'হ্যালো, শফিক!' মোবাইলের অন্যপ্রান্তে রাণুর উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর।
বিচলিত শফিক। 'কী হলো রাণু? কোনো সমস্যা?'
'নবীনকে...' কথা শেষ করতে পারে না রাণু। শফিক ওর দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ অনুভব করে।
'কী হলো রাণু? 'নবীনকে' কী? কী হয়েছে নবীনের?' উত্তেজনা ভর করে শফিকের কণ্ঠেও।
উত্তর পায় না শফিক। রাণু ফোঁপাতে শুরু করেছে। শফিক বোঝে একমাত্র সন্তান নীবনের বড় কোনো অঘটন হয়েছে।
'নীবনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না...' কথা দ্রুত শেষ করে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে রাণু।
'কখন থেকে?'
'বিকেল থেকে...' রাণুর কান্নাজড়িত কণ্ঠের জবাব।
শফিক আর রাণুকে ঘাটায় না। লাইনটা কেটে ফোন রেখে দেয়। মটরবাইকে বসে স্টার্টারে চাপ দেয়। গো গো করে প্রতিবাদ করে মোটরবাইক। কিন্তু সেই প্রতিবাদ শুনছে কে? আসফাক চেঁচিয়ে ওঠে, 'কী রে শফিক, কোনো প্রবলেম?? শফিক গিয়ার প্যাডেলে পা দিতে দিতে কেবল উচ্চারণ করে, 'নবীনকে পাওয়া যাচ্ছে না।'
নবীন আর দশটা ছেলের চেয়ে অন্যরকম। বয়স মাত্র আট কিন্তু প্রশ্ন করে চিন্তাবিদদের মতো। সেসব প্রশ্নের জবাব নেই রাণু-শফিকের কাছে। হরতালের সময় টেলিভিশনের খবরে পুলিশ পিকেটারদের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া দেখে বলে, 'বাবা বাবা অত বড় মানুষগুলো কী অসভ্য দেখো, আর ওই পুলিশটা না কী দুষ্টু! মারামারি করছে। কই আমি তো রুবেল-রাসেলদের সাথে মারামারি করি না!' দৈনিক পত্রিকা পড়ে একদিন রাণুকে প্রশ্ন করেছিল, 'ধর্ষণ কী আম্মু? ধর্ষণ করলে মেয়েরা গলায় ওড়না পেঁচিয়ে মরে যায় কেন?'
জবাবে রাণু শুধু বলেছিল, 'বড় হও তখন বুঝবে, বাবা। সব প্রশ্ন করতে নেই।,
'কিন্তু ক্লাস ম্যাডাম বললেন, 'বেশি বেশি প্রশ্ন করবে তাহলে বেশি বেশি শিখবে। তুমি বলছ অন্য কথা। ধর্ষণ কী, জানলে ক্ষতি কী?'
রাণু চুপ হয়ে যায়। সব প্রশ্নের উত্তর হয়তো সে দিতে পারে না, তবে ছেলের এই প্রশ্ন করার প্রবণতাই ওকে গর্বিত করে।
ঢাকা শহরের বদ্ধ ফ্ল্যাটে দম আটকে আসে নবীনের। মন চায় ছুটিতে গ্রাম থেকে ঘুরে আসে। টিভিতে গ্রামের সবুজ ফসলের মাঠ, নদী, রাখল ছেলেদের অবাধ স্বাধীনতা দেখে ওর হিংসে হয়। বাবা শফিক একটা ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার। ছুটি-ছাটা নেই বললেই চলে। দেশের বাড়ি সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাই তিনদিনের ঈদের ছুটিতে দেশের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার স্বপ্ন দেখতে পারে না।
নবীনের মন চায় বাবা মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে একাই বেরিয়ে পড়ে কোনো এক গাঁয়ের পথে। কিন্তু যাবে কী করে? পথ চেনে না। তাছাড়া বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিলে গাড়ি ভাড়াই বা কোথায়? গাড়ির ড্রাইভারও কী পিচ্চি ছেলেকে নিয়ে খেপ মারতে যাবে? বাবা অবশ্য ছুটির দিনে চিড়িয়াখানা কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে যায়। শিশু পার্ক, ফ্যান্টাসি কিংডম, নন্দন পার্ক, ওয়াটারল্যান্ডেও গেছ, কিন্তু ভালো লাগেনি ওর। গ্রামীণ পরিবেশ নেই সেখানে। তারচেয়ে চিড়ায়াখানা-বোটানিক্যাল গার্ডেনই অনেক ভালো। অন্তত পশুপাখি, গাছ-গাছালিদের সাথে একদিনের জন্য হলেও কাছাকাছি হওয়া যায়। ইশ, চিড়িয়াখানার পশুগুলো যদি বন্দি না থেকে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারত ঢাকা শহরের অলিগলিতে কিংবা গ্রামের পথে-ঘাটে; কী মজাই না হতো!
