সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন নিয়ে ব্লগ-ফেসবুকে অনেক লেখালেখি, সমালোচনা-প্রতিসমালোচনা হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে বাঙালীদের আত্নপরিচয় ও আত্নসম্মানবোধের অভাব, মিডিয়া ব্যবসায়ী এবং ভারতীয় সরকারের ষড়যন্ত্র, সরকারী অবহেলা ইত্যাদিকে দায়ী করছেন লেখকরা। কিন্তু প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে একটি ব্যাপারকে এড়িয়ে যাচ্ছেন সবাই। সেটা হলো বাংলায় উপভোগ্য মাধ্যমের অভাব, বিশেষ করে শিশুদের জন্য।
প্রথমে চলমান কার্টুনের কথায় আসি। 'ডোরেমন' নামের হিন্দি অনুবাদ করা এক জাপানী কার্টুন আমাদের শিশুদের এতই সম্মোহিত করে ফেলেছে যে তাদের মধ্যে অনেকে বাংলার চেয়ে হিন্দিতে কথা বলতে এখন অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। টিভিতো বটেই, খেলনার দোকানগুলোতে পর্যন্ত ডোরেমনের আধিপত্য একচ্ছত্র। এমন ভয়ানক আগ্রাসন দেখে অনেকেই ডোরেমন এর নিরিহ, গোবেচারা চেহারাটিকে সংস্কৃতি-যোদ্ধার চতুর ছদ্মবেশ হিসেবে দেখিয়ে হিন্দি টেলিভিশন চ্যানেল নিষিদ্ধ করার মতো কঠোর পদক্ষেপের পক্ষে মতামত দিচ্ছেন। আচ্ছা, নিষিদ্ধ না হয় করা গেলো - এবার এমন একটি আকর্ষণীয় বাংলা কার্টুন এর নাম বলুনতো যা ডোরেমন এর দর্শকশ্রেণীকে আকৃষ্ট করবে? পাচ্ছেন না? আরেকটু সহজ করে দেই - আকর্ষণীয় হওয়ারও দরকার নেই, চলতি যেকোন একটি বাংলা কার্টুন ধারাবাহিক এর নাম বলুন। প্রয়োজনে আপনার বাড়ির কচি-কাঁচাদের সাহায্য নিতে পারেন।
সবার পরিচিত জনসচেতনতামূলক 'মিনা'কে বাদ দিলে, খুব সম্ভবত আপনি কোন বাংলা ধারাবাহিক কার্টুন এর নাম বের করতে পারেননি। বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশী শিল্পীদের নিজেদের তৈরি কার্টুন হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি (মানসম্মত কিছু বলতে গেলে 'মন্টু মিয়ার অভিযান' ছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না আপাতত)। 'মিনা' বেশ উপভোগ্য হলেও মাত্র কয়েকটি পর্বে সীমাবদ্ধ; তাছাড়া এটি পুরোপুরি বাংলাদেশীও নয়। অন্যদিকে 'মিনা'র অতিরিক্ত জনপ্রিয়তা এবং পুনঃপুনঃপ্রচার মানসম্মত বাংলা কার্টুনের সংকটকেই প্রচ্ছন্নভাবে প্রকাশ করে। 'মন্টু মিয়ার অভিযান' নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় - বাঙালী স্ফূলিঙ্গকে আগুনে রূপ দিতে জানে না। নয়তো বাংলাদেশে এতো দিনে শতকোটি টাকার দেশীয় ত্রিমাত্রিক কার্টুনের শিল্প দাঁড়িয়ে যেতো।
নিজেদের নেই মানলাম, কিন্তু ভারতীয় রীতিতে ডোরেমন এর মতো কার্টুনগুলোকে বাংলা অনুবাদ করে অন্তত কাজ চালানো যেতো। আর যদি ওটুকুও না পারি তো বিদেশী কার্টুনগুলোকেই ইংরেজীতে চালাতে পারতাম(ইংরেজীতে দক্ষ হওয়ার অন্তত কিছু সুবিধা আছে)। কোথায় কি! দেশী টিভি চ্যানেলগুলো আঁতি-পাতি করে খুঁজে দেখুনতো কোথাও একটু কার্টুন পান কিনা! খুব সম্ভবত বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল পরিচালকদের ধারণা - বাংলাদেশের আর সবার মতো শিশু-কিশোর-কিশোরীদেরও অতিপ্রয়োজনীয় মানসিক খাদ্য (দুঃ)সংবাদ এবং বিজ্ঞাপন। একটা সময় ছিলো যখন বিটিভির অনুষ্ঠানসূচীতে সন্ধ্যার আগে আগে কার্টুন সম্প্রচার হতো প্রায় প্রতিদিন। বিটিভি দেখিনা প্রায় ছয় বছর হতে চললো, কিন্তু শেষ যখন দেখতে বসেছিলাম তখন ধর্মবাজদের কারণে বিদেশী সব ধারাবাহিক ও চলৎচিত্রের সাথে সাথে বিদেশী কার্টুনেরও দফারফা।
