কনসার্ট রিভিউঃ "মাইকেল লার্নস টু রক"

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৭/০৬/২০১২ - ৭:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(অফিসের কাজে ফাঁকি দিয়ে লেখা। ভুল ভ্রান্তি থাকাই স্বাভাবিক)

এক
আমি আগেও খেয়াল করে দেখেছি, সত্যবাদী লোকদের মানুষজন খুব একটা পছন্দ করে না। বিশেষ করে তারা যদি আপনার সহকর্মী বা বস হয়ে থাকেন, তাহলে তো কথাই নেই। এই যেমন ধরুন, গত শুক্রবার আমি যাবো কনসার্টে। ১০,০০০ টাকা খরচ করে টিকেট কিনলাম। অফিসের লোকজন যদি ঘুনাক্ষরেও টের পেত আমি কনসার্টে যাওয়ার জন্য অফিসে আসবও না, তাহলে কি আর আমাকে আসতে দিতো ভেবেছেন? অতএব যা হওয়ার তাই হলো। আমি হঠাৎ করে মারাত্নক অসুস্থ হয়ে গেলাম। মরি কি বাঁচি ঠিক নাই। আর ফোনটাকে অফ করে এক কোনায় ফেলে রাখলাম।

যাহোক। কনসার্টের গেট ওপেন হওয়ার কথা ৫টায়। আমি ভাবলাম, অফিসে যেহেতু যাই নি, খামাখা বাসায় বসে থেকে লাভ কি? তাড়াতাড়ি কনসার্টে গিয়ে লাইন ধরাই উত্তম। অতএব বউএর সাজুগুজুর টাইম কাটছাট করে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে উপস্থিত হলাম বিকেল ৪ টা২০ এ।

ওমা! গিয়ে দেখি দর্শকের চেয়ে ভলেন্টিয়ার বেশি! সিকিউরিটির লোকেরা বললো, ৫ টার আগে লাইন ও হবে না। এমতাবস্থায় অবিবাহিত থাকলে দিব্যি মেয়ে-টেয়ে দেখে কাটিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু সাথে বউ থাকায় আর সে রাস্তা মাড়ালাম না মন খারাপ
৪০ মিনিট বেশি 'সাজগোজ না করলেই তোমাকে বেশি সুন্দর লাগে' টাইপের বউ-ভুলানো কথাবার্তা বলে পার করার চেষ্টা করলাম। বার দুয়েক টয়লেট ভ্রমনও করলাম।

ইত্যাদি ইত্যাদি করতে করতে বহু কষ্টে ৫ টা বাজলো। ঘড়ির কাঁটা ৫টা ছুঁতে না ছুঁতেই সস্ত্রীক সিকিউরিটি চেকের লাইনে দাঁড়ালাম। কিন্তু সিকিউরিটির লোকেদের তেমন একটা উৎসাহ দেখলাম না। ্তাদের হাবভাব দেখে মনে হল ঠিক সময়ে চলে এসেছি বলে আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।

অতঃপর আস্তে ধীরে লোকজন আসতে লাগলো। সিকিউরিটির লোকজন ৫টা ২০ নাগাদ তাদের ডিটেক্টর কাজ করে কিনা চেক করতে থাকলো। একজন ঢুকে, আবার বের হয়। আবার একজন ঢুকে, আবার বের হয়। এরকম চলতে লাগলো ৫টা ৪০ নাগাদ।

ইতিমধ্যে লাইনে এসে দাঁড়িয়েছে কিছু আল্ট্রা মডার্ণ ছেলে-মেয়ে। গাল-গল্প শুনে বোঝা গেল, তারা ব্রায়ান এডামসের কনসার্টেও এসেছিলো। কারণ তাদের প্রায় প্রতিটা সেন্টেন্স শুরু হতে লাগলো "ব্র্যায়ান এডামসের কনসার্টের সময় অমুক হয়েছিলো, তমুক হয়েছিলো" টাইপের কথা দিয়ে। তাদের কল্যাণে ব্রায়ান এডামসের কনসার্টে না গিয়েও সেখানে কি হয়েছিলো খুঁটি-নাটি সব জেনে গেলাম।

