কর্পোরেট কালচার: দুধ-ভাতে ঘি ঢালা সংস্কৃতি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৪/০৫/২০১২ - ১২:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি এবং আমার স্ত্রী দু’জন দুইটি কর্পোরেট অফিসে চাকরী করি। আমারটি বহুজাতিক একটি মোবাইল অপারেটর; আমার স্ত্রী আছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ওষুধ কোম্পানীতে (নাম বলাটা নিরাপদ নয়)। আমাদের অভিজ্ঞতাটাই শেয়ার করবো আপনার সাথে; আপনারটাও জানতে চাই সবশেষে।এ বিষয়ে অনাগ্রহীরা পোস্টটি এখনই বন্ধ করে দিতে পারেন, আগ্রহীরা সাথেই থাকুন।

আমার অফিসের (আমি এখানে আছি গত ৪ বছর ধরে) টপ ম্যানেজমেন্ট বিদেশী। এখানে যোগ দেবার আগে আমাকে কেউ কেউ নিষেধ করেছিল এখানে আসতে; কারণটা বুঝলাম এখানে ঢোকার পর: সব ডিপার্টমেন্টের প্রধান মাদার কোম্পানী থেকে আসা নতুন-পুরনো লোক; তারা এখানে এসে ছড়ি ঘোরাচ্ছে বাংগালীদের ওপর; তাদের অধিকাংশেরই আচার-আচরণ যাচ্ছেতাই। আমার মতো যারা একটু নিচের দিকে কাজ করছি, তাদের সালামের জবাব দেবারও প্রয়োজন এরা বোধ করেনা মাঝে মাঝে; এদের সাথে হেসে কথা বললে বেয়াদবি হয় (অবশ্য এরা শুধু নিজের ডিপার্টমেন্ট-এর লোকদের সাথেই এমন কুৎসিত আচরণ করে; সেটাও আমার কাছে আরেক বিস্ময়)। ৪টি বছর কাটাবার পর আমার বিম্ময় অন্য বিষয়ে গিয়ে আটকেছে: এই অফিসে সবচেয়ে বেশী কষ্ট যারা করে, তারা সবচেয়ে অবহেলিত! যারা দিন নেই, রাত নেই টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে নেটওয়ার্ককে সচল রাখছে, যারা শুক্র-শনির ছুটি আর আরামের হাতছানি উপেক্ষা করে, মৃত্যু উপত্যকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোতে জীবন বাজী রেখে যারা ট্যুর করে বেড়ায়, ছুটে বেড়ায় এক জেলা থেকে আরেক জেলায়, পরিবারকে যারা সময় আর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করে, তাদের কথা বছর শেষে ভুলেই যান ম্যানেজাররা। ম্যনেজাররা যদিও বা তাদের কারো কারো প্রমোশনের জন্যে সুপারিশ করেন, বিভাগীয় প্রধানরা তা তুড়ি মেরে উড়িযে দেন; দেবেনইতো! সেই সব নেপথ্যের কর্মীদেরকে তো বড় বড় বস্-রা চোখেও দেখেননা, কানেও শোনেননা…। আমি অবশ্য তাদের দলে নই; আমি সেই কর্মীবাহিনীর দলে, যারা অফিসে বসেই যাকে বলে “দৌড়ের উপর” থাকে। আমি একজন প্রকৌশলী; আমার দিন শুরু হয় কলিগ(সহকর্মী) অথবা ভেন্ডর (ঠিকাদারকে এখানে ‘ভেন্ডর’ বলা হয়)- এর ফোন