এবার আসি কমিক বই নিয়ে। এখানে হিন্দি আগ্রাসন নেই। কেনো জানেন? কারণ পড়তে শেখাটা দেখে-শুনে বলতে শেখার মতো না, আরেকটু কঠিন। আমি নিশ্চিত বাংলা আর হিন্দি হরফে যদি আরেকটু বেশি মিল থাকতো তবে বাংলাদেশী শিশুরা এতো দিনে হিন্দি লিখতেও শিখে যেতো। বাংলাদেশে জনপ্রিয় কমিকগুলোর মধ্যে - 'চাচা চৌধুরী', 'বিল্লু', 'পিংকি' ইত্যাদি সবই ভারতীয় কার্টুনিস্ট প্রাণের আঁকা ; 'টিনটিন', 'এস্টেরিক্স' আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় কার্টুন কিন্তু বাংলা অনুবাদ বের করে কলকাতার আনন্দ পাব্লিশার্স; 'নন্টে ফন্টে', 'হাদা ভোদা', 'বাটুল দ্যা গ্রেট', 'ফেলুদা', 'প্রোফেসর শংকু' সবই ওপার বাংলার কার্টুনিস্টদের । 'উন্মাদ' এর আহসান হাবিব এর দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন প্রয়াস(যেমন 'বিল্টু মামা', 'টোকাই') আর শাহরিয়ার এর 'বেসিক আলী' ছাড়া বাংলাদেশীদের গর্ব করার মতো কিছু নেই বললেই চলে (নাকি আছে? হয়তো আমি জানি না ...)। মোটমাট বাংলাদেশে কমিক এর বাজার ভারতীয় শিল্পীদের কব্জায়। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরা সবসময় হিন্দি আগ্রাসনের মধ্যে থেকেও যে পরিমাণ অর্জন করেছেন, তার কানাটুকু অর্জনও আমাদের শিল্পীদের নেই(কমিক বই এ অন্তত)।
এভাবে প্রায় প্রত্যেকটা মাধ্যমেই দেখা যায় বাংলাদেশী শিল্পীদের অনিহা-অবহেলা এবং কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমুখী প্রবণতা - চলৎচিত্র ('আর্ট ফিল্ম' এবং 'অতিস্হূল বিনোদন' এর মাঝখানে কিছু নেই), টিভি নাটক('এক পর্বের প্যাকেজ' এবং 'গিগা-সিরিয়াল' এর মাঝখানে আছে শুধু বিজ্ঞাপন!), উপন্যাস(হুমায়ুন আহমেদের 'রূপকথা' এবং সমসাময়িক অন্যান্যদের 'কঠিন পরাবাস্তবতা' মাঝখানে বিশাল ফারাক) ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার আছেন অতীতবাদী - বাঙালীদের যা কিছু উপভোগ্য তার সবটুকু রবীন্দ্রনাথ-নজরুলেরা দিয়ে গেছেন, তাই আমাদের নতুন করে কিছু করার নেই! শুধুমাত্র সংগীত ছাড়া অন্যকোন মাধ্যমে বাংলাদেশী শিল্পীরা সবশ্রেণীর ভোক্তাকে তৃপ্ত করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয় না।
সমালোচনা অনেক হলো, কিন্তু এর সমাধান কি? সমাধান খুবই সহজ। আপনি যদি আঁকতে জানেন তবে আঁকুন; শুধু বিমূর্ত ছবি আঁকলেই চলবে না, মাঝে মাঝে মূর্ত কিছুও আঁকুন (ফ্রেন্ক মিলার আর এলান মুর-রা কমিক বই এঁকে-লিখে বিখ্যাত হয়েছেন)। আপনি যদি লিখতে জানেন তো লিখতে থাকুন, থামবেন না; সামাজিক উপন্যাসের পাশাপাশি এ্যাডভেঞ্চার-কল্পকথা লিখুন যা দিয়ে হয়তো ভবিষ্যতের 'ব্লকবাস্টার' বাংলা চলৎচিত্র তৈরি হবে। যদি কম্পিউটার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির অভ্যাস থাকে তবে ছবি দেখা আর গেম খেলার পাশাপাশি দুয়েকটা এনিমেশন সফ্টওয়্যার শিখার চেষ্টা করুন; প্রোগ্রামিং পারলে গেম বানানোর চেষ্টা করুন। যদি বিদেশী ভাষা পারেন, তবে বিদেশী কোন ভালো বই বাংলায় অনুবাদের চেষ্টা করুন। যদি নাটক-সিনেমার নির্মাতা হয়ে থাকেন তবে অন্যদের অনুসরণ না করে এমনকিছু করুন যাতে অন্যরা আপনাকে অনুসরণ করেন। যদি আমার মতো কিছুই না পারেন, তাহলে অন্তত অন্যদের উৎসাহ দিন কিছু সৃষ্টি করতে।
হিন্দি সংস্কৃতির স্রোত বাঁধ দিয়ে ঠেকানো যাবে না। তাই স্রোতেই ভাসুন, তবে বাংলা সংস্কৃতির।
[সম্পূর্ণ নিজের মনগড়া উপলদ্ধি, কোন রকম গবেষণা ছাড়া। তথ্যে প্রচুর পরিমাণে ভুল থাকার সম্ভাবনা প্রচুর। ]
- রসুন
মন্তব্য
সহমত!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
হ দ্য ইয়েস!