কোথায় যেতে পারে নবীন, মটরবাইক চালাতে চালাতেই ভাবতে থাকে শফিক। ছেলেধরার কবলে পড়লে সর্বনাশ। আশার আলো হচ্ছে ছেলের দার্শনিক ভাবটা, কোথাও বসে যদি ভাবনার রাজ্যে বিচরণ করতে থাকে তাহলে ঠিক খুঁজে বের করতে পারবে শফিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ঠিক কোন জায়গা থেকে খুঁজতে শুরু করবে? পল্টনের আশপাশে নবীনের চেনা জায়গা বলতে রমনা আর শিশু পার্ক।
হাইকোর্ট মোড় থেকে মৎসভবন পর্যন্ত লম্বা জ্যাম। অগত্যা ফুটপাতের ওপর তুলে দেয় মোটর বাইক। অগত্যাই বা বলি কেন, রোজই এ কাজ করে। শুধু নবীন নয়, লক্ষ লক্ষ মোটরারোহী। পথচারীদের সমস্যা হয়। তাতে এতটুক অপরাধবোধ নেই বাইকওয়ালাদের। বরং হর্ন শুনে পথচারীরা সময়মতো সাইড না দিলে উল্টো গালিগালাজ করে বাইকওয়ালা। 'যেন ওদের বাবার রাস্তা!' পাল্টা গালি দেয় পথচারীও। সামনে নয়, বাইকওয়ালা পাশ কেটে বেরিয়ে যাওয়ার পর।
শিশু পার্ক, রমনা পার্ক তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে শফিক। নবীনকে পাওয়া যায়নি। রমনা থেকে বেরিয়ে ক্যাপ্টেন মনসুর আলি সড়কের বামদিকের ফুটপাতের ওপর দিয়ে চলে যায় কাকরাইল মসজিদ পর্যন্ত। তারপর বামে মোড় নিয়ে রূপসী বাংলার দিকে। রমনা পার্কের উত্তর গেটের সামনে এসে তাল হারিয়ে ফেলে। হঠাৎ সামনে এসে পড়ে একদল টোকাই। হর্ন বাজানো কিংবা ব্রেক চাপার অবকাশও পায় না শফিক। সোজা গিয়ে ধাক্কা লাগায় ছোট্ট এক ছেলের সাথে। ছেলেটা ফুটপাতের একপাশে ছিটকে পড়ে যায়। কী ঘটল দেখার ফুসরৎ নেই। শুধু শুনতে পায় একদল জনতা হৈ চৈ করে তেড়ে আসছে। গণপিটুনি কী জিনিস কিছুদিন আগেই আমিনবাজারে একদল ছাত্রকে পরপারে পাঠিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে জনতা। শফিক সিগন্যাল আর হেডলাইট বন্ধ করে হারিয়ে যায় রাস্তার হাজারো গাড়ির ভিড়ে।
সারা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নবিনের হদিস মেলেনি। রাণুকে ফোন করে যে জানবে সে সুযোগও নেই; মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ শেষ। ভফক অনেক হয়ছে, তাই বাণিজ্যিক ফোন ফ্যাক্সের দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন পুলিশই শেষ ভরসা। ভগ্ন হৃদয়ে বাড়ির দিকে বাইক ঘোরায় শফিক। নিজের ছেলেকে হারানোর ব্যথার সাথে আবার যোগ হয়েছে পরের ছেলেকে আঘাত করার অনুশোচনাও। আল্লাহ জানে ছেলেটার কী অবস্থা?
