আমার মৌসুমি ফল আস্বাদনের চাহিদা আর সামর্থ্যের লেখচিত্র যখন দুই মেরুর দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে যাত্রা শুরু করেছে তখন তাদেরকে একটি বিন্দুতে ছেদ করানোর মহান ব্রত নিয়ে হাজির হল বন্ধু ফাহিম, যার পিতা-হুজুর দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার কারবুরিডাঙ্গা (বা এর কাছাকাছি কোন নাম হবে) গ্রামের মস্ত এক ভূস্বামী। প্রায় সব মৌসুমি ফলই রয়েছে তাঁর অধিকারে যার মধ্যে লিচু বাগানই আছে ২০ বিঘার উপরে। সেই বাগানে সবান্ধব যাওয়ার প্রস্তাবটা ছিল মেঘ না চাইতেই সুনামির মতো। তো শুভক্ষণ আর ইউনিভার্সিটির মিড টার্ম ব্রেক দেখে সেই লিচু-বাগান ভ্রমণের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেল। কারা কারা যাবে এই হিসাব করতে গিয়ে দেখা গেল আমার মতো আরও ১১ জন দুস্থ যুবক আছে যারা এই দুর্মূল্যের বাজারে মৌসুমি ফলের রস ঠিকমতো আস্বাদন করতে পারছে না। সুতরাং যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল ওরা ১২ জন।
আমেরিকান স্থপতি রবার্ট বাউঘের স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আমাদের নির্ধারিত ট্রেন ছাড়ার কথা রাত সাতটা বেজে চল্লিশ মিনিটে। কিন্তু সময়ের ট্রেন সময়ে ছাড়লে সেটা তো আর বাংলাদেশ থাকে না। সুতরাং আমাদের ট্রেন ‘দ্রুতযান এক্সপ্রেস’ গন্তব্যের উদ্দেশে নির্ধারিত সময়ের মাত্র(!) ছয় ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট দেরিতে, রাত ২ টা বেজে ২০ মিনিটে ছন্দময় শব্দ সহযোগে যাত্রা শুরু করল।
বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই ট্রেন জিনিসটাকে আমার কখনোই জড়যান বলে মনে হয় নি। অন্যান্য যানবাহন থেকে এটা রহস্যজনকভাবে আলাদা। আমার তো মনে হয়, আমরা ট্রেনে চেপে বসি না বরং ট্রেনই আমাদের উপর চেপে বসে। ট্রেনের জানলা থেকে হু হু করে ঢুকে পড়া বাতাস, কখন যে মনের ভেতরও হু হু করে বইতে শুরু করে টেরই পাওয়া যায় না। রাত যত গভীর হয় ট্রেন তার যাত্রীর সাথে তত ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। কখনো সে মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা শৈশব, কখনো ফেলা আসা শহর, আবার কখনোবা ভুলে যাওয়া প্রেয়সীর চুলের গন্ধ।
আমাদের ট্রেন ছুটে চলতে শুরু করার পর প্রথমেই আমরা দেখতে পেলাম রাতের এক অন্যরকম ঢাকা। আপনি শহর দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু শহরের গর্জন সহ্য করতে হচ্ছে না, এই অনুভূতিটা অসাধারণ। দেরি পুষিয়ে নেয়ার জন্যই বোধ হয় ট্রেনটা তার সচরাচর গতির চেয়ে একটু বেশী গতিতেই ছুটে চলছিল। জানলা দিয়ে দেখা সোডিয়াম আলোর শহর, অন্ধকার গ্রাম, ভোরের আলোয় জেগে ওঠা জনপদ, সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে কর্মঠ হওয়া মানুষ, এই দৃশ্যগুলোর ক্রমবিবর্তনে দুপুর ১২টার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম দিনাজপুর শহরে। সেখান থেকে অটোরিকশায় দিনাজপুর বাস-স্ট্যান্ড, তারপর বাসে করে বীরগঞ্জ। সেখান থেকে আবার অটোরিকশা করে গোলাপগঞ্জ, তারপর ভ্যানে করে কারবুরিডাঙ্গা।
