পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ আইভোরি কোস্ট। দেশটির পূর্বে ঘানা, উত্তরে মালি ও বুরকিনা ফাসো, পশ্চিমে গিনি ও লাইবেরিয়া এবং দক্ষিণে আটলান্টিক মহাসাগর। প্রায় দুই কোটির সামান্য বেশী মানুষের এই দেশে ৬০ টিরও বেশী বিভিন্ন গোত্রের মানুষের বসবাস। কালো বর্ণের এসব মানুষের স্থান ও গোত্র ভেদে তাদের সংস্কৃতি ও ভাষা গত পার্থক্য থাকলেও একজন আগন্তুকের জন্য এটা বোঝা মুশকিল। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। প্রায় সবাইকেই একই রকমের মনে হত আর ভাষা ভালো বুঝতাম না তাই এদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করার চেষ্টা এক রকম অরণ্য রোদনই বলা চলে। এত কিছুর পরও এক শ্রেণীর মানুষকে আমার কাছে একটু ব্যতিক্রমই মনে হয়েছিলো বলতে হয়।
চটের তৈরি ঘিয়ে রঙয়ের ঢিলা আলখাল্লার মত কাপড় জড়ানো , মাথায় টুপি , সারা গলায় তাবিজ ঝোলানো , পায়ে বুট আর গলায় গাঁদা বন্দুক ঝুলিয়ে পুরানো একটি মোটর সাইকেলে দুইজন আরোহী কোন একটা মিশনে যাওয়ার জন্য বোধহয় অনেক গতিতে সামনে দিয়ে ছুতে যেতে দেখলাম। কিছুক্ষণ পরপর এরকম মোটর বাইকে করে এই পোশাকেই আরও কয়েকজনকে চোখে পড়লো। স্থানীয় একটি ছেলেকে এদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলাম । প্রত্যুত্তরে সে বলল এদের নাম দোজো (DONZO )।
দোজো নামটি এর আগে কখনও শুনিনি ওই প্রথম। তাই একটু কৌতূহল জাগল এদের সম্পর্কে জানার। তারপর বেরিয়ে এলো এদের নিয়ে নানাবিধ তথ্য। আমার সাথে একজন স্থানীয় দোভাষী ছিল। সেই আমাকে সাহায্য করলো এদের সম্পর্কে অজানা অনেক কিছু জানবার।
দোজোদের বলা হয় ট্র্যাডিশনাল হান্টার বা শিকারি। বনে বাদাড়ে শিকার করে বেড়ানোই এদের প্রধান কাজ।
শিকারের জন্য বর্শা, তীর , বিভিন্ন ধরনের ছুরি এরা ব্যবহার করে। বড় বড় সাপ, আগুতি( ইঁদুরের মত দেখতে যা অনেক সুস্বাদু খাবার এদের কাছে), বন্য অনেক প্রাণীদেরকে শিকার করা এদের প্রধান পেশা। বংশ পরম্পরায় শিকার করে চলেছে। এদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এরা খুবি বিশ্বাসী সাধারণ মানুষের কাছে । ঐতিহ্যগতভাবেই সাধারণ মানুষদের কাছে এরা খুব জনপ্রিয়। দেশের উত্তরাঞ্চলেই এদেরকে বেশী দেখা যায়। উত্তরে মালি বর্ডারের দিকে যতই গিয়েছি এদের সংখ্যা ততই বাড়তে থাকে। পথে যখনি দেখা হয়েছে ওই একই পোশাক একই বেশ ভূষা।
দেশটির আবহাওয়া ভালোই। তবে রোদের নিচে দাঁড়ানো যায়না, মনে হয় এখনই সারা গা হাত পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। অথচ অবাক কাণ্ড হল দোজোরা এই রোদের মধ্যেও ওই একই বস্তার মত মোটা আলখাল্লা গায়ে দিয়ে ছুটে চলেছে শিকারের উদ্দেশ্যে।
গাড়িতে চড়তে চড়তে দোভাষী আপু( ডাক নাম) বলল এদের এক রহস্যময় ক্ষমতার কথা। দোজোদের একটা রহস্যময় ক্ষমতা আছে বলে মানুষের ধারণা। এক ধরনের ঘিয়ে রঙয়ের বিশেষ পোশাক , মাদুলি আর হ্যাট আছে যেটা পরলে তারা এই বিশেষ ক্ষমতা পায় বলে মানুষের বিশ্বাস। দোজোরা মনে করে এই পোশাক পরলে সকল প্রকার অপশক্তি থেকে মুক্ত থাকা যায় অর্জন করা যায় এক অশরীরী ক্ষমতা।
