অপরিচিত একজন লোক বারবার শরীরের দিকে তাকালে কেমন লাগে! অস্বস্তিতে ওড়নাটা বুকের ওপর টেনে দেয় তন্দ্রা। বাসে থাকলে তা-ও এসব লোলুপদৃষ্টি পাশ ফেরানো যায়, কিন্তু লেগুনায় একদম মুখোমুখি।
“হারামজাদা!”
তন্দ্রা বিরক্তি প্রশমনের জন্য বাইরে তাকায়। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের প্রশস্ত সড়ক দিয়ে একে একে ছুটে চলেছে বিভিন্ন ছোট-বড় যানবাহন। তন্দ্রা রূপালি রঙের প্রাইভেট কারগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়, মনের লুকোনো ব্যাকুলতায় ভদ্রতার স্বাভাবিক সীমাটুকু ভুলে গিয়ে ভেতরে বসে থাকা মানুষগুলোকে দেখতে থাকে। এর কোনোটির মাঝেই হয়তো বসে আছে আবীর, অফিস শেষে ক্লান্ত ফিরছে।
এ পর্যন্ত আবীরের সঙ্গে ওর যতবার দেখা হয়েছে, ততবার নিজের ওই রূপালি গাড়িতে করেই এসেছে ও। ড্রাইভারকে সঙ্গে আনে না, নিজেই ড্রাইভ করে। স্টিয়ারিং হুইল ডানে-বায়ে ঘোরাতে ঘোরাতে নিজ জীবনের গল্প শোনায়। তন্দ্রা সম্মোহিতের মতো শুনে সেসব গল্প। আবীরের বিবাহিত জীবনের নিঃসঙ্গতার মাঝে তন্দ্রা কোথায় যেন নিজেকে খুঁজে পায়, হয়তো আবীরের মতো ও নিজেও কোনো না কোনোভাবে যন্ত্রণার সেই একই জালে জড়িয়ে আছে বলে।
ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় থার্ড ইয়ারের মারুফকে ভালোবেসে ফেলে তন্দ্রা। ভার্সিটির এক কালচারাল প্রোগ্রাম করতে গিয়ে ওদের পরিচয় হয়েছিল। শফিক তুহিনের ‘এর বেশি ভালোবাসা যায় না’ গানটিতে জুটি হিসেবে নাচতে গিয়ে ওরা যে কখন বাস্তব জীবনেও জুটি হয়ে গিয়েছিল, খেয়াল ছিল না কারোরই। বন্ধুরা তো বটেই, মাঝে মাঝে স্যাররাও ওদের নিয়ে টুকটাক রসিকতা করতেন ক্লাসে। প্রতিষ্ঠান ওদের সম্পর্ক মেনে নিলেও পরিবার মেনে নিতে পারেনি। আর তাই বাবা-মা’র অমতেই মারুফকে বিয়ে করেছিল তন্দ্রা। জীবনের একটা বড় ভুল ছিল সেটা।
মারুফ যে কতটা পসেসিভ তা ও বুঝতে পেরেছিল বিয়ের পর। তাছাড়া ওর ‘ডিলেইড ইজাকুলেশন’র সমস্যাও ছিল। শারীরিক ও মানসিকভাবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল তন্দ্রার জীবন। তারপরও ও চেয়েছিল সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু পারেনি। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ডিভোর্স হয়ে যায় ওদের। তন্দ্রা তখন বুঝতে পেরেছিল, পড়াশুনাটা ঠিকমতো শেষ না করে বিয়ে করায় ও কতোটা ভুল করেছিল। অনেক ক্ষমা চেয়ে, অনেক কান্নাকাটি করে বাবা-মায়ের বাসায় আবার ফিরে আসতে পারলেও সেখানে নিজের অতীতকে আর ফিরে পায়নি ও। ভাবী কথায় কথায় খোঁটা দিত। ভাইয়ার টাকায় সংসার চলে বলে বাবা-মাও অবচেতন মনে ভাবীকে সমর্থন করত। নিজেকে তখন খুব অবাঞ্ছিত মনে হতো তন্দ্রার। মনের আঘাতগুলো চোখের অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ত। কিন্তু কাউকে তা দেখাত না ও। নিজের রুম থেকেও খুব একটা বাইরে বের হতো না। একা একা থাকত আর বারবার ভাবত- ও নাহয় একবার ভুল করেছে, তাই বলে কি আবার নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার অধিকার ওর নেই? চারপাশের মানুষগুলো এতো নিষ্ঠুর কেন, কেন তারা অবহেলিতকে আরো অবহেলার দিকে ঠেলে দেয়? পৃথিবীটা কেন এতো স্বার্থপর?
