হঠাৎ করেই আমাদের লাল কুররটা বদহজমে মরে গেল। কুকুরটা সবার এতো প্রিয় ছিল সিদ্ধান্ত হলো- আবার কুকুর পুষলে সেটা লাল রংয়েরই হবে। তো আমি আর আমার ছোট ছোট সব চাচতো ভাইয়েরা শীতকালের অপেক্ষায় রইলামÑ- শীতকালে নেড়ি কুকুরগুলো বচ্চা দেয় কিনা।
বর্ষা শরত হেমন্ত শেষ করে অবশেষে এলো শীত । কুকুরের তুলতুলে ছানায় ভরে উঠল পাড়ার গোলাঘর,পাটখড়ি, বিচালি গাঁদার তলাগুলো। আমারাও মহা শোরগোলে কুকুর ছানার খান-তল্লাশে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু কোথাও ঠিক আমাদের আগের কুকুরটার মতো লাল রংয়ের ছানা মিলল না। যদিওবা দু-একটা মিলল তার কোনোটাই মর্দা নয়, মাদি। হয়রাণ হয়ে অবশেষে যখন খোঁজাখুঁজির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি, ঠিক তখনই একদিন চাচাতো ভাই ফিন্টু এসে জানালো ডোমপাড়ায় দুটো লাল বাচ্চা দেখে এসেছে এবং দুটোই মর্দা। তখন আমাদের আনন্দ আর দেখে কে!
কিন্তু শূধু আনন্দ করলে তো আর চলবে না, একটাকে তো ধরে আনতে হবে? সম্যসা হচ্ছে ডোম পাড়া থেকে আমাদের পাড়ার দূরত্ব এক মাইলেরও বেশি, তাই ইচ্ছে করলেই যখন-তখন ধরে আনা যায় না। তাছাড়া কুকুর ছানাগুলো যে বাড়ির সে বাড়ির ছেলেরাই বা ধরে আনতে দেবে কেন। যদিও এসব কুকুরছানার বেশিরভাগই শেয়ালের পেটে যাবে আর বাকিগুলো পরে বেওয়ারিশ হয়ে পথে পথে ঘুরবে। অতএব চুরি করতে হবে!
আমরা বৈঠকে বসলাম। ফিন্টু জানালো- সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্তই নাকি উপযুক্ত সময়। এ সমেয়ে ডোমপাড়ার পুরুষেরা শুকোরের পাল চরাতে বের হয় আর মহিলারা কুলো চ্যাঙারি ফেরি করে বেড়ায় এগ্রাম থেকে সেগ্রামে।
পরদিন সকালেই আমরা ডোমপাড়ায় হাজির। সূর্য কেবল ঘন কুয়াশার চাদর ভেদ করে উঁকি মারার চেষ্টা করছে। আমাদের সামনে দিয়েই ডোমপাড়ার নারী-পুরষেরা বেরিয়ে গেলো যে যার কাজে। ডোমপাড়ার পুকুর পাড়ে একটা প্রকাণ্ড লিচুগাছ। পরিকল্পনা মাফিক ফিন্টু গিয়ে লিচুগাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। বাকি তিনভাই এগিয়ে গেলাম ডোমবাড়িগুলোর দিকে। ছেলে বুড়োর একটা জটলা দেখলাম গোল হয়ে আগুন পোহাচ্ছে। মাটিতে দাগ কেটে মার্বেল খেলছে একদল কিশোর। তাদের পাশেই খেলা করছে চার-পাঁচটা ফুটফুটে কুকুরছানা। দুটো আবার লাল রংয়ের। ভাগ্য ভালো যে মা কুকুরটা আশেপাশে নেই।আমারা রাস্তায় দাঁড়িয়েই 'কুর-কুর কুর-কর' বলে চিৎকার দিয়ে চেষ্টা করলাম বাচ্চাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের। ভেতর চাঞ্চল্য লক্ষ্য দেখা গেল বাচ্চগুলোর। কী করা উচিৎ ওরা যেন বুঝে উঠতে পারছিল না। একটা সাদকালো রংয়ের ছানাকে দেখলাম, সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে আমদের দিকে এগিয়ে আসছে। অন্যগুলোও ভীরু চোখে এদিক-ওদিক একবার দেখে নিয়ে প্রথম বাচ্চাটাকে অনুসরণ করল।
আমাদের চিৎকার মার্বেল খেলারত ছেলেদের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছিল। আমাদের মতলব বুঝে হৈ হৈ করে তেড়ে এলো ওরা । আমরাও পালানোর ভান করে দিলাম ভৌ-দৌড়। আর এই সুযোগে ফিন্টু গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে একটা লাল রঙের কুকুরছানা কব্জা করে উল্টোপথে দৌড় দিল।
ধাওয়া খেয়ে বেশ কিছুক্ষণ ছোটার পর মনে হলো, আর নয়; এবার ওদেরকে আসল কৌশলটা জানিয়ে দেয়া যাক। মুহূর্তের জন্য পেছন দিকে ঘুরে বললাম, 'ওই দেখ্, তোদের কুকুর ছানা কে নিয়ে যায়!'