দিয়ে, দিন শেষ হয় ভেন্ডর অথবা ম্যানেজার-এর ফোন দিয়ে; অফিসে ঢাকার আগে থেকে ফোন আসতে থাকে, রাতে খাবার সময়ও ফোন বেজে ওঠে; আমরা স্ত্রী বিরক্ত হয়, আমি নিরুপায়। এভাবে দিন-মাস-বছর গড়ায়; বছর শেষে অ্যাপরেইজাল নামের একটি প্রহসন হয়; সেখানে নিজেকে নিজে মূল্যায়ন করতে হয়, সেটা ম্যানেজার রিভিউ করেন; কোন কোন ভদ্রবেশী ম্যানেজার প্রত্যেককে নিয়ে গোপন বৈঠকে বসেন; তার দোষ-গুণ আলোচনা করেন; আদেশ-উপদেশ দেন; আর কোন কোন ম্যানেজার কাউকে কিছু না জানিয়ে ‘কিছু একটা ’ গ্রেড দিয়ে বিভাগীয় প্রধানের কাছে জমা দেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বেশ কিছু কর্মকর্তা অ্যাপরেইজাল-এর মৌসুমে খুব সক্রিয় হয়ে ওঠেন; অফিস কাঁপিযে আদেশ-নির্দেশ দেন ভেন্ডর বা সাবঅর্ডিনেট(অধ:স্তন কর্মকর্তা)-কে। তাদের কর্কশ ‘কল-কাকলী’তে অফিস মুখর হয়ে ওঠে; বস্-রা তাদের ‘আউটস্ট্যান্ডিং’ পারফরমেন্স দেখে মেইল করে ‘পিঠ-চাপড়ানি’ দেন…। এবং সত্যিই তারা সফল; অ্যাপরেইজালে এরা ভাল গ্রেড পান, ইনক্রিমেন্ট, প্রমোশন, অ্যাওয়ার্ড সবই তাদের হস্তগত! আর বঞ্চিতদেরকে ম্যানেজাররা সান্তনা দেন: কোটা কম থাকায় সব যোগ্য লোককে এবার প্রমোশন দেওয়া গেলনা; পরেরবার দেখা যাবে। তার পরের বার দেখা যায় কেউ কেউ প্রমোশন পেয়েছে, কিন্তু বেতন তেমন বাড়েনি, কেউ কেউ আবার যা পেয়েছে, তাতেই খুশী। আমার আপত্তিটা অন্য জায়গায়: আমি দেখেছি কিছু চেনা মুখ, যারা প্রায় প্রতি বছর একটা করে প্রমোশন পেয়ে তর তর করে উঠে যাচ্ছেন; নিশ্চয়ই তিনি যোগ্য; কিন্তু তাকে বেশী দিতে গিয়ে যে আরেকজনের ভাগে কম পড়ছে! অন্যের ভাগেরটা নিয়ে নিয়ে তিনি একা উপরে উঠছেন, সেটা কি ঠিক? যে লোকের বেতন লাখের উপর, তিনি গাড়ী পান, ব্র্যান্ড নিউ ল্যাপটপ পান, আরো নানান রকম সুবিধা পান; তার বেতন যখন ১০%-১২% বাড়ে, সেই পরিমানটা হয় বিশাল। অথচ যে লোকটা বেতন পায় মাত্র ২৫-৩০ হাজার, তিনি গাড়ী তো দূরের কথা, অনেক সময় অফিসের ভাল কম্পিউটারটাও তার ভাগ্যে জোটেনা, পুরনো একটা ঢিলা ডেস্কটপ দিয়ে তাকে সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয়; এই লোকের বেতন যখন বছর শেষে ১০%-১২% বাড়ে, তখন সেই বেতনটা এমন জায়ড়ায় দাঁড়ায়, যা তার আগের বছরের বেতনের তুলনায় তেমন বেশী কিছুতো নয়ই, বরং তার বাজার খরচ আর বাসাভাড়া ১ বছরে যতটুকু বেড়েছে, তার তুলনায় বেতন কমেছে কমপক্ষে ৫%।

