এক দুপুরের বৈশাখ ও কিছু মর্মান্তিক অনুভূতি
প্রতিটি মানুষই তার কোন একটি সময়ে জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাড়ায়। মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও অনেক সময় তাকে আলিঙ্গন করতে যেতে হয় আবার নিশ্চিত পরিনতির কথা জেনেও অনন্যপায় হয়ে মৃত্যুকূপে ঝাঁপ দিতে হয়।আর যখন এ থেকে পরিত্রানের কোন পথ খোলা থাকে না তখন ভাগ্যকে নিয়তির হাতে ছেড়ে দিতে হয়। এই সময় অবিচল থাকা যেমন কঠিন,ঠিক তেমনি কাউকে অবিচলিত থাকতে দেখলে তার উপস্থিতির গণ্ডিটা একটু রহস্যময় হয়ে ওঠে। এই অবিচল ব্যক্তির ক্ষেত্রে দুই রকম ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে। প্রথমত তিনি হয়তো একই পরিস্থিতি আগেও মোকাবেলা করেছেন অথবা তিনি পুরো বিষয়টি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন।
২০০১ সালের বৈশাখ মাসে এমনই এক জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছিলাম আমি । পদ্মার ওপারের মানুষ হবার সুবাদে এই নদীর বুকে পাড়া দিয়েই আমাকে আমার গ্রামের বাড়ী পৌঁছুতে হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি হয়েছিলাম সেই সুবাদে গ্রামের টান ঠিক তখনও প্রখর। ভর্তি হবার মাস দুই পরেই মন ছুটেছিল বাড়ীর টানে। তখন যশোরে আসার জন্য দুই ধরনের গাড়ী পাওয়া যেত। একটা ফেরি পারাপার আর অন্যটি লঞ্চ পারাপার। ফেরির চাইতে লঞ্চ পারাপারে খরচ ছিল অনেক কম।
ঐ দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের ৭ তারিখ। বৈশাখের আকাশ ছোট শিশুর মতোই আনপ্রেডিকটেবল। ঠিক কখন মেঘ জমে বৃষ্টি আসবে আগে থেকেই কিছু বলা যায় না। ভার্সিটির হল থেকে যখন গাবতলি আসি আকাশ তখন একেবারেই মেঘমুক্ত ঝকঝকা। আকাশ গবেষণা করে সিদ্ধান্ত নিলাম লঞ্চ পারাপারের গাড়ীতে যাবার। এর ফলে একের ভিতর দুই রকম সুবিধা পাওয়া যাবে। ফেরি পারাপারের চেয়ে ভাড়া যেমন কম অন্যদিকে ফেরির চেয়ে অনেক আগে ওপারে পৌঁছান যাবে। যথারীতি দুপুর ১২ টার দিকে গাড়ী আরিচা ঘাঁটে ভিড়ল।
সুপারভাইজার মাথা গুনে আমাদেরকে একটি লঞ্চের উপরে ঠেলে দিলেন। লঞ্চের নিচতলা ছিল মহিলা শিশু দিয়ে ঠাঁসা আর দোতলা আমার মতো দেরিতে ওঠা অথবা একটু সবল চিত্তের মানুষে আঁটা। ১২ টা ২০ মিনিটে কুণ্ডলী পাকান রশি খুলে দিলে লঞ্চ ওপারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। লঞ্চে ওঠার পর বৈশাখের আকাশ তার বৈশাখী রুপ ধারণ করতে শুরু করলো। হালকা দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছিলো পদ্মার বুকের উপর দিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে বিশাল পদ্মা এক দানবীয় রুপ ধারণ করলো। তার বুকের ঢেউ ক্রমেই আছড়ে পড়তে থাকলো আমাদের উপর।
অনেক দূরে একটি নৌকা দেখছিলাম ঝড়ের শুরু থেকেই। ৪/৫ জন যাত্রী সহ নৌকাটি প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলো প্রকৃতির এই বৈরিতার সাথে। দুই তিন মিনিট পর পর ভেসে ওঠা নৌকাটি দেখে নিজেকে অনেক নিরাপদ মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো এই মুহূর্তে যেন আমি ওদের থেকে ভালো অবস্থানে। আমার ঐ মুহূর্তের সান্ত্বনা তখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যাওয়া ওই ৪/৫ টি প্রাণ। এদিকে বিশাল ঢেউ আমাদের লঞ্চকে যেন আছড়াতে লাগলো। নিচে থাকা নারী শিশুর কান্নায় রীতিমত ভারী হয়ে যেতে লাগলো চারপাশ। ক্রমেই ঝড়ের গতি বাড়তে লাগলো যেন লঞ্চটাকে এখনই উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারলে সে শান্তি পায়।