ধাওয়কারী ছেলেরা পেছনে ফিরে দেখে আসল চোর ফিন্টু! ওরা আমাদের ছেড়ে এবার ফিন্টুর দিকে তেড়ে গেলো। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
পরের দুটোদিন বেশ হৈ চৈ করে কাটল আমাদের। সারাটাদিন কুকুর ছানাটা নিয়েই ব্যস্ত, এমনকী পড়ার সময়ও মন চাইত বাচ্চাটাকে একটু আদর করে আসি। দোকান থেকে কেক, বিস্কুট কিনে খাওয়াতাম। দিনের বেলা কোনো সম্যস্যা ছিলো না, রাত হলেই হয়তো মা আর ভাইবোনের কথা হত ওর। তাই করুণ স্বরে কেঁদে উঠত সে। তা শুনে আমার আমার যে কী খারাপ লাগত!
কুকুরছানার সাথে খেলার সেই আনন্দ দুদিনেই মাটি হয়ে গেল। চতুর্থদিন ভোরে চারভাই মিলে বাচ্চাটাকে জাগাতে গিয়ে দেখি, গোয়াল ঘরটা খালি। কোথায় গেল? খোঁজ খোঁজ রব উঠল সবার মাঝে। অনকে তল্লাসি চালিয়েও যখন হদিস মিলল না ঠিক তখনই আমি আবিষ্কার করলাম, গোয়াল ঘরের কঞ্চির বেড়ায় বেশ বড়সড় একটা ফুঁটো। একটা বড় কুকুর অনায়াশে ঢুকতে পারবে সেই ফুঁটো দিয়ে। কাজটা যে শেয়াল পণ্ডিতের তাতে কারো সন্দেহ রইল না।
চার-পাঁচদিন পর একমাত্র ফিন্টু ছাড়া বাকি তিনভাই শোক ভুলে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলাম। ডোমপাড়ায় আরেকটা আভিযান চালিয়ে দ্বিতীয় লাল ছানাটাও চুরি করার সিদ্ধান্ত পাকা হলো। এবং দ্বিতীয় অভিযানটাও সফল হলো। ডোমপাড়ার ছেলেরা ভাবতেই পারেনি সেদিন অমন রাম-ধাওয়া খায়ার পর এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার ওপাড়া মুখো হব। তারপরও আমাদের আবার দেখার পর ওরা ভেবেছিল, প্রথম দিনের কৌশলই হয়তো অবলম্বন করব। আমরা যখন 'কুর-কুর কুর-কুর' বলে চিৎকার দিলাম তখন ওরা ভাবল, আজো হয়তো ফিন্টু লিচুগাছের আড়ালে লূকিয়ে আছে। তাই আমাদেরকে গুরুত্ব না দিয়ে ওরা সে দিকে দিকে ছুটল ফিন্টুকে হাতেনাতে ধরার জন্য। এই ফাঁকে আমারা দ্বিতীয় ছানাটাকে নিয়ে পগার পার! পরে যখন ওরা নিজেদের বোকামী বুঝতে পেরেছিল তখন ওরা নিজেদের ওপরে রাগ ঝেড়েছিল সে কথা কল্পনা করলে আজো আমার হাসি পায়।
এই বাচ্চাটাকে আমরা আর পণ্ডিতমশায়ের খাবার হতে দিইনি। পরবর্তী দশ বছর সেই লাল কুকরটাই পাড়াটাকে শাসন করেছে। গভীর রাতের ওর বাঘের মতো গুরুগম্ভীর গর্জন কলজে কাঁপিয়ে দিত আমাদেরও। ওকে নিয়ে মাঠে অভিযান চালিয়ে কত যে শেয়াল, বেজি, বনবিড়াল, গুইসাপ মেরে পাড়ার লোকেদের কত হাঁস-মুরগি রক্ষা করেছি তার ইয়ত্তা নেই। পাড়ার সব কুকুরগুলো ওকে দেখামাত্র লেজ গুটিয়ে আগেভাগেই আত্মসমর্পন করত। চোর দূরে থাক, পুলিশেরও হয়তো সাধ্য ছিল ওর বাধা পেরিয়ে রাতে আমাদের বাড়িতে ঢোকে। শিয়াল আর বনবিড়ালদের কথা আর নাইবা বললাম।
এখন আমি সেই গ্রাম থেকে বহুদূরের পথ ঢাকা শহরে বাস করি। রাত বিরাতে কারো পোষা হাউন্ডের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলে এখনো ভাবি, বুঝি আমাদের সেই লাল কুকরটা শেয়াল বাবাজিদেরকে সদর্পে জানিয়ে দিচ্ছে, 'সাবধান! এ বাড়ির ত্রিসীমনায় ঘেঁষবে না কেউ!'