এবার আসি দেশী একটি ওষুধ কোম্পানীর কথায়। এই কোম্পানীটি যেন তৈরী হয়েছে লুটে-পুটে খাবার জন্যে। কীরকম? এখানে ডেপুটি ম্যানেজার এবং তার উপরের সব কর্মকর্তারা অফিস থেকে সার্বক্ষণিক গাড়ী পান; বছরে কমপক্ষে একবার অফিসের খরচে বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং অফিসে তাদেরকে কয়েকটি ফোন-কল আর কিছু মেইল আদান-প্রদান ছাড়া নিয়মিত তেমন কিছু করতে হয়না; সব কাজ তারা করিয়ে নেন অধ:স্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে। বছর শেষে বেতন যা বাড়ে, তা নামমাত্র; আর প্রমোশন শুধু তাদের হয়, যারা তেলবাজীটা সময়মতো এবং জায়গামতো করতে পেরেছেন; বাকীরা হলো ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা! এখানে অবশ্য ফিল্ডফোর্সকে বেশ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়: বছরে বড় সড় কনফারেন্স করে শ্রেষ্ঠ একজনকে পুরস্কৃত করা হয়; সবাইকে নিয়ে বড় একটা ভোজ হয়, সাথে কনসার্ট; কোন কোন বছর সবাইকে নিয়ে বিদেশ ভ্রমন, আর দুই নম্বর পথে কোম্পানীর ‘ফিজিশিয়ানস স্যাম্পল’ বিক্রি করে লাখপতি হবার বিশেষ সুযোগতো আছেই। আমার অফিসের মতো এখানে বিদেশীদের দৌরাত্ম নেই, তবে মালিক এবং তার আত্মীয়দের মধ্যে আছে একটা ‘রাজা’ ‘রাজা’ ভাব, প্রজারা তাদের দেখামাত্র ‘কুর্নিশ’ না করলে খবর আছে! এমনকি বাৎসরিক পিকনিকে (যেখানে অন্তত এক দিনের জন্যে উঁচু-নীচু ব্যবধান ঘুঁচে যাবার কথা) দেখা যায় শ্রেণীবৈষম্যের এক ঘৃণ্য নগ্ন রূপ!!!)

আর সবচেয়ে বেশী যেটা অসহনীয় তা হলো সেই দুধ-ভাতে ঘি: লাখের উপর যার বেতন, তিনি পাবেন গাড়ী, ফার্নিচার কেনার টাকা, টেলিফোন বিল, স্পেশাল অ্যালাউন্স, চাইল্ড অ্যালাউন্স, বিদেশে ছুটি কাটাবার জন্যে অ্যালাউন্স আরো কত কী…। আর যে লোক সকাল থেকে কাজ করতে করতে রাত বানিয়ে তার পর বিধ্বস্ত হয়ে লোকাল বাসের ঠাসাঠাসি ভীড়ে চ্যাপ্টা হয়ে বাসায় ফেরে, তার জন্যে অপেক্ষা করে বছর শেষের সেই প্রহসনমূলক অ্যাপরেইজাল আর নামমাত্র ইনক্রিমেন্ট!
দেশের সরকারী অফিস আদলতের অনেক অনিয়মের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। কিন্তু কর্পোরেট কারচারের নামে এই নিষ্পেষণ চলতে তাকে নীরবে, নিভৃতে। আর তাইতো যারা সহ্য করতে পারে, তারা মাটি কামড়ে মুখ বুজে পড়ে থাকে; আর যারা পারেনা, তারা খুঁজতে থাকে পালাবার পথ।


মন্তব্য

রংধনুর কথা এর ছবি

তিক্ত হলেও বাস্তব সত্য।

সাফি এর ছবি

কর্পোরেট কালচারে উপরের দিকে যারা থাকবে তারা সুবিধে বেশী পাবে এইটাই স্বাভাবিক। আমেরিকান কোম্পানিগুলো দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিলো বলে সরকার বেইল আউট পলিসির মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে টাকা দেয় আর সেই টাকায় বোনাস পায় সিইও লেভেলের কর্মকর্তারা। প্রাসঙ্গিক হিসেবে একটা উদাহরন দেই, চ্যারিটি সংস্থা রেড ক্রসের সিইও এর বাৎসরিক বেতন ১০লাখ ডলারের উপরে।

