প্রিয় আওয়ামিলিগ...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০১/০৬/২০১২ - ৬:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি আর রাজি রিক্সা করে সিলেটের কোর্ট পয়েন্ট দিয়ে যাচ্ছি। খুব বেশি দিন আগের কথা না। ইলিয়াস আলীর খোঁজে পুরো বাংলাদেশে তখন খোঁজ দ্য সার্চ অবস্থা। সিলেটের অবস্থা তো পুরাই উড়াধুড়া। পোস্টারে আর ব্যানারে পুরো শহর ইলিয়াসময়। হঠাৎ একটা ব্যনারে চোখ আটকে গেল। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে ব্যনারের একটা লাইনে চোখ আটকে গেল। ব্যানারে ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেবার পরিণতি সম্বন্ধে কিছু লেখা না থাকলেও ফিরিয়ে না দেয়ার পরিণতি সম্বন্ধে সরকারকে সম্যক অবহিত করা হয়েছে। যে বিশেষ লাইনে চোখ আটকে গিয়েছে তা হচ্ছে, ‘এ কেমন বর্বরতা!’। রাজি আমাকে বলল, ‘ব্যাপারটার অন্য অর্থ দাঁড়িয়ে গেল না?’
-কিভাবে?
-‘এ কেমন বর্বরতা’ লাইনটা পড়ে মনে হচ্ছে বর্বরতা আসলে খুব খারাপ না বা তত বেশি গায়ে লাগে না। মোটামুটি সহ্য করা যায়। কিন্তু এখন ব্যাপারটা একটু বেশি খারাপ হয়ে গেছে।
-কাহিনী সত্য। তবে বাংলার মানুষ, হোক শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, তারা সবচেয়ে সহজ অর্থটা গ্রহণ করে, এতো বিশ্লেষণ করে না।

একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়লাম, ‘আগে মানুষ ‘বর্বরতা’ বলতে বুঝত মধ্যযুগ, আরব। এখন পুলিশের কল্যাণে ‘বর্বরতা’ বলতে বুঝে বাংলাদেশ, একবিংশ শতাব্দী, আওয়ামিলিগ’।

প্রিয় আওয়ামিলিগ, আমরা বাঙ্গালী। সবচেয়ে সহজ জিনিসটা বুঝি। আপনাদের পুলিশ বাহিনীর কল্যাণে, আরো স্পষ্ট করে বলা চলে, আপনাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কল্যাণে আমরা হয়তো ‘বর্বরতা’ আর মধ্যযুগে খুঁজতে যাবোনা, আওয়ামিলিগেই খুজে নেব।

বিষয়টা আরেকটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। এমন না যে বিগত সরকারগুলোর আমলে কারো উপর পুলিশি নির্যাতন হয়নি। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পা ভাঙ্গা, মতিয়া চৌধুরী রাজপথে কি পরিমাণ মার খেয়েছেন তাও ভুলে যাওয়ার নয়। পুলিশি নির্যাতন আমাদের সকল সরকারের আমলে হয়েছে। পুলিশ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পেটাবে, সাংবাদিকদের পেটাবে, ছাত্রদের পেটাবে- এতো আমাদের সরকারগুলোর উত্তরাধীকার সুত্রে পাওয়া ঐতিহ্য। এই পেটানো, সভ্য বাংলায় বললে পুলিশি নির্যাতন, আরো সুন্দর ও স্পষ্ট করে বললে সরকারদলীয় নির্যাতন খারাপ হলেও আমরা যেহেতু বাংলাদেশে বাস করি এবং আমাদের রাজনীতিবিদদের মানসিকতা সম্বন্ধে আমরা জানি তাই আমরা এতোদিন তা মেনে এসেছি। কিন্তু এখন যে আর পারছি না। যে শিক্ষক আমাদের পড়িয়েছেন তার মৃত্যুর দায়ভার আপনারা নিবেন না, যে সাংবাদিক নিজের জীবন বাজি রেখে আমাদের খবর জানান তাকে পঙ্গু করার দায়ভার আপনারা নিবেন না, আদালতপাড়ায় একজন তরুণীর শ্লীলতাহানীর-তাও পুলিশ কর্তৃক- দায়ভার আপনারা নিবেন না, আমরা এগুলো জানি। আবহমান কালের রাজনীতির ঐতিহ্য তো আপনাদেরকেই ধরে রাখতে হবে। একইসাথে আমাদের আম পাবলিকদের চামড়া হয়ে গেছে হাতির চামড়ার মত। লজ্জা ঢাকতে মনিকা বেল্লুচিরও যে পরিমাণ কাপড় পড়তে হয় আমাদের তাও লাগেনা। এনাটমি পড়তে গিয়ে পড়েছিলাম Male external genitelia-র skin নাকি Hyperpigmented and corugated. হাতি দেখলেই তার চামড়ার দিকে তাকিয়ে আমার হাসি পায়। ন্যাংটার যেমন নাই বাটপারের ভয়, আমাদের যতটুকুই অপমান করা হোক না কেন আমরা লজ্জায় আর ঘৃণায় এখন আর এতটুকু শিউরে উঠি না, কারণ আমাদের পুরো শরীরইতো লজ্জাস্থান দিয়ে ঢাকা। সবার যখন একই জিনিস দেখা যাচ্ছে, তখন আর লজ্জা পাওয়ার কি আছে। এজন্য এতোদিন আমরা বিষয়গুলোকে ‘বর্বরতা’ বলে আস্তে করিয়ে পাশে সরিয়ে রেখেছি। কিন্তু প্রিয় আওয়ামিলিগ, যখন আপনাদের আইন প্রতিমন্ত্রী বলে উঠেন, ‘পুলিশ হতে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সংবাদ সংগ্রহ করলেইতো আর এরকম ‘দূর্ঘটনা’ ঘটে না’। কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, ‘পুলিশ এখন অনেক ‘ভালো’’। ঠিক তখনই তথাকথিত ‘ভালো’ পুলিশের অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো ‘দূর্ঘটনা’-র পক্ষে এই সাফাই-ই আমাদের বলে উঠতে বাধ্য করায় ‘এ কেমন বর্বরতা!’।

