চল বদলে যাই : পর্ব ১

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২২/০৭/২০১২ - ৯:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

"চল বদলে যাই" কথাটা নতুন কিছু নয়| বহুবার এটা নিয়ে কথা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে, এমনকি টক-শো বাদ যায়নি বলেই আমার বিশ্বাস| আমি আমার প্রেক্ষাপট থেকেই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করছি| চারপাশে আমি কি দেখছি, আমার চারপাশের মানুষগুলো কেমন, তারা কি ভাবছে, কি বলছে তা নিয়েই শুরু করতে চাই| প্রথমে বলে নেই আমার বয়স যেহেতু ২৪ এর কোঠায় আমি নিজেকে তরুণ বলতে পারি| আর আমাদের বর্তমান অবস্থা সাপেক্ষে তরুনদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে চারিদিকে শ্লোগান, আলাপ-আলোচনা শুনতে পাচ্ছি| আলোচনা বা শ্লোগান যারা করে বা দিয়ে আসছেন তাদেরকে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখে থাকি আমাদের আগের প্রজন্মের| অবশ্য সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে তরুনদেরকেও দেখতে পাওয়া যায়| যাই হোক, আসল কথায় আসতে চাই|

চারপাশে আমি যখন তাকাই, আমার কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, মানুষগুলো বড়ই বিচিত্র| তাদের কেউ বাঙালি কৃষ্টিতে বিশ্বাসী, কেউবা ধর্মীয় রীতিতে বিশ্বাসী, কেউবা নিজেদের "স্বকীয়তা" পরিবর্তনে বিশ্বাসী! এখানে "স্বকীয়তা" ব্যাপারটা খোলাসা করেই বলি|

বাঙালি রীতিতে বেড়ে উঠেছি বলে ছোটবেলা থেকে গান শিখেছি, বাংলা গান| বাসাতে গানের চর্চা, আলোচনা সবসময় হত, এখনো হয়| ছোটবেলায় বিটিভি ছাড়া অন্য চ্যানেল ছিল বলে মনে পড়েনা| এখনো মনে আছে আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, মিনা-রাজু'র কার্টুন, আলিফ লায়লা, সিন্দবাদ, রবিন হুডের কথা| খানিকটা বড় হলাম, যখন ক্লাস ৭/৮ এ পড়ি, তখন আসলো দেশী প্রাইভেট আর বিদেশী চ্যানেল এর ধুম| আমরাও টিভি তে নতুন কানেকশন নিলাম| তখন বিদেশী সংস্কৃতির সাথে "গভীর"ভাবে পরিচয় হলো| বিটিভি র সেই পুরনো প্রোগ্রামগুলোকে সবাই বলতে লাগলো "গেয়ো"| এই শব্দটা আমার মোটেও পছন্দের নয়| কারণ নিজের কানেই এই শব্দটা অন্যের মুখ থেকে শুনতে হয়েছে|

প্রাইভেট চ্যানেল এর পছন্দের তালিকায় প্রথমে আসলো ইটিভি| কারনটা ছিল, এর নাটকের মান| "বন্ধন" এর কথা কখনই ভুলতে পারব না| কেন হুট করে ইটিভি বন্ধ হয়ে গেল, এই ক্ষোভ সেই অবুঝ মনটাতে তীক্ষ্ণ হয়ে বিঁধে ছিল| তারপর দেখলাম স্টার প্লাস, সনি, স্টার ওর্ল্ড| চ্যানেল গুলো দেখতাম| কিন্তু তাই বলে এই নয় নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা| বাংলাদেশী চ্যানেল যে দেখতাম না তা কিন্তু নয়| বিজ্ঞাপনের ভিড়ে মূল অনুষ্ঠান/নাটক কোথায় হারিয়ে যেত টেরও পেতাম না| সেই সুত্রে কিছু চ্যানেল এ এখন "বিরতিহীন নাটক" এর বেশ প্রশংসা করতে হয়| এই নাটক শিল্পে আমরা এখনো মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছি, এ কথা আমি জোর গলায় বলতে পারি|