তানজিম এর ছবি

ভিন্ন মাত্রার লিখা পড়ে ভাল লাগল। শুধু দেশেই না এই চিত্র কমবেশি সারা দুনিয়াতেই আছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূলই হল, রাজার হস্ত করে কাঙালের ধন চুরি মন খারাপ

লাবণ্যপ্রভা এর ছবি

হা হা হা, আপনি যা লিখেছেন তা সবই আমরা জানি-মেনেও নিয়েছি, নিশ্চই মেজাজ খুব খারাপ তাই এটা লিখেছেন। কর্পোরেট কালচার যে কি জিনিস ....

জুঁই মনি দাশ এর ছবি

কর্পোরেট কালচার সবাইকে প্রথম হওয়ার স্বপ্ন দেখায় তাই প্রথম শ্রেণির পদ নিয়েই তাদের মাথাব্যথা......

কালো কাক এর ছবি

কর্পোরেট কালচার একটা ইঁদুর দৌড়ের মাঠ। সবাই দৌড়াচ্ছে আরো উপরে ওঠার জন্য। তেলবাজি, লসগুলোকে কার্পেটের তলে রেখে এচিভমেন্ট দেখিয়ে প্রমোশন এগুলো আছেই।
নিচের আর ওপরের বৈষম্য চোখে লাগার মত। বিদেশের অবস্থা জানি না, দেশে বেশিরভাগ ম্যানেজার আসলে ম্যানেজার না, একেকজন মহারাজা। আমার নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি , আমার লিখে দেয়া মেইল, আমার করে দেয়া রিপোর্ট, আমার বানিয়ে দেয়া প্রেজেন্টেশন দিয়ে আমার বস মাসে ৩লাখ টাকা ঘরে তুলছেন। আমারটা বলার মত না খাইছে
কিন্তু এছাড়া তো উপায় নাই। তাই একদিন আমিও এইরকম বস হতে পারবো এই আশায় খেটে যাচ্ছি।

S এর ছবি

এছাড়া তো উপায় নাই। তাই একদিন আমিও এইরকম বস হতে পারবো এই আশায় খেটে যাচ্ছি।

- জীবনেও পারবেন না চোখ টিপি যারা এভাবে ভাবে তারা বস হলেও জুনিয়রদের ব্যাপারগুলোই ভাবে (সোর্স: আমি এবং আমার টিমলিড)

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এই বৈষম্য দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে আমাদের চোখ।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

|জণারন্যে নিঃসঙ্গ পথিক| এর ছবি

আপনি যে বহুজাতিক অপারেটর এ কাজ করছেন , আন্দাজ করতে পারছি। আমি এক ভেন্ডর এর কামলা, সেই অফিসে ৮০% সময় থাকি। নিজের চোখেই দেখা অনেককিছু। যত উপরের ফ্লোরে যাবেন ভাবের মাত্রা বাড়তে থাকে। রুট এর কর্মীদের উদয়াস্ত খাটুনির চাইতে উপরতলার ( আক্ষরিক অর্থেও ) আয়েশী মিটিং এর প্রাধান্য বেশী।
আমার কাস্টমার টীম এর একটা বড় অংশ মাঝখানে বিরক্ত হয়ে চলে গেলো আরেকটি অপারেটর এ, বঞ্চনার শেষ নেই সেখানে।

বহুজাতিক ভেন্ডরগুলোতেও বঞ্চনার / অনিয়ম অনেক। একেকটাতে একেকধরনের। কোথাও জাতিগত বঞ্চনা, আমাদের এখানে ছোট দেশের ছোট নোড হবার কারনে ফোকাস না পাবার যন্ত্রণা, বৃহৎ ভেন্ডরটিতে ইদানীং প্রতিবেশী দেশের ম্যানেজমেন্টের যন্ত্রণা।

ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুড়ে গ্রামে গিয়ে দাদাজানের জমিতে আদা চাষ করি!

