স্রোত
-রাজীব মাহমুদ
ব্যাপারটার ভেতরে একটা পাপ ছিল। গভীর। স্বচ্ছ। স্থির। নিঃসঙ্গ। ...একেকটা মুহুর্তের ভেতর দিয়ে নিঃসৃত হতে হতে কেমন ভীষণ তলিয়ে যায়, আবার আলতো ভেসে ওঠে। সময়গুলোকে কখনো পাথরের মত জগদ্দল, কখনো মার্বেলের মত খেলো মনে হত। রাতের পর রাত চলে সময়ের যোজন-বিয়োজনের এই হলুদ খেলা; চোখ বুঁজে করোটির পানপাত্র-সদৃশ ডোবায় দেখে উঠি স্থিরতার গহীনে এক-বুদ্বুদ ঘেয়ো অস্থিরতা। মাঝে মাঝে এমন হয় যে রাত্রির ভারী কান্নার বাতাসে হঠাৎই নির্ভার ভাসতে থাকি...কোথায় যেন বহুদুরে গুম গুম শব্দ হয়। জানালার বাইরে শোঁ শোঁ বাতাসের ভেতর কে যেন কাঁদে। কান পেতে রই। ফুলের গন্ধ নেই, ঘুমও নেই। কাজলা দিদি কোন দূরের তুষার-ঝড়ে হারিয়ে গেছে। আমি কান পেতে রই। দীর্ঘক্ষণ। বহুক্ষণ। সারারাত। গাঢ় নৈঃশব্দ ছাড়া আর কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়না।
সকালটা আসে দূরদেশে বসে অসুস্থ্ জননীর হঠাৎ আরোগ্য লাভের খবরের মত; চারপাশের বাতাস কেমন হাল্কা হয়ে চোখে ঝাপ্টা দেয়। রাতে জমে থাকা গভীর বিষাদ কেমন ছিন্নভিন্ন পালিয়ে যায়, থাকলে যেন অপমানিত হবে এই ভয়ে। আবার বলা যায় সমুদ্রের তলদেশে ছিলাম এতক্ষণ-ভুশ করে ভেসে উঠে সুর্যের আলোর ভেতর গড়িয়ে পড়ি; হাল্কা আলস্যে উঠে বসি, তছনছ হয়ে যায় অর্ধস্বচ্ছ জানালার শার্সি থেকে প্রতিসরিত আলোর রেখা।
চোখ কুঁচকে দেখি জানালা গলে ঢোকা ভীষণ রোদ ।
প্রতিদিন ভোরে বিছানা ছেড়ে মনে হয় আজ আর কোথাও যাবনা। কাজটাজ পড়ে থাক সামনের লনে গা এলিয়ে পড়ে থাকা বুড়ো চেয়ারটার মত। আজও সেরকমই মনে হলো। সামনে পড়ে আছে একটা দীর্ঘ ধূসর দিন। ইউনিভার্সিটিতে যাব, ওভারকোটে ডুবে নিশ্চল বসে থাকব ক্লাসে। মধ্যবয়স্ক অধ্যাপকের ক্রমাগত ছুড়তে থাকা নিরাবেগ বাক্য একের পর এক কানের গলি পার হয়ে করোটির ভেতরে বিশুষ্ক জমতে থাকবে। ক্লাস শেষে হিম পশমের মত তুষার মাথায় নিয়ে হেঁটে যাব অবনত। পৌঁছে যাব স্টারবাক্স কিংবা ডান্কিন্ ডোনাট্স এ। কফিশপের চকচকে পালিশ করা টেবিলে ঝাপশা দেখে উঠব এস এম সুলতানের গরুর গাড়ীর উপর ডিম আলো পড়া পিচ্ছিল আভা। হট ক্রিমি কফিতে প্রথম চুমুকটা দিয়ে মনে হবে স্লো-মোশনে চলছে আমার চারপাশের জীবন, কোন তাড়া নেই। কুরোসাওয়ার ‘ড্রীম্স’ ছবিতে যেভাবে সেই ছেলেটা একটা পোট্রেট দেখতে দেখতে ছবির ভেতরে প্রবেশ করে...জীবন্ত হয়ে ওঠে এতক্ষনের জড় শস্যক্ষেত, আমিও তেমনি এই প্রায়-বর্গাকৃতি জড় কফি-শপে ঢুকে একে জীবন্ত করে তুলেছি। আমি জীবন্ত করে তুলেছি? এই মার্কিন কফি-শপের কাউন্টার আমার দৃষ্টির ভেতর দিয়ে এস এম সুলতানের পোর্ট্রেট হয়ে গেছে? হা হা হা। আমি কে গো? আমি কে?
