হৃদিটার নতুন টিচার
১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। এস এস সি পরীক্ষা কেবল শেষ করেছি। সময় যেন কাটছিলনা । কিছু একটা করা দরকার সময় কাটানোর এরকম একটা ভাবনা আমাকে পেয়ে বসলো। এমন সময় আমার পাড়ার এক বড় ভাই বলল একটা টিউশনির কথা। আমি এর পূর্বে কখনও কারো বাসায় টিউশনি করিনি অর্থাৎ পড়ায়নি । বরং আমাদের বাসায় এসে এক অনার্স পড়ুয়া ভাইয়া পড়িয়ে যেত। তাই এই বিষয়টির কথা কখনও মাথায় আসেনি।
তারপরও সেই ভাইয়ের জোরাজুরিতে অনেকটা রাজী হয়ে গেলাম। তাই প্রথমেই কোন ক্লাসে পড়ে তা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। জীবনের প্রথম টিউশনি তাও আবার ক্লাস ওয়ান তাই নিজেকে একটু কম শিক্ষিত গোছের মনে হচ্ছিলো। প্রথমে অমত করলেও পরে পড়াতে সম্মত হলাম। একেবারে ছোট ক্লাস বলে নিজেকেও বেশ ছোট ছোট মনে হচ্ছিলো। যাহোক টিউশনি ঠিক হল মাসে দেবে তিন শত টাকা। ঐ সময়ের জন্য টাকার এই অংকটা একেবারে কম ছিল না।ঠিক হল পরের সপ্তাহে শনিবারে বিকালে পড়াতে যাবো।
আমি যথারীতি ছাত্রীর বাড়িতে বিকাল চারটায় গিয়ে হাজির হলাম। প্রথমেই ছাত্রীর মা এলেন এবং আমাকে বললেন তার মেয়ে একটু বোকাসোকা তাই শেখাতে আমার একটু কষ্ট হবে। তবে তিনি আশ্বস্ত করলেন যে সে বেশ শান্ত স্বভাবের আশা করা যায় আমার পড়াতে সমস্যা হবে না।আমি ওসব দেখে নেবো বলে তার মাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর আমার জীবনের প্রথম টিউশনির প্রথম স্টুডেন্ট এসে হাজির হল।
প্রথম দিন তাই খুব বেশী পাঠ পরিক্রমায় গেলাম না। তার নাম জিজ্ঞাসা করলে সে কিছুই বলল না। শুধু আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো। যাহোক প্রথম দিন নতুন মানুষের কাছে নাম বলতে বাচ্চারা অনেক সময় একটু সংকোচ করে তাই আর তা জানার জন্য আগ বাড়ালাম না।প্রথমেই তাকে বাংলা বই বের করতে বললাম আর সেগুলো জানে কিনা তা ধরার চেষ্টা করলাম। সে অ আ ই ঈ এগুলো মোটামুটি পারে এবং দুই একটি ইংরেজি অক্ষর পারে বলেও আমার মনে হল। তবে সে যা বলে পরক্ষনেই ধরলে আর পারে না। কাজেই আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমাকে যে বেশ খাটতে হবে এটুকু ঐ সময়ে ভালোই বুঝতে পারলাম।
প্রথম দিন তাই আর বেশীক্ষণ পড়ালাম না। পাঁচটার দিকে ওদের বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। মনে মনে হতাশ হলাম আর এইটুকু বাচ্চাকে পড়ান আমার পক্ষে সম্ভব নয় বলে একরকম ধরে নিলাম। তারপরও একবার শুরু করেছি আর একমাস পড়াবো না সেটা মনে হয় খারাপ দেখায়।তাই প্রথম মাসটা পড়াবো বলে মনস্থির করলাম।
পরেরদিন বিকাল চারটায় আবার পড়াতে গেলাম। যথারীতি আমার ছাত্রী এসে হাজির। সে টেবিলে পড়তে বসলো। আজ আমি আবার তার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। সে নাম বলল না ,আগের দিনের মত তাকিয়ে থাকলো। এবার ওর মা পাশেই ছিল তাই সেই বলল , ‘বল মা তোমার নাম। বল আমার নাম হৃদিটা।
তার মায়ের এই উত্তরে সে প্রশ্ন করলো , ‘মা উনি কে?’
