একটি অলস কর্পোরেট দুপুর, অতঃপর... (শেষ পর্ব) - এভাবেই পাল্টায় সুখের ধরন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১০/০৬/২০১২ - ১০:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই লেখাটা শুরু করেছিলাম ২২শে নভেম্বর ২০১১ তে। আজ ৯ই জুন ২০১২। কত তাড়াতাড়ি সময় বয়ে যায়। হঠাৎ ল্যাপটপের “হাউস কিপিং” করতে গিয়ে অসম্পূর্ণ লেখাটা পেলাম। এরই মধ্যে চাকরীটা পাল্টেছি, মেঘাও বেশ বড় হয়ে গেছে।

অফিসের সব চাইতে বিরক্তিকর সময়টা হচ্ছে যখন খুব একটা কাজ না থাকা সত্তেও, রাত ৮-৯টা পর্যন্ত বসে থাকতে হয়। সেরকমই একটা পরিস্থিতি হচ্ছে এজেন্সির সাবমিশন এর জন্য অপেক্ষা করা। অফিস আউটলুক নামক বিদিকিচ্ছিরি এক প্রোগ্রাম সামনে নিয়ে তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা। মেইল আসবে। সেই একই মেইল টা বস কে ফরওয়ার্ড করে আবারও অপেক্ষা করতে হয়। কখন তিনি “This layout is OK and approved.” লিখে ফিরতি মেইল পাঠাবেন। ততক্ষণে এজেন্সির ছেলেটা কম করে হলেও দশবার ফোন করে, “দাদা, আর কতক্ষণ বসায় রাখবেন?” খুব চিন্তা করে দেখলাম, এই সময়টাই ব্লগ পড়া আর লেখার জন্য সর্বোত্তম।

শহিদ ফ্লোর-এর লাইট গুলো একে একে নিভিয়ে দিয়ে খুবই অনুনয় ভরা আকুতি নিয়ে অফিস ত্যাগ করার অনুরোধ করে যায়। মুখে কিছু না বললেও, বেশ বুঝতে পারি সে খুবই বিরক্ত। আজ তো আমাদের মুশতাক ভাইও বাসায় চলে গেছেন, তাও প্রায় ঘণ্টা খানেক আগে। আমি নিরুপায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, রাস্তার পাশে বেশ্যাদেরও নিজের ইচ্ছে বলতে একটা কিছু আছে। আমার মত কর্পোরেট গোলামদের তাও নেই।

গত বেশ কয়েকটা দিন ধরে খুব ব্যস্ত সময় কেটেছে। অবশ্য এখন এটা নিস্তরঙ্গ রুটিনে পরিণত হয়েছে। সারাদিন PowerPoint আর Excel নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে নিজের ভাললাগা কিংবা প্রয়োজন গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখার ফুরসত হয়না। আবার কাজ করতে করতেই এক একটা সময় আসে যখন “থট প্রসেস” পুরো আটকে যায়। মাথার ভেতর কেমন যেন একটা শূন্যতা তৈরি হয়। টুকরো টুকরো চিন্তা আসে কিন্তু সেগুলো গোছাতে গেলেই তিন আর নয় বারি খায়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নাম্বার ক্রাঞ্চিং করতে করতে ঘুমের মধ্যেও দেখি নাম্বার ছোটাছুটি করছে – কখনও ৭ তাড়া করছে ৫ কে আবার কখনও ৩ তেড়ে যাচ্ছে ৯ এর দিকে । অফিস থেকে বাসায় ফেরার পরও মাথার ভেতর সংখ্যাগুলোর এই কুজকাওয়াজ চলতেই থাকে।

ক্লান্তির কাছে হার মেনে নিয়ে আমার চোখের পাতা যখন ঘুমের আদর মাখা চাদর মুড়ে বুজে আসে, তখনই মেঘার আহ্লাদ করার খায়েশ জাগে। কখনও সে “ক-অ-ম” দিয়ে আমার হাতে পায়ে আঁকিবুঁকি করে, “বা-বা, ত্যাতু” (ট্যাট্টু)। আবার কখনও নিজের শিল্পকর্মে মুগ্ধ হয়ে খুশিতে আত্মহারা মেঘা আমার ঘাড়ে কিংবা গলায় কামড় বসায়। রাগ করার কিংবা বিরক্তি প্রকাশ করার সেখানে কোন অবকাশ নেই। আমি কিছুটা নিরুপায়, ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে মেয়ের অবুঝ ভালোবাসা মাখা এসব খুনসুটিতে ডুবে যাই। বন্ধ চোখের ভেতরে তখনও সংখ্যাতত্তের হিজিবিজি স্ক্রিনসেভারটা চলতে থাকে।

সেখানেও বিপত্তি। আমার চোখের পাতা এক হলেই হয়ত মেঘার মনে হয় আমি তার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছি না। “ক-অ-ম”-এর খোঁচা গুলো আস্তে আস্তে বেয়নেট-এর আঘাতের মত তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হতে থাকে। “বা-আ-বা”, “এই বা-বা-আ”। চেখ না খুলে উপায় নেই। অগত্যা উঠে বসি, মেঘা কিছুটা অনুযোগের সুরে আমার বুকে মাথা রাখে, অনেক কিছু বলতে চায়। তার অস্পষ্ট শব্দ চয়নের মর্মার্থ উদ্ধার করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। বোকার মত মেয়ের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলি, “বাবা, চকলেট খাবে?”।