কে আবার? তুমি একজন ভবঘুরে নিঃসঙ্গতা। তোমার মত নিঃসঙ্গ আর কেউ নয়। কেউ না। কাফকা, জয়েস...কেউই না। এভাবে হেঁটে বসে আলস্যের গভীর ঘোরে একটু একটু করে ছিঁড়ে যেতে দেখবে দিনটাকে...এরপর আসবে সন্ধ্যা...রাত নামার আগে হঠাৎই নিজেকে প্রশ্ন করবে তুমি কেন বেঁচে আছ। প্রশ্ন করবে এরকম সাদা নিদাগ মুহুর্তগুলো তোমার মধ্য দিয়ে কেন পার হচ্ছে...এগুলো তো যাপন করে দেখার কিছু নেই। বিছানায় শুয়ে-বসেই গুটিয়ে আনা যায় দিনব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সময়ের বয়স্ক পুরণো জালটাকে।
দুধে ভেজা ঠান্ডা পাউরুটির রস চাবাতে চাবাতে বাইরে পনির রঙা আলোয় আমার এ্যাপার্টমেন্টের পেছনে দেখি ছায়া ছায়া পার্কিং লট। একটা ঢ্যাঙা সাদা মাঝবয়েসী আমেরিকান বিশাল এক কাপড়ের ব্যাগ তার সাদা ভ্যানে (এদেশে মাইক্রোবাস্কে বলে ভ্যান) ঢোকানোর চেষ্টা করছে। আমার করোটির ভেতরে রাত জাগা ভারী শূণ্যতা।
ফ্রিজ খুলে স্মির্ন অফ এর লাল বোতলটা বের করে ঢক করে র’ এক পেগ গলা দিয়ে নামিয়ে দিলাম। আমার রুমমেট একরাশ ঘুম চোখে উস্কোখুস্কো চুলে কিচেনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে। সাদা গেঞ্জিটা লুঙ্গি থেকে উপরে উঠে গেছে; পেটের বাদামি মেদ বিশাল একটা বাদামী ফোল্ডেড কন্ডমের মত বেরিয়ে আছে।
“ঘুমান নাই রাত্রে?” রুমমেট বলে।
“হুম ঘুমাইসি”। কথাটা অর্ধসত্য, বলি এমনভাবে যেন কোন হেঁটে যাওয়া সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে থাকার সময় গুরুত্ত্বহীন কারও কুশল বিনিময়ের জবাব দিচ্ছি।
রুমমেট ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা ফলের রস খায়। জানালার ফ্রেমে চোখ রেখে হাই তোলে। লুঙির গিঁট খুলে আবার পরে। এ সময় তার ফোন বেজে উঠলে স্ক্রীনে চোখ বোলাতে বোলাতে সে দ্রুত ভেতরে চলে যায়। যাবার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিতে ভোলেনা । তার রুমের দরজা নাই; লিভিং রমের স্পেসটুকুতেই বিছানা বালিশ নিয়ে তার সংসার। ইদানীং সে গভীর রাতে কার সাথে যেন কথা বলে। চাপা ঘন স্বরে বলা বাক্যগুলো থেকে একেকটা দলছুট শব্দ-বাক্য আমার কানে ফিশফিশিয়ে ভেসে আসে। গত পরশু রাতে টেনে টেনে হাল্কা চপল গলায় রুমমেট ফোনে বলছিলো, ‘তা-ই? আমার তো মনে হয় তোমার মনটা অনেক নরম। পনিরের মত।’ এরপর যেন দারুন এক উপমা দিয়েছে এরকম আত্মপ্রশংশা-মাখা ভীষণ ভেঙ্গে পড়া আবেগে হি হি হি...ন...তিহি তিহি করে হেসে ওঠে। মেয়েটা এখানকার অভিবাসী বাঙালী। নিউ ইয়র্কের একটা কমিউনিটি কলেজে সাইকোলজি না কি যেন পড়ে। শ্রীমান রুমমেট প্রথম ২ দিনের আলাপেই জেনে নিয়েছে মেয়েটার এখানের জীবনের জমা-খরচের হিসেব, বার্গার-কিং-এ পার্ট-টাইম কাজে কত আসে, কলেজে পড়তে কত খরচ হয়, বাড়ীতে টাকা পাঠাতে হয় কিনা ইত্যাদি। এসবের সাথে তাল মিলিয়ে ভাব বুঝে চলে ‘পনিরের মত নরম’ মন বা আরেকদিন শুনলাম ‘সি ভি এস স্টোরের স্পঞ্জ কেকের মত নরম ঠোঁট’ এসব কথা। এদিকে আবার তার একাডেমিক ডিগ্রীটি নিয়ে কথা বলতে ভুল্লে চলবে কেন। মেয়েটাকে প্রায় প্রতিদিন শোনায় যে সে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের পি এইচ ডি’র ছাত্র। নর্থ আমেরিকান ইউনিভার্সিটিগুলো কত উচ্চ উচ্চশিক্ষা দেয় যা দেশে পড়ে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনাকে প্রতিটি মুহুর্তে তাচ্ছিল্য করে তার ভীষণ শ্লেষ-রসপূর্ণ বর্ণনা দিতে দিতে সে রাতে খাওয়া মাছের ঝোলের স্বাদটা মুর্হুমুহু কথার ভেতর চাখতে থাকে। তবে একটা কথা রুম্মেট স্পষ্ট জানাতে ভোলেনা আর সেটা হল এদেশীয় মেয়েমানুষ তার পছন্দ নয়। নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়েগুলো বুক-পেট-পাছা দেখিয়ে কেমন্ ‘ড্যামকেয়ার’ ভাবে চলাফেরা করে। এদেশে চমৎকার আইন-শৃঙ্খলা না থাকলে মেয়েগুলো যে দিনের খোলা রাস্তায় ধর্ষিতা হত সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই বলে হাসতে হাসতে মন্তব্য করে। গত সপ্তাহে আমার কাছে আসা একটা মোবাইল মেসেজে আসা ‘ ডু ইউ নো হু হ্যাজ আ ক্রাশ অন ইউ?’ র উত্তরে যখন সুসি নামের একটা মেয়ের নাম আসে তখন রুমমেট বলে, ‘সুসি রে চোষেণ...হা হা হা’।
আমি সিঙ্কের উপরে লটকে থাকা টিকটিকিটাকে স্থির চোখে দেখি। দিন শুরু করার অনিচ্ছাটা ভেতরে প্রবল হতে থাকে।
গতরাতে শায়লা ফোনে বলল ‘আমার ভালো লাগছে যে তোমার সাথে পরিচয় হয়েছিলো। বাক্যের শেষ ক্রিয়াপদের কালরুপটা কানের শূন্য বাতাসে ধক্ করে ধাক্কা দিল। মনে হলো খুব ঠান্ডা শীতের ভোরে কুয়াশার ভেতর হাঁটছি। বাড়ী খুঁজে পাচ্ছিনা। আমি থুতুর জলো রসটুকু অবশ গিলে বললাম, ‘তাই?’