সাধারণ মানুষদের মধ্যে অর্থাৎ আমার সাথের ওই দোভাষীও বলে যে এই পোশাক পরে থাকলে নাকি কোন কিছুই তাকে ভেদ করতে পারবে না এমনকি গুলি করলেও। এই পোশাক পড়লে অন্ধকারেও তারা দেখতে পায় বলে দোজোরা দাবী করে। আমি জানিনা আসলে সেটা আদৌ সত্যি কিনা তবে আইভোরিয়ান্দের এটা এক বিশ্বাস। সমাজের বিভিন্ন গোত্রের মানুষ তাদেরকে ধর্মগুরু হিসেবেও মনে করে। তাদের এই ক্ষমতাকে তারা অলৌকিক একটা শক্তি হিসেবে ধরে নিয়েছে। তাই তাদের প্রতি ভক্তি আর শ্রদ্ধাটাও সাধারণ মানুষের অনেক বেশি।
দোজোরা সাধারণত বনের ক্ষতিকারক বন্য প্রাণীদেরকে শিকার করে। সেই হিসেবে তাদের একটা জনপ্রিয়তাও আছে। সমাজের মানুষ বিশ্বাস করে যে একমাত্র দোজোরাই দূর করতে পারে সকল পঙ্কিলতা ও অশুভ শক্তি।
এত কিছুর পরও দোজোদের আছে এক সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৯০ সালের গোঁড়ার দিকে যখন সন্ত্রাস ,দুর্নীতি ক্রমেই বেড়ে যায় তখন প্রেসিডেন্ট বাওনি দেশের এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে দোজোদেরকে জেনডামারির (পুলিশের পাশাপাশি একটি সরকারি বাহিনী) সাথে একযোগে কাজ করার জন্য অনেক দোজোকে রিক্রুট করে।সাধারণ মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও সততার কারণেই তখন এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রহস্যময় ওই পোশাকি ক্ষমতার কারনে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ভক্তিও বেশি বলে মনে হয় ।
পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট বাগবোর সময় তারা আইভোরিয়ান জাতীয়তার ইস্যুতে (যারা জন্মগত ভাবে আইভোরিয়ান না তাদের সাথে) বিবাদে জড়িয়ে পড়ে । এর ফলে বাগবো তাদের উপর মনঃক্ষুণ্ণ হয়। ফলে তারা উত্তরাঞ্চলে বাগবো বিরোধীদের সাথে যুক্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ২০০২ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত গৃহ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারা উত্তরাঞ্চলে বিদ্রোহীদের সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। এরপর বাগবোকে আটক করা হয়। ক্ষমতায় আসে আলাসান ওতারা। ওতারা মুলত উত্তরাঞ্চলের এবং ডেঙ্গুইন রিজিওনের। উত্তরাঞ্চলের এই রিজিওনে মূলত দোজো অধ্যুষিত। বর্তমানে তারা বিভিন্ন জায়গায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি পোস্ট স্থাপন করে দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আছে।
দোজোদের একটি বৃহৎ সম্প্রদায় আছে। এদের একটি সংগঠনও আছে যেখানে পশ্চিম আফ্রিকার মালি ,বুরকিনা ফাসোর দোজোরাও অন্তর্ভুক্ত। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে দোজোদের সম্মেলন হয় আইভোরি কোস্টের সর্ব উত্তরের শহর ওদিয়ানেতে। মালি, বুরকিনা ফাসোর দোজোরাও এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে আসে। কয়েক হাজার দোজো তখন একত্রিত হয় । এই সম্মেলনে নির্ধারিত হয় তাদের বিভিন্ন কর্মসূচী আর প্রদান করা হয় দিক নির্দেশনা।