দীর্ঘ প্রায় ১৪ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষ করে যখন আমরা প্রথম লিচু বাগান দেখলাম, আমাদের ক্লান্তি নিমিষেই ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল। বন্যা আক্রান্ত জনপদ যেমন ত্রাণের নৌকা দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমরাও তেমনি লিচু বাগানে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। যে কোন গাছ থেকে যত ইচ্ছা লিচু খাওয়া যাবে এরকম পরিস্থিতিতে আগে কখনো পরি নি বলে কিছুটা দিশেহারা হয়ে গেছিলাম সবাই। তারপর দ্রুতই এই মধুর পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে লেগে গেলাম লিচু সাবাড় করতে। ফাহিম কথা দিয়েছিল আমাদের মধ্যে কেউ যদি একটা গাছের লিচু সাবাড় করতে পারে তবে অর্ধেক লিচু বাগান তার নামে লিখে দেয়া হবে। ঘোষণা শুনে ঐ ছোকরাকে ‘অকাল-তত্ত্বজ্ঞানী’ মানব মনে হলেও বাস্তবে ১২ জন হাট্টা-কাট্টা যুবক মিলেও শেষ পর্যন্ত একটা গাছের অর্ধেকও সাবাড় করতে পারি নি।
লিচু ভক্ষণের প্রাথমিক পর্ব শেষ হতেই শুরু হল শ্যালো মেশিনের উঠানো পানিতে গোসল করা। আমার জন্য সম্পূর্ণ আনকোরা অভিজ্ঞতা। দিনাজপুরের উত্তুরে গরমের মধ্যে শ্যালো মেশিনের ঐ ঠাণ্ডা পানি একেবারে বেহেশতের হাউজে কাউছারের পানি বলে মনে হচ্ছিল। এরকম একটা পরিস্থিতিতে ১২ জন যুবক আর কতক্ষণ ভদ্রলোকের মতো আচরণ করতে পারে? আমাদের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা পশু গুলো দিগুণ উৎসাহ নিয়ে জেগে উঠল। তারপর শুরু হল যাকে বলে অশ্লীল দাপাদাপি। দলের মধ্যে সবলেরা তাদের বিভিন্ন অতৃপ্ত বাসনা চরিতার্থ করার জন্য বেছে নিল অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের। তারপর ঐ ঠাণ্ডা জলের তলে চলতে থাকল আইয়ামে জাহেলিয়াত।
গোসল পর্ব শেষে ভোজন পর্ব সেরে আমরা বেড়িয়ে পরলাম ঘুরতে। গ্রামের মেঠো-পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা খোলা মাঠের মতো জায়গায় গোল হয়ে বসলাম। একদল আবার বাগান থেকে লিচু নিয়ে আসল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে সেদিন আমরা নিঃশ্বাসের সাথে অক্সিজেন না নিয়ে লিচু নিচ্ছিলাম। এই পর্যন্ত সব কিছু ঠিকই চলছিল। বেহেশতে যেতে না পারলেও বেহেশত কেমন হতে পারে তার একটা আন্দাজ তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু অত্যধিক লিচু জনিত ধকল সইতে না পেরে আমার এবং অন্যান্য অনেকেরই পাকস্থলী মহাশয় বসল বেকে। খুব দ্রুতই স্বর্গ থেকে নরকে পতিত হলাম। দ্রুত দৌড় লাগালাম টাট্টিখানার দিকে।
রাতে আমাদের থাকার জায়গাটা ছিল অদ্ভুত সুন্দর। বাগানের মধ্যেই একটা লিচু গাছের নিচে ক্যাম্পের মতো তৈরি করা হয়েছিল। ইচ্ছে হলে গল্প করছি, গান করছি আর কি করছি সেটা তো জানেনই, লিচু খাচ্ছি। ঘুমানোর আগে আবার গ্রাম ঘুরতে দল বেধে বেড়িয়ে পরলাম। এক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গী হলেন ফাহিমের নতুন ভাবী। ঘুটঘুটে অন্ধকার, গ্রামের মেঠো-পথ, মাঝে মধ্যে বাঁশ-বাগান; ভুতের গল্প করাটা তখন ফরজে কিফায়া, মানে কেউ ভুতের গল্প শুরু না করলে সবার গুনাহ হবে। সুতরাং গুনাহর হাত থেকে বাঁচতে শুরু হয়ে গেল ভুতের গল্প। ফাহিমের নতুন ভাবী এবং আমাদের মধ্যকার জিসান সবচেয়ে বেশী ধরাশায়ী হল এই গল্প পরিক্রমায়। মনে মনে ভূতের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম ভূতের ভয় নামক একটা সুন্দর জিনিস উপহার দেয়ার জন্য।