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
খুব ভালো লাগলো চিন্তা। স্যাটেলাইট চ্যানেলের মধ্যে একমাত্র চ্যানেল নাইনে দেখলাম কার্টুন দেখায়, তাও সেই ছোটবেলায় আমরা বিটিভিতে যেগুলো দেখেছিলাম সেগুলোই। নতুন কার্টুন বা বাচ্চাদের উপযোগী অনুষ্ঠান কেন এখন আর আনা হচ্ছে না বুঝি না।
আমি মাঝে মাঝেই ক্ষোভ প্রকাশ করি যে কেন আমাদের টিভি চ্যানেল গুলো ভারতে প্রচার করেনা, কিন্তু এই কথাও সত্য যে চ্যানেলগুলোতে বিনোদনের তেমন কিছু নাই, তারা দেখায় শুধু খবর, তাও সব চ্যানেলে একই খবর, এক ঘন্টা পরপর। তারপর আছে কিছু টক শো, সেখানেও একই লোক। আমরা নিজেরাই যা দেখিনা, ওদের কি দেখাব?
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
আমরা শুরু করেছি। আপাতত বাচ্চাদের জন্য কিছু বই নিয়ে। আমাদের প্রকাশনার নাম "হট্টিটি"। আর্থিক দিক েথকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র মাপের উদ্যোক্তা হলেও স্বপ্ন আর ইচ্ছের দিক থেকে নই। সচলায়তনের পাঠকদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ রইল আমাদের বইগুলো দেখার, কেনার এবং সমালোচনা আর পরামর্শ দেয়ার। িনজের সন্তানদের জন্য "দেশী" রুচিশীল বই িনজের রুচী অনুযায়ী পাইনি বলেই এই উদ্যোগ নেয়া। সাথে যাদুকরী এক আঁকিয়ে বন্ধু যোগ দেয়ায় যা হলো তা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই - বানিজ্যক িবজ্ঞাপন হিসেবে না। আরো জানতে পারবেন এই লিংক থেকে: www.facebook.com/hottiti.books
অনলাইনে কিনতে হলে (ঘরে বসেই পাবেন): www.rokomari.com/publisher/477
বইগুলো খুব শীঘ্রই অ্যানিমেটেড, ইন্টারেক্টিভ এ্যাপ আকারেও পাবেন। ই-বুক আকারেও।
রকমারিতে আপনাদের বইয়ের প্রচ্ছদ দেখতে পেলাম শুধু, বেশ ভাল লাগলো। কোথাও কোন গ্রন্থালোচনা প্রকাশিত হয়ে থাকলে দয়া করে লিঙ্কটা দেবেন।
___________________
সৌরভ কবীর
দারুন উদ্যোগ! চালিয়ে যান!
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
কড়িকাঠুরে
আপনাদের এই প্রয়াসকে মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধা জানাই।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
বেশ ভাল লাগল, দেশের বাহির থেকেও কি কেনা যাবে?
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
হ
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
সহমত।
__________________
সৌরভ কবীর
আপনার দেখানো পথেই আমাদের মুক্তি। যারা কাজ করার যোগ্য, দয়া করে শুরু করুন।
মনের রাজা টারজান,
সহমত
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
সহমত
কড়িকাঠুরে
উত্তম বলেছেন।
যে সকল লেখক বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনের কারণ হিসেবে বাঙালীদের আত্নপরিচয় ও আত্নসম্মানবোধের অভাবকে চিহ্নিত করেন তাঁদের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের 'গোরা' উপন্যাসের গোরার মতো বজ্রগর্জনে বলতে ইচ্ছে করে, “ধিক্ তোমাদের! লজ্জা নাই!”