বিদেশী চ্যানেলের প্রভাব শুরু হলো বাসায় কাজের মেয়ের হিন্দিতে কথা বলা থেকে, তারপর আশেপাশের বন্ধুবান্ধবদের হিন্দিতে স্মার্টনেস প্রদর্শন| কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখলাম সহপাঠীরা কত সহজে হিন্দী/ইংলিশ "স্ল্যাং" ব্যবহার করছে| ফেসবুক এ যখন কাউকে দিব্যিতে হিন্দী তে কমেন্ট/পোস্ট করতে দেখি খারাপ লাগে যে, ওই ভাষা আমি বুঝি না| যে কমেন্ট/পোস্ট করেছে সে ভাষাটি বুঝে, এটা তার গুণ বলা যেতে পারে| আমরা বাংলার পাশাপাশি ইংলিশ শিখি, স্প্যানিশ, ফ্রেন্চ, জার্মান, আরো কত ভাষাই তো শিখি| হিন্দী শিখতেও সমস্যা নেই| তাই বলে বাংলাকে হেয় করে অন্য ভাষায় দাপট দেখানোর মানে আমি বুঝি না|

আমার বন্ধুদের অনেককে দেখেছি, ইংলিশ হার্ড মেটালের গান শুনতে অভ্যস্ত, তারা রবীন্দ্র/নজরুল ধারার গানগুলোকে এতটা অসম্মান করে তা প্রকাশের বাইরে| আমি এখনো মনে করতে পারি এই ব্যাপারটা নিয়ে তাদের সাথে বাক-বিতন্ডা হয়েছিল| তারা আমাকে বলেছিল, সময় এগিয়ে চলছে, আমি কেন পিছিয়ে আছি, আমার মত তরুনদের জন্যই দেশ পিছিয়ে থাকবে| আমার যুক্তি এই যে, আমি বলছি না অন্য ভাষার গান শুনা যাবে না| আমি বলছি, নিজের সংস্কৃতিকে অসম্মান করে নিজেকে বড় ভাবাটা বোকামি| কারণ আমি যেখানেই যাব, যে কাজেই যাব আমার প্রথম পরিচয় হবে আমি একজন বাঙালি| আর আমি বিশ্বাস করি নিজেকে জানার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো নিজের সংস্কৃতিকে জানা| আমার ওই বন্ধুটি খুব ভালো ইংলিশ গান গাইতে পারে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই| কিন্তু সে যখন বিদেশের মাটিতে পা রাখবে, ধরে নিলাম ইংলিশ গানের গায়ক হিসেবেই, তাকে প্রথম প্রশ্নটি করা হবে যে সে কোন দেশ থেকে এসেছে| সে কি তখন তার শিকড়কে অস্বীকার করতে পারবে? পরিবর্তনের সংজ্ঞা কি তাই?


মন্তব্য

ক্রেসিডা এর ছবি

কোন দেশের সত্যিকারের নাগরিক হতে ভূমি কোন ভুমিকা রাখে না, তার মনমানসিকতা টাই আসল। এই মনমানসিকতা টা না থাকলে হাজার সুবিধা পেলেও সে কথনো সেখাসে শিকড়ের টান অনুভব করবে না। অন্য ভাষায় কথা বলা বা অন্য ভাষার সংস্কৃতির সুস্থ চর্চা করা অবশ্যই ভালো, যদিনা সে নিজের দেশের সস্কৃতি কে উপেক্ষা না করে করে, বা হেয় না করে। আপনার বয়স ২৪ বললেন। আপনার বন্ধুদের বয়সও ধরে নিচ্ছি ২২-২৫ এর মধ্যে। এই বয়সটায় এইসব ব্যাপারে খুব একটা সচেতনতা গড়ে ওঠে না। আমার বিশ্বাস, সময়ের সাথে তারা তাদের চয়েস কে আরো পরিনত করবে। তারা নিজেরাও পরিনত হবে। একটা সময় আমিও হয়তো ব্যান্ডের গান কে মনে হতো সবকিছু। যারা নজরুল-রবীন্দ্রনাথ শুনতো কেমন হেয় লাগতো। অথচ আমি বলতে পারি খুব কম মানুষের কাছে এত্তো নজরুল গীতি এর কালেকশন ছিল যতটা আমার কাছে ছিল। খুব কমন গান, প্রিয় গান, আনকমন বা কম প্রচলিত গান.. অনেক খুঁজে খুঁজে কালেকশন করতাম। বয়সের সাথে সহনশীলতা আসে, আচরন ও রুচিতে পরিবর্তন আসে খুব নীরবে। কখনো খুব প্রবলভাবে অনুভবের ও আগে।