রাতটা ক্যাম্পে কাটিয়ে সকালে উঠে জানলাম আমাদের জন্য মুরশেদি গানের আয়োজন করা হয়েছে। এক পাগলাটে কিশোর যার কণ্ঠে সোঁদা মাটির গন্ধ, একের পর এক মুরশেদি আর বিচ্ছেদী গান শুনিয়ে গেল। বুঝলাম আমরা যত আধুনিকই হই না কেন এইসব গান ঠিকই আমাদের ভিতরে বসত করা আরেকটা আদিম মানুষকে ঠিকই আকর্ষণ করে। আমাদের রওয়ানা দেয়ার সময় ঘনিয়ে আসছিল। রওয়ানা দেয়ার আগে ফাহিমের আব্বা আমাদের বলছিলেন এই বাগান গড়ে তোলার শুরুর দিকের কথা, বাগান দেখাশোনার কথা এবং মানুষকে বিশ্বাস করার দর্শনের কথা। কোন নাড়ির টান নেই এমন একটা অচেনা অজানা গ্রামের প্রতি উনার দায়বদ্ধতা দেখে সত্যি একটা অসাধারণ ভালোলাগা কাজ করে।
ফুরিয়ে আসছিল বেহেশতি এই বাগানে থাকার সময়। নিভে যাওয়ার আগে মোমবাতি যেমন একবার দপ করে জ্বলে ওঠে আমরাও তেমনি শেষ বারের মতো বাগান ঘুরে আমাদের লিচু-তৃষ্ণা মিটিয়ে নিলাম। শ্যালো মেশিনে আরেকবার গোসল করার সুযোগ পাওয়া গেল যাওয়ার আগে। আগের দিনের চেয়ে আরেকটু বেশি বাড়াবাড়ি না করলে তো আর ইজ্জত থাকে না। তাই কে যেন শুরু করল কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি। ব্যাস, আর যায় কোথায়, শুরু হয়ে গেল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আমাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালো ছেলে আরিফ সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছিল না দেখে আমি আমার দু’মণি শরীর নিয়ে ওকে ধাওয়া করলাম। এরপরের ঘটনা হৃদয়বিদারক। বাকি এগারোজনের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত আরিফ কাঁদতে শুরু করার আগ পর্যন্ত তার উপর কাঁদা-বর্ষণ চলতেই থাকল।
চলে এলো বিদায়বেলা। বিদায় নেয়ার আগে চাচা আমাদেরকে বললেন, ‘পরের বছর কিন্তু আবার আসতে হবে।’ আমরা মনে মনে এই সুবর্ণ সুযোগ না হারানোর প্রত্যয় নিয়ে উনাকে জানালাম, ‘সেটা বলাই বাহুল্য!’ আবার আসিব ফিরে, এই শত-সহস্র লিচুর ভীরে...
# হিল্লোল
মন্তব্য
ফুটো কই? লিচু বাগানের ছবি দেন।
ছবি দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সচলের নিয়ম-কানুন ঠিক মতো বুঝি নাই বলে দিতে পারি নাই। এইখানে একটা দেয়ার চেষ্টা করলাম। জানি না হবে কিনা?
ছবি আসে নাই ভাইডি। এখানে ছবি যোগের পদ্ধতি বলা আছে-
http://www.sachalayatan.com/node/435/
দেখি আপনার দেয়া চোথা কাজে লাগল নাকি?
এত্ত জোস করে কীভাবে লেখেন???? এরকম টাইপের লেখায় এক্কেবারে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ ধরে রাখা কিন্তু বিশাল ব্যাপার! লেখালেখি চালিয়ে যাবেন অবশ্যই!
অনেক অনেক ধন্যবাদ। লেখালেখি জারি রাখার চেষ্টা থাকবে।
ফটো ছাড়া কথা নাই!! পরের বার ১৩ জন যাইয়েন; সাথে আমারেও নিয়েন!!