শাব্দিক এর ছবি

ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুড়ে গ্রামে গিয়ে দাদাজানের জমিতে আদা চাষ করি!

চলুক সহমত

রংধনুর কথা এর ছবি

সব টেলিকম অফিসের একই অবস্থা।

ভবঘুরে এর ছবি

দেশের একটা বড় টেলিযোগাযোগ কোম্পানিতে কিছুদিন কাজ করেছিলাম বিএসসি পাশ করার পরে। খুব আগ্রহ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম এই ভেবে যে বড় কোম্পানি, অনেক কিছু শিখতে পারব। কাজ শুরু করার পরে দেখলাম চূড়ান্ত রকম প্রফেশনালিজমের অভাব। আর তার সাথে তো স্বজনপ্রীতি আছেই। আমার টিমে দুইজন সিনিয়র ভাই ছিলেন। আমি জয়েন করার পরে দেখা গেল আমার আর তাদের অফিসিয়াল পোস্ট একই! আমিও যেই ইঞ্জিনিয়ার, ওনারাও সেই ইঞ্জিনিয়ার। অথচ একজন আছেন পাঁচ বছর ধরে আর একজন চার বছর ধরে, কিন্তু কারোরই কোনো প্রমোশন হয়নি! তাদের কে খুব হতাশ দেখতাম এগুলো নিয়ে। আর জয়েন করেই শিখতে হয়েছিল কোন ভাইয়া কে এড়িয়ে চলতে হবে কারণ উনি আবার ম্যানেজারের প্রিয়পাত্র এবং ম্যানেজারের স্পাই হিসেবে কাজ করেন। সব দেখে-শুনে আমিতো হতভম্ব। এই স্পাই ভাইয়ার স্বভাব ছিল আমাদের জুনিয়রদের দিয়ে ফাই-ফরমাস খাটানো। একদিন আমাকে পাঠালেন আর এক জায়গায় যেয়ে উনার এক কাগজ নিয়ে আসতে। আমি জীবনেও ভাবি নাই, দেশের প্রথম সারির একটা কোম্পানিতে এইসব চলতে পারে। খুবই হতাশ হয়েছিলাম।

সুলতান এর ছবি

আমার জানামতে হাতেগোনা গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব প্রতিষ্ঠানের একই অবস্থা।

মন মাঝি এর ছবি

এজন্যেই বোধহর র‍্যাট-রেস বলে!

****************************************

দুর্দান্ত এর ছবি

" আমি দেখেছি কিছু চেনা মুখ, যারা প্রায় প্রতি বছর একটা করে প্রমোশন পেয়ে তর তর করে উঠে যাচ্ছেন; নিশ্চয়ই তিনি যোগ্য; কিন্তু তাকে বেশী দিতে গিয়ে যে আরেকজনের ভাগে কম পড়ছে! অন্যের ভাগেরটা নিয়ে নিয়ে তিনি একা উপরে উঠছেন, সেটা কি ঠিক? যে লোকের বেতন লাখের উপর, তিনি গাড়ী পান, ব্র্যান্ড নিউ ল্যাপটপ পান, আরো নানান রকম সুবিধা পান; তার বেতন যখন ১০%-১২% বাড়ে, সেই পরিমানটা হয় বিশাল। অথচ যে লোকটা বেতন পায় মাত্র ২৫-৩০ হাজার, তিনি গাড়ী তো দূরের কথা, অনেক সময় অফিসের ভাল কম্পিউটারটাও তার ভাগ্যে জোটেনা, পুরনো একটা ঢিলা ডেস্কটপ দিয়ে তাকে সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয়; এই লোকের বেতন যখন বছর শেষে ১০%-১২% বাড়ে, তখন সেই বেতনটা এমন জায়ড়ায় দাঁড়ায়, যা তার আগের বছরের বেতনের তুলনায় তেমন বেশী কিছুতো নয়ই, বরং তার বাজার খরচ আর বাসাভাড়া ১ বছরে যতটুকু বেড়েছে, তার তুলনায় বেতন কমেছে কমপক্ষে ৫%।"