যাহোক। অবশেষে সিকিউরিটি গেট পার হয়ে যখন ওপাশে গেলাম, তখন ৬:১৫। আমাদের টিকেট ছিলো গ্যালারি সাইড। অর্থাৎ সেখানে গিয়ে আবার দোতালায় আরেক লাইন ধরতে হল হলে ঢোকার জন্য। ততক্ষনে দেখলাম আমাদের পিছনের "ব্রায়ান এডামস" পার্টি অন্যত্র চলে গেছে। অতঃপর আমি আর আমার বউ সজোরে আলাপ করতে লাগলাম গতবার ব্রায়ান এডামসের কনসার্টে কি হয়েছিলো হাসি

দুই
অবশেষে ৬:৩০ নাগাদ একটা চেয়ারে বসার সৌভাগ্য হলো। কিন্তু দর্শক সমাগম খুব একটা সুবিধার না। উপর-নীচ মিলিয়ে টেনেটুনে ১০০০ লোক হবে। আমাদের সিট অবস্য ভালো জায়গাতেই পড়েছে। দোতালায়, মোটামুটি মাঝামাঝি।

আমার মেজাজ অবশ্য মোটামুটি খারাপ। প্রথম কারণ দর্শক খুব বেশি না। বেশিরভাগ আসনই ফাঁকা। দ্বিতীয় কারণ, নীচে প্লাটিনাম সারিতে (একদম প্রথম সারি) তে বসে আছে খালাম্মা-নানা টাইপের বয়সের লোকজন। এরা জীবনে মাইকেল লার্নস টু রকের গান তো পরে, এই কনসার্টের আগে কোনদিন এ ব্যান্ডের নাম শুনেছে বলে আমার মনে হলো না। এরা প্রথম সারিতে বসে কি মাথা-মুন্ডু শুনবে কে জানে!

অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে ৭:৩০ নাগাদ এলো সেই প্রতীক্ষিত ক্ষণ। মঞ্চে আসলো "মাইকেল লার্নস টু রক"। তবে কিনা, একেতে দর্শক কম, তার উপর দর্শকরা যে যার চেয়ারে আটসাট হয়ে বসে আছে। একটু নড়াচড়ার উপায় নেই (মানে জায়গা নেই)। পর পর দুটো সারির মধ্যে বলতে গেলে জায়গাই নেই! এরকম চেয়ারে বসে বসে কি আর কনসার্ট জমে?

বেশিরভাগ দর্শকই কি গান হচ্ছে জানে না। গানে তাল মিলানো বা সাথে সাথে গাওয়া তো দূরের ব্যাপার। অতএব বেশির ভাগ গানই চলতে লাগলো "আমি পয়সা দিয়া টিকিট কিনছি গান শোনার লাইগ্যা, তুই গান গা। আমি গামু ক্যা?" মনোভাবের ভিত্তিতে।

আসলে কনসার্ট তখনই ভালো লাগবে, যখন সেই গায়কের সাথে বা গানের সাথে আপনার ইমোশোনাল এটাচমেন্ট থাকবে। আর কনসার্ট তো মুভি দেখার মত না, তুই গান গা , আমি দেখি। গায়ক-শ্রোতা ইন্টারএকশন না থাকলে কনসার্ট খুব একটা জমার কথা না।

আর যত যাই হোক, ইনডোর কনসার্ট, চেয়ারের মধ্যে বসে বসে কনসার্ট আর কত জমবে? এর মাঝেও ওরা বেশ অনেকগুলো গান করলো। দর্শক প্রতিক্রিয়া বলতে গান শেষে নিয়ম মাফিক কিছু তালি। আমি মাঝখানে একবার উঠে দাঁড়িয়ে গান গাইতে চাইলাম, কিন্তু পিছনে বসা কিছু লোকের আপত্তিতে আবার বসে যেতে বাধ্য হলাম।

