এখনও দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি । ঘুম থেকে বিকাল ৪’টার সময় উঠলে সন্ধ্যা ৭’টায় দ্বিতীয়বার উদরপূর্তি না হওয়াটা অস্বাভাবিক না । অবশ্য যখন লিখতে বসলাম পাকস্থলী বাবাজি কে শান্ত করেই বসলাম । বৃষ্টি আসব আসব করে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে । এখন সন্ধ্যা হলেও আমি ফিরে গেছি দুপুরবেলায়, আজ থেকে বার-তের বছর আগে ।
ক্লাস শেষ । হুড়োহুড়ি করে বের হয়েই বাড়ির দিকে ছুট । বৃষ্টি হলে, পলিথিনের ভেতর বইগুলো ভরে তা আবার শার্টের ভেতর সযত্নে লুকিয়ে ফেলতাম বৃষ্টির কাছ থেকে । তারপর ভিজে ভিজে, একটু বাঁকা হয়ে ঝুঁকে বৃষ্টি সামলে বাড়ির পথ মাপা । বাড়ি পৌঁছাতে বেশিক্ষণ লাগত না । সযত্নে বুকে রাখা বইগুলো বের করতাম- আম্মু বলত ভেজা কাপড় খুলে দিতে । যথারীতি তাই করে পরের কাজে লেগে যাওয়া । আর সেই কাজের কথাই ভাবছিলাম সন্ধ্যা বেলায় এই ইট-কাঠের শহরে বসে ।
বৃষ্টি থেমে গেছে । জালি(এক রকমের মাছ ধরার জাল, তিনকোণা বাঁশের কাঠামোতে আটকানো থাকে), খালই(মাছ রাখার জন্য বাঁশের তৈরি পাত্র) আর ভাঙ্গা বাটি নিয়ে ছুটতাম পুকুরের পাশের ছোট্ট গর্তে । হাত দিয়ে কাদা তুলে প্রথমে বাঁধ দেয়া গর্তের চারপাশে যেন বাইরের পানি ভেতরে না যেতে পারে । এরপর বাঁধের বাইরে জালি জাল খুঁটির সাহায্যে ঠেস দিয়ে দাড় করানো । প্রাথমিক কাজ শেষ । এখন গর্তের পানি সেঁচে বাইরে ফেলা আর এর জন্য ভাঙ্গা বাটি । পানি ছুড়ে দিতাম ঠেস দিয়ে রাখা জালিতে যাতে কোন মাছই ছুটে যেতে না পারে ।
পানি সেচতে গিয়ে একটু পরপর পিছনে তাকাতাম । আর কতটুকু পানি আছে? মাছ ধরা যাবে এখন? আবার গর্তের একপাশ যেহেতু পুকুরের সাথে সংযুক্ত তাই তাড়াও থাকত, কখন আবার পুকুরের পানি এসে গর্ত ভাসিয়ে নেয় । তাই দ্রুত- কখনো চোখ বন্ধ করে- দাঁত খটমট করে জোড়া লাগিয়ে একটানা পানি সিঁচে চলা । এইতো আর একটু, ঐ তো একটা ছোট পুঁটি মাছ দৌড় লাগালো, তাড়াহুড়ো লেগে গেছে ওদের মাঝেও । দাড়াও বাবারা আর একটু সবুর কর, আমি আসছি । এইতো শেষ, কাদা দেখা যাচ্ছে- খালই টা কোমরে বেঁধে এখন মাছ ধরা শুরু । প্রথমে একটু একটু পানি আছে যেখানে, সেখান থেকে আঁজলা দিয়ে দাড়কিনা মাছ ধরা- সাথে ছোট পুঁটি । এখনি কাদা ওলটপালট করলে ওদের আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা- এগুলোই সবচেয়ে প্রিয় আমার । এরপর কাদায় পা দিয়ে ওলটপালট । ঐ তো বাইম- একবার ধরি তো ফসকে বেরিয়ে যায়, আবার ধরি- আঙ্গুল ফসকে বেরিয়ে যায় এরপর বাটি দিয়ে ধরে খালইয়ে চালান । বাইমের চেয়ে ছোট গুতুম । ও ব্যাটাও পিছলা- ফসকে যেতে চায় । এরপর কাদার ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা টাকি । যদিও তখন খেতাম না তারপরও ধরতে তো ভালই লাগতো । সাথে যদি দু-একটা মাগুর হত- আর আমাকে পায় কে । জালিটা কাঁধে নিয়ে, বাটি হাতে, কোমরে খালই- যেন এক যোদ্ধা, গায়ে কাদামাটির আঁশটে গন্ধ । এক দৌড়ে বাড়িতে ।
কাদায় মাখামাখি হয়ে রান্নাঘরে হাজির । আম্মুর আবার একটু বকা- “গোছল করে আসো যাও, ঠাণ্ডা লাগলে আমি জানি না" । হয়তো একমুঠো মাছ- তাতে কী- আমার চলবে ওতে- ওসব বকা-টকা আমি হজম করতে পারি ।
গোছল শেষে খেতে বসে ঐ মাছ টুকুই যখন পাতে পাই, তেমন কিছু না- একটু তেল- একটু মরিচ- একটু পেঁয়াজ- একটু লবণও তো লাগে, এইতো । এর চেয়ে সুখাদ্য কোথায় পাই । নস্টালজিক করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট এটুকুই । দুঃখ না- মায়ায় ভরে ওঠে চোখ, আহা!