আমি একটু অবাক হলাম। গতকাল পড়াতে আসলাম আর আজ বলে আমি কে। সে বারবার জিজ্ঞাসা করতে থাকলো উনি কে?
ওর মা বলল, ‘ উনি তোমার নতুন টিচার। কাল বিকালে তোমাকে পড়াতে এসেছিলো না?’
এইবার আমি মেয়েটির দিকে একটু ভালো ভাবে লক্ষ্য করলাম। আর বেশ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম মেয়েটি মানসিক প্রতিবন্ধী। এত সুন্দর এই পাঁচ বছরের মেয়েটি যে তাকে দেখলেই যে কারো মায়া জড়িয়ে যাবে।প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি আর একরকম মেনে নিতেও পারছিলাম না। আমি ওর মাকে এবার জিজ্ঞাসা করে ওর সম্বন্ধে জানতে চাইলাম।
মুহূর্তেই মহিলাটির চোখ জলে ছলছল হয়ে গেল। তিনি বললেন হৃদিটা জন্ম থেকেই মানসিক প্রতিবন্ধী। দুই বোনের মধ্যে সে বড়। অনেক চিকিৎসা করিয়েছে কিন্তু সমস্যা রয়েই গেছে। বাসায় নতুন কেউ এলে প্রথম কিছুক্ষণ যখন কাছে থাকে তখন চিনতে পারে কিন্তু পরক্ষনেই আর চিনতে পারে না। তখন নতুন করে পরিচয় শুরু করতে হয়।
তিনি বললেন এর আগেও তাকে পড়ানোর জন্য হাফিজ( সেই বড় ভাই) একটি ছেলে ঠিক করে দিয়েছিল কিন্তু এক সপ্তাহ পরে ওর এই অবস্থার কারণে আর পড়াতে আসেনি। তাই এবার আমি নিজেই মানা করেছিলাম আগে থেকে হৃদিটা সম্বন্ধে কিছু না জানাতে আপনাকে। মনে মনে ভেবেছিলাম সামনা সামনি এলেই আপনাকে অনুরোধ করবো ওকে পড়াতে।
ওই মুহূর্তে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো ওই অসহায় মায়ের জন্য যিনি তার সন্তানের এই অবস্থা জেনেও আমাকে অনুরোধ করলেন তার মেয়েকে পড়াতে। হয়তো মেয়েটি কিছুই শিখবেনা বা শিখলেও মনে রাখতে পারবে না তারপরও সন্তানের প্রতি মায়ের এই দায়িত্ববোধ দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেলো। আমি পড়াতে রাজী হয়ে গেলাম এবং যতদিন কলেজে না যাবো তার আগ পর্যন্ত পড়াবো বলে আশ্বস্ত করলাম।
এরপর থেকে শুরু হল মেয়েটিকে পড়ানোর এক নিরন্তন চেষ্টা। প্রতিদিন আমি পড়াতে যেতাম একজন আগন্তুক হিসেবে যেন আজই আমি তাকে প্রথম পড়াতে এলাম। শুরুতেই তার সেই গৎবাঁধা প্রশ্ন আমি কে? আর সাথে সাথেই বলে ফেলতাম আমি তোমার নতুন টিচার। এভাবেই চলতে থাকলো আমার জীবনের প্রথম টিউশনি। প্রতিদিন একজনের কাছে নিজের নতুন পরিচয় দিতে দিতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। এভাবে তিনমাস পড়ানোর পর আমার এস এস সির রেজাল্ট দিয়ে দিল। কলেজে ভর্তি হবার প্রস্তুতি শুরু হল সেই সাথে বাড়ল ব্যস্ততা। তবে শেষের দিকে হৃদিটা আমাকে চিনতে পারত। ঠিক যেমন ওর ঘরের মানুষদের চিনত। আমি গেলেই বলত নতুন টিচার। এর ফাকে সে কিছু বর্ণের সাথেও পরিচিত হয়েছিল।
তিন মাস পরে আমি কলেজের কারণে পড়াতে পারবোনা বলে জানিয়ে দিলাম। সাথে সাথেই ওদের মন খারাপ হয়েছিল। আমারও ভীষণ খারাপ লেগেছিল। আর সবচেয়ে খারাপ লাগছিল যখন হৃদিটাকে জানানো হল তার টিচার আর আসবেনা। তখন তার মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না শুধু আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে তার মাকে বলেছিল মা মা নতুন টিচার- নতুন টিচার । কথাগুলো আজও কানে বাজে আর মনে পড়ে যায় সেই নতুন টিচারের কথা যে প্রতিদিন একজন নতুন মানুষ ,একজন নতুন টিচার ওই প্রতিবন্ধী বাচ্চাটির কাছে।
