মান জলপ্রপাতে একদিন ( আইভরি কোস্ট টুকিটাকি -২)
এই বছরের জানুয়ারি থেকে অবস্থান করছি আইভরি কোস্টের মান শহরে। পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই ১৮ মাউন্টেন রিজিওনের পাহাড় আর মেঘের যে কি খেলা তা এর আগেই একটি লেখায় উপস্থাপন করেছি। এখানে আশার পর থেকেই মান ওয়াটার ফল বা জলপ্রপাতের কথা শুনে আসছি। তাই তখন থেকেই এটা দেখার এক তীব্র ইচ্ছা নিয়ে দিনাতিপাত করছিলাম। জানুয়ারিতে শুষ্ক মৌসুম থাকে। চারিদিকে শুকিয়ে একেবারেই কাঠ তাই তখন পানি দেখতে যাওয়া বিফল।
(১)
উপরের ছবিটি মান ফলের (ওয়াটার ফল) শুষ্ক মৌসুমের এক চিত্র। তাই তখন থেকেই ভাবছি কবে আসবে বর্ষাকাল আর পূর্ণ হবে উপর থেকে ছিটকে আসা গড়িয়ে পড়া পানি দেখার সাধ।
জুনের শেষের দিক থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি । কখনও ঝির ঝির আবার মাঝে মাঝেই মুসল ধারে কান্নায় ভেঙে পড়ে আকাশ। এই সময় বাড়তে থাকে মেঘের খেলা। এই শহরের যে কোন প্রান্তে দাড়িয়েই এই খেলা আপনি খুব সহজেই উপভোগ করতে পারেন। যুদ্ধের বিভিন্ন ক্ষয় ক্ষতির কারণে এখনকার পরিস্থিতি বা পট একটু ভিন্ন। তা না হলে এই মান শহর ছিল ভ্রমণ পিয়াসিদের এক স্বর্গরাজ্য । টুরিস্ট স্পট হিসেবে এদেশে মানের কদর বরাবরই একটু বেশী ।
যাহোক কদিন আগেই এই মান ফল দেখার এরকম একটি সুযোগ হাতছানি দিল । সেদিন সকাল থেকেই মেঘ গলে গলে পড়ছিল । তখনই আঁচ করলাম মান ফলে যাবার এইটাই উত্তম ক্ষণ । তাই আর দেরী না করেই আমরা কজন বেড়িয়ে পড়লাম মান জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি তখনও হচ্ছে । বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে রওনা হলাম। শহরের ভেতর দিয়ে যেতে হয় সেখানে। মান শহরের চেহারাটা এই সময় কেমন ছিল তা একটু দেখে নেয়া যাক ।
(২)
আমরা মান ফলের কাছে আসতেই বৃষ্টি পালানো শুরু করলো । বেচারা বৃষ্টি শুকনা কাপড় ভেজাতে চাইনি মনে হয়। প্রথমেই এক একজন ৫০০ সেফা দিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। সেদিন শনিবার ছিল তাই ভিড় একটু বেশি। আমরা আস্তে আস্তে পাথর দিয়ে বাঁধায় করা পাহাড় কাটা রাস্তার ভেতর দিয়ে ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম। ফলের কাছাকাছি আসতেই আমরা পানির ছোট ছোট প্রবাহ দেখতে পেলাম।
(৪)
তক্তা বেছানো ছোট্ট সাঁকো পার হয়ে পৌঁছে গেলাম মূল জলপ্রপাতের একেবারে কাছে। উপর থেকে এত সুন্দর পানির প্রবাহ দেখে আমরা যারপরনাই খুশিতে বাকবাক। বেশ উঁচু থেকে গল গল করে আছড়ে পড়ছে স্বচ্ছ চকচকে ঝর্ণার পানি। পানির প্রবাহ আসছে একেবারে পাহাড় চুড়া থেকে এবং ক্রমেই তা পাথুরে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে নিচে।
বেশ কিছু কপোত কপোতীকে জলকেলিতে মগ্ন থাকতে দেখলাম। আসলে এখানে বিশুদ্ধ স্বচ্ছ পানির এতই অভাব যে এই পানি দেখে তার ভেতর দেহের সম্পূর্ণটা না ডুবিয়ে উপায় নেই। তখন প্রায় বিকেল কাজেই গোসল করার কোন প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া হয়নি। কিন্তু তাদের এই অবগাহন দেখে নিজেকে ঠিক স্থির রাখাও ছিল কষ্টের ।
(১০)
কি আর করা খুব বেশি দূরে নয় যে আর আসা হবে না। তাই গোসল করার ওই পার্ট পরের জন্য বাকি রাখলাম ।এরপর একে একে উপভোগ করতে থাকলাম প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য ।