পত্রিকা পড়লে মনে হয়না আর আমরা এমন একটি সোনার দেশে বাস করছি যা দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তাক্ত সংগ্রামে অর্জিত। পত্রিকা পড়লে মনে হয় আমরা বাংলাদেশে বাস করছি না, বাস করছি ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জার্মানি অকুপাইড পোল্যান্ডে। মনে হচ্ছে পুলিশরা মনে হয় জার্মান সৈন্য, আর আমরা ইহুদী। এই লেখাটি লেখার সময় আমার বার বার মনে পড়ছে Schindler’s List মুভিটার কথা। মনে হচ্ছে আমাদের দেশের একেকজন সাংবাদিক একেকজন Olek Rosner বা Ryszardz Horowitz, আদালত প্রাঙ্গনের তরুণী একজন Helena Hirsch. যদি তাই না হবে তাহলে আমরা একজন পুলিশেরও কিছু হতে দেখি না কেন? উল্টো তাদের পক্ষে সাফাই শুনতে হয় কেন? লিমন তার পা হারাবে, কাদেরের বিরুদ্ধে মামলা হবে ইত্যদি ইত্যাদি অনেক কিছু হবে, কিন্তু কোন ইউনিফর্মধারীর গুপ্তাঙ্গের সামান্য কেশও ছিড়বেনা-এরকম সময়তো আমরা অনেক আগেই কবর দিয়ে এসেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়।

পুরো বাংলাদেশ থেকে শিক্ষকরা এসেছেলেন ঢাকায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তারা হেটে হেটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাবেন এবং তাদের চাকরি জাতীয়করণের একটা আবেদনপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিবেন। না তারা কোন অবরোধ করেননি, কোন হরতাল দিয়ে দেশ অচল করে দেননি। ফলস্বরূপ, তাদের একজনকে পুলিশের লাঠিচার্জে প্রাণ দিতে হল। আমরা জানি, প্রিয় আওয়ামিলিগ, এখানে আপনাদের কোন দোষ নেই, নেই কোন দায়ভার। দোষতো ঐ শিক্ষকদের, যারা ভুলে গিয়েছিলেন, তাদের চাকরিটা জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি আপনি দিলেও আবেদনপত্র জমা দিতে এলে প্রাণ থাকবে এই প্রতিশ্রুতি দেননি।

টার্ম পরীক্ষা দিয়ে পাঁচমাস পরে সিলেট এসেছি। গোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র ডাক্তার বলে আমার খাতির একটু অন্যরকম। তাই সিলেট এলে সকল আত্মীয়ের বাসায় একটু ঢুঁ মারতে হয়। ঢুঁ মারা অভিযানের অংশ হিসেবে গিয়েছি বড়খালার বাসায়। বড় খালার শ্বশুর বাড়ি সম্বন্ধীয় যত আত্মীয়-স্বজন আছেন, সবাই এসেছে আমাকে দেখতে। আমি কাউকেই চিনিনা। যিনিই আসেন, তাকেই বলি, ‘আসসালামু আলাইকুম, বালা আসইন নি?’ সেখানে একজন মহিলার সাথে পরিচয় হল। বেশ বয়স্ক মহিলা। বয়স ৪৫-৫০ বছর। পড়ালেখা তেমন করেননি। তিনি অনেকক্ষণ আমার সাথে পড়ালেখা নিয়ে কথা বললেন। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আজকাল কেউ কথা বলে অবধারিতভাবে যে বিষয়টা চলে আসে তার নাম ছাত্রলীগ। কথায় কথায় জানলাম, তার বড় ছেলে একটি পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। সে ইউনিভার্সিটির হলগুলোতে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্য মারামারি করে কিরকম তান্ডব চালিয়েছে তার একটি বিবরণ তিনি দিলেন। আমি নিজে মোটামুটি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। হয়তো তত শক্তভাবে না, তারপরেও যুক্ত। আমি তার কথার উত্তরে কিছু বললাম না। শুধু হু হু করে গেলাম। তারপর কথা ঘুরতে ঘুরতে ইলিয়াস আলী হয়ে রাজনীতিতে চলে আসল। সকল বিষয়ে তিনি আওয়ামিলিগ সরকারের বিষোধগার করলেন। আমি হু হু-র মাঝে ‘শুধু আওয়ামিলিগ না, সব সরকারের আমলে এরকম হয়েছে’ বলে ডিফেন্ড করতে চাইলেও তার কথার তোড়ে আমার ডিফেন্স ভেঙ্গে গেল। সবশেষে তিনি একটা কথা বললেন, যা শুনে আমি খুব অবাক হলাম। আমি এতক্ষণ ভাবছিলাম তিনি চরম আওয়ামী বিদ্বেষী, তাই তার শেষ কথাটি শুনে আমি একটু তব্দা খেয়ে গেলাম। তার কথাটি ছিল এরকম, ‘এ দেশকে যদি কোন দল রাতারাতি উন্নত করতে চায় তবে তা পারবে শুধু আওয়ামিলিগ। সব বড় বড় মাথাওয়ালার আওয়ামিলিগান, বিএনপিতে এরকম নেই বললেই চলে। কিন্তু আওয়ামিলিগ এদের কাজে না লাগিয়ে লাগিয়েছে সব মাথামোটাদের’।