"আর যে লোক সকাল থেকে কাজ করতে করতে রাত বানিয়ে তার পর বিধ্বস্ত হয়ে লোকাল বাসের ঠাসাঠাসি ভীড়ে চ্যাপ্টা হয়ে বাসায় ফেরে, তার জন্যে অপেক্ষা করে বছর শেষের সেই প্রহসনমূলক অ্যাপরেইজাল আর নামমাত্র ইনক্রিমেন্ট!"

কাজ করার জন্য় বেতন/বোনাস দেয়া হয়। পদোন্নতি তো বেতন নয়, যে সেটা সবাইকেই পেতে হবে। যে কাজের জন্য় চুক্তি করা হয়েছে, সেটা করতে যদি 'গাধার খাটুনি' আর জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়, তাহলে আলোচনা হতে পারে যে প্রদত্ত বেতন/ভাতা/বোনাস সেই কাজের সাথে সামন্জস্য়পূরন কি না।

কিন্তু গাধার খাটুনি করার সাথে পদন্নোতির যোগসুত্র থাকার কথা নয়। খুব সহজে বলি, পদন্নোতি ক্রাইটেরিয়া হওয়া উচিত করমচারির যোগ্য়তা আর কোম্পানির প্রয়োজনের ভিত্তিতে। যোগ্য়তার পরিমাপও হবে কোম্পানির বরতমান ও ভবিষয়্তের প্রয়োজনের ভিত্তিতে। কোম্পানির চোখে সেই যোগ্য়তা যদি গাধার খাটুনি আর জীবন বাজি রাখা না হয়, তাহলে সেখানে পদন্নোতি হবেনা। বেসরকারি খাত প্রতিযোগিতায় ভরা। কিছু মানুষ আসলেই তেল মেরে পার পায়, কিছু ব্য়াবস্থাপক আসলেই তেল খেয়ে পদন্নোতি দেয়, এটা ঠিক। কিন্তু শুধু তেলমেরে/তেল খেয়ে অথবা শুধু গাধার খাটুনি/জীবন বাজি রেখে কিন্তু কোম্পানি বাজার ধরে রাখতে পারবে না। বাজারে টিকে থাকতে কোম্পানির করমচারি/করমকরতাদের আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন। এর একটার কথা বলি।

আমরা ভালবেসে কিছু লোককে 'করিতকরমা' বা 'চাল্লু' পোলাপান বলি। বোরডরুমে এদের সমাদর করা হয়, কিন্তু অফিসফ্লোরে এদের ভাল চোখে দেখা হয়না। কারন, আপনি যেটা বললেন, এইসব চাল্লু পোলাপানের না আছে কারিগরি যোগ্য়তা, না আছে গতর খাটানোর তাকদ। কিন্তু ভাবুন, এইসব চাল্লু ছেলেমেয়েরা এগিয়ে যায় কেন? এরা পরিস্থিতি বোঝে, অন্য়ের দ্ররিষ্টিকোন থেকেও সেই পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে, এরা সিদ্ধান্ত নেয় আবার সেই সিদ্ধান্তের পেছনে অন্য়দের দাঁড় করায়। এরা নানারকম মানুষের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেয় - কাউকে এরা তেল মারে, কাউকে ভয় দেখায়, কাউকে প্রভাবিত করে, কাউকে জবরদস্তি করে - কিন্তু শেষমেশ এরা কাজ হাসিল করে। এরা এদের গন্তব্য় নিজে বানিয়ে নেয়।

জায়গামত চাল্লু পোলাপান না রাখলে কিন্তু কোম্পানির কাজ হাসিল হবেনা। আর কোম্পানির কাজ হাসিল করতে না পারলে মালিকপক্ষ আদর আহ্লাদ (পড়ুন লাখ টাকা বেতন, গাড়ি এসব) করবে কি কারনে?

