গ্রামের নাম ঢেরপাড়া, চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় অবস্থিত এই গ্রাম ‘পটিয়া চা বাগান’ নামেও পরিচিত। ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত এই চা বাগানের সীমানা থেকেই শুরু হয়েছে পাহাড় যা বান্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত। শোনা যায় চা বাগানে কাজ করার জন্য ব্রিটিশরা বাঁকুড়া থেকে হতদরিদ্রদের নিয়ে আসে। সস্তা হওয়ার কারণে বিপুল সংখ্যায় তাদের নিয়ে আসা হয়। এই সব দরিদ্র শ্রমিকরা সংখ্যায় অনেক হওয়ার কারণে আশেপাশের গ্রামের লোকজন তাদের “ঢের” ডাকা শুরু করে। সামাজিকভাবে তাদের নিম্নশ্রেণী হিসেবে গণ্য করা হত। “ঢের” নামটা কটাক্ষ এবং অপমান করে ডাকা হয়। তাই “ঢের” নামটা ছিল এই চা-শ্রমিকদের জন্য গালিস্বরূপ। কয়েক দশক আগে চা বাগানটি বন্ধ হয়ে যায়, এরপর থেকে শ্রমিকরাও বেকার হয়ে যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কোন নির্দিষ্ট পেশা নেই তাদের। পেয়ারার মৌসুমে পেয়ারা বাগানে কাজ করে, ইটের ভাটায় দিনমজুরী করে বা বন থেকে কাঠ কেটে তারা দিন কাটায়।
আর্থিক ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ায়, নাগরিক হিসেবে ন্যূনতম কোন সুযোগ-সুবিধা তারা পায়না। গ্রামটিতে ছিলনা কোন স্কুল, স্বাস্থ্যসম্মত পানি ও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা, চিকিৎসাকেন্দ্র। পানিবাহিত রোগ এদের নিত্যসঙ্গী। বেশিরভাগ ঘর মাটি ও শনের তৈরি। গ্রামের সীমানা থেকে যে জঙ্গলের শুরু, নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে উজাড় হচ্ছে সেই জঙ্গল। জঙ্গলে খাবারের অভাব হওয়ায় প্রতি বছর পাহাড় থেকে নামে বন্যহাতীর দল, নষ্ট করে ঘর-বাড়ী, ক্ষেত-খামার-সবজি-ফলের গাছ।
এভাবেই চলছিল এই গ্রামের জীবন। ২০০৪ সালে পাশের গ্রামের দুই কিশোর- রফিক ও ওয়াসিম গ্রামের অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেয় স্কুল স্থাপন করার। একচালা একটি ঘরে তারা শুরু করে স্কুল। কখনো কারো বাড়ির উঠান বা কোন গাছের নিচেও চলত ক্লাস। ২০০৫ সালে স্কুলের সাথে যুক্ত হয় ধ্রুব। নিয়মিত ক্লাস চললেও অর্থাভাবে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায় ২০০৭ সালে। স্কুলের তখনকার বেশিরভাগ ছাত্রকে পরে সরকারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। যদিও অর্থাভাব, স্কুলের দূরত্ব সবকিছু মিলিয়ে তারা বেশিদিন তাদের শিক্ষাজীবন চালিয়ে যেতে পারেনি। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে নতুন আঙ্গিকে চলা শুরু হয় এই স্কুলের, যুক্ত হয়- ইশতিয়াক, শান্তা, সুজা সহ আরো অনেকে। শুধু শিক্ষা কার্যক্রম নয়, গ্রামে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাজের সূচনা করে গ্রামবাসীকে নতুন ভাবে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে এই স্কুল, তাই এই স্কুলের নাম দেয়া হয়- স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন, গ্রামটির নাম ও হয়ে যায়- স্বপ্ননগর।
একটি ভিন্ন চিন্তা থেকে এই স্কুলের কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। যদিও আর্থিক সংকট, দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে অনেক কর্মসূচী সফল করা সম্ভব হয়নি। শুরু থেকেই স্কুলটিকে স্বাবলম্বী করার প্রয়াস ছিল, কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সাফল্য সেভাবে আসেনি। এছাড়া বয়স্ক শিক্ষা, মেডিকেল ক্যাম্প, হাতীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা, টিউবওয়েল স্থাপন, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন সচেষ্ট রয়েছে।
এই বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে দেয় বহু ক্ষেত্রেই। শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা আরোপ করে তাদের একঘরে করে রাখে। বহু বছর ধরে যে অপমানের শিকার হচ্ছিল এই জনগোষ্ঠী, সেই অবস্থার পরিবর্তন আনা শুরু করেছে এই স্কুল- সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই এই লেখা।