“আফা, ভাড়াটা দেন!” লেগুনার অল্পবয়সী হেল্পারের ফ্যাসফ্যাসে গলার স্বর শুনে তন্দ্রার ভাবনায় ছেদ পড়ে। দশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দেয় ও। ছেলেটা নোটটা নিয়ে আরো দুই টাকা বাড়তি চায়।
তন্দ্রা বলে, “কেন, আবার দুই টাকা কেন? গতকালও তো দশ টাকায় গেলাম!”
“আফা, সবকিছুর দাম বাড়ছে, হেইল্লেইগা ভাড়াও বাড়তি।”
যে লোকটা একটু আগে বারবার তন্দ্রার শরীরের দিকে বিশ্রীভাবে তাকাচ্ছিল সে এবার বলে উঠল, “আর বলবেন না! এদের শুধু ভাড়া বাড়ানোর জন্য একটা ছুঁতো দরকার, শুধু একটা ছুঁতো!”
“আর তোর কী দরকার হারামজাদা, কথা বলার ছুঁতো?” ঘৃণামিশ্রিত প্রশ্নটা তন্দ্রা মনে মনেই রাখল, মুখ ফুটে বের করল না।
যেভাবে দিনদিন যাতায়াত ভাড়া বাড়ছে তাতে ক’দিন পর টিউশনির সব টাকা যাওয়া-আসাতেই খরচ হয়ে যাবে ভেবে শঙ্কিত তন্দ্রা। এদিকে এখনো একটা চাকুরি জোগাড় করতে পারল না ও। নিজের এইচএসসির সার্টিফিকেটটা দেখিয়ে কোনো একটা ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানে ফ্রন্ট ডেস্কের চাকরিটা ও সহজেই নিয়ে নিতে পারে। চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তারা সার্টিফিকেটের চেয়ে ওর চেহারার দিকেই বেশি মনোযোগী ছিল। চারপাশে সম্ভবত সারমেয় পুরুষের সংখ্যা দিনদিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে!
লেগুনা স্ট্যান্ডে এসে থামতেই তন্দ্রা তরতর করে হেঁটে জনস্রোতে হারিয়ে গেল, লোকটা পিছু নিতে পারল না। ফার্মগেট এলাকাটিকে এখন ঢাকা শহরের দর্শনীয় স্থান বললেও ভুল হবে না। যেই এলাকার চতুর্মুখী ওভারব্রীজে উঠতেও লাইন ধরতে হয়, সে এলাকাকে তো দর্শনীয় বলতেই হবে! এ ছাড়া আনন্দ সিনেমা হলের সামনে বাসের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষমাণ যাত্রীদের এলোমেলো অবস্থান দেখলে তন্দ্রার বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণের প্রতীক্ষায় থাকা ভিকটিমদের কথাই মনে পড়ে। ভাগ্যিস, ওকে সেই দুর্ভোগ সইতে হয় না। ওভারব্রীজ ছাড়িয়ে একটু ভেতরে গেলেই ওদের বাসা। তন্দ্রার মতে, ভাইয়ার বাসা। ওদের বাসা হলে তো ওরও সেখানে একটা গুরুত্ব থাকত, নাকি?
বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যার একটু বেশি হওয়ায় মা চোখ রাঙালেন, “এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”
তন্দ্রা দৃশ্যটির সাথে অতি পরিচিত, তাই ওর কোনো ভাবান্তর হলো না। খুব সংক্ষেপে বলল, “টিউশনিতে।”
“এতক্ষণ কিসের টিউশনি? সেই দুপুরে বেরিয়েছিস!”