ওর সাথে প্রথম কথা হয় এক তুষারঝড়ের রাতে। পেছনের পার্কিং লটের পাশে ফেলে যাওয়া এক বিদায়ী দম্পতির লেখার টেবিলটা তুলে এনে তার ওপর রাখা আমার ল্যাপটপে টাইপ করে করে প্রথম কথা চালাচালি ওর সাথে চ্যাটরুমে। পাশে রাখা ছিল নারকের তেলের কৌটার গড়নের ক্যাসুনাটের বক্স, একটু দূরে একটা পেটমোটা কাপ-ভেতরে স্মির্ণ অফ;। পরিচয়ের প্রাথমিক বাক্যগুলোর পর ও বলছিল ‘দেশ ছাড়লাম একটা ঘোরের মধ্যে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি এসব ভাবার আগেই সংসার শুরু করতে হল। আমার হা্জবেন্ড খুব গম্ভীর বাট কেয়ারিং ছিল। কেমন ছেঁড়াখোঁড়া কাটল ৬ টা মাস। ও সবসময়ই কেমন আনমনা হয়ে থাকত। আই ট্রাইড টু লাভ হিম। ইয়েস আই ডিড...এ লট। দেশের চেনাজানা সবকিছুর ওপর এই আমেরিকার জীবন কেমন পুকুরের উপরে ফেনার মত ভাসতে থাক্ল। আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। গ্রোসারি, উইকেন্ড, ক্রেডিট কার্ড, কুকিজ, ম্যাকারনি এন্ড চীজ, উইন্ডোশপিং...এসব জিভের আগায় চলে আস্ল....’
প্রায় প্রতিদিন কথা হত। আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে আরও অতলের তুমি। নরম কবিতার বিচ্ছিন্ন পংক্তি, রিসেন্ট দ্যাখা বলিউডের একটু আর্ট আর্ট গন্ধ হিন্দি ছবি, দুপুরে রান্না করা মাছের ঝোল, উঠ্তি কোন দেশী গায়িকার ‘ভারী মিষ্টি’ গলার প্রশংসা , ঘন উষ্ণ লালা মাখা একেকটা স্পঞ্জের মত ভারী সচেতন বাক্য, গভীর রাতে ম্ম্ অস্থির চুমু, ছোট্ট করে বলা ‘ভালোবাসি’, হোম-মেড হট ডগ, কাঁচভাঙা হাসির চূর্ণ, কালকে-ফোন-করলানা-কেন অভিমান, পেঁয়াজ-ঝাঁজ কান্নার গমক, মান-ভাঙ্গানোর দীর্ঘ দীর্ঘ গড়ানো বাক্য...টুকরো টুকরো সবকিছুই ছিল দিনগুলোর মধ্যে। কথাই হয়ে উঠত একেকটা কঠিন-কোমল নির্মাণ; হঠাৎ ঝোড়ো বাতাসে উল্টেও যেত। নিভে যেত সব । কতদিন খাঁ খাঁ শূণ্যতায় ফাঁকা হয়ে গ্যাছে ঘন্টার পর ঘন্টা!
ছেঁড়াখোঁড়া অদ্ভূত মাতাল একটা সময়। আমি আর ও। ও আর আমি। নির্ভার। খুব ভারী। এরকম...দিনের পর দিন।
গভীর। স্বচ্ছ। স্থির। নিঃসঙ্গ।
শায়লা এক গুমোট দুপুরে বল্ল ‘চলে এসো না আমার এখানে। বেশী দূর তো না। ঘন্টা চারেকের রাস্তা।
“দেখি” এক শব্দে বলি।
“দেখে যাও আমি কিভাবে থাকি। বাচ্চাদের সাথে গল্প করে যাও। আমার সাথেও।
“হুম...”