অমি_বন্যা
মন্তব্য
লেখার ধরন আর লেখার বিষয় দুইটাই (গুড়) হয়ছে। তবে গল্পটা পরে মন খারাপ হয়ে গেল আর "First 50 dates" movie টার কথা মনে পরে গেল।
ইয়ে, মুভিটার নাম বোধ হয় "ফিফটিফারস্ট ডেইট" ছিল।
আমারো ওটার কথা মনে হয়েছিল।
ভাল লিখেছেন।
ধন্যবাদ আপনাকে
লেখা দারুণ লেগেছে
ভালো লাগলো আপনার ভালো লেগেছে জেনে।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
মন খারাপ হয়ে গেল। লেখা ভালো হয়েছে।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
ধন্যবাদ আপনাকে। আসলেই এ ঘটনাগুলো মন খারাপ করে দেয়।
মায়াময় লেখনি-
-বিক্ষিপ্ত মাত্রা
PS : হৃদিটার জন্যে ভালবাসা।
জানিনা হৃদিটা আজ কোথায় তবে আপনার ভালোবাসা তাঁর কাছে পৌঁছে দিলাম।
মন খারাপ করা লেখা। ভালো লাগলো।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ কীর্তিনাশা ।
বুকের মাঝে হাহাকার আর চোখে পানি নিয়ে হৃদিটার কথা ভাবছি।
মনের রাজা টারজান,
মন খারাপ হয়ে গেল...
কড়িকাঠুরে
হৃদিটার জন্য দোয়া করবেন।
বাচ্চাটার জন্য মন খারাপ হয়ে গেল। সুস্থ হয়ে উঠুক হৃদি!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ও সুস্থ হয়ে উঠুক সেই প্রার্থনা আমারও।
আমারও সেই প্রার্থনা। ভাল থাকুন আপনি।
ভাল থাকুক হৃদি...
কড়িকাঠুরে
সেটাই সেরে উঠুক মেয়েটি।
কি অদ্ভুত কষ্ট!
সুন্দর লিখা ।
ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো লাগলো লেখাটা। মন খারাপ করে দেয় অনুভূতিগুলি।
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ তাপসদা। অনুভূতিগুলো আসলেই এরকম।
মন খারাপ হল পড়ে। আর মন খারাপ করা লেখাই আমার বেশী ভাল লাগে। আরও লিখুন।
দেখি আপনার মন আবার খারাপ করে দেয়া যায় কি না। লেখা চালিয়ে যাবো।
লেখা তো ভালো লাগল বেশ। আরো লিখুন।
আপনাকে
সুস্থ হয়ে উঠুক হৃদি! তার সারাজীবন হেসে কাটুক; আশেপাশের সবাইকে হাসাক, আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাক।
আপনার জন্যও শুভকামনা।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
ওর সুস্থতা আমিও কামনা করছি। আপনার জন্যও শুভকামনা রইলো।
মন খারাপ করা লেখা।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
হুম
লেখা ভাল লাগল।
হৃদিটা যেখানেই থাকুক ভাল থাকুক।
শাব্দিক আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার মত সেই কামনা আমারও ।
গুটলুদের এমন কাহিনী শুনলে কিছুই আর ভাল্লাগে না, ঝাপসা দেখি চারিদিক।
লেখালেখি জারি থাক!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
আপনার কথাগুলো ভালো লাগলো । লেখা চালু আছে।
লেখা - ভালো
মন - খারাপ
অত্যন্ত ভালো লাগলো এই কারণে, মেয়েটি মানসিক প্রতিবন্ধী যেনেও আপনি তাকে পড়িয়েছেন।
লেখককে সাধুবাদ।
ধন্যবাদ সায়েম আপনাকে।
ওয়াও!
কিছু কিছু মানুষ কেন এত দূর্ভাগ্য নিয়ে পৃথীবিতে আসে ভাবলেই কষ্টে আমার দুচোখ ঝাপসা হয়ে যায়। হৃদিতারা ভালো থাকুক।
নতুন মন্তব্য করুন