বলতে ইচ্ছে করে,
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
বিদেশী স্রোতের কাছে আত্মসমর্পনের সুখ দেশীয় সংস্কৃতিতে পাবে কি করে? চরম জাতীয়তাবাদী মানুষকেও দেখেছি উৎসব পার্বনে পোষাক আশাক কেনার সময় হিন্দি সিরিয়ালের নাম নেয়। এরা হলো অভিভাবক শ্রেনী। এরা নিজেরা স্রোতে ভেসে গেছে, এরপর ভাসাচ্ছে পরের জেনারেশানকেও।
যারা দেশীয় সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। তাদের কাজ বেড়ে গেল। তারা সংস্কৃতি মানার সাথে সাথে, চোপা খানাও ব্যবহার করতে পারেন ওইসব মগজধোলাইকৃত মানুষের কানের উপর। কিছু যদি কাজ হয় তাতে। টিভি চ্যানেলগুলো একটু সচেতন হতে পারে। বিদেশী সংস্কৃতির ভুত ওখানেও। ওঝা দিয়ে ওগুলো ঝেটাতে হবে সবার আগে। তারপর জাতি যদি শুদ্ধতার পথে যায়।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
অনেক ভালো লাগলো আপনার লেখাটা।
মিনা বাংলাদেশী কার্টুন না, এটা দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশগুলোর জন্য ইউনিসেফের তৈরী কমন কার্টুন।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
পুরা খাঁটি কথা।
আচ্ছা, যাঁরা এই ব্লগে "গোয়ান্দা ঝাকানাকা"র মত চমৎকার কমিক্স বের করার জন্য মেহনত করতেছেন, তাঁরা কিন্তু ইচ্ছা করলেই বাচ্চাদের জন্য একটা কমিক্স সিরিজ শুরু করতে পারেন (যেহেতু আমার এই লাইনে কন্ট্রিবিউট করার মত কোনই যোগ্যতা নাই, তাই জাস্ট একটা আইডিয়া দিলাম আরকি)
আমি একজন কার্টুন নির্মাতা। শিশু-কিশোরদের জন্য কার্টুন বানানো শুরু করি আজ থেকে প্রায় দু দশক আগে। আমাদের নির্মিত প্রথম কার্টুন ‘রোবটদের গ্রহে একদিন’ প্রদর্শিত হয় ১৯৯৫ সালে বিটিভিতে, প্রচারিত হয় ঈদের দিন। তখন বিটিভি অনুষ্ঠান কিনে নিজেরা স্পন্সর যোগাড় করে প্রচার করত, পরবর্তীতে অনুষ্ঠান নির্মাতাদের ঘাড়ে এ দায়িত্ব বর্তায়, যা সম্ভবত এখনও চলছে। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ অবধি তৈরি হয় আরও দুটি পূর্ণ দৈর্ঘ্য কার্টুন ‘চিংড়ির ইচ্ছে’ ও ‘পিঁপড়ে যখন একলা হয়’।
কিন্তু বিটিভি পরের দুটো কার্টুন প্রদর্শনে অনিহা প্রকাশ করে এবং উপযুক্ত স্পন্সরের অভাবে আমরাও একসময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।
দুঃখের বিষয় আজবধি এই দুটো কার্টুন কোনও টিভি চ্যানেল প্রদর্শনে রাজি হয়নি।
কেন এই অনিহা?