ওয়েবক্যামে ওকে প্রথম যেদিন দেখলাম, সেদিন কেমন যেন নতুন এক অনানুভূত নিঃসঙ্গতা ঘাড়ের কাছে চাপ দিল; ও দেখতে আমার প্রাইমারী স্কুলের এক মিসের মত-গোলাটে মুখ, শান্ত বিষন্ন গভীর একজোড়া চোখ, পরিপাটি বেঁধে রাখা ঘন জাম-কালো চুল। দৃষ্টিটা অতলদর্শী। হাসলে কেমন দুঃখী দ্যাখাত। ওর ২ মেয়ে, বড়টার বয়স ৬, ছোটটা ৪, কলকল করে ওর চারপাশে। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে আহ্লাদ করত, ওড়না দিয়ে গাল ঘষত, ল্যাপটপের কী-বোর্ডের একটা কী চেপে দৌড় দিয়ে পাশের ঘরে চলে যেত। মনে হত একটা বিষাদবর্ণ মমিকে ঘিরে আনন্দে নাচ্ছে কিছু অন্ধ স্বপ্নভূক অলীক পাখী।
ও যেদিন প্রথম চুমু খেতে চাইল, আমার নিজেকে কেমন অচেনা মনে হল; আমার যেন চুমু খাওয়ার ঠোঁট নেই, আবেগের যথেষ্ট যোগান নেই...আমি আমার নিজের কন্ঠস্বরে কোন পরিপূর্ণ যুবককে পাইনি। মনে হচ্ছিল শৈশব পেরিয়ে এক দৌড়ে আমি পূর্ণবয়স্ক মানুষদের মিছিলে ভীড়ে গেছি, আর আমার কেমন কান্না পাচ্ছে, আমি মা কে খুঁজছি ভীড়ের মধ্যে; মা আমি অনেক বড় হবার পরও আমার স্কুলে কেনা টিফিন বক্সে করে টিফিন দিয়ে দিতেন...বক্সটার ভেতরটয় কেমন পুরোণো একটা খুব চেনা গন্ধ ছিল। ওটা যে দুপুরে হারিয়ে যায়, সেদিন মনে হচ্ছিল আমি আর কোনদিন টিফিন খেতে পারবনা। কোনদিন না। কখনো না। আমার আর কোনদিন টিফিন পিরিওডে ক্ষুধা লাগবেনা।
শায়লার কাছে খুব জানতে চাইতাম ওর ছেলেবেলার কথা, ওর বেড়ে ওঠা, ওর এ পর্যন্ত কাটিয়ে আসা জীবনটার ভেতরের গল্প । শুনতে শুনতে একেকবার ভোর হয়ে যেত। দশ বছর বয়সে ওর মা মারা যাওয়ার পর ওর জায়গা হয়েছিল ফুপুর বাড়ীতে। একবার প্রবল জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার সময় ও অলক্ষ্যে বিছানায় প্রস্রাব করে ফেলে। ফুপু সেদিন গাছের ডাল ভেঙ্গে প্রচন্ড মেরেছিল ওকে। পরদিন বাবা এসে কপালে হাত বুলিয়ে দেয়ার সময় ও ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে উঠেছিল-‘ফুপ্পি আর করবনা ফুপ্পি...আর কক্ষনো পেশাব করবনা...আমাকে মেরোনা ফুপ্পি’। ও বলে যেত, “বাবা চাপাস্বরে চীৎকার করে উঠেছিল ‘মা কী হয়েছে গো মা? কে মেরেছে তোকে?’ বাবার কথাগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎই কেমন ফাঁকা লাগছিলো সবকিছু, হঠাৎ বুঝলাম বাবা পাশে নেই। রান্নাঘর থেকে বাবার উচ্চকন্ঠ চীৎকার শুনলাম; শেষের দিকে বাবার গলা কেমন ধরে এলো বলে মনে হল। ফুপু স্থির থমথমে গলায় কি যেন বলে থেমে যাচ্ছে, আবার বলছে। কানের বাইরে কেমন ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনি। এরপর হঠাৎই নিজেকে একটা চলন্ত কিছুর মধ্যে আবিষ্কার করি...বাবার ব্যবহার করা আতরের গন্ধ নাকে পাই...চোখ খুলে দেখি আমার মাথা বাবার কোলে...বাবার চশমার কাঁচ ঘোলা... আই রিয়্যালাইযড্ দ্যাট আই ওয়ায গোইং হোম।”
ও ফোন রেখে ঘুমাতে গেলে আমার মনে পড়ে অনেক ছোটবেলায় এক মেঘলা দুপুরে আমি একটা কিশোরী মেয়েকে আমাদের পাশের বাড়ীর ছাদে কতদিন একলা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। চোখ দু’টি বিষন্ন, ভীষণ একা যেন। আমার অনেক ইচ্ছে করত ওর সাথে কথা বলতে। একেকবার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম যে এক দৌড়ে ওদের ছাদে উঠে ওর মুখোমুখি দাঁড়াব। শেষ মুহুর্তে একটা অসম্ভব দ্বিধা আমার পা থাকে মাথা গ্রাস করে নিল। আর যাওয়া হয়নি। কখনো না।