মায়া নিয়েই শেষ করি । বুঝতে পারছি বাড়ি যেতে হবে শীঘ্রই । বৃষ্টিও হচ্ছে । একবেলা সেই ছোট পুঁটি আর দাড়কিনা’র চচ্চড়ি- না হলেই নয় ।
--------------------------------------------------------------------
কড়িকাঠুরে
০৫.০৬.২০১২
মন্তব্য
কড়িকাঠুরে
যাহ, রান্নাবান্না ট্যাগ দেখে ঢুকলুম, ভাবলাম না জানি কী রেসিপি দেবেন!
ঐ যে- পেঁয়াজ-মরিচ-তেল-নুন দিয়ে দাড়কিনা মাছ, সাথে ছোট্ট পুঁটি- খারাপ দিলাম নাকি...
কড়িকাঠুরে
ভাল লাগল স্মৃতিচারণ।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
কড়িকাঠুরে
- নেন খান-
কড়িকাঠুরে
কি যে লিখলেন, আর কতকিছুই যে মনে করিয়ে দিলেন.........
ভালো লাগছে খুব।
ডাকঘর | ছবিঘর
আশা করছি ভাল কিছুই মনে পড়ছে...
কড়িকাঠুরে
সে অনেক স্মৃতিরে ভাই...... ভাবলে ভালো লাগে, আবার কষ্টও হয়।
ডাকঘর | ছবিঘর
প্রায় সবারই একই রকম...
কৈশোর শেষ হওয়া রং চং স্বপ্নের দিন
চলে গেছে রং হারিয়ে- চলে গেছে মুখ ফিরিয়ে
ভাল থাকুন..
কড়িকাঠুরে
কিছুই হল না-- বাজানো গেলো না সময়---
আপনার বর্ণনা পড়ে মনে হল যেন আমার কাহিনী লিখে দিচ্ছেন!! হাউ দিস কোলাভেরি?
পথিক পরাণ
--------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নাছাড়া ঘুরছি ভীষণ--
কপি মারলাম নাকি-
প্রথম গানটা- আমার গান, পরের টা-
- নেন
কড়িকাঠুরে
সোদা মাটির গন্ধ পাচ্ছি যেন...
-বিক্ষিপ্ত মাত্রা
অনেক অনেক-
কড়িকাঠুরে
ভালো লাগলো। অবশেষে লিখলেন কিছু
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
- হ...
কড়িকাঠুরে
বাহ!!
_____________________
Give Her Freedom!
- কী যে বলেন!!
কড়িকাঠুরে
বাইম আর গুতম এই দুটো মাছই আমার খুব প্রিয়। সাথে বেশি পিয়াজ, গাদা খানিক কাঁচা মরিচ , ছিটেফোঁটা আলু , পরিমান মত তেল দিয়ে একটু নেড়ে চচ্চড়ি করলে একেবারে মাথা নষ্ট। অনেক দিন খাওয়া হয় না। আজ আবার মনে করিয়ে দিলেন।
অনেক ভালো লাগলো।
আমি মাছ দুটো এখনো ঠিক খাইনা- তবে মনে হয় ওরা দারুণ । এক ঘটনা বলি- বরশি ফেলেছি পুকুরে- হটাৎ লম্বা ইয়া মতন কিছু একটা উঠলো, আমি তো ভয়ে অস্থির- কী ধরলাম এটা । একটা গর্তের মত জায়গায় বরশি সহ ওটা পড়ে আছে । ভয়ে আম্মুকে দিলাম ডাক- আম্মু এসে দেখে বিশাল এক গাঙ বাইম । যাক্ সাপ-টাপ না বাঁচা গেল । আমি মনে মনে ঠিক করলাম এবার আমি খাব- খেয়েই দেখি কেমন । কিন্তু বাইম আমি খাইনা সবাই তো জানে । তাই আমাকে কেউ বলেইনি । খেতে গিয়ে দেখি মাছ শেষ । বেশি করে পেঁয়াজ- কাঁচা মরিচ- তেল দিয়ে দোঁ-পেঁয়াজা করে অলরেডি পেটে চালান হয়ে গেছে । কী আর করা । আমার আর বাইম খাওয়া হল না... আজ পর্যন্ত হয় নি...