আমাদের দেশে শিশুর অভাব না শিশুতোষ পণ্যর অভাব নাকি নির্মাতার অভাব? বিষয়টি খাতিয়ে দেখা দরকার।
প্রথমত দেশে শিশুর অভাব নেই(হাঃ হাঃ) শিশু কিশোর পণ্যর অভাব থাকা স্বাভাবিক, আমরা গরিব দেশ- শিশু কিশোর পণ্যের ‘কনঞ্জুমার’ বা এই বিশেষ ভোক্তা শ্রেণীর পণ্য ধনী দেশের চাইতে অস্বাভাবিক রকম কম।
কিন্তু পণ্য কি একদম নেই- আছে।
কিন্তু পণ্য উৎপাদনকারিরা তাদের পণ্য বিপননের সময় শিশু কিশোরদের ভোক্তা হিসেবে দেখেন না, দেখেন তাদের বাবা মা অভিবাবকদের, কারন শিশু কিশোরদের ক্রয় ক্ষমতা নেই তাদের অভিবাবকদের আছে।
আর এদেশের অবিভাবকরা তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার মতো ‘পণ্য বাছাই’ স্বাধীনতা নিজেদের দখলে রাখেন, শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেন। এবং হাস্যকর ভাবে আমরা বড়দের নাটকে ‘শিশুপণ্যর’ বিজ্ঞাপন দেখি।
কিন্তু আমরা ভুলে যাই প্রত্যেক মানুষের আলাদা চেতনা আছে স্বাধীনতা আছে, শিশুরাও এর বাতিক্রম নয়, চাহিদা অনুযায়ী অভাবের জন্য তাই ওরা বেছে নিয়েছে হিন্দি ডাবিং ‘ডোরেমন’।
এখন অনুষ্ঠান নির্মাতাদের দিকে তাকানো যাক। বাংলাদেশে এটারও কোন অভাব নেই। হয়তবা মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, সেটা অনেক পরের বিষয়।
অনুষ্ঠান নির্মাণ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা আগে একটু বলেছি বাকিটা বলছি এখন-
১৯৯৯ বা ২০০০ সালে একুশে টিভির জয়যাত্রা শুরু হয়, তখন একুশের সাথে আমরা কার্টুন বানানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হই (চুক্তি হবার আগে আমাদের রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছে, সাইমন ড্রিং প্রত্যেক মিটিংয়ে আমাদের কাছে ক্ষমা চাইতেন), স্পন্সর খোজার ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা একদল তরুন তৈরি করি ‘মন্টু মিয়ার অভিযান’ সব মিলেয়ে তৈরি হয় ১৩ টি আলাদা অভিযান।
এখন দেখা যাক মোট কয়টি অভিযান প্রচারিত হয়েছে। মাত্র – দুটো,
একটি ঈদের দিনে অন্যটি পহেলা বৈশাখে, বাকি এগারোটি অনুষ্ঠান গেলো কই?
একুশে টিভির ভল্টে।
অন্ধকার ভল্টে থেকে পচে যাচ্ছে এই উপমহাদেশের তৈরি তথা বাংলা ভাষায় তৈরি, প্রথম কার্টুন সিরিয়াল।
আমি মেনে নিয়েছি- বঙ্গদেশে এই স্বাভাবিক। প্রচারিত মাত্র ‘দুটো’ অনুষ্ঠান চোরাই সিডি ডিভিডি হিসেবে বছরের পর বছর বাজারে চলবে, আর ভল্টে থাকবে বাকি এগারো ‘মন্টু মিয়ার অভিযান’ এটাই স্বাভাবিক।
নাকি অস্বাভাবিক ! মাত্র দশ থেকে পনেরো লক্ষ টাকা স্পন্সর পেলেই একুশে টিভি আনন্দে প্রচার করবে বাকি এগারো ‘মন্টু মিয়ার অভিযান’।
শুধু মাত্র পনেরো লক্ষ টাকা ‘মন্টু মিয়ার’ মুক্তি আনবে না, সেই সাথে খুলে যাবে একটি দরজা- কারন আমি জানি দরজার ওপারে অপেক্ষায় আছে অনেক কার্টুন নির্মাতা, ওরা বাংলাদেশী, ওদের কার্টুন বাংলায় কথা বলে।
এপারে কেউ আছেন কি? কোন স্পন্সর? টিভি চ্যানেলের হর্তাকর্তা ?
কেউ কি শুনছেন ড্রামের আওয়াজ।
অনর্থক আলাপে সবার আগ্রহ। উঠুন- দাঁড়ান- বদলে দিন।
লেখাটা ভালৈছে।
প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালেখি চলুক।
আমাদের আর একটা সমস্যা হচ্ছে একটা কাজ ভালো হলেও কিছুদিন মাতামাতির পর সেটা বিস্মৃতির গর্ভে চলে যায়।
মনে করুন 'টু কিল এ মকিং বার্ড' বইটা। ঐ মহিলা একটাই ফাটাফাটি কিশোর ফিকশন লিখেছিলেন। ওনার বাকি লেখালিখি/কাজকর্মের সাথে এর কোন মিল নেই। কিন্তু ভালো বইটা হারিয়ে যায় নি। এরকম একটা একটা রত্ন নিয়েই তো দিনে দিনে ঝলমলে রত্নাগার হয়। আমাদের বেশিরভাগ লেখা/কাজই, যদি 'বিখ্যাত' ব্যাক্তির রচনা না হয়, তাহলে লোকচক্ষু ও স্মৃতির আড়ালে চলে যায়। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কোন নামনিশানাও থাকে না। ফলে, সংস্কৃতি সমৃদ্ধটা হবে কোত্থেকে?
নতুন মন্তব্য করুন