সময়টার কথা ভাবলে ‘ভেতরে একটা ঘুর্ণি পাকিয়ে উঠত।’ শায়লা বলত। ‘মনে হত ওটা কেমন অলক্ষ্যে বয়ে যাওয়া একটা জলের রেখা...গড়াতে গড়াতে কোথায় কতদূর পৌঁছে গ্যাছে। মাঝে মাঝে মনে হত অতীতটা কোন গল্পে পড়া, আমি ওতে বিলং করিনা। আমার বর্তমানই আমার অস্তিত্ত্ব; আমার মেয়েরা, ওদের স্কুল, বইখাতা, পেন্সিল, ওভেন, ফ্রিজ, লাইজল, ক্যাসুনাট, ব্রোকোলি এইসব। অতীতের অতীতটুকুতে আমাকে পাইনা আমি।’
কয়েকদিন পর এক বৃষ্টির রাতে ও বলছিল, “আমার কন্জুগাল লাইফটাকে আমার একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির মত মনে হয় জান... আমেরিকা আসার পর আমার মনে হত কেমন আলগা ভাবে বেঁচে আছি। আমার হাসব্যান্ড আস্তে আস্তে কেমন পাথরের মত হয়ে যাচ্ছিল। আমার জন্য ওর সময় নাই... ভীষণ ব্যস্ত... সারাদিন যেন একটা মেশিনের সাথে আছি এমন মনে হত।...আমার কলেজ লাইফ এ একটা ছেলে আমাকে প্রতিদিন রাতে ফোন করত...আমি কখন কোথায় যাই কি করি কার সাথে কথা বলি সবকিছুর উপর নজরদারি করত...আমাকে বলত আমাকে বিয়ে করে পকেট এ রেখে দেবে...আমি শুনে ভীষণ রেগে বলতাম ‘আমি কি ঘড়ি না কলম যে আমাকে পকেটে রেখে দেবেন’। আমার বিয়ের পর ছেলেটা পাগল হয়ে গিয়েছিল প্রায়...আমার এখন মনে হয় ওর অভিশাপেই বোধহয় আমার জীবনটা আজ এরকম...বিলিভ মে আই ট্রাইড মাই বেস্ট টু মেক মাই হাজবেন্ড হ্যাপি...আই ট্রাইড টু ইভেন কোপ আপ উইথ হিজ ফ্রিজিডিটি...ইউ নো হি কুড নট মেক লাভ অন বেড...দিনের পর দিন আমি ওকে আগলে ধরে বসে থেকেছি...হি ইউজ্ড টু লাই অন মাই ল্যাপ লাইক এ বেইবি...কোল্ড অ্যান্ড হেল্পলেস।’
ওর সাথে কথা হত যখন তখন। সকাল।দুপুর।গভীর রাত।
ছুটির দিনে গ্রোসারি করতে গেলে খুব অচেনা লাগত সবকিছু। মনে হত এই মাল্টার মত ছড়ানো রোদ, সাদা সাদা পেলব নারী-শিশুর স্বচ্ছন্দ হেঁটে যাওয়া, মাঠে ঘেমে ঘেমে খেলতে থাকা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলোর কলকাকলী...সাজানো কাঠের বাড়ীগুলোকে দু’পাশে রেখে বয়ে যাওয়া শান্ত রাস্তা এসবের ভেতরে যেন ছড়িয়ে আছে একটা অবহেলায় যাপিত জীবন...শূণ্য দৃষ্টির ভেতরে ঝুলে থাকা একেকটা সো কল্ড রিয়েল ওয়ার্ল্ড ম্যাটার। এসব কোন কিছুই ছোঁয় না আমাকে। একটুও না।
আমি একটা নির্লিপ্তির মধ্যে থেকে কিন্তু মনোযোগ একটুও না টলিয়ে ওর কথা শুনে যেতাম। নিঃশব্দেও বটে। শুধু মাঝে মাঝে যখন এই নৈঃশব্দ নিজের কাছেই অসহনীয় ঠেকত তখন, তখন ‘হুম’ বা ‘তারপর’ এরকম বলতাম। শায়লা বলে যেত অনর্গল। ওর বিয়ের আগের জীবন। কৈশোর। শৈশব। হঠাৎ আবার গতকালে ওর বাচ্চার কোন দুষ্টামির কথা। সময়ের ল্যাপ্স থাকলেও ভেদরেখা নেই। একটা টানা বয়ান।
ওর একেকটা বাক্যের সাথে আমি একেকবার একটা করে জার্নি করে আসতাম। ফুপুর বাড়ী থেকে ফিরে ও বাবার বাড়ীতে ছিল কয়েক মাস। তারপর বাবা বিয়ে করলেন। ওর জায়গা হল প্রচন্ড রক্ষণশীল মামা-মামীর কাছে। একদিন ওর বাবার বাড়ীতে মামী নিজেই এসে ওকে বল্লেন সব গুছিয়ে নিতে। সেই ওর বাবাকে মোটামুটি একেবারে ছেড়ে আসা।