(১২)
এরই মাঝে এদেশিয় এক ভদ্রলোক তার ছবি বেশ আগ্রহ নিয়েই তুলতে বলল । সাথে সাথেই সে কাজ করা হল কারণ এখানকার মানুষেরা নিজেদের ছবি কাউকে তুলতে দেয় না খুব পরিচিত না হলে।
(১৫)
তাকে বেশ খুশি খুশীই দেখাল। প্রাণ খুলে পানি দিয়ে সারা শরীর ছাপিয়ে ফেলল। তার মত আরও অনেকেই তখন এ কাজে বেশ ব্যস্ত। আর আমি তখন এই অপরূপ ঝর্ণার ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত।
(১৬)
দেখতে দেখতে বিকাল বেশ পড়ে আসা শুরু হল। তাই দেরী না করে ঘরের পথে রওনা দিলাম।
ঝর্ণা ধারার সামনেই বেশ পাকা করে সান বাধানো।
(১৮)
তার উপর দিয়ে আস্তে আস্তে নেমে আসতে হল। এবার সেই আসার পথ দিয়েই আবার ফিরে যাবার পালা। জলপ্রপাতের সাথেই একটু মিনি রেস্টুরেন্ট । কিছু খাওয়া যাবে কিনা খোঁজ নিলাম। দেখি কলা ভাজি।
(১৯)
মানে পাকা কলা ভাজি। এই দেশের মানুষের খুব সুস্বাদু একটি খাবার এটি। খাবার নিয়ে আর একদিন আজ না। তারপর সেই পথেই আবার উঠে এলাম পাহাড় কাটা রাস্তা ধরে। পাথুরে বাধানো রাস্তা দিয়ে উঠে আসতে মোটামুটি হাঁটুর মালা খিল ধরে গেল। এরপর গাড়িতে উঠেই আবার নিজ গৃহে রওনা দিলাম। রাস্তাই উঠতেই দেখলাম দুই পাহাড়ের এক সংযোগস্থল । এটাকে মানের দাঁত বলে। তর্জনী আর মধ্যমার মত লাগোয়া এই দুই পাহাড়কে বলা হয় টিথ অব মান।
(২০)
টিথ অব মান দেখে যাওয়ার পথে পড়ে মাঙ্কি ফরেস্ট অর্থাৎ বানরের বন।
(২১)
দুর্ভাগ্য ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ তাই আর ছবি তোলা হয়নি। এই বানরের ফরেস্ট নিয়ে মজার ঘটনা আর একদিনের জন্য পাওনা থাকলো ।
তারপর সন্ধ্যায় ফিরে এলাম নীড়ে । মান ফলের এই সৌন্দর্য সত্যি উপভোগ করার মত। অনু দা’র মত তেমন ছবি তুলতে পারিনা আবার ক্যামেরার রেজুলেশন ও খুব ভাল না তাই ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আইভরি কোস্ট নিয়ে আমার অন্যান্য লেখা গুলো হলঃ
১। http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44877
২। http://www.sachalayatan.com/guest_writer/45222
৩। http://www.sachalayatan.com/guest_writer/45337
অমি_বন্যা
মন্তব্য
আইভরি কোস্ট দেখেই বুঝছি যে আপনার কাম।
বাদাম নিয়ে পোস্ট পাইছি.. বাদামওয়ালাদের নিয়ে একটা পোস্ট দাবী জানিয়ে গেলাম। মনে হয়না তাদের নিয়ে পোস্ট খারাপ লাগবে.. বরং একটা ইন্টারেস্টিং লেখা হওয়ার কথা।
বস, "মুসল" টা "মুষল" হবে। মুসল দেখে মনে হইতেছিল মুসলমানির জন্যে কান্না
পাঁকা কলা ভাজি দেখে গা গুলালো। কেন জানি না.. পাঁকা কলা ছিলিয়ে ই খেতে ও দেখতে ও ভাবতে অভ্যস্ত আমার চোখ এবং মন। তাই হয়তো।
বাই দ্য ওয়ে.. আইভরি কোস্ট কতদিন ধরে আছেন?
ভালো থাকবেন।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
ক্রেসিডা ভাই , এখানে বাদামওয়ালা খুজে পাওয়া বেশ কঠিন হবে হয়ত তার পরও খুজে দেখবো ।
বানান সংশোধনের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার মত আমারও খুব একটা ভালো লাগেনি এই কলা ভাজি দেখতে। একবার এক পার্টিতে আপ্যায়ন হিসেবে এই খাদ্য সহ আরও বেশ কিছু আইটেম ছিল কিন্তু গিলতে পারিনি কিছুই
আমি এখানে প্রায় ছমাস হবে আছি।
আপনিও ভালো থাকুন।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
দারুণ জায়গা তো!
