আতঙ্ক
১৯৯৬ সালের শেষের দিকের কথা। সকালে বেশ দেরী করেই ঘুম ভেঙ্গেছে মামুনের কারণ শেষ রাতের দিকে একটু চোখ বুজেছিল তাও নিজের অজান্তেই। দিনের আলোটাই তার ভালো লাগে আর খুব বীভৎস মনে হয় রাতের অন্ধকার। সন্ধ্যার গোধূলি চলে যাবার ঠিক পরেই যখন অন্ধকার আসে তখনই মনের ভিতর ভীষণ একটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। ক্লাস এইটে পড়া ছেলেটি একেবারেই ঠিক ক্লাস ওয়ানে পড়া বাচ্চাদের মত আচরণ করতে থাকে। সন্ধ্যার পরে ভীষণ ভয় লাগে তার। রাত তার কাছে হয়ে উঠেছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। রাতে খাবার আগ পর্যন্ত ভালোই যায় কিন্তু খাবার পরেই যখন ঘুমের পালা তখনই রাজ্যের যত ভয় তার উপর ভর করে। তার মনে হয় এই বুঝি দরজায় কড়া নেড়ে কেউ দরজা খুলতে বলবে। আর হবেই বা না কেন খোলাডাঙ্গার দুইটা বাসা থেকে এক সপ্তাহে তিনজনকে ধরে নিয়ে গেছে কিছু অস্ত্রধারী লোক। এরা নাকি গভীর রাতে এসে প্রথমে দরজায় টোকা দেয় । ঘর থেকে কেউ বের হয়ে এলে অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে ১০ - ১৫ বছরেরে যুবক ছেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। আর স্বেচ্ছায় কেউ বের না হলে দরজা ভেঙ্গে ফেলা হয় তারপর বাসার লোকদের উপর নেমে আসে কিছু সময়ের জন্য অত্যাচার । কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় যুবক ছেলেদের। গত এক সপ্তাহে যশোরের আরও কয়েকটি গ্রাম থেকে এ ধরনের ছেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । তারপর আর কাউকেই পাওয়া যায়নি এখনও।
মামুন গত এক সপ্তাহে বেশ শুকিয়ে গেছে। ঠিকমতো খেতে পারে না। কেমন যেন অরুচি সবকিছুর ভিতরে। পেট কেমন জানি ভরা ভরা লাগে। আতঙ্ক একবার দানা বাঁধলেই এমন হয় বোধহয়। কিছু ভালো লাগেনা। তার সবকিছুর ভিতরে ওই একটাই চিন্তা কে জানি ধরে নিয়ে যাবে তাকে। তারপর আর সে ফিরে আসবে না ওই চির চেনা ঘরে।
খুবই অন্যমনস্ক থাকে সে আজকাল। ক্লাসের হোম ওয়ার্ক বেশ জমে গেছে ঠিকমতো করতে পারছে না। স্কুলের একটি কোনে একা বসে বসে কি যেন সব অদ্ভুত চিন্তা ঘুরাঘুরি করে সারাদিন। বন্ধুদের থেকে বেশ আলাদা থাকে সে। একটা আস্থাহীনতা থেকে নিজের উপর সকল সাহস ক্রমেই সরে যেতে শুরু করেছে। অপরিচিত লোক দেখলেই তার পালাতে মন চায় ওখান থেকে। কাউকেই সে এখন আর বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রতিদিনের দেখে চলা অচেনা মানুষেরা আজ তার কাছে খুব বেশী অচেনা। তার ধারণা এদেরই কেউ হয়তো স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে তার পিছু নেয় বাড়িটি চিনে রাখার জন্যে। কোন এক সুযোগে হয়তো গভীর রাতে শুনতে পাবে এদেরই কারো হাতের চাপটে দরজায় করে ওঠা কড়া নাড়ার শব্দ। কড়া নাড়ার শব্দে আচমকা তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ খুললে দেখতে পায় তার মা দুপুরের খাবার নিয়ে টেবিলে এসেছে। মায়ের দরজা খোলার শব্দে আচমকা ঘুমের ঘোরে দেখতে থাকা স্বপ্ন ভঙ্গে সে একেবারে লাফ দিয়ে ওঠে।