উকিল মামার গোছানো সংসারে এসে সবকিছু বদলে গেল। বাড়ীতে থেকেও বাড়ীতে নেই—এই বোধের সাথে আস্তে আস্তে ও অভ্যস্ত হয়ে গেল। মামাত ভাইটা ওর চেয়ে ৮ বছরের বড়। ভীষণ স্নেহ করত ওকে। প্রতিদিন চকলেট দেয়া থেকে শুরু করে পড়া দেখিয়ে দেয়া, মেলায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, পরীক্ষায় ভালো করতে না পারলে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়া; মামাত ভাইটির এই স্নেহ বাড়ীর এই গুমোট পরিবেশে ওর জন্য একটা প্রতিনিয়ত স্বস্তির ছায়ার মত। মামী মাঝে মাঝে স্থির চোখে তাকিয়ে দেখতেন ওদের দিকে; লম্বাটে মুখটা একটা লালাভ ছায়ার ভেতর তিরতির করে কাঁপত। কিশোরী শায়লা কেমন কাঠ হয়ে যেত সেই দৃষ্টির সীমানার ভেতর। মামাত ভাইটা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে কেমন আনমনা হয়ে যেত বা অন্যমনস্কভাবে লজ্জা পেত।
এক চৈত্রের দুপুরে সবকিছু কেমন একটানে ছিড়ে গেল। খালি বাসা। মামী গেছেন তাঁর এক দুসম্পর্কের খালার বাসায়। মামা কোর্টে। মামাত ভাইটি কেমন অস্থির ভাবে শায়লার ঘরে এসে পায়চারি শুরু করল। যেন সে একটা অন্ধকার গুহায় ঢুকে পড়েছে। বেরুনোর পথটা সামনেই উজ্জ্বল পড়ে রইলেও ভেতরের অন্ধকার তাকে কেমন জড়িয়ে ধরে। বাইরের টানটান বিকট সূর্যের আলো যেন ওকে অন্ধকারের কোমল অস্থি থেকে টেনে বের করে এনে গাছে ঝুলিয়ে ঠা ঠা হেসে উঠতে চায়।
ভাইটা হঠাৎই পেছন থেকে এসে ওর চুলে হাত বোলাতে থাকে। ওকে আপুনি বলে ডাকত। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, “আপুনি কি করিস?” শায়লা স্কুলের বাড়ীর কাজ করছিল। খাতা থেকে মুখ না তুলে উত্তর দিল, “হোমওয়ার্ক করি ভাইয়া। সন্ধ্যায় আজকে ঝুমিদের বাড়ীতে যাব। ওর বড় আপুকে দেখতে বরের বাড়ী থেকে লোক আসবে।” সেই দুপুরে মামাতো ভাই যখন ওর বিনুনি টেনে, গাল টিপে সবসময় যেরকম আদর করে সেরকম করছিল...তখন ও আর কিছু ভাবতে পারেনি, আসলে ভাবতে শেখেনি।
...হঠাৎই কয়েকটা মুহুর্ত কেমন জোর করে ঠেলে ঢুকে পড়ে ওই দীর্ঘ ছড়ানো দুপুরটার মধ্যে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করে; ফ্রকের ঝালরে ঢেকে যাওয়া মামাত ভাইয়ের মুখটা আর দেখতে পায়না। শুধু বোঝে ওর সাদা ফ্রক ভিজে উঠেছে ভাইটির নোনা ঘামের স্রোতে।ওর খুব ইচ্ছে করছিল ভাইয়ার স্নেহ-ঝরা দৃষ্টিটা এক পলকের জন্য দ্যাখে। কিন্তু ভাইয়া এমন করছে কেন? বাইরে আকাশটা কেমন কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছিল। ঘরটা অদ্ভূত ছায়া ছায়া আর ভীষণ অস্পষ্ট চারপাশ। বাইরের হু হু বাতাস শোঁ শোঁ শব্দে ভেতরে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। প্রথমে ২ ৩ ৪ ৫ টা পৃষ্ঠা উড়িয়ে পুরো অংক খাতাটাই উড়ে ছিটকে পড়ল মেঝেতে ওর পাশে। অস্পষ্ট খামচে ধরা অন্ধকারে ভীষণ ঘর্মাক্ত একটা মুখ দেখে ও। মানুষটাকে কেমন অচেনা দেখায়; বন্য কিন্তু অসহায়; লম্বা কালো শরীরটা নিয়ে গোঁ গোঁ করে কিশোরী বোনকে সাপটে ধরে ওর বুকের উপর কান্নার মত শব্দ করে মুখ লুকালো। অনেক রক্ত গিয়েছিলো সেদিন। মেঝে পাপোশে মাখামাখি। কিছুক্ষণ পর ভাইটা যখন উঠে দাঁড়াল, ভীষণ শান্ত লাগছিলো তাকে। দৃষ্টিটা কেমন মরা মাছের মত। ফোঁশ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখের পাতায় ঘাম নিয়ে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর ছুটে বেরিরে গিয়েছিলো
গভীর। স্বচ্ছ। স্থির। নিঃসঙ্গ।
মামাত ভাইটার এখন লিভারে ক্যান্সার । দেশের একটা সেরা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। মামা মারা গেছেন বহুদিন। মামী শয্যাশায়ী। ভাইয়ের চিকিৎসার খরচের পুরোটাই স্বামীকে বলে মাসে মাসে শায়লা পাঠায় এখান থেকে। ভদ্রলোক আইন ব্যাবসা করে প্রচুর টাকা কামান নিউ ইয়র্ক-এ। এখন এক বছরের জন্য গেছেন ইউকে তে একটা ট্রেনিং এ। শায়লা ওর ২ মেয়েকে নিয়ে একা এখন।