__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;

অতিথি লেখক এর ছবি

আমিও আশা দেখি আমার সেই বন্ধুরা একদিন নিশ্চয় ভুল বুঝতে পারবে|

অতিথি লেখক এর ছবি

কেন হুট করে ইটিভি বন্ধ হয়ে গেল, এই ক্ষোভ সেই অবুঝ মনটাতে তীক্ষ্ণ হয়ে বিঁধে ছিল

আহা!!!দুঃখের সেই মুহূর্তটা মনে করায় দিলেন ভাই।
আলাদিন দেখব বলে খেলা ছেড়ে দৌড় দিয়া এসে টেলিভিশনটা খুললাম আর ইটিভি টা নীল হইয়া গেল।
খুব কষ্ট পাইছিলাম।

কাক্কেশ্বর কুচকুচে

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার একই দশা হয়েছিল, আলাদিন আর দেখা হয় নাই।

কাক্কেশ্বর কুচকুচে এর ছবি

হা!!হা!!!
আপনেরও!!!
ভালো থাকবেন হাসি

কাক্কেশ্বর কুচকুচে

তদানিন্তন পাঁঠা (জুন) এর ছবি

লেখক ভাইয়ের নামটা জানা হলো না। যতদিন অতিথি হিসেবে লিখবেন ততদিন লেখার নিচে নাম দেয়াটাই নিয়ম। হোকনা কেন সেটি ছদ্মনাম। লেখার হাত আপনার ভালই। তবে যতি চিহ্নগুলো চোখে লেগেছে খুব। লিখতে থাকুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

এটি আমার প্রথম লেখা ছিল| চালিয়ে যাব ইনশাল্লাহ| নামটা উল্লেখ করার কথা জানতাম না| আপনাকে ধন্যবাদ| -নাওমি

উতপাখির হৃদয় এর ছবি

অনেক তথা কথিত স্মার্ট আর ফ্যাশনেবল লোকজন এর মধ্যে দেশজ সংস্কৃতির পরিবর্তে পশ্চিমা কালচারের প্রতি অত্তাধিক ভালবাসা দেখা যায় । এদের উদ্দেশ্য করেই তো কবি বলেছেন

যেই সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সেই সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি

উতপাখির হৃদয়

অতিথি লেখক এর ছবি

যারা রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে অবজ্ঞা করে স্মার্ট হতে চায়, তারা শুধু সংস্কৃতিকে নয়, নিজের ইতিহাসের প্রতিও চরম উদাসীনতা দেখায়। আমার আরো দুঃখ লাগে যখন দেখি যে, নিজের ভাষাটাকে এরা দুমড়ে মুচড়ে বিকৃত করে বলে।

আমারও এরকম কিছু বন্ধু আছে। এদেরকে এমনি বলে শোধরাতে পারি নি। তবে ব্যাপারটা নিয়ে আমার বেশ মজার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
কাজের সুত্রে আমাকে অসংখ্য বিদেশীর সংস্পর্শে আসতে হয়েছে। তারা যখন এদেশে আসে, অনেকেই এদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চায়। তখন আমি সময়ের অভাবে আমার এরকমই একজন বন্ধুর হাতে এক বিদেশীকে বাংলা শেখানোর ভার দিয়েছিলাম। এবং তখন সেই বিদেশীর মেয়ের জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে গিয়ে সেই বন্ধু বুঝেছিল, নিজের ভাষা আর সংস্কৃতি সম্পর্কে সে আসলেই কত কম জানে।
বাইরে থেকে অপমানিত না হলে বাঙ্গালীর হুঁশ হয় না। কারো কারো আবার কোনদিনই হয় না।

-- চিত্রাঙ্গদা

অতিথি লেখক এর ছবি

বাইরে থেকে অপমানিত না হলে বাঙ্গালীর হুঁশ হয় না। কারো কারো আবার কোনদিনই হয় না।

-- চিত্রাঙ্গদা

আপনার সাথে একমত
-নাওমি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।