***

"সব কাজ তারা করিয়ে নেন অধ:স্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে।"
ব্য়াবস্থাপকের কাজই তো এটা। তাদের বেতন দেয়া হয় ঠিক এটা করার জন্য়ই।

লাবণ্যপ্রভা এর ছবি

আপনি যাদের "চাল্লু" বলছেন, আমি বলি ফাঁপরবাজ। এরা হল আপনার ও কর্মীদের মাঝের মিডিয়া। এরা সত্যি আপনার কাজ আদায় করে দিচ্ছে, কিন্তু কর্মী গোত্র না থাকলে "চাল্লুরা" যতই তেল মারুক, ভয় দেখাক, প্রভাবিত/জবরদস্তি করুক - আসল কাজ আসবে না।
বেসরকারি খাত প্রতিযোগিতায় ভরা বলেই, এখানে যে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকে সে পদোন্নতি আশা করে, নাই থাকতে পারে তার ডিব্বা যোগ্যতা ও আত্মসম্মানের বদলে তেলে ভরা। অনেকেতো করিডোরে সিগেরেট খেতে খেতে বসকে তার কাজের গতি বুঝিয়ে ফেলে।
আর পদোন্নতি মনে হয় কাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা, নিষ্ঠা ও কর্মীর যোগ্যতা দিয়ে বিচার করা উচ্রেই।দেশে কাজের প্রশংসা হিসেবে কমিশন দেয়ার একটা চল আছে, কিন্তু সেটা মনে রাখার চল নাই।

Extra mile সবাই তার কর্মীবাহিনীর কাছে আশা করে, কিছু ব্যয় না করেই হাসি

মরুদ্যান এর ছবি

সব জায়গায় মোটামুটি একই অবস্হা। চেষ্টা করেন যেভাবেই হোক ভীড়ের মধ্যেও নিজেকে আলাদা করে চেনাবার। কেউ এসে আপনাকে খুঁজে বের করবেনা এটা নিশ্চিত।

বুনোফুল এর ছবি

কোথায় নেই কর্পোরেট রাজত্ব!! সবই তাদের দখলে!! চমৎকার লিখেছেন।

________
বুনোফুল

কানা বাবা এর ছবি

আপনার কথা মনযোগ দিয়ে শুনলাম এবং বুঝলাম কর্পরেট কালচারে আমি অচল মাল। কয়েকটি প্রশ্ন জানার ছিলোঃ

১। বিদেশি বসরা কাজ কর্মে কতটুকু দক্ষ? নাকি বিদেশি হওয়াই এদের যোগ‌্যতা? আমিতো শুনেছিলাম ( সত্য মিথ্যা জানি না) যে এরা খুব একটা বেশি দক্ষ নয়, বেশি যোগ্য হলে বিদেশেই চড়িয়ে খেতে পারত।

২। দেশি যারা ম্যানেজার বা তার চেয়ে একটু বড় পজিশনে আছেন, তারা কতটুকু যোগ্য? তারা কি কেবলই তেল মেরেই প্রমোশন পেয়েছেন? অনেক মনে হয় আবার কোম্পানি এক্সপান্ড করার সময়ও প্রমোশন পেয়েছেন, ঠিক কিনা?

৩। শেষ প্রশ্নটি হলো টপ ম্যানেজমেন্টে যে সব বাংলাদেশি কর্মকর্তা আছেন, তারা কেমন - যোগ্য-অযোগ্য? তারা কি সাবঅর্ডিনেটদের সাথে ভালো না খারাপ ব্যবহার করেন? ঠিক টপ ম্যানেজমেন্টে নয়, তবে তার এক ধাপ নীচের বিভাগীয় প্রধানরাই বা কেমন?