স্বপ্ননগর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০০৭-২০০৮ সাল পর্যন্ত স্বপ্ননগরের ছেলেমেয়েরা সরকারী বিদ্যালয়ে পড়তে যেত (কারণ তখন অর্থাভাবে স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন বন্ধ ছিল)। আশেপাশের গ্রামের লোকজনরা তখন তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। প্রকাশ্যে তাদের “ঢের” ডেকে অপমান করা হত, এক প্রকার অচ্ছ্যুৎ করে রাখা হত। ২০০৯ সালের পর থেকে স্বপ্ননগরের ছেলেমেয়েরা আর সরকারী বিদ্যালয়ে পড়তে যায় না। তারা তাদের নিজেদের বিদ্যানিকেতনে পড়ে। ২০১০ সালে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে স্বপ্ননগরের দুইজন ছাত্র এবং দুইজনই পাশ করে। এলাকায় ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতনের শিক্ষাকার্যক্রম যথেষ্ট মানসম্পন্ন। স্বপ্ননগরে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত ১৫:১ যা শহরের অনেক নামী স্কুলেও নেই। বার্ষিক “স্কুল ডে” উপলক্ষ্যে শুভানুধ্যায়ীরা আসেন প্রতিবছর। খেলাধূলা, গান, কবিতা, নাটক, একসাথে দুপুরে খাওয়া, ইত্যাদির মাধ্যমে উদযাপন করা হয় এই দিনটাকে। এই দিনটা পুরো গ্রামবাসীদের উদ্দীপ্ত করে প্রতি বছর। ২১ ফেব্রুয়ারী ও ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষ্যে কখনো শহীদ মিনার তৈরী করা অথবা র্যালি করে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার ঘটনা আশেপাশের গ্রামবাসীদেরও আলোড়িত করে। এই সব ঘটনার ফলাফল হল, আশেপাশের লোকজন এখন আর স্বপ্ননগরবাসীকে অপমান করেনা। বরং তারা স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতনে তাদের সন্তানদের পড়াতে আগ্রহী। এই বছর বিশ জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয় আশেপাশের গ্রাম থেকে। আশেপাশের গ্রামের বাচ্চারা আর স্বপ্ননগরের বাচ্চাদের “ঢের” বলে অপমান করেনা। আস্তে আস্তে তারা হয়ে উঠছে বন্ধু। স্বপ্ননগরের নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে আত্মসম্মানবোধ নিয়ে।
সংগঠকদের চেষ্টা রয়েছে, স্কুলটির আয়ের একটা নির্ভরযোগ্য ও টেকসই উৎস বের করার। শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন বিষয়, পদ্ধতি চালু করার চেষ্টা চলছে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মানোন্নয়নের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে আস্তে আস্তে স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন তার স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
নিলয় দাশ
মন্তব্য
স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের উপায় কী?
সৌরভ কবীর
স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতনের একটা facebook group আছেঃ https://www.facebook.com/groups/swapnanagar/
স্কুল সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যাবে এখানে। সংগঠকদের Contact Details ও আছে।
স্বাগত উদ্যোক্তাদের। অধিকার বঞ্চিতদের মাঝে জ্ঞানের আলো বিতরণের এ মহতি প্রচেষ্টার উত্তরোত্তর সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করছি।
সাত্তার হোসেন
স্কুলটির জন্য শুভকামনা। এই উদ্যোগগুলো সমাজকে আলোকিত করার কাজে সাহায্য করে।
লেখাটি হুবহু ফেসবুক নোট হিসেবে পূর্বপ্রকাশিত হয়েছিল দেখা যাচ্ছে। নীতিমালা অনুসারে পূর্বপ্রকাশিত লেখা সচলে দেয়া যায় না। ব্যাপারটা খেয়াল রাখার অনুরোধ রইল।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ফেসবুক নোটটা সরানোর কথা ভুলে গিয়েছিলাম। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখিত।
নিলয় দাশ
দারুণ উদ্যোগ।
শুভকামনা।
নতুন মন্তব্য করুন