দর্শকদের আচরণ দেখে আমার মেজাজ ক্রমে ক্রমে আরো চড়ছিলো। অবশেষে ৯ টার দিকে এম এল টি আর ঘোষণা দিলো এটাই তাদের শেষ গান। আশ্চর্যের ব্যপার, এতেও কারো কোন প্রতিক্রিয়া নেই।শেষ গান গাইলো "Some day"। সবাইই শেষ গান শুনে যে যার রাস্তা ধরলো।

কনসার্টের আসল মজা হলো ঠিক তখনই। আমার আবার স্বভাব হচ্ছে একটু দেরীতে বের হওয়া। লোকজন শেষ হতে না হতেই বের হওয়ার জন্য হুড়মুড় শুরু করে। সেটা সিনেমা হলই হোক, খেলার স্টেডিয়ামই হোক, আর কনসার্টই হোক। আমি মোটামুটি এসব ধাক্কা ধাক্কি কমলে তারপর বের হই। এবং এই স্বভাব ফাইন্যালি পেইড অফ।

কনসার্টের ৫০% এর ও বেশি মানুষ (দুই নম্বরী ভক্ত) যখন বের হয়ে গেছে, ঠিক তখনই "মাইকেল লার্নস টু রক" এর আবার আবির্ভাব। মাইকটা হাতে নিয়ে বললো You guys are leaving too soon! থেকে যাওয়া (এক নম্বুরী) দর্শকদের তুমুল হর্ষ ধবনিতে শুরু হলো "Paint My Love" মোটামুটি ৫০% দর্শক চলে যাওয়াতে আগের আর আট সাট অবস্থা আর নেই। আমি ইচ্ছামত হাত পা ছড়িয়ে নাচানাচি করছি, আর সজোরে বেসুরো গলায় গান গাচ্ছি। That was the moment of the concert! আমার বউ আর তখন মাইকেল লার্নস টু রকের দিকে নজর দিচ্ছে না, সে অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। আমার এই বাধ ভাঙা উচ্ছাস দেখেই সম্ভবত সে আনন্দ পাচ্ছে।

এরপর গাইলো "“That’s Why"। যথারীতি এই গানেও তীব্র উচ্ছাস। কনসার্টকে এতক্ষণে জীবন্ত মনে হচ্ছে। ১০০০ লোক যে কনসার্ট গরম করতে পারলো না, আমরা ১৫০ মত পাবলিক তীব্র চেচামেচিতে তা গরম করে ফেললাম।

এতক্ষনে মনে হলো, একটা কনসার্টে এসেছি, আর শৈশবের ভালোবাসা "মাইকেল লার্নস টু রক" গান গাইছে!

কনসার্টে গেসিলেন, কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই বেরিয়ে গেছেন যারা, তারা চরম মিস করেছেন দেঁতো হাসি

বাবু
Thatone4565এটgmail.com

ছবি: 
08/24/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

ফাহিম এর ছবি

রিভিউ বেশ ভালো হয়েছে! আরো কয়টা ছবি দিলেও পারতেন।

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

অতিথি লেখক এর ছবি

রিভিউ ভালো লেগেছে চলুক

হিল্লোল

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুণ মজা করে লিখেছেন, ভালো লাগলো...
ইদানিং আর এসব কনসার্টে যেতে ইচ্ছে করে না, মূলত দর্শকের আচরণের জন্যই।
গত অনেকগুলো বছরে আমি অনেকগুলো অনুষ্ঠানে গিয়ে বুঝেছি যে অধিকাংশ দর্শকই যায় শুধু 'একটা কনসার্টে যাওয়ার সুখ উপভোগ' করতে। বোঝে না কচুটাও... বিরক্ত লাগে।

এই কনসার্টের এক দর্শকরে দুপুরবেলা জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি এই ব্যান্ডের গান আগে শুনছেন কি না... জবাবে জানলাম ব্যান্ডের নামটাই তিনি প্রথম শুনছেন... কিন্তু "অনেক দামী একটা শো" তিনি দেখতে যেতে পারছেন সেই গর্বেই তিনি আনন্দিত... আর কনসার্টে থেকে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস আর ছবি আপলোডেই যাবতীয় তৃপ্তি!