“যাওয়ার সময় তো বলেই গেলাম, স্টুডেন্টের কাল পরীক্ষা, ফিরতে দেরি হবে।” উত্তরটা দিয়েই দ্রুত নিজের রুমে চলে গেলো তন্দ্রা। ও ভালো করেই জানে- এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে এখন কথা বাড়বে।
রুমে ঢুকে ব্যাগটা টেবিলে রাখতেই ব্যাপারটা চোখে পড়ল। ওর ব্যক্তিগত ডায়েরিটা আজ ভুলে টেবিলের উপর রয়ে গিয়েছিল, কেউ এসে সেটি নেড়েচেড়ে গেছে। তবে যে এ কাজটা করেছে সে খুব সতর্কতার সাথে করতে চেয়েছিল, পারেনি। ডায়েরির ভেতরে রাখা কলমটা বাইরে ফেলেই সে চলে গেছে। এরূপ চাতুর্য-প্রদর্শনমূলক আনাড়ি কাজ একমাত্র ভাবীই করতে পারে। হিন্দি সিরিয়ালের ভ্যাম্পদের দেখে দেখে সে নিজেকেও খুব চৌকশ মনে করে। হায়রে ভাবী! ভাগ্যিস, আবীরের কথা ও এ ডায়রিতে লেখেনি। নইলে রাতেরবেলা ভাইয়া আসার পর ওকে শাসানোর জন্য ভাবী নতুন কোনো ব্রেকিং নিউজ পেয়ে যেত।
নিজের ক্লান্তি দূর করার জন্য তন্দ্রা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হাল্কা গোলাপি রঙের কোমল পর্দাগুলো দু’পাশে সরিয়ে দিলো। সহসা একটুখানি মৃদু হাওয়া এসে ওকে ভালোলাগার পরশ বুলিয়ে দিয়ে গেলো।
আচ্ছা, আবীর এখন কী করছে? নিশ্চয়ই টিভি ছেড়ে ভাত খাচ্ছে, কিংবা কিছু না খেয়েই খেলা দেখছে। ছেলেরা যে খেলার মাঝে কি খুঁজে পায়! ওর বউটা কি বাসায় আছে, নাকি ঈদের নাটকের শুটিং নিয়ে থাইল্যান্ড কিংবা নেপালের মনোরম লোকেশানে ঘুরে বেড়াচ্ছে? বেচারা! বিয়ের আগে তো প্রেম করতে পারলই না, বিয়ের পরও না। অবশ্য ও নিজেই বা কতটা পেরেছে? ভার্সিটির দিনগুলোই যেটুকু রঙিন ছিল, এর পরের চ্যাপ্টারগুলো তো ‘ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’! দুজনের গল্পটা এ কারণেই বোধহয় মেলে, দুই উৎস থেকে বয়ে আসা দু’টি নদী যেমন মিলে যায় সাগরে।
মোবাইলে ব্যালেন্স থাকলে আবীরকে একটা মিসডকল দিত তন্দ্রা। ওর নাম্বারটা আবীরের মোবাইলে একটা পুরুষের নামে সেভ করা। আবীর যখনি ওর ফোনে ওই নামটি ভেসে উঠতে দেখে, তখনি ধরে নেয় তন্দ্রা ওকে মিস করছে। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে কল ব্যাক করে, প্রতিকূলে থাকলে ফোন বন্ধ করে দেয়। তন্দ্রা বাকিটা বুঝে নেয়। তন্দ্রার অবাক লাগে, ভার্সিটির যেই মেধাবী সিনিয়র ছেলেটির প্রতি ও কখনই কোনো আকর্ষণ অনুভব করত না, সেই ছেলেটিই কি না এখন ওর সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পুরুষ! সময় সবকিছুই কেমন বদলে দেয়।
মারুফের সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর এ বাড়িতে ওর যে দুর্বিষহ দিনগুলি কাটছিল, যেই হতাশায় ও তিলে তিলে নিঃশেষ হচ্ছিল, তা থেকে আবীরই তো ওকে তুলে এনেছে। প্রত্যক্ষভাবে ও হয়তো কিছুই করেনি, কিন্তু পরোক্ষভাবে আবীর যেই সাপোর্টটা দিয়েছে, তখন তো ওর সেটারই প্রয়োজন ছিল অনেক বেশি, যা ওকে ওর কাছের মানুষেরাও দিতে পারেনি।
আবীরকে নিয়ে এখন তন্দ্রার মধ্যে দু’টি সত্তা কাজ করে। একটি বলে, তুমি যা করছ তা ভুল। অপরটি বলে, এটিই ঠিক। দ্বৈতসত্ত্বার এই দ্যোতনা ছাপিয়ে তন্দ্রা নিজেকে বোঝাতে চায়, দু’টি নিঃসঙ্গ মানব-মানবী কি একে অপরের ভালো বন্ধু হতে পারে না? হোক না সেটা সন্তর্পণে!