/----------------------------------------------------
ওইখানে আমিও আছি, যেইখানে সূর্য উদয়
প্রিয়দেশ, পাল্টে দেবো, তুমি আর আমি বোধহয়
কমরেড, তৈরি থেকো,গায়ে মাখো আলতা বরণ
আমি তুমি, আমি তুমি, এভাবেই লক্ষ চরণ।।

মরুদ্যান এর ছবি

১) বিদেশি বসরা কাজকর্ম পারেনা সেটা ঠিক না, কিছু তো ফাঁপরবাজ থাকবেই। তবে আচার আচরণে বা ফেয়ারনেসের দিক দিয়ে বিদেশি (ভারতীয় বা পাকিস্তানি বা আরবদের কথা বলছিনা, সাদা চামড়া) ম্যানেজার রা অনেক ক্ষেত্রে দেশি ম্যানেজারদের থেকেও অনেকাংশে ভাল। এটা আমার আর আমার খুব কাছের কিছু বন্ধুর অভিজ্ঞতা। বিদেশিরা যারা আসে তারা বেশিরভাগ হেডকোয়ার্টারের আদেশেই আসে। আর ইনডিপেন্ডেন্টলি আসলে তখনই আসে যখন অফারটা সে তার দেশে যা আয় করে তার ৩-৪ গুণ হয়।

২) যোগ্য বা তেল মেরে দুই রকম ভাবেই আছে, তবে একেক অফিসের কালচার একেক রকম। সেই অনুসারে % উঠানাম করে। প্রমোশনে ভাগ্যটাও একটা রোল প্লে করে।

৩) যোগ্য লোক না থাকলে কোম্পানিগুলো চলতনা। তাই ঢালাও ভাবে সব ম্যানেজার অযোগ্য এটা বলা ঠিক হবেনা।

এবিএম এর ছবি

পড়ে খারাপ লাগল কর্পোরেট জগতের হতভাগা মানুষগুলোর জন্য। মন খারাপ

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি ও একজন করপোরেট কর্মী। আমার এখানে একজন ম্যানাজার আছেন উনি কমপানির সব কাজ পারেন। আর জি এম / ডিজি এম সাহেব রা উনার পদ লেহন করে চাকরি করেন। বরাবোরের মতো বেয়াদবির জন্য আমার এবার ও প্রমোশোন টা হয়নি। 'তেল দিবোনা' নীতিতে আটুট থাকতে পারাতে আমি খুশি। আমি অখুশি না, ইনক্রিমেন্টে আমাকে ঠকায় নি।

একলা পথিক এর ছবি

১। যোগ্য লোক উপরে উঠবে, এখানে অন্যায় কিছু নেই; সমস্যা হলো যোগ্য লোকেরা যখন অযোগ্যদের চেয়ে পিছিয়ে থাকে
২। উপরের দিকের লোকেদের তুলনায় নীচের দিকের লোকেদের ইনক্রিমেন্ট হার ও পদোন্নতির কোটা বেশী থাকা উচিত বলে মনে করি।

November Rain এর ছবি

পরে খুব খারাপ লাগলেো। কিন্তু াটাই দেখেছি যখন দেশে ছিলাম।কোন এক বহুজাতিক কমপানিতে কাজ করতাম। সারাদিন শুধু পলিটিক্স করাই ছিলো কারো কারো কাজ। সবকিছু মেনে নিয়ে শুধু কাজ নিয়ে থাকবো তারো উপায় ছিলো না।কেন কাজ করি সেটাও কারো কারো সহ্য হত না। র তারাই পেত সব সুযোগ সুবিধাগুলো।সেখানে আমার মত নরাধম এর যে কোন আশা নেই, সে বেশ ভাল বুঝতে পেরেছিলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।