ভ্রালো... ব্রেশ ভ্রালো হাসি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বন্দনা এর ছবি

তাদের হাবভাব দেখে মনে হল ঠিক সময়ে চলে এসেছি বলে আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।

হো হো হো এই ব্যাপারটা আমার খুব হয়, সময় নিয়ে আমার নিজের একদম খুব কড়াকড়ি মনোভাব, নিজে ও সময়মত যেতে চেষ্টা করি, লোকে দেরী করলে আমার মেজাজ বিলা হয়।
রিভিউ ভালো লাগছে, শেষ কনসার্ট পাইছি সেই বুয়েটে, যেই পাগলের মত নাচানাচি করছি , মেলাদিন সেই পাগলামি করিনা।

আসলে কনসার্ট তখনই ভালো লাগবে, যখন সেই গায়কের সাথে বা গানের সাথে আপনার ইমোশোনাল এটাচমেন্ট থাকবে। আর কনসার্ট তো মুভি দেখার মত না, তুই গান গা , আমি দেখি। গায়ক-শ্রোতা ইন্টারএকশন না থাকলে কনসার্ট খুব একটা জমার কথা না।

একদম ঠিক কথা।

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

আমি পয়সা দিয়া টিকিট কিনছি গান শোনার লাইগ্যা, তুই গান গা। আমি গামু ক্যা?

গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি

আপনার স্বপ্ন যে পূরণ হল তার জন্যে অভিনন্দন।

লেখাটা খুব সুন্দর লিখেছেন।

বাপ্পীহায়াত এর ছবি

খুব ভাল লাগল আপনার রিভিউ চলুক

দেশে থাকলে কোনভাবেই এই কনসার্ট মিস করতামনা
এম.এল.টি.আর -এর গান নিয়ে অনেক অনেক সুখ স্মৃতি আছে

কালো কাক এর ছবি

রিভিউ খুব ভালো লাগলো। কন্সার্টে যারা নাচানাচি চিল্লাচিল্লি করে না এরা ক্যান যায় কে জানে ! আর এখন একটা নতুন কাহিনি শুরু হইসে, যেকোন স্টেজ প্রোগ্রামে সাম্নের সারিতে কিছু খালামামিচাচাটাইপ লোকজন বসে থাকে। এরা বেশিরভাগই মনে হয় স্পন্সরদের জন্য ফ্রী টিকেটের দর্শক। হুদাই প্রোগ্রামের মজা নষ্ট করে

অনুপম ত্রিবেদি এর ছবি

মাইকেল লার্নস টু রকের গান শুনতে শুনতেই এই পোস্টটা পড়লাম। বেশ ভাল্লাগ্লো।

রিভিউ মজার হইছে মিয়া। মাগার আপ্নে এতো কিপ্টা ক্যা? একটাই ছবি দিলেন রেগে টং

==========================================================
ফ্লিকারফেসবুক500 PX

অস্বাভাবিক এর ছবি

রিভিউ ভালো হইছে । আমার MLTR এর গান দারুণ লাগে।
শুভ কামনা

তারেক অণু এর ছবি

(গুড়)

ইঁদুর এর ছবি

মজার রিভিউ হইছে!=)=)-ছবি আরো থাকলে মজাটা বেশি পাইতাম!

অনিকেত এর ছবি

সেই লাগল রে বস---
কেম্নে এইটা মিস করে গেসিলাম জানি না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।