একটু পরে ঘুমের ঘোর কেটে যায়। তখন কুকুর চুরির কথা ভাবলে আপন মনেই যেমন হাঃ হঃ করে হেসে উঠি, তেমনি কুকুরটার জন্য মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। কারণ ঢাকা ছেড়ে বাড়ি গেলেও যে তাকে আর দেখতে পাব না- আট বছর হলো আমাদের সেই প্রিয় লাল কুকুরটা চলে গেছে না ফেরার দেশে ।
----------------------
আব্দুল গাফফার রনি
মন্তব্য
পড়েছিলাম কালকেই। শৈশব নিয়ে আরও লিখুন।
সমস্যটা হচ্ছে কি শৈশব নিয়ে নিয় অনেক লেখ ইতিমধ্যে 'রহস্য পত্রিকা' প্রকাশ হয়ে যাওয়াই ইচ্ছা থাক্লেও খুব বেশি লিখে উঠতে পারব কিনা সন্দেহ আছে।
খুব শিঘ্রি জামিল সিরিজের প্রথম কাহিনি 'ভিনগ্রহের পাণ্ডুলিপি'র প্রথম পর্ব পোস্ট করতে চাই। সচলদের অভিমত কী?
ভালো লাগলো।যদিও কুকুর-বেড়াল আমার পছন্দ না।
ক্রেসিডা
সবার সবকিছু পছন্দ হবে না- এটাই স্বভাবিক
পোষা প্রাণী হারানো খুব কষ্টের ব্যাপার।
পাহারাদার হিসাবে বিদেশী এবং ছেলে কুকুর ভাল, প্রচলিত এই ধারনাকে ভুল প্রমান করে আমাদের দেশি, মেয়ে কুকুরটা প্রায় দশ বছর বীর বিক্রমে পাড়া শাসন করে গেছে। ও যতদিন ছিল পাড়ায় একটা বেওয়ারিশ বিড়াল ও দেখা যেত না।
আমার কুকুরের কথা মনে পড়ে গেল ঃ(
#সুন্দর লিখেছেন, বেশ ভালো লেগেছে তবে মন একটু খারাপ ও হয়েছে।।।।
পুনশ্চ: দুবার পোষ্ট হলো নাকি?
পুনোত্তর : প্রথমবার নিড়পাতায় একাধিক গল্প পোস্ট করার অপরাধেট একটু উত্তম-মাধ্যম পড়েছিল পিঠে
খুব ভালো লাগলো পড়ে। এমন কোন কিছু আমার কোনদিন করা হয় নি!
করা হয়নি তো কি হয়েছে এখন যেটা করার সুযোগ আছে সেটাই করুন
বাচ্চাকালের গল্পগুলা কেমন মায়াময় হয়।
স্মৃতি তোমায় জানাই প্রিতি
তুমি আমার জীবন সাথি...
চমৎকার হয়েছে, ওল্ড ইয়েলার আমার খুব খুব প্রিয় একটা বই।
facebook
আহা শৈশব! কুকুরছানা, বেড়ালছানা, পাখিরছানা আরও কত কি!
আরো আছে- মুরগিছনা, কবুতর, কাঠদবিড়ালি, বাছুর, ছগছানা......রাজহাঁসের বাচ্চা দেখেছেন? কিংবা আকাশের মত নীল শালিকের ডিম?
আমার একটা কুকুর পালার শখ কখনোই মিটলো না।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
যদি দেশি কুকুর পালতে চান তো হেমন্তের শুরুতে গাঁয়ে চলে যান, ডজন ডজন মিলবে। আরেকটা কথা চুপি চুপি বলি, আমাদের গ্রামের ডোমপাড়াটা আজো আছ এবং কুকুর ছানার আঁতুড়ঘরও পাবেন গণ্ডায় গণ্ডায়...
নতুন মন্তব্য করুন