মামুনকে নিয়ে তার বাবা মাও খুব চিন্তিত। কারণ গত কয়েকদিনে এরকম ঘটনা বেশ কয়েকটি শোনা গেছে। তাদের পাড়াতেও আসবে বলে গুজব উঠেছে। অনেকে তাদের উঠতি বয়সী ছেলেদের বাসা থেকে দূরে আত্মীয়ের বাসায় রেখে আসা শুরু করেছে। মামুনের বাবাও এমন একটি জায়গার খোঁজ করছে যেখানে সে তার একমাত্র ছেলেকে রেখে আসতে পারে। বড় খারাপ সময় পার করছেন তারা। প্রশাসনকে জানানো হয়েছে কিন্তু তারা কোন কুল কিনারা করতে পারছে না । মামুনদের বাবলা তলার মানুষের মুখে মুখে আজ এই একই গল্প আর একই আতঙ্কের কথা শোনা যাচ্ছে। অনেকে বলছে এসব ছেলেদের ধরে নিয়ে নাকি পাচার করে দেয়া হচ্ছে। তবে সবার একই কথা কেন ধরা পড়ছে না এসব মানুষরূপী পশুগুলি।
আবারও রাত এসেছে সেই সাথে এসেছে দেশের সব আতংকরা। রাতের প্রতিটি প্রহর গণনা করে বলে দিতে পারে মামুন। অনিদ্রা তাকে খুব করে জেঁকে বসেছে। রাতে তার হৃৎস্পন্দন অনেক বেশী থাকে। বিছানার এপাশ ওপাশ শুধু গড়াগড়ি কিন্তু ঘুম আসেছে না যে। একটু ঝিম আসছে আবার ঘুম থেকে জেগে উঠছে সেই আতঙ্কে এই বুঝি কেউ এসে দরজায় কড়া নাড়ল। দরজার চেয়ে তার মনে করাঘাত হচ্ছে খুবই বেশী। জানালার পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া মানুষের পদধ্বনি এখন খুব কানে বাজে মামুনের। আর এটা যদি গভীর রাতে হয় তাহলে তো কথায় নেই।
এভাবেই আধো ঘুম নিয়ে রাত পার হল সেই সাথে শেষ হল আরও একটি রাত। ঊষার আলোর হাতছানিতে উঠে পড়লো মামুন। চট করে তৈরি হয়ে নিয়ে স্কুলে যাবার প্রস্তুতি চলছে। তার শার্টের বোতাম ঠিকমতো লাগেনি , জুতার ফিতাও আলুথালু হয়ে আছে। ছেলের ভিতরে এসব পরিবর্তন তার বাবার চোখ এড়ায়নি। তিনি বুঝতে পারছেন যে মামুনের সময়গুলো বেশ আতঙ্কের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। মামুন আজ তাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলেছে । সে তাকে বলেছে 'বাবা আমাকে কি ধরে নিয়ে যাবে? ’
ছেলের এই কথায় তিনি একটি বিষয় নিশ্চিত যে মামুনের ভিতর থেকে এই ভয় দূর করতে হবে। আজ তাই যে কাজটি অনেক দিন ধরে ব্যবসায়ী ফারুক সাহেব করেন না তাই করলেন অর্থাৎ ছেলের সাথে স্কুলে গেলেন। টিফিনের আগ পর্যন্ত তিনি স্কুলের পাশের পার্কে বসেই সময় কাটালেন। ছুটি শেষ আবার দুইজন মিলে বাসার পথে রওনা হলেন।
স্কুলে বাবার সাথে আসাতে তার মধ্যে বেশ সাহস সঞ্চারিত হল। তাকে আজ বেশ উন্মুক্ত মনে হচ্ছে। পথের ধারে থাকা বাদাম ওয়ালার কাছ থেকে বাদাম কিনে তারা আজ বাদাম খেয়েছে। ফারুক সাহেব আজ পরিচিত তার বেশ কজন বন্ধুর সাথে বাসায় আসার পথে দেখা করেছেন। পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ছেলেকে সবার সাথে যেন সে একটু হাল্কা হয়ে উঠতে পারে । মামুন সবার সাথেই প্রাণ খুলে কথা বলা শুরু করেছে। রিকসায় চেপে দুজনে বাসায় ফিরলেন। আজ বাসার সবায় মিলে বিকেলে ঘুরতে যাবে বলে স্থির হল। ফারুক সাহেবের একটাই লক্ষ্য আর তা হল মামুনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আতঙ্কের এই পঙ্কিল জাল থেকে ছেলেকে বের করে নিয়ে আসাই তার একমাত্র লক্ষ্য।
বাবার এই আপ্রাণ চেষ্টা আর থেমে নেই। ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আজ পার্কে বসে এসব নিয়েই চিন্তা করছিলেন। তার ভিতরে একটা দহনও শুরু হয়েছে এই নিয়ে যে প্রায় সাত দিন ধরে মামুন এই আতঙ্ক বয়ে বেড়াচ্ছে আর তিনি তা উপলব্ধি করতে পারেন নি। বেশ রাগ হল নিজের প্রতি। এটাও ঠিক যে কাজ নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে তাই বলে ছেলেকে উপলব্ধি করার সময় কি তিনি পাননি।