‘ঐ ঘটনার পর মামা কাউকে কিছু বল্লেন না। আমাকে জড়ায়ে ধরে অনেক্ষন কাঁদলেন মামা। এরপর আমাকে নিয়ে জেলা সদরের একটা বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিলেন । ছেলেকে ঢাকার কলেজে ভর্তি করে দিলেন। বাবা মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে আসলে ্মামা আমাকে আগে থেকে বাড়ীতে এনে রাখতেন। আমি বাবাকে কোন দিন বলিনি কিছু। কেমন নীরব আর বোকা হয়ে গিয়েছহিলাম। আমার কাছে আর কিছুই স্বাভাবিক লাগত না তখন থেকে। ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে জেগে উঠে পানি পানি বলে চীৎকার করতাম। মনে হত আমি একটা মাটির বাক্সে বন্দী হয়ে আছি...এখনি দরজা খুলে একটা লম্বা কালো লোক ঢুকবে আর আমাকে সাপটে ধরে দরদর করে ঘামতে থাকবে...আমার বিয়ের আগ পর্যন্ত আমি এরকম শত শত রাত কাটিয়েছি দুঃস্বপ্নের ঘোরের মধ্যে...আমার ম্যারেড লাইফ এ আমার হাজবেন্ড যখন রাতের পর রাত অনেক্ষন চেষ্টা করে এলায়ে পড়ে ঘুমায়ে যেত...আমার শরীর কুলকুল করে ঘামত।...সে যে কি কষ্ট...তোমাকে বোঝাতে পারব না...বিয়ের কয়েক মাস পর থেকে আমি স্বপ্নে আমার মামাত ভাইকে দেখতাম...কী এক অদ্ভূত বন্য আদরে আমাকে এঁফোড়-ওঁফোড় করে দিচ্ছে...উফ্ফ্ আমাকে একটু আদর কর না প্লীজ...একটু আদর কর...আর পারিনা...’
আমি হঠাৎই আমার কৈশোর-যৌবনের মাঝামাঝিতে যখন একটা ভাঙ্গা সাঁকো আবিষ্কার করেছিলাম সেই সময়টার ভেতরে সময়ের ভাঁজ গলে গড়িয়ে পড়ি। চোখ বন্ধ করে আমার ভেতরের সেঁধিয়ে বাঁচতে চাই। মনে পড়ে সেই ভাঙ্গা সাঁকো পার হতে গিয়ে সাঁতার না জানা একটা গোলগাল পোকার মত কী ভীষণ অকুল পাথারে পড়েছিলাম। মনে পড়ে সেই রাতে আমি একটুও ঘুমাতে পারিনি। পরদিন সকালে আগের রাতের আঠালো ঘুম শীতকালে জমে জাওয়া একতাল গ্লু এর মত তখনো সাপ্টে ধরে আছে আমার সমস্ত চেতনা। সকালে নাস্তার টেবিলে আস্ত ডিমের কুসুমটা মুখে পুরে মনের পর্দায় ভেসে উঠেছিল আগের সন্ধ্যায় গাউসিয়া মার্কেটে দ্যাখা এক মাঝবয়েসী গৃহবধুর স্তনের ভাঁজ । চারপাশের রকমারি আলোর ভেতর নিজেকে মনে হচ্ছিল ভয়ংকর এক কিলবিলে কীট যে নারীর স্বপ্ন-নরম স্নিগ্ধতায় বিহ্ববল না হয়ে ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠছে এক আদিম শরীরী কামনায়...রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসহ্য বাসনার গলিত আগুন। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে ঐরকম আরেকজন মহিলাকে দেখে সকালের চাপা পড়া কামনা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বাড়ীতে ফিরে বাবার ডিস্পেন্সারীর পেছনের অন্ধকার ঘরের তেল চিটচিটে বালিশের ওপর শুয়ে মনের পর্দায় ঐ মহিলার সারস-সাদা বুকের ভাঁজে মুখ গুঁজে দেই—তীব্র সুখের গণগণে জ্বালা কুসুম কুসুম বেরিয়ে আসে। দেহটা নুয়ে পড়লে দেখি ভদ্রমহিলা কেমন পবিত্র একটা হাসি হাসেন। আমি নিজের চুল খামচে ধরি...কী করলাম এটা কী করলাম...আমি নরকের কীট...আমি অমানুষ!
শায়লা আর আমি ঘন কাল্পনিক স্পর্শে বুঁদ হয়ে একটা ভীষন খর চোরাস্রোতে ভেসে যাই...
পরদিন সকালে শায়লা অনেক্ষন পরে ফোন ধরে, “হ্যালো”
“ব্যস্ত তুমি? এতক্ষন পরে ধরলা যে?”