জীবনে ওই প্রথমবার খুব বেশী বাঁচতে ইচ্ছা করছিলো। মনে হচ্ছিলো মনে হয় অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু বলা আর হল না। এতক্ষণ যেই নৌকাটিকে দেখে সাহস পেয়েছিলাম মুহূর্তের মধ্যে তাকেও হারিয়ে ফেললাম। নৌকাটি উলটে গিয়েছিলো আর প্রবল স্রোতে ক্রমেই তলিয়ে যাওয়া মানুষগুলো কয়েকবার হাত উঁচু করে যেন বেঁচে থাকার আহবান জানাতে চাইছিল। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মানুষগুলো একটু বাঁচার আশায় সেই মৃত্যু কূপে ঝাপ দিয়েছিলো। দূর থেকে বাঁচা মরার এই দৃশ্য দেখে নিজের অন্তিম মুহূর্তের কথা মনে পড়ছিল। মানুষের মৃত্যু যখন আসন্ন তখন এক আবেগি খেয়ালে সে শিশুর মতো আচরণ করতে থাকে। হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। যেভাবেই হোক বাঁচতে হবে এটাই হয় তখন মুখ্য। আর এই আচরণটিই করে বসেছিল আমার পাশে থাকা এক মাঝ বয়সী লোক। বেশ অস্বাভাবিক আচরণ করছিলেন তিনি সামনের নৌকা ডুবে যাবার পর থেকে।আমাদেরকে নদীতে ঝাপ দেয়ার জন্য তিনি বারবার বলছিলেন। কাউকে সাথে না পেয়ে আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি ঝাপ দিয়েছিলেন নদীতে। হয়তো প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া এই মুহুর্মুহু মৃত্যু যন্ত্রণা তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিলো। তাই জীবন ফিরে পেতে তিনি মৃত্যুকেই যেন আলিঙ্গন করে ফেললেন। তাকে আর দেখা যায়নি তিরে আসা অবধি।
আমি সেদিন খুব কাছ থেকে বেঁচে থাকার জোরালো আহবানটা আমার চারপাশের যাত্রীদের কাছ থেকে পাচ্ছিলাম। বিশেষ করে মাঝ বয়সী লোকটার সলিল সমাধির পর। লঞ্চ কোন সময় ডানে কখনও বামে হেলে যেন প্রায় ঢেউয়ের বুকে জোর করে ঝড়ো হাওয়া মিশিয়ে দিতে চাইছিল। আমি সাঁতার জানতাম । তাই একেবারে দোতলায় লঞ্চের কার্নিশ ধরে দাড়িয়ে গেলাম। আমার ব্যাগটা ডেকের ভিতরে রেখে প্যান্ট গুটিয়ে ঝাপ দেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। চারপাশ কালো মেঘে , আছড়ে পড়া ঢেউ আর ডেকের নিচ থেকে ভেসে আসা চিৎকারে নিজেকে এক অন্তিম পরিণতির জন্য গুটিয়ে নেয়া শুরু করলাম। নিজেকে ভাগ্যের হাতে সেদিন ছেড়ে দিয়েছিলাম। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা ঢেউ আর ঝড়ের সাথে সংগ্রাম করে অবশেষে ওপারে পৌঁছেছিলাম। আমাদের লঞ্চটা সেদিন ভাগ্যের সুপ্রসন্নতার কারনে ভাসতে ভাসতে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছেছিল। আমরা সেদিন ফিরে পেয়েছিলাম নতুন জীবন এবং অমোঘ এক পরিনতির মুখোমুখি হতে পারার এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। কিন্তু বারবার তাড়া করে ফিরছিল মাঝ বয়সী ওই লোকটির বাঁচতে চাওয়ার আকুতি।
জীবন মৃত্যুর ওই অন্তিম মুহূর্তে আমি লঞ্চে থাকা একজন মানুষকে দেখে সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম। চারিদিকে মানুষ যখন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছিলো পঞ্চাশের কোঠার এক ভদ্রলোক নির্বিকার বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। কোন উৎকণ্ঠাই যেন তাকে স্পর্শ করছিলো না। ঐ সময়ের জন্য এক রহস্যময় অতিমানব মনে হয়েছিলো তাকে।এতগুলো মানুষের আর্তনাদ , একজনের জীবন ফিরে পেতে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া কোন কিছুই তাকে তার আসন থেকে নড়াতে পারেনি। শেষ অবধি তিনি অবিচল থেকে লঞ্চ থেকে নেমে গিয়েছিলেন। এখনও মাঝে মাঝে মনে হয় সেই বৃদ্ধের কথা। তিনি কি সেদিন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন নাকি জীবনের সাথে এরকম অনেক সংগ্রামই তিনি প্রতিনিয়ত করে চলেছেন? হয়তো তাই অথবা ভাবছিলেন যা হবার তাতো হবেই- দেখা যাক কি হয়!