লেখকঃ ইফতেখারুল ইসলাম
মন্তব্য
খুব চেনা গল্প। আমাদের আশেপাশের অসংখ্য মুখের আদল।
"তোমার মনে বসত করে কয়জনা..ও মন জানে না"
ভালো লাগলো ।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
ধন্যবাদ ক্রেসিডা।
ভাল লেগেছে। আমাদের চারপাশের চেনা মুখগুলোরই যেন প্রতিফলন।
তারপরও বলব, কিসের যেন অভাব বোধ করলাম। হয়ত এত তাড়াতাড়ি গল্পটা শেষ হোক সেতা চায়নি আমার মন। চালিয়ে যান।
পরবর্তীতে বর্ণনাগুলো আরও ডিটেইল করার চেষ্টা থাকবে। আপনাকে কৃতজ্ঞতা অচেনা আগন্তুক।
#সুন্দর লিখেছেন, এগিয়ে চলুন
কৃতজ্ঞতা আশরাফ ভাই
ভালো বন্ধুর চেয়ে দুঃসময়ের বন্ধু পাওয়া খুব জরুরী । যদি সেটা পাওয়া যায় তবেই ভালো বন্ধু পাওয়া হল। এই বন্ধু যে কেউ যে কোন সময়ের জন্যই হতে পারে।
ভালো লিখেছেন । চেনা চেনা এই বিষয়গুলো গুছিয়ে বলতে পেরেছেন । ভালো থাকুন সবসময় ।
আপনাকে বলব যে গল্পে ডিটেইলের কাজটা নিয়ে আরেকটু ভাবুন। তন্দ্রার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণ হিশেবে দু'টো শব্দ বলেছেন মাত্রঃ হাসব্যান্ডের পোসেসিভনেস আর ডিলেইড ইজ্যাকুলাশন। এটা শুধুই ২ টা শব্দ মাত্র। কোন বিশ্লেষণ নেই। একটা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার জন্য বিশ্লেষণবিহীন এই দু'টি শব্দ যথেষ্ট নয়। শুধু এই একটা ব্যাপার নিয়ে একটা গোটা উপন্যাস হতে পারে।
আরেকটা ব্যাপার হল যে আবীরের কোন কোন ব্যাপারগুলো তন্দ্রাকে কাছে টেনেছিল সেটাও আপনি এক শব্দে (সাপোর্ট দেয়া) শেষ করেছেন। বিষয়গুলো সময় নিয়ে একটু বিশ্লেষনের জায়গা থেকে ভাবুন। অনেক ভালো লিখবেন আপনি।
রাজীব মাহমুদ
ভালো।
তবে শুরু করতে না করতেই শেষ হয়ে গেলো।
তবুও বলতেই হবে
কেমন একটু তাড়াহুড়া মনে হলো লেখায়। আরও গভীরতা, ডিটেইলিং থাকলে ভালো হতো। প্লটটা কিন্তু বেশ ছিল। নিয়মিত লিখুন।
বেশ তাড়াহুড়ো করে শেষ করে দিলেন,তারপরও বলবো নিয়মিত লিখুন। শুভকামনা রইলো।
tusqit
আপনার গল্পের হাত বেশ সাবলীল। একটানা পড়ে শেষ করা গেল, কোথাও না আটকেই। তবে গল্পের প্লট পরিচিত সেটা ঠিক, কিন্তু এটাকেই আরও বিস্তৃত করা যেতনা কি? তন্দ্রার মনের জটিলতা ও দ্বন্দ্বগুলিকে আরও বেশী করে ফুটিয়ে তোলা যেত মনে হয়। ভালো একটা বড় গল্প হয়ে যেতে পারতো। সেই যায়গায় একটা সাব-প্লট সম্পন্ন টুকরো কথাই হয়ে গেলো।
যাই হোক, আরও লিখুন নিয়মিত।
ডাকঘর | ছবিঘর
আমার কাছে ভাল লেগেছে, আর একটু বড় হলে ভাল লাগতো ।
হুমম
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
বর্ণনাভঙ্গি ভাল লাগল, বিশেষ করে ডায়েরির অংশটা। বিশ্লেষণটা আরও একটু বেশি হলে ভাল হত।
-চিত্রাঙ্গদা
নতুন মন্তব্য করুন