সেফা'র কনভার্শন রেট কত?
আসলেই দারুন জায়গা।
এক ডলার সমান ৫৪০ সেফা চলে এখন।
আর এক টাকা সমান ৬ টাকা ৭০ পয়সা । রেটের উত্থান পতন হয় প্রায়শই।
মন্তব্যের জন্য কৌস্তুভ দা । ভালো থাকবেন।
এটা ৬ দশমিক ৭০ সেফা হবে ১ টাকা সমান। ভুলে টাকা লিখে ফেলেছি।
বানরের ছবি আরও পেলে ভাল লাগত।
facebook
ধন্যবাদ অনু দা। বানরের ছবি তুলতেই ব্যাটারির চার্জ গেল চলে। কি আর করা তবে এই মাঙ্কি ফরেস্ট বেশ চমৎকার জায়গা। এবার ভালো করে চার্জ দিয়ে নিয়ে যাবো । পরবর্তীতে আরও ছবি পাবেন বানরের।
ছবি ও লেখা চমৎকার হয়েছে।
সুন্দর ছবি ও ক্যাপশন
আমি_বন্যা ভাইয়ের হাচলত্বের জোর দাবী জানিয়ে রাখলাম
হিল্লোল
তোমার ভাই আমার ভাই , হিল্লোল ভাই হিল্লোল ভাই । ধন্যবাদ আপনাকে।
সুন্দরতো ঝর্ণাটা, তবে একদম ঠিক ঝর্ণার পানির নিচে দাঁড়িয়ে ভেজার খুব একটা অপশন নেই মনে হল। আপনি কি দেশের শু্ভলং ঝর্ণায় গিয়েছেন, ওটা কিন্তু এই ঝর্ণার চেয়ে ও অনেক সুন্দর, ভরা বর্ষায় ঝর্ণাটা যা লাগেনা।
আর ইয়ে কলাভাজার ছবিটা দেখতে ভালো অবশ্য, খেয়েছেন নাকি?
বন্দনা, শু্ভলং যাওয়া হয়নি তবে আপনি যেহেতু বললেন একবার যেয়ে দেখতে হবে।
কলাভাজা দেখলে আমার গা ঘিনঘিন করে। কাচাকলা হলে তাও হয় একেবারে পাকা কলা ভাজি। তবে এটা খাওয়ার উপলক্ষ এসেছে বেশ কয়েকবার কিন্তু সব বারই এড়িয়ে গিয়েছি।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
ঝর্ণা খুব ভাল লাগে আমার।
ছবিগুলো ভাল লাগল।
ধন্যবাদ শাব্দিক আপু । ভালো থাকবেন। আমি কিন্তু আপনাকে শাব্দিক ভাই বলেই জানতাম
আমারো ধারনা ছিল আপনি বন্যা আপু
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
বয়সের কারনে ইচ্ছে হলেও এখন আর হুট করে বেরিয়ে পড়া হয়না। বাড়িতে একরকম বন্দী বলতে পারেন। তাই এইসব ঘুরাঘুরির লেখা ছবি মনটাকে বড় উদাস করে ফেলে। তবে এর মধ্যেও এক ধরনের ভাল লাগার অনুভূতি তৈরি হয় বৈ কি।
ধন্যবাদ। ভাল থকুন। আনন্দে থাকুন।
ধন্যবাদ প্রৌড় দা। আপনার ভালো লাগার অনুভুতি আমার লেখাকে সার্থক করে তুলল ।
ঝর্ণা কথাটা শুনলেই মনটা কেমন আনচান করে উঠে। তা সে হোক শুভলং এর মতো ঝিরঝিরে ঝর্ণা অথবা রিজ্যুকের মতো দামামা বাজানো। অনেক ভাল লাগল। বানরদেখাচ্ছেন কবে? অপেক্ষায় থাকলাম।
যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ...
আফ্রিকার একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, সেখানে ভার্জিন প্রকৃতির পাশাপাশি মানুষের ভার্জিন মনেরও দেখা মেলে। প্রকৃতির পাশাপাশি সেই মানুষগুলোর কান্না-হাসিকেও আপনার লেখায় তুলে আনুন, সেসব লেখা আমরা মন ভরে পড়ে যুগপৎ তৃপ্ত ও শুদ্ধ হই।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
শুভলং দেখিনাই, আশা করি এই বছর দেখতে পাব।
'মান' নামটা খুব সুন্দর লাগল। অর্থ কী এর?
নতুন মন্তব্য করুন