোচার সাথে আজিতন বেওয়ার নাতনীটার ফেলে যাওয়া টিউব ফেটে বেরুনো রং ফর্সা করার ক্রিম আর এক বোতল কেরসিন মিশে কেমন পিচ্ছিল পিচ্ছিল লাগে। কিসব হচ্ছে, ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে আজিতন বেওয়ার ছয় বছরের নাতনিটা কেমন ভেবদার মতন দাদির আঁচলের খুঁট ধরে টানতে থাকে একমনে। সীমানার কোণায় পোঁতা লাল নিশান ধরে তার আকুলি বিকুলি করে কান্নার স্বর অবশ্য সমবেত জনতা ভালো শুনতে পায় না।
দূরে একটা বেওয়ারিশ কুকুর কেবল তারস্বরে এই পৃথিবীর তাবৎ শব্দের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ জানাতে থাকে।
মন্তব্য
গল্প লেখার ধরনটা ভালোই।
কিন্তু গল্পটা কেমন জানি অসম্পূর্ন মনে হল, অন্তত আমার কাছে।
আলী ভাই
ঠিক ধরেছেন। বুঝতে পারছি অনেক মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন। ধন্যবাদ।
গল্প শুরু করাটা একটু সহজ বোধহয়। শেষ করাটা আমার কাছে ভীষণ জটিল হয়ে পড়ে। শেষমেশ তাড়াহুড়োয় কিছু একটা গোঁজামিল দিয়ে ফেলি-- বাক্যের ভেতর দাড়ি বসিয়ে দেবার মতন। দিন পনের পরে আবার লেখাটি নিয়ে বসতে হবে ঘষামাজার জন্য---
-------------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
গল্প চলুক পাভেল ভাই।
আর লেখার শেষে নামটা দিয়ে দেবেন মনে করে।
অচলের নামেই কি- আর বেনামেই কি?
(মজা লইলাম। আসল কথা হইল - টুকটাক মন্তব্য কইরা অভ্যাস তো। মন্তব্য করার সময় তো নাম লিখতে হয়না। এম্নেই নাম চইলা আসে। ঐ ধান্দায় নাম ছাড়াই পোস্ট দিয়া দিসি--)
গল্পের বুনন বেশ ঠাসা। আপনার গল্প লেখার হাত ভাল। নাম দিতে ভুলবেন না।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
অনেক ধন্যবাদ।
এরপর নাম লিখে দেবার কথা মনে রাখব---
-----------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
গল্পটা পড়তে পড়তে সন্দেহ হচ্ছিল যে এটা আপনার লেখা। শেষ করার পর দেখি লেখকের নাম নেই। মন্তব্যের ঘরে গিয়ে সন্দেহ দূর হলো।
আমার কাছে ফরম্যাট এবং দৈর্ঘ্য দুটোই ঠিক লেগেছে। ভাষা যথারীতি চমৎকার। আপনার খুঁটিনাটি বর্ণনা, প্লট বাছাই, অবজারভেশন আমার কাছে সবসময়ই ভালো লেগেছে।
পাঠক হিসেবে একটা অনুরোধ করি। লেখার সময় গল্প বা উপন্যাস ছাড়া অন্যকিছু লেখার লোভ সংবরণ করুন। উপন্যাসে হাত দেবার কথা ভাবুন - আপনি পারবেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পান্ডব দা
আপনার এই মন্তব্যে আমার সচলে গত ৪/৫ মাস জুড়ে লেখা (যদিও তা খুব অল্প ও মানে অতি নিম্ন পদের) সার্থক হল।
আপনি আমার লেখার পাঠক হিসেবে নয়, শক্তিমান একজন অগ্রজ গল্পকার হিসেবে পরামর্শ দিন। মাথা পেতে নেব।
------------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
নিরংকুশ ভালো লেগেছে।
নিরঙ্কুশ কৃতজ্ঞতা মাশরুম ভাই---
ভাল লাগল....জটিলতার গল্প সহজ সুরে বলা ।
অনেক ধন্যবাদ।
আপনার বাক্সে অনেক সম্ভাবনার মণিরত্ন লুকিয়ে আছে। বাক্স খুলে এক এক করে তা আমাদের দেখান। নয়ল মেলে দেখি।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
আমার বাক্সে যা কিছুই থাকুক, দুর্মূল্য অথবা মূল্যহীন, সবই দেখাচ্ছি ভাই---
অনেক কৃতজ্ঞতা উৎসাহ দেবার জন্য।
ভালো লেগেছে। আরও অনেক কিছুর আশায় রইলাম।
ভাল লাগা জানানোর জন্য কৃতজ্ঞতা---
অনেক ভালো থাকুন।
অনেকদিন কিন্তু আপনার লেখা নেই---
একটু অসম্পূর্ণ, মনে হল লেখকের কি জানি বলার ছিল, বলা হয়ে উঠলনা।
আমরা যা কিছু দেখি আর জানি এবং বুঝি, তার সব বলা যায়না, বলতে নেই।
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য---
নতুন মন্তব্য করুন