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
আরেকটু টেকিজ্ঞান বাড়লেই ছবি দিয়ে দেব। আর পরেরবার আপনারে নেয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। ভাগের লিচু কমানোর মতো বলদ আমি না।
হিল্লোল
এক গাছের অর্ধেকও তো শেষ করতে পারেন নাই! সো, কম পড়বে না
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
আপনার লিচু বাগানের গল্প শুনে আমার লিচু খেতে ইচ্ছা করছে খুব!
সত্যি খুবি মজার করে লিখেছেন , কিন্তু এর মাঝেও গল্পের গাম্ভীর্য রক্ষা পেয়েছে !
ওহ! আই জাস্ট লাভ ইট !
অনেক ধন্যবাদ উচ্ছ্বসিত মন্তব্যের জন্য।
হিল্লোল
লিচু কই???- খেলুম না...
কড়িকাঠুরে
থাক, আপনার খেলতে হবে না। আপনি দুধভাত
হিল্লোল
লিচুর মতই রসাল লেখা।
লিচুর রসের শুভেচ্ছা।
হিল্লোল
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
ধইন্যা।
হিল্লোল
শুরু থেকে ছবি খুঁজছিলাম, ছবি ছাড়া তো কেমন কেমন লাগছে এত মজার ভ্রমণগাঁথা
আমি নিজেও লজ্জিত ছবি না দিতে পারার জন্য। পরেরবার চেষ্টা থাকবে অবশ্যই।
হিল্লোল
প্রথমে লেখার প্রশংসা করি... আপনার লেখার হাত ভালো, মজা করে লিখেছেন... পাঠক হিসেবে আনন্দ পেয়েছি।
দ্বিতীয়ত প্রবল হিংসা... ঐ বারোজনের একজন কেন আমি হলাম না? লোভ হলো খুব... তবু তারপরও আপনাদের আনন্দময় ভ্রমণের কথা পড়ে ভালো লাগলো। পরের বছর কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিতে হবে
নিয়মিত লিখবেন...
লেখার শেষদিকে এসে দেখলাম আপনারা বেশ 'কাঁদা' ছুড়েছেন কারো একজনের প্রতি। এটা পড়ে খুব স্মৃতি আক্রান্ত হলাম।
সে অনেক বছর আগেকার কথা... অন্তত বছর পনেরো আগের। ভোরের কাগজে লিখতাম। মেলার একটা এসাইনমেন্ট লিখে জমা দিলাম সঞ্জীবদার কাছে। সেখানে কোনো এক প্রসঙ্গে 'কাঁদা ছোড়া'র বিষয়টা লিখেছিলাম। সঞ্জীবদা শুধরে দিয়েছিলেন... কান্না হচ্ছে কাঁদা, আর মাটি হচ্ছে কাদা... কাঁদতে চাইলে চন্দ্রবিন্দু দিবি, নয়তো চন্দ্রবিন্দু ছাড়াই চলবে...
এখনো আমার অনেক বানান ভুল হয়, কিন্তু এই বানানটা ভুল হয় না। এখন আর কাদা ছোড়া হয় না, কিন্তু সঞ্জীবদার জন্য কাঁদি মাঝে মধ্যে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
প্রথমেই অনেক ধন্যবাদ। সত্যিকার অর্থেই অনেক উৎসাহ পেলাম। নিয়মিত লেখার চেষ্টা থাকবে।
আপনি এতো সুন্দর একটা উদাহরণ দিয়ে কাদা বানানের ভুলটা ধরিয়ে দিলেন যে সজ্ঞানে কখনো এই বানানটা আর হয়তো ভুল হবে না।
হিল্লোল
আপনার লেখার হাত বেশ ভালো।
অনেক ধন্যবাদ।
লেখাটা খুব ভাল লাগল।
তবে ছবি থাকলে আরও ভাল লাগত।
একটা কথা ভেবেই খারাপ লাগছে, আমাকে যদি কেউ লিচু খাওয়ার ঐ অফারটা দিত !!
ধন্যবাদ। ছবি আসলে দিতে চেয়েছিলাম, পরেরবার নিয্যস দিব।
লিচুবাগান আছে এমন কারও সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলেন।
হিল্লোল
লিচুর ছবি থাকলে বেশি ভালো হত। তাতে ও সমস্যা নাই অবশ্য লিচু খেতে খেতে মন্তব্য দিচ্ছি
নতুন মন্তব্য করুন