প্রিয় আওয়ামিলিগ, গ্রামের একজন অর্ধশিক্ষিত মহিলাও জানেন দেশটাকে সুন্দর করার ক্ষমতা আপনাদের আছে। আফসোস, আপনারাই শুধু তা জানেননা। আপনারা শুধু পারেন, চোখ-মুখ কুঁচকে ‘দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো’ এ কথা বলতে অথবা আবুল প্রকৃতির হাসি দিয়ে বলতে, ‘শেয়ার বাজারের সবাই ফটকাবাজ’।

প্রিয় আওয়ামিলিগ, আপনারা আসলে দেশ খারাপ চালান না। তবে আপনাদের খাসলত ভালো না। আপনারা কি জানেন বিএনপি-জামাত জোট কিভাবে ক্ষমতায় আসে? না আপনাদের ব্যর্থতায় নয়। আপনাদের খাসলতের কারণে।

আমার বয়স এখন ২২। অর্থাৎ আগামি নির্বাচন হবে আমার অংশ নেয়া প্রথম জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনে নৌকা মার্কায় সিল মারার সময় অনেকের মত আমিও হয়তো অনুভব করব আমি একজন ডাকাত, অথবা আমার উচিত ছিল দূর থেকে সংবাদ সংগ্রহ করা, অথবা উচিত ছিল নিজের চাকরিটা জাতীয়করণের জন্য হেটে প্রধানমন্ত্রীর কাছে না এসে জীবন বাঁচানো।

এ হাসনাত

eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%61%68%61%73%6e%61%74%31%33%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%22%3e%61%68%61%73%6e%61%74%31%33%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))

____________________________________________________
সচলে আমার অন্যান্য লেখাঃ
আমার নজরুল কাহন
মহান শাবি ভ্রমণ
মেডিকেল লাইফ সাক্স
ঢাকা-সিলেট বাস ভ্রমণ এবং আমার স্বজাতি ভাবনা
আমি যামুনা। আমার ইচ্ছা।
মৃত্যু


মন্তব্য

বুনোফুল এর ছবি

চেনা চেনা লাগে তোমারে!! চোখ টিপি ;) ভালো লাগলো!!

_______
বুনোফুল

এ হাসনাত এর ছবি

চেনা চেনা লাগে। ভাই আপ্নে কেটা?

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো। মাঝে মাঝে হতাশ হৈ।

shuchonauk

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

সৌরভ কবীর

অতিথি লেখক এর ছবি

ঐ মহিলার কথা মনে হয় সঠিক। দুই- তৃতীয়াংশ এর বেশি ভোট পেয়ে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখন ভেবেছিলাম যাক এবার হয়ত দেশের কিছু হবে। কারণ বিএনপি-জামায়াত সরকার যেভাবে লুটপাট চালিয়েছিলো, তাতে এদের হাতে আবার ক্ষমতা গেলে বাংলাদেশকে এখন গ্রিস এর মতো হতে হতো। কিন্তু হতাশ,,,,,,,,,,,,,,,,
চিনি না,,,,,,,,,,,,,,,,জানি না,,,,,,,,,,,কোত্তেকে কতগুলো মাখাল/মাখালনী( বলতে বাধ্য হচ্ছি যদি ও আমি আওয়ামী লীগ এর খাশ সাপোরটার ) ধরে আনলো। আর দেশ বিনে পানিতে ঢুবে গেলো। আসলে এরা সবাই সমান। এদের ( বিএনপি/আওয়ামী লীগ) মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দেশের যা পরিস্থিতি এখন তো মনে হচ্ছে
ঐ ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিন এর আমলেই ভালো ছিলাম(!!!)

kamran2535 এর ছবি

এককেরে সত্য বলছেন ভাই। আমরা যে যেই দল করিনা না কেন, ভালো কে ভালো আর খারাপ কে খারাপ না বলি তবে দলীয় পরিচয় টিক থাকলেও মানব পরিচয় ঠিক থাকে না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।