কলিংবেল বাজায় শফিক। একবার... দুবার... তিনবার...। দরজা খুলে যায়। মুখ বাড়িয়ে দেয় কাজের মেয়েটা। শফিককে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে, 'ভাইজান, নবীন সোনা...'
'কী হয়েছে নবীনের, পাওয়া যায়নি?’ অথৈ জলে ডুবতে চলা হতভাগ্য পিঁপড়ের খড়কুটো আকড়ে ধরার নিষ্ফল আশারবানী শোনার জন্য উৎকর্ণ হয় শফিক।
'পাওয়া গিইছে, তয়...'
'তবে কী?' আশংকায় কেঁপে ওঠে শফিকের বুক।
'রমনার ধারে কিডা যেন মটর চাপা দিয়া মাইরা ফ্যালছে ভাইজান...'
স্তব্ধ বিমূঢ় হয়ে যায় শফিক। এক মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে যায় সবকিছু। কী করবে এখন- ডুকরে কেঁদে উঠবে? নাকি অশ্রু ঝরাবে নিঃশব্দে। তারপর একসময় রাণুর সামনে তো দাঁড়াতে হবে। সেটা কোন বেশে নবীনের পিতা না হত্যাকারী?
----------------------
আব্দুল গাফফার রনি
মন্তব্য
বেশ ভালো লাগলো
হুম শেষটায় কি হবে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম আগেই। তবে আপনার গল্পের বুনোট বেশ ভালো।
আমি অর্বাচীন, তাই গল্পের অনেজ বিষয়ই তাই এলোমেলো হয়ে জাই।
আমি অর্বাচীন, তাই গল্পের অনেক বিষয়ই এলোমেলো হয়ে যাই।
গল্পটা ভালো লেগেছে।
কিন্তু একটা খটকা।
এটা বোধহয় শফিক হবে।
হ্যাঁ প্রদীপদা, আপনার কথাই ঠিক- এখানে 'নবীন'-এর স্থলে 'শফিক' হবে...
নামকরণটা বুঝিনি
নামকরণটা হয়ত ঠিকই হয়নি...
গল্প ভালো লাগল।
ধন্যবাদ, তবে সাথে একটূ সমালোচনা থাকলে উপকৃত হতাম...
সমালোচনা করার তেমন কিছু পেলাম না, বেশ বিভ্রাট বলতে সম্ভবত শফিক কোন বেশে রানুর সামনে গিয়ে দাড়াবে সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন........তারপরও নামকরনটা ভিন্ন হলে ভালো হত, বাকি সব ঠিক আছে।
এক্টু দূর গিয়েই বুঝেছি কি হতে যাচ্ছে।
এর সাথে 'বেশ-বিভ্রাট' নামটা ঠিক গেল না।(শুধুই আমার মতামত)
চালিয়ে যান
আপনার মতামত হয়ত ঠিকই আছে...
নামকরণে বিভ্রাট হয়েছে।
এটা রম্যগল্পের নাম হতে পারে, ইমোশনাল সামাজিক গল্পের নাম এমনটা হয় না।
বুঝেছি নিলয়দা...