উপরের ছবি দোজো সম্মেলনের
এই বছরের এই সম্মেলনে যাবার সুযোগ হয়েছিলো। কথা তাদের কিছুই বুঝিনি তবে উপভোগ করেছি সারা রাত ধরে চলা নাচ আর বাদ্যযন্ত্রে পরিবেষ্টিত বাহারি গান। বাহারি রকমের দেশীয় খাবার আর নৃত্তের মুছনায় মুখর হয়ে থাকে তাদের এই বাৎসরিক আনুষ্ঠানিকতা।
দোজোদের এই জীবনযাত্রা বড়ই বিচিত্র। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য মনে হয়েছে দেশটির উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা দেখে। এই অঞ্চলের মানুষেরা যেন অগাধ শ্রদ্ধায় তাদের প্রতি অবনত।আধুনিক সমাজেও দোজোদের প্রতি মানুষের এই বিশ্বাস আর তাদের জীবনযাত্রা সত্যি এক বিস্ময়।
অমি_বন্যা
নোট ঃছবি সংবলিত পোস্ট এটিই আমার প্রথম তাই কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। তাই পরামর্শ আশা করছি। যদি প্রকাশিত হয়।
মন্তব্য
নতুন জিনিস জানলাম!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
জানার নাই শেষ ।
হুমম ইন্টারেস্টিং। রাতঃস্মরণীয় ভাই কই?
রাতঃস্মরণীয় ভাই বর্তমানে স্মরণ হওয়ার মতো অবস্থায় নেই। ঢাকা-যশোর-সাতক্ষীরা-ব্যাংকক দৌড়ের উপর আছে। ওলি ফেসবুকে বার্তা না দিলে হয়তো ঢোকা হতো না। যাহোক, আপনি ভালো তো?
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
উরিব্বাস। যাহোক ভালো থাইকেন, আমি দিব্যি।
চমৎকার লেখা।নতুন জানলাম এই তথ্য।লেখা চালিয়ে যান।
নতুন কিছু জানাতে পেরে ভালো লাগলো।
লেখা চালিয়ে যাচ্ছি।
সুন্দর লেখা।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
ধন্যবাদ
এই লাইনটা একটু পরিস্কার করবেন? বনের জন্য ক্ষতিকর কিন্তু বন্য প্রাণী আসলে কোনটি?
দোজোরা শিকারি। অন্যান্য প্রাণী শিকারের পাশাপাশি যেসব প্রাণীরা মানুষের জন্য ক্ষতিকর তাদেরকেও শিকার করে। আর এজন্য তাদের একটা জনপ্রিয়তা রয়েছে।
লাইনটা মনে হয় এমন হলে ভালো হত
দোজোরা সাধারণত অন্যান্য প্রাণী শিকারের পাশাপাশি মানুষের জন্য ক্ষতিকর এমন অনেক প্রাণীকেই শিকার করে।
হুম , এমন কোন প্রাণী নেই ।
পোস্ট ভাল লাগল, আরো লিখুন, পারলে নিজের তোলা ছবিও দিয়েন।
facebook
ধন্যবাদ অনু ভাই। এর পরে নিজের তোলা ছবি দেব।
হ্যাঁ, সত্যিই ভাল লাগলো।
ধন্যবাদ আপনাকে।
হতেম যদি আইভোরিয়ান দোজো!
লেখা ভালো লেগেছে।
___________________
সৌরভ কবীর
দোজো হবেন ভালো কিন্তু কষ্ট আছে কিন্তু।
দারুন, খুবই ইন্টারেস্টিং। এরকম পোস্ট আরো চাই
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
আরও পোস্ট পাবেন আশাকরি।
পড়ে ভালো লাগলো ।
লেখা আর ছবি দুটোই ভালো লাগছে।
কিন্তু এর পর থেকে নিজের তোলা ছবি দেয়ার চেষ্টা করবেন।
নতুন মন্তব্য করুন