কড়িকাঠুরে
যদিও আপনি বাইম মাছ খান না তারপও তিন রকমের বাইম মাছের নাম বলেই ফেলি । গোচি , তারা আর সাল এই তিন রকমের মাইম মাছ আছে বলে আমি জানি। কি আপনার নিশ্চয় গা গুলিয়ে যাচ্ছে। মাছগুলো কিন্তু বেশ স্বাদের । একবার ট্রাই দিয়ে দেখবেন নাকি।
আগে হলে গা গুলাতো- এখন না । আগে অনেক কিছুই খেতাম না- এখন যেগুলো অনেক প্রিয় হয়ে গেছে, মাছের সংখ্যাই বেশি । ট্রাই- করা যায়- কী বলেন?
কড়িকাঠুরে
হুম
ঘটনা কি?
আমি নিজেও টাকি আর বাইন(বাইম) মাছ জীবনে খাইনাইক্কা!! আগে তরকারীতে দেখলেই বমি পাইত। এখন অবশ্য বমি পায়না। তবে খেতে পাইনা এখনো।
------------
পথিক পরাণ
ঘটনা হইলো- আমরা কলঙ্ক- $)- নাই
বাঙ্গালি জাতির মুখে চুন কালি মাখাইয়া মাছ না খাওয়ার কথা কইতাছি...
কড়িকাঠুরে
আমি এখনো খাই না এ দুটো তবে খাওয়া শুরু করবো... শীঘ্রই...
কড়িকাঠুরে
জালিটাকে আমাদের বরিশালের দিকে বলে খুঁচইন।
ছোটবেলায় একবার পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে টাকি মাছ মনে করে মেছোসাপ ধরে ফেলেছিলাম। ওরে বাবা সে কী ভয়ানক অভিজ্ঞতা ! মনে পড়লে এখনও গায় কাঁটা দেয়।
আপনার স্মৃতিচারন ভালো লাগলো। চালিয়ে যান
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
জালির মতই আর একটা জাল আছে ওটাকে আমাদের ময়মনসিংহে বলে খুঁইয়া । জালের ছিঁদ্র দিয়েই সম্ভবত আলাদা করা হয় ।
আর মাছ ধরতে গিয়ে মেছসাপ ধরা- টাকি ভেবে গর্তে হাত- বের হয়ে এলো সাপ... ওহ্...
ভাল থাকবেন-
কড়িকাঠুরে
জালির মতই আর একটা জাল আছে- আমাদের ঐ দিকে- খুঁইয়া বলে ।
আর টাকি ধরতে গিয়ে- গর্তে হাত- তারপর সা-আ-পা-পা-প্...
কড়িকাঠুরে
নস্টালজিক করে দেবার মতো লেখাই বটে
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ভাল থাকবেন...
কড়িকাঠুরে
আমার দাদাবাড়ি ছিল ডাকাতিয়া নদীর পারে। বর্ষাকালে দেশে গেলেই আমি ও অন্য কাজিন্দের সাথে মাছ ধরতে চলে যেতাম ডুলা নিয়ে।পাঁচমিশালী মাছ আর শালুক এর গোড়া তুলতে কি যে আনন্দ হত। আমি হয়তো কিছুই পেতাম না তবু ও অন্যরা মাছ ধরে আনলেই আমার আনন্দ। বাড়ি গেলে দাদী সেগুলা কড়া করে ভেজে দিত, সেই স্বাদ যেন এখন ও জিভে লেগে আছে।লেখা বেশ লাগলো, চোখের সামনে নিজের ফেলে আসা দিনগুলা যেন আবার ভেসে উঠলো।
এখানে আমার অনেক বড় আফসোস- - আমার শৈশবে কোন নদী নাই-
কড়িকাঠুরে
নতুন মন্তব্য করুন