ফারুক সাহেব তার স্ত্রীকেও আজ তাদের বাইরে আসার কারণ বলেছেন। মামুনের মানসিক অবস্থা তিনি তার স্ত্রীকে বুঝিয়েছেন। এই মুহূর্তে তাদের একমাত্র ব্যস্ততা থাকবে মামুন কে নিয়ে। দুজনে মিলে আজ সন্ধ্যার পরেই তাই মামুন কে নিয়ে টিভি দেখছেন। দুইটা ইয়ো ইয়ো ( এক ধরনের খেলনা) কেনা হয়েছে আজ সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে। দুই জনে মিলে সন্ধ্যা থেকে খেলতে খেলতে কখন যে ডিনারের সময় হয়েছে তা টের পায়নি মামুন। রাতের খাবার পর ফারুক সাহেব মামুন কে বলল ‘আজ তুই আমার কোলে ঘুমাবি ঠিক যেভাবে ছোট বেলায় তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম’।মামুন খুশিতে বাক বাক। বাবার কোলে শুয়ে টি ভি দেখতে দেখতেই ঘুম। তারপর একেবারে পাখির কিচির মিচির শব্দে সকাল।
এভাবে তিনি ছেলের পিছনে সময় দিতে থাকলেন। একই রুটিন তিনি অনুসরণ করতে থাকলেন বেশ কয়েক দিন। আস্তে আস্তে মামুনের ভেতর থেকে আতঙ্করা কেটে উঠতে শুরু করেছে তা বুঝতে পারলেন মামুনের আচরণে। খাওয়া দাওয়ায় তার পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন সেই সাথে স্কুলে বন্ধুদের সাথে তার মেলামেশাও আগের মত হয়েছে বোধ করলেন।মামুনের এই মানসিক পরিবর্তনে আজ তিনি এক বড় শিক্ষা নিলেন। বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার পথে তাদের আচরণে কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলে খুব গুরুত্বের সাথে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করতে হয়। আতঙ্কিত হয়ে পড়লে তাদের ভিতরের এই আতঙ্ক যত দ্রুত সম্ভব দূর করতে হয় । আজ তিনি তাই করেছেন। ছেলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাওয়া আতঙ্ক তার সময় , শ্রম ও ভালোবাসা দিয়ে দূর করেছেন। মামুনের ভেতরে থাকা জুজুর ভয় ক্রমেই দূর হয়েছে
।
আজ সবাই মিলে খবর দেখছিলেন। ১০ জনের একটি গ্যাং যারা যশোরের কয়েকটি গ্রামে বেশ কয়েকদিন ধরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অল্প বয়সী ছেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো তাদেরকে গতরাতে একটি অভিযান চালিয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। সাথে কিছু অস্ত্র ও জিম্মি করা ছেলেগুলোকেও একটি বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সংবাদটি সবার আগে মামুনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
সে তার বাবাকে তাই বলছে – ‘বাবা এখন আর কেউ আমাকে ধরতে আসবে না। কি মজা কি মজা’। মামুনের মুখের এই উৎফুল্লতা এতদিন পরে একেবারে পূর্ণতা পেল বলে মনে হচ্ছে। শিশুদের মন এমনই -খুবই নাজুক।খুব দ্রুত যে কোন কিছু এদের মনকে প্রভাবিত করে। যদি তা খারাপ কিছু হয় তবে পরিবারের উচিৎ খুব দ্রুতই তার এই অবস্থা থেকে তাকে বের করে নিয়ে আসা । একটু দেরি হলেও ফারুক সাহেব সেই কাজটি করতে পেরেছেন । পিতৃ সুলভ একটি হাসি ঠোটের কোনে লাগিয়ে তিনি মামুনের দিকে তাকিয়ে বোধহয় এসব নিয়েই ভাবছেন।
অমি_বন্যা
মন্তব্য
চালিয়ে যান।ভাল লিখেছেন।
দেব মুখার্জি
[db.dev.m@gmail.com]
--------------------------------------------------------------
দেব এর উঠোন ॥ ফেইসবুক ॥ গুগলপ্লাস
নতুন মন্তব্য করুন