অমি_বন্যা
মন্তব্য
ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। লঞ্চ যাত্রা আমার কাছে সবসময়ই প্রিয়, সেটা সারারাতের জন্যই হোক বা আরিচার ঘন্টাখানিকের জন্য হোক। জীবনে বহুবার দু ধরনের যাত্রাই করা হয়েছে, তবে এই রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি, বরং সুখের অভিজ্ঞতাই বেশি।
লেখা ভাল হয়েছে, চালিয়ে যাও বন্ধু।
এই অভিজ্ঞতার পর আর আমার লঞ্চে চড়া হয়নি। এর আগে গিয়েছি বহুবার কিন্তু এই রকম মুহূর্তের মুখোমুখি ওই প্রথম। লেখাটা তোর ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো।
ভয়ানক অভিজ্ঞতা। যাক, তবু আজ আপনি আমাদের মাঝে আছেন। ভাল থাকুন।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
এমন বিপদ থেকে ফিরে এসেছেন?আল্লাহ আপনাকে অনেক দীন বাচিয়ে রাখুক।লেখা ভাল হয়েছে।
আপনার এই দোয়া যেন কবুল হয়। আপনাকেও
কেমন একটা দুঃস্বপ্ন তাইনা। আমরা একবার মালেশিয়ায় একটা আইল্যান্ডে বেড়াতে গেলাম, এমন ঢেউ যে বোট আছড়ে ফেলে দিচ্ছে বারবার, আর বোটের মেঝেতে ধুপধাপ শব্দ হচ্ছিল, তখন মনে হয়েছিল এইবার বেঁচে ফিরলে আর কোন্দিন এমুখো হবনা।এইসব উত্তাল সাগরে সাঁতার জানলে ও লাভ হয়না, এত উঁচু উঁচু ঢেউ এর মাঝে সাতরে তীরে ফিরে যাওয়া সম্ভব না।সেইসময় কেমন লেগেছিল আমি ভালোই জানি, আপনার অনুভূতি বুঝতে কষ্ট হয়নি তাই। ভাগ্যসি বেঁচে ফিরে এসেছেন, আজকে তাই অভিজ্ঞতার কথা আমাদেরকে শেয়ার করতে পারছেন।
সত্যিই এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা যা আজীবন সরণীয় হয়ে থাকবে। চাইনা আর কেউ এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হোক।
আপনার লেখার হাত বেশ।
চক্ষু-কর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা
ঘুমায় যেন চিত্রপটে আঁকা...
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
লেখার চেষ্টা করছি , দোয়া করবেন।
এরকম ঘটনার মুখোমুখি আমিও হয়েছি একবার। লঞ্চ পারাপার ও ফেরী পারাপারের বাসের ভাড়াও বোধহয় কমবেশী থাকে না্; অন্তত আমি যখন গেছি ছিল না, শুধু মানুষ লঞ্চ পারাপারের বাসে উঠতো, কারন ফেরী পারাপারের বাসে ফেরীঘাটে অনেক জ্যাম থাকতো - আর থাকতো অপেক্ষা। লঞ্চ পারাপারের বাসে এই ঝামেলা নাই।শুধু বাস বদলানো লঞ্চে নদীটা্ পার হয়ে।
মূঃলত, এই লঞ্চগুলো ছোট খুব। দেড়তলা হবে। সো, উত্তাল পদ্মার বুকে ঝড়ো আবহাওয়ায় অনেক রিস্কি। সদরঘাট থেকে ছাড়া লঞ্চগুলো বেশ বড়ো। অস্বাভাকিক বাজে ওয়েদার না হলে খুব একটা ভয় নেই।
ক্রেসিডা
আগের আরিচা আর এখনকার পাটুরিয়া ফেরিঘাটের লঞ্চগুলো আসলেই অনেক ছোট। বর্ষাকালে লঞ্চ পারাপার না হওয়ায় ভালো।
ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।
__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত
হু ম ম
ভয়ানক!!
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
দুর্লভ অভিজ্ঞতা। জীবনে একটি সঞ্চয় হয়ে থাকলো।
আসলেই দুর্লভ তবে তা আর ফিরে ফিরে না আসুক সেই কামনায় করছি।
মনে রাখার মত অভিজ্ঞতা। চমৎকার বর্ননা, খুব ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ আপনাকে।
খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখলেন। বেশ ভালো লাগল।
বৃদ্ধ লোকটাকে ইন্টারেস্টিং মনে হলো খুব। অবশ্য এরকমটা দেখা যায়। হয়ত মানুষটা প্রস্তুত ছিল সবকিছুর জন্য।
আপনার লেখা ভালো লাগল, আরো লিখবেন।
-এবিএম
অবশ্যই আরও লিখবো।
হয়তো বৃদ্ধ লোকটা জীবনের সাথে সংগ্রাম করে পোড় খাওয়া একজন মানুষ তাই কঠিন মুহূর্তগুলোকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলো বলে মনে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন