বিচ্ছেদ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৮/০৭/২০১২ - ১১:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নওসী, ভারতীয় দ্বিতীয় প্রজন্মের মিস্টি একটি মেয়ে, বাবার মতই পি এইচ ডি, ইউনিভার্সিটিতে না ঢুকে কানাডিয়ান গভর্মেন্টে উচ্চ পদে আসীন। ধুমধামের হীরের আংটির অনুষ্ঠানের প্রায় এক বছর ধরে তাদের বাড়ী কেনা, ঘর সাজানোর পরে হলুদ ও বিয়ের কার্ড পেলাম, খুব খুশি হলাম, মাতৃহারা এই মেয়ে স্বভাবগুনে সকলেরই আদরের। একটু বিলম্বে পৌছে আমার কাছে হলুদের অনুষ্ঠানের জৌলুশ কেন যেন প্রানহীন লাগছিল, বেশ অনেক টেবিল ফাঁকা, তাড়াহুরা করে খাবারের ডাক পড়লে মনে করলাম, কি জানি হয়তো খাবারের পর স্ফুর্তির গান বাজনা হবে। সেই প্রান হীন অনুষ্ঠানে অতিথীদের খাবার শেষ হবার আগেই বঁধু সাজে নওসী মাথা নত করে বৃদ্ধ পিতার হাত ধরে যখন হল ত্যাগ করলো, ঝগড়া বিবাদ ছাড়াই উপস্থিত সবাই বুঝতে পারলো বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে। স্বপ্নময় ঝলমলে খুশির বদলে বুকভাঙ্গা কস্ট, লজ্জা, অপমান এ জীবনের সকল অর্জন যেন ধুলায় লুটিয়ে দিল।

অবসরপ্রাপ্ত বাবা, হার্টের রোগি মা, উচ্চপদের কানাডিয়ান সরকারি একটি চাকরি নিয়ে পাকিস্তানি কারিন বেশ সতর্ক, সে প্রথমে খুব ইতস্তত করেছে, তার হাইস্কুলের নীরব প্রেমিক যখন উপযুক্ত চাকরি পেয়ে সরবে প্রেম নিবেদন করেছে, সে খুব দ্বিধায় ছিল। প্রেমিকের উচ্ছাসের কাছে সে দ্বীধা টেকেনি। বয়সটাও এমন, মন স্বপ্ন দেখালো, রাজি হবার সাথে সাথেই প্রেমিক পরিবারকে জানিয়ে বিয়ের প্রস্তুতি নিলো। ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাবার জন্য, অর্থাৎ ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করবে! প্রেমিকের মা এই কানাডাতেও তার ইজ্জতে আঘাতের বদলা নিল হীরের আংটির অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি তচনচ করে যখন ছেলের মা সদর্পে চলে গেল, তার পিছু পিছু অন্যান্যদের সাথে অপরাধ বোধ, লজ্জায়, মাতৃভক্ত ছেলেও যখন চলে গেল, হতভম্ভ কারিন বুঝতে পারছিল না সে কি করবে। কারন বিয়েটা এখনো সমাজের দায়, তাই সমাজের চোখ খুঁজবে, জেরা করবে ‘কার দোষ’ বা ‘ঘটনাটা কি’?

তিনটি বাচ্চা ও ফুল টাইম চাকরির মধ্য মরবারও ফুরসত নেই, হটাৎ লেবানিজ মরিয়ম অনুভব করে তার স্বামি যেন ক্রমশ অচেনা হয়ে যাচ্ছে। দুজনের ব্যাস্ত জীবনে একটু ব্রেক দিয়ে ভাবলো সব ঠিক করে ফেলবে। কিন্তু বুঝতে পারলো ওমর ও তার মাঝখানে অন্য কেউ আছে মনে হয়, আলগোছে ফোন বিলে একটি বিশেষ নাম্বারের কথা স্বামিকে জিজ্ঞেস করায়, একই বাড়িতে ওমর তার বেডরুম বদলে ফেললো। অনুভবে কস্টের মোচর পরলেও বুঝতে পারলো যে কোন সময়েই যে কোন উছিলায় বাড়ির ভিত ধ্বশে পড়তে পারে, বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে, থর থর ভয়ে মুখ বুজেই থাকতে হবে তার কারন বাড়িবদল এর থেকে অনেক বেশি কস্টের হবে।

চাইনিজ কিম হাইস্কুলের স্বাধিনতার ক্ষতিকর পথে না জেনেই হাটতে শুরু করে। প্রথম প্রেম কানাডিয়ান সাদা সহপাঠি যশুয়া বা যশের হাত ধরে কখন যে স্ট্রিট গ্যাঙ্গের অংশ হয়ে ওঠে সে নিজেও সে বুঝতে পারেনি। গ্যাঙ্গে ঢোকা যত সহজ, বেড় হওয়া ঠিক ততটা কঠিন। পরিচিত সমাজের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে, আহত, অসহায় অবস্থায়, অন্য শহরের অচেনা সহৃদয় এক পরিবারের অন্ধকার বেইজমেন্টে আশ্রয় নেয়। মাথায় ঝুলছে যশ এবং তার গ্যাঙ্গের শাস্তি পরোয়ানা। ভয়ে সে দুই বছর সুর্য্যর মুখ দেখেনি, ঐ বেইজমেন্টে তার দ্বিতীয় জন্ম। ধীরে অতি ধীরে সাহস সঞ্চয় করে, ঐ অন্ধকার মাটির নীচের ঘরে বসে বসে অনলাইনে হাইস্কুল ডিপ্লোমা করে অসম্ভব ভালো রেজাল্ট করে অন্য আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে।

ইউনিভার্সিটি তাকে সহজোগিতা করে, স্বল্প খরচের বাসা, বিভিন্ন আর্থিক সাহায্যে পরবর্তি চার বছরে কঠোর নিয়মানুবর্তিতায়, অনুশীলনে নামী হাইটেক কোম্পানীতে চাকরিসহ, সিস্টেম ইঞ্জিনীরিং এ ডিগ্রি লাভ করে। গ্রাজুয়েশান অনুষ্ঠানে আরেক বিস্ময় ছিল, হুইল চেয়ারে ভয়াবহ পঙ্গু যশকে ঠেলে নিয়ে এসে দাড়ালেন যশের মা, বাবা, প্রথমে ক্ষমাপ্রার্থি হলেন, পরে অভিনন্দন জানালেন!!ক্ষমা করলেও কিম জানে মনের গভীরে প্রথম প্রেমের রোমহর্ষক নিষ্ঠুর স্মৃতি গুলি তাকে তাড়া করবে আজীবন।

কম্পিউটার পোগ্রামার কানাডিয়ান সামান্থার একাধারে সাত বছর ধরে একই ছেলে বন্ধুর সাথে আপাত সুখী জীবনে একটি বাচ্চার অভাব তীব্র ভাবে অনুভব করে। টম বাচ্চার দায়িত্ব নিতে অপারগতা জানালে সে পোগ্রামের ‘এবং’ লজিকের পরিবর্তে ‘অথবা’ লজিক নিয়ে, চল্লিশতম জন্মদিনে সে ডাক্তার ও স্পার্ম ব্যংকের সহজোগিতায় কন্সিভ করে। একটু অলস, স্বার্থপর টম আপোশে ব্যাগ গুছিয়ে এতদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যায়। একেলা ঘরে সামান্থা অপেক্ষায় থাকে এক অমুল্য সন্তান প্রাপ্তির। নিজের ভিতরে আর একটি প্রানের স্পন্দন তাকে স্বপ্ন দেখায়, জীবন অনেক অর্থবহ করে তোলে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নার্সারি সাজায়, অনুভুতিতে পরিপুর্ন নারীর প্রশান্তি। কিন্ত দুশ্চিন্তা যখন তখন কড়া নাড়ে, অসহায়ত্বের অনুভুতি পায়ের নীচের ভিতটাকেও কাঁপিয়ে দেয়।

মার্কেটিং এর ডিগ্রি, ব্যাঙ্কে উচ্চপদের একটি লোভনীয় চাকরি পছন্দের ছেলে বন্ধু নিয়ে রাশিয়ান এমির সুখি জীবন যাপন। মুক্ত সমাজে বসবাস, সামাজিক কোন আচার অনুষ্ঠান নেই, ধর্মীয় বিধিনিষেধ নেই, লোকায়ত কোন সংস্কার ও নেই, তরুন তরুনীর দ্বৈত জীবনে নিজেদের পছন্দ অপছন্দই চুরান্ত সিদ্ধান্ত! যাপিত জীবনে ঘর দোরের সাফ সুতরো, বাজার সদাই, রান্নাবান্না, ধোয়া কাঁচা কে কি করবে, খরচের কে কতটা দেবে, প্রেমের কুয়াষায় আনন্দের আপোষে রুম মেটের মত থাকা। বাড়িটার লিজ যেহেতু রনের নামে, এমি ব্যাগ গুছিয়ে সদ্য কেনা গাড়িতে করে, সহৃদয় বন্ধুর এপার্টমেন্টে এসে প্রত্যাক্ষানের যাতনায় মুখ থুবড়ে পরে। তিন দিন পরে খবর পেয়ে অভুক্ত, অস্নাত, নিদ্রাহীন প্রায় ভাঙ্গনের প্রান্ত থেকে তার মা তাকে ফিরিয়ে আনে। প্রথমে নিঃশব্দে গভীর মমতায় তার কথা শোনেন, তার বুক ভাঙ্গা প্রশ্ন ‘আমি এখন কি করবো’? নিরুত্তরই রয়ে যায়।