তার দুষ্টুমিতে অস্থির আমি এক পর্যায়ে তার দিকে একটু রেগে তাকাতেই সে মুচকি হেসে উল্টো প্রশ্ন করল, “বাবা, রাগ করশে? অ্যাঁ, বাবা রাগ করশে?” তারপর পাশ থেকে আমার ফোনটা তুলে নিয়ে কাকে যেন ফোন করে অনুযোগের সুরে বলতে থাকে, “বাবা রা-গ করশে না-আ? এখন কথা বোব্বনা।” আজকাল বাচ্চারা অনেক বুদ্ধিমান। ভাবলে অবাক লাগে এই বয়সে আমি ফোন কি জিনিস তাই চিনতামই না।

মেয়েকে জিজ্ঞেস করি, “মেঘা কার সাথে কথা বলে?”
“মনি’র সা-থে” [আমার বড় বোনকে মেঘা মনি ডাকে]
“মনিকে কি বললে?”
“বাবা, রাগ করশে।”
“কেন? বাবা রাগ করব না?”
“না-আ।”
“মেঘা বাবাকে ভালোবাসে?”
“ভাল-বাশি।”
এ পর্যায়ে মেঘা’র মা ঘরে ঢুকে, “মেঘা, মাকে ভালোবাসেনা?”
“মা-কে ভাল-বাশি।”
খুব কৌতূহল থেকে মেয়েকে জিজ্ঞেস করি, “মেঘা কাকে বেশি ভালোবাসে?”
একটু বিচলিত হয়ে, নিজেকে সামলে নিয়ে মুচকি হেসে উত্তর দেয়, “দা-দ্দা কে”।
মেয়ের কাণ্ড দেখে আমরা দুজন হেসে উঠি। আর মেঘা লাজুক একটা হাসি দিয়ে আমাদের গায়ের ওপর ঝাপ দিয়ে পরে। অনেক আহ্লাদের “হুম্পি”র বর্ষণ হতে থাকে।

অফিসের ডেস্ক এ বসে বারবার এ কথোপকথন মনে করি। ক্লান্তি জাতীয় শব্দ গুলো হারিয়ে যায়, আমার চোখগুলো জ্বলে ওঠে। নিজের অজান্তেই হাসতে থাকি আমি। সত্যিই, এভাবেই পাল্টায় সুখের ধরন।

অচেনা আগন্তুক

এ সিরিজের আগের লেখা গুলোঃ
১। একটি অলস কর্পোরেট দুপুর, অতঃপর...
২। একটি অলস কর্পোরেট দুপুর, অতঃপর... (দ্বিতীয় পর্ব)


মন্তব্য

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

রংধনুর কথা এর ছবি

চলুক

কালো কাক এর ছবি

অপেক্ষা করছি নতুন জায়গার অভিজ্ঞতা শুনতে। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

চেষ্টা করব। হাসি

শামীম এর ছবি

ঘুমানোর সময়ে মেয়ের আদরের অত্যাচার - নিজের অনুভুতির সাথে মিলে গেল।

ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি বুড়ি হলে ও কেমন হবে দেখতে ... আমি সেই সময়ে থাকবো না ভাবতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ

তারানা_শব্দ এর ছবি

খুব সুন্দর।।।

"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"

অচেনা আগন্তুক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

[i এভাবেই পাল্টায়][/i]...

কড়িকাঠুরে

অমি_বন্যা এর ছবি

কর্পোরেট জবের সাথে আমি যুক্ত নই। তবে অনেক বন্ধুরা কাজ করছে । ওদের বেতন ভালো তবে পার্সোনাল টাইম নেই বললেই চলে। কেমন যেন যান্ত্রিক জীবন যাপন করছে সবায়। আমার কাছে তাই মনে হয় আবার অনেক কে বলতেও শুনেছি।

ভাল থাকবেন । লেখা ভাল লাগলো।

অচেনা আগন্তুক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অচল এর ছবি

সত্যিই, এইভাবে পাল্টায় সুখের ধরন । অসাধারণ চলুক (গুড়)

শাব্দিক এর ছবি

ইয়ে, মানে...

অতিথি লেখক এর ছবি

শুনেছি বাচ্চাদের কখনো জিজ্ঞেস করতে নাই "বাবাকে বেশী ভালবাস নাকি মা কে"

মর্ম এর ছবি

কর্পোরেট জীবন বড় উত্‍কট ঠেকছে আজকাল। ধৈর্য ধরে রেখে কাজকর্ম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বেশ মুশকিলের কাজ।

শেষ কথা বোধ হয় ঐ একটাই-

"নদীর এইপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস!"

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

চলুক

বন্দনা এর ছবি

আপনার মেয়েটার জন্য অনেক আদর।

অচেনা আগন্তুক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।