আপনি বোধহয় বেশ তাড়াহুড়ো করে লেখেন। সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার সব কটি লেখাই পড়েছি, সেখান থেকেই এমনটা মনে হলো, ভুল হতেও পারে আমার পর্যবেক্ষন। আপনার উদ্যম এবং প্রাণচাঞ্চল্য প্রশংসা করার মত, আমার ব্যক্তিগত ধারণা একটু সময় নিয়ে প্লটের কঙ্কালে রক্ত মাংস জোড়া দিলে আপনার লেখা আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। ছোটখাট কিছু অসঙ্গতি (আমার চোখে) তুলে দিচ্ছি
১।
চিন্তাবিদ বলতে কি দার্শনিক বোঝাতে চেয়েছেন? তাছাড়া যেসব প্রশ্ন উদাহরণ হিসেবে দিয়েছেন সেগুলো আট বছরের আর দশটা বাচ্চার জন্য স্বাভাবিক, আলাদা কিছু নয়
২। কোন পুর্বাভাস ছাড়াই আসফাক নামে একটি চরিত্র উল্লেখ করেছেন, পরে এই চরিত্রের আর কোন অংশগ্রহণ নেই
৩।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি মার্কেটিং ম্যানেজার পদবীধারীরা (যে কোম্পানীরই হোক না কেন) ভালোই সুযোগসুবিধা ভোগ করেন। আপনি কি সেলস/মার্কেটিং রিপ্রেজেনটেটিভ বলতে চেয়েছেন? এদের জীবন মোটামুটি দূর্বিষহ
৪। কাকরাইল থেকে শেরাটন যাবার পথে রমনা পার্কের উত্তর গেটে দিনে রাতে কখনোই রাস্তা খালি থাকে না (আবারো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ১৯৯৯-২০০৬), জোরে বাইক চালিয়ে নিয়ন্ত্রন হারানো বেশ কঠিন, অন্য কোন রাস্তা বেছে নিতে পারতেন
৫।
ঢাকায় এত বেশি লোক আর এত বাড়িঘর, সারা শহর খুঁজে ফেলাটা একটু অতিশয়োক্তি মনে হয়
৬।
বাক্যের তিন গুণের একটি, "আসত্তি" জনিত সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে মনে করি
যদি মনে হয় বেশি বেশি খুঁত ধরার চেষ্টা করছি তবে ক্ষমা করবেন।
ভালো থাকবেন।
না, আপনার পর্যবেক্ষণে কোনো সমস্যা নেই, বরং খুঁটিনাটি ত্রুটিগুলো সংশোধণ না করতে পারলে আমিই বিপদে পড়ে যাব...আবারো ধন্যবাদ আপনাকে...
আমার সবচে' বড় সমস্যা- আমি সচলে সময় দিই খুব কম। এতো অল্প সময়ের মধ্যে সচলের অন্য লেখা পড়া, সেগুলোয় মন্তব্য করা, নিজের লেখার ওপর জমা পড়া মন্তব্য গুলোর জবাব দেয়া, নাতুন লেখা পোস্ট কর- সবমিলিয়ে আল্প সময়ে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলি। আমার আরো আরো...আরো বেশি মনযোগী হতে হবে। আমার সামনে 'নিলয়দা'র মতো একটা বড় উদাহরণ থাকতেও কেন যে এমনটা হয়...?
রনি, আপনি দ্বিতীয়বারের মতো আমাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেললেন।
আপনি অনেক আগে থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত।
আমি শুধু আপনার কিছু ভুল ধরিয়ে দিয়েছি, কিছু পথ হয়তো দেখিয়ে দিয়েছি। এর বেশি কিছু নয়।
যে কেউ সহযোগিতা চাইলেই আমি এগিয়ে আসতে রাজী আছি, যদি আমার সময় এবং সুযোগ থেকে থাকে।
তবে সেটা উল্লেখের প্রয়োজন নেই।
নিলয়দা এখানে কিন্তু সহযোগিতার কথা বলিনি, আপনার নিজের লেখার যত্নশীলতার কথা বলেছি। আপনি যখন লেখেন তখন যত্ন নিয়ে লেখেন, ভুল-ত্রুটি প্রায় থাকে না বললেই চলে। আমি সেই বিষ্যটাকেই উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছি। সচলের অন্য লেখদের উদাহরণ দেয়া যেত, কিন্তু সচলে আমি নতুন, তাই অন্যদের সম্পর্কে ধারণা নেই বললেই চলে। ভুল ক্ষমা করে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।
'বেশ-বিভ্রাট' গল্পটি প্রথম পাতা থেকে সরে যাওয়ার পর আমি 'কুকুর চুরি' লেখাটা আবার প্রথম পাতায় কিভাবে পোস্ট করব। নতুন লেখার মত করে পোস্ট করতে হবে, নাকি অন্য ব্যবস্থ আছে? এ ব্যাপারে মডারেটরদের সাহায্য চাই।
আপনার অন্য গল্প গুলোর তুলনায় এটা একটু কম জমেছে। লিখতে থাকুন।
ট্যাগ এ আপনার নাম না দিয়ে লেখার শেষে দিয়ে দেয়াটাই ভাল বেশী। মানে ট্যাগে লেখকের নাম থাকার কথা না। আপনি হয়ত জানেন না, তাই জানালাম।
আসলেই আমি জানতাম না। যাই হোক এখন থেকে সাবধান হব।
নতুন মন্তব্য করুন