ইমাম, পুরুত, যাজক, বা রাব্বি কোন ধর্মীয় শ্লোকে আত্বিক বন্ধনে বাঁধুক আর না বাঁধুক, রেজস্ট্রি অফিসে আইনি স্বীকৃতি দিক আর না দিক, সামাজিক বা লোকায়ত কোন আচার, উচ্ছলিত কোন অনুষ্ঠান হোক বা না হোক, দুটি মানুষ যখন রহস্যময় প্রাকৃতিক, জৈবিক, সামাজিক আকর্ষনে গাঁটছড়া বাঁধে, তখন তাদের মাঝে প্রেম থাকে, থাকে আনন্দ, মনে থাকে সমঝোথায় বরনের উৎসব। কিন্তু দ্বৈত জীবনে একজন তার সংগিকে যখন নির্দয় ভাবে প্রত্যাখান করে, বিচ্ছেদের আঘাতটা মেয়েদেরই লাগে বেশি। শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, স্বনির্ভর বা পরনির্ভর বিচ্ছেদের অপমানটা মেয়েদেরই সহ্য করতে হয়, সেই প্রাচিন কাল থেকেই দুনিয়ার নির্মম, নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানের চিত্র সব এক। প্রাচ্যে অশিক্ষিত, দরিদ্র, পরনির্ভর, সন্তানসহ অন্যর গলগ্রহ অসহায় নারীর জীবনটা আরো অনেক বেশি যাতনাময়। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্যে সরকারের কঠোর আইন, বিচ্ছেদের পর একাকি মায়ের পক্ষে হওয়ায় বিচ্ছেদের পর সন্তান নিয়ে অন্তত কারো গলগ্রহ হতে হয় না।

আসমা খান, অটোয়া


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বাহ!
আপনার ঝাঁপিতো দেখি অনেক সত্য গল্পে ঠাসা!! চলুক

পথিক পরাণ

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যর জন্য। গল্পগুলি খুব কস্টের। মনে দাগ কাটে।সচেতনতার আশায় লিখেছি। সমাধান জানা নেই, কিন্তু মনে মনে এর সমাধান চাই, সামাজিক মংগলের জন্যই।

সাইদ এর ছবি

প্রথম গল্পটার বিয়েটা কী কারণে ভেঙ্গে গেল???

অতিথি লেখক এর ছবি

কারনটা ঠিক জানি না। অশেষ ধন্যবাদ মন্তব্যর জন্য।

কৌস্তুভ এর ছবি

অতিথি লেখক এর ছবি

্ধন্যবাদ ।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ভরাট অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে আরও অনেক অনেক বিভিন্ন ধরনের কথা আসুক। ভাল লেগেছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যর জন্য অশেষ ধন্যবাদ।

অস্বাভাবিক  এর ছবি

গল্পগুলো এত ছোট কেন ? আরেকটু বিস্তারিত লেখা যেত না
১ ও ৬ নং গল্পটায় কার্যকারণ ঠিক ধরতে পারিনি
লেখা ভাল হয়েছে চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পগুলি আসলেই ছোট হয়ে গেছে। পরবর্তি লেখায় খেয়াল রাখবো।
সুস্পষ্ট কোন কার্য-কারন ছাড়াই এখন সম্পর্ক ভেঙ্গে যাচ্ছে। মানুষের অনুভুতি, মায়া, সহনশীলতা, সমঝোতা কি কমে যাচ্ছে?
লেখাটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য অশে ষ ধন্যবাদ।
আসমা খান, অটোয়া

অতিথি লেখক এর ছবি

আলাদা আলাদা গল্প লিখে ফেলতে পারতেন কিন্তু!
আরও লেখা দেখতে চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলে আমাকে পর পর কয়েকটি বিচ্ছেদের ঘটনা ছুঁয়ে গেছে। সমাজে বিচ্ছেদ আগেও ছিল, দৈহিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য অনেক ক্ষমতার কারনে মেয়েদের ছেলেদেরকে সমঝে চলতে হোত, সভ্য সমাজে শিক্ষা, মেধা, কর্ম দক্ষতার কারনে মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে 'সমঝে' চলার পালা বদলের কারনেই কি হচ্ছে?
চল্লিশ বছরের একটি ছেলের বিয়ের ক্ষেত্র সমবয়সের একটি মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রের অবস্থান এক নয়। কিন্ত কেন?

মন্তব্যর জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আসমা খান, অটোয়া

Guest এর ছবি

মন খারাপ হয়ে গেল। ঘটনাগুলো কি সব ই সত্যি?? যদি সত্যি না হয়ে নিছক গল্প হয় তাহলে খুবিইই খুশি হব।।

অতিথি লেখক এর ছবি

মনযোগ দিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ঘটনা সবই সত্যি। আপনার মন খারাপের জন্য নয়, সচেতনতার জন্য লিখেছি।

আসমা খান,অটোয়া

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক
tusqit

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

আসমা খান, অটোয়া

বন্দনা এর ছবি

সবগুলা ঘটনার মাঝে কোথায় যেন একটা মিল আছে। অনেকদিন পর লিখেলেন আপনি।

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। মিলটা কোন খানে আপনার মনে হয় ?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।