ওপাশে নীরব। কয়েক সেকেন্ড বিরতির পর শোনা গেল, ‘না... ব্যস্ত না’
‘কিছু ভাবছ?’
‘ম্ ম্ ম্...নাহ’
‘ভাবছ একটা কিছু। বলে ফেল কী ভাবছ’
‘নিজের অজান্তেই কালকে কেমন উইন্ডোশপিং করে ফেল্লাম, তাই ভাবছি’
আমি দপ করে নিভে গেলাম। ভেতরের আলো, মায়া, স্তব্ধতা কেমন অবশ গলে গলে পড়তে থাকে। অস্ফুটে বলি, ‘স্যরি’
‘তুমি স্যরি বলছ কেন?’
‘আই থিঙ্ক আই শুড’
‘নো, ইউ শুড নট। আমি ইদানীং একটা কথা ভাবি জান...জীবনে কেউ ভালোবাসল না আমাকে...’
আমি চুপ করে নিঃসাড় শুনে যাই। কিছু বলি না । একটা অব্যয়ধ্বনিও না।
‘কী বোকা আমি না! আমি ভাবলাম তুমি বলবা তুমি আমাকে ভালোবাস...হা হা হা...’ তবে আমার ভাবতে ভালো লাগছে যে তোমার সাথে পরিচয় হয়েছিলো।’
বেহালার চাবি টাইট দিতে দিতে হঠাৎই যেন মন ভেঙ্গে দিয়ে সবচেয়ে সূক্ষ তারটা ছিড়ে যায়।
‘তাই?’
‘হুম্ম্’
‘তুমি আমার সাথে দেশে যাবা, শায়লা?
‘দেশে?’ ছোট্ট শব্দটা একটা প্রশ্নের ভার নিয়ে কেমন প্রতিধ্বনি তোলে বাতাসে।
‘হ্যাঁ, দেশে। যাবা?’
ওপাশে হাল্কা শ্বাসের শব্দ শোনা যায়, ‘থ্যাংক্স’
‘মানে?’
‘কিছু না’
‘আমি বুঝি নাই’
‘বোঝার কিছু নাই তো’
‘যাবা না?’
‘না’ ছোট্ট, অথচ ভীষণ দৃঢ়।
‘কেন?’
‘বাদ দাও না। অন্য কথা বল।’
‘চাওনা যেতে?’
‘না।’
‘প্রব্লেমটা কী?’
‘আমার মেয়েরা।’
‘ওরাও যাবে’
‘সেটা হয়না।’
‘কেন?’
‘তুমি পারলেও আমি পারব না। আমি আত্মহত্যা করতেও যদি যাই, রিনি মিনি ডাকলে ফিরে আসব।’
‘আত্মহত্যার কথা আসছে কেন?’
‘উলটাটাও যে সত্যি তাই।’
‘মানে?’
‘উফ্ফ্ তোমার এত মানের জবাব দিতে পারবনা। ওভেন এ পোলাও বসাইয়ে এসেছি। বাচ্চারা খেতে চেয়েছে। এতক্ষনে হয়ে গেছে। আমি যাই। পরে কথা হবে।’
পরে আর কথা হয়নি। দু’দিন টানা ফোন করেছি; ও ধরেনি। চারদিন পর শায়লার একটা তিন লাইনের টেক্সট পেলাম, ‘মাই হাসব্যান্ড হ্যাজ্ কাম। মাই কিড্স আর সো হ্যাপী। সো হ্যাপী।’
পরপর কয়েকটা রাত ফ্রক পরা বিনুনী করা একটা কৈশোর ছুঁই ছুঁই মেয়েকে স্বপ্ন দেখলাম। চেহারাটা ভীষণ মায়াময়। মধ্যরাতে ঘুম ছিঁড়ে যেত। বাইরে গাঢ় কালো রাত।
গভীর। স্বচ্ছ। স্থির। নিঃসঙ্গ।
মন্তব্য
# দারুন লিখেছেন-অভিনন্দন আপনাকে
ধন্যবাদ আপনাকে, পাঠ্ক। অনুপ্রাণিত হলাম।
বাহ। ভালো লাগলো।
পথিক পরাণ
ধন্যবাদ পরাণ দা। আপনার লেখাটাও আমার খুব ভালো লেগেছে। লিখে যান অবিরল এই কামনা করি
বেশ বড় গল্প। এটাকে ছোটখাট একটা উপন্যাস হিসেবেও তৈরী করা যাবে। কথক হিসেবে আপনার দক্ষতায় মুগ্ধ। তবে যেখানে যেখানে পাঠকের থামা উচিত, সেখানে প্যারাভাগটা একটু স্পষ্ট করে দিলে ভালো হতো। বিশেষ করে শেষদিকে গল্পটা যখন দুই চরিত্রের মুখ দিয়েই গড়াচ্ছে, তখন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধন্যবাদ, নীড় সন্ধানী। আপনি ঠিকই বলেছেন। এটা আমার নিজেরও মনে হয়েছে লেখাটা ছাপা হবার পর।অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
রাজীব মাহমুদ
নতুন মন্তব্য করুন