কপালফেরে রাণীর রাজ্যে আমার বর্তমান নিবাস। তবে যেখানে থাকি সেখান থেকে লন্ডন বেশ খানিকটা দূরে বলে অলিম্পিকের উত্তাপ এখানে ওভাবে আসেনি। তবে অলিম্পিক আসছে- এমন একটা শোরগোল চলছে অনেকদিন ধরেই। এপ্রিল যখন শেষবার লন্ডন গিয়েছিলাম তখন অলিম্পিক ভেন্যুগুলো দেখে এসেছিলাম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখার পর সেটার একটা রিভিউ লিখতে বসে গেলাম।
আগেই বলে রাখি, বেইজিং এর সাথে পাল্লা দেওয়ার কোন ইচ্ছা/ উপায় গ্রেট বৃটেনের ছিল না! মন্দার চাপে থাকা সরকারের খরচ কমানোর প্রত্যয় তো ছিল-ই, সেই সাথে গ্রেট বৃটেনের প্রকৃত রূপকে সবার সামনে তুলে ধরার পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোই ছিল পরিচালক ড্যানি বয়েলের মিশন। আমার মতে সেকাজে তিনি যথেষ্ট-ই সফল! বয়েলের হাতে বেইজিং এর মত ব্লাংক চেক ছিল না কিন্তু তাঁর হাতে ছিল সমৃদ্ধ ইতিহাস, শেক্সপীয়র, রাজপরিবার ইত্যাদি তুরুপের তাস, যেটা তিনি দারুণভাবেই ব্যবহার করেছেন!
বাড়ী থেকে পাঁচ মিনিটের পথ এমন একটা পাবে বসে অনুষ্ঠান দেখছিলাম! শুরু হয় গ্রামীণ ইংল্যান্ডকে সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে। ডেভনের যেদিকটায় আমি থাকি সেদিকের প্রকৃতি এখনো প্রায় এরকম-ই আছে, এখনো গাওয়া একইভাবে হয় ইংরেজ পল্লীগীতি। তাই আমার কাছে বেশ বাস্তব-ই লাগছিল। এরপর শেক্সপীয়রের টেম্পেস্টের একটা অংশ, যেটা থেকেই বোধহয় অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছে আইসলস অফ ওয়ান্ডার, শিল্পবিপ্লবের সূচনা (মিল্টনের কবিতা যেটাকে বলছে পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা!) পর্বটা আমার অসাধারণ লেগেছে। সবুজ মাঠ- ঘাট ততক্ষণে পালটে হয়ে গেছে চিমনি-ওলা কল, সেটা থেকে আবার সত্যি সত্যি ধোঁয়াও বের হচ্ছে! যাদের অবদানে তিলতিল করে বৃটেন গড়ে উঠেছে, সেই শ্রমজীবী মানুষের অবদানকে আরেকবার তুলে ধরা হয়েছে। এর মাঝেই নারীদের ভোটাধিকারের আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন এসব-ও আসছিল একের পর এক! অলিম্পিকের রিংগুলোর আসার দৃশ্যটাও ভাল লেগেছে বেশ!
এরপরেই তো আলোচিত বন্ড আর রাণীমার দৃশ্যটি, শার্লক হোমসীয় কায়দার জুড়ীগাড়ীর পরিবর্তে ‘বদলে যাও, বদলে দাও’ বলে রাণী-মা বন্ডের সাথে হেলিকপ্টার নিয়ে প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়লেন! পাবে আশে-পাশের লোকজন দারুণ মজা পেয়েছে! ছোট্ট ফিল্মটায় বয়েল বুদ্ধিদীপ্তভাবে লন্ডনের সব বিশেষ দ্রষ্টব্যগুলো দেখিয়ে দিলেন! মাল্টিকাল্টারাল বৃটেনের দৃষ্টান্ত ছিল অনুষ্ঠানের পদে পদেই। ফিল্মে হাত নাড়া মানুষের মধ্যে সব জাতির সবাইকেই দেখলাম! পরের পর্বের গুলোতেও শ্বেতাঙ্গদের পাশাপাশি সব জাতির সবাইকে নিয়েই দল গঠন করা হয়েছে লক্ষ্য করলাম।
রাজপরিবারকে এখানে যেমন সম্মানের চোখে দেখা হয় ঠিক-ই তবে বৃটিশ পাব্লিক তাদের নিয়ে রঙ্গ- রসিকতা করতে একটুও দ্বিধা করে না। বুড়ি রাণী- মা কে ‘বন্ড- গার্ল’ বানিয়ে হেলিকপ্টার থেকে ‘স্কাই-ফল’ করিয়ে আদি অকৃত্রিম সূক্ষ্ম বৃটিশ সেন্স অফ হিউমারের একটা ভাল উদাহরণ তৈরি করলেন বয়েল! অনেকে রাণীর সম্মান নিয়ে হায়- হায় রব ওঠাবেন ভাবছিলাম, কিন্তু বন্ডের সাথে অভিনয়ে রাজি হয়ে রাণীও দেখিয়েছেন তিনিও কম রসিক নন! প্রথামত জাতীয় পতাকা আর সঙ্গীত তো ছিল-ই কিন্তু বয়েল সেটাকেও অন্যমাত্রা দিয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর লোকজন দিয়ে পতাকা তুলে আর মূক- বধির শিশুদের দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইয়ে!
হেলথ কেয়ার নিয়ে পর্বটা অনেকের জন্য অপ্রাসঙ্গিক লাগতে পারে কিন্তু বৃটেনবাসীর জন্য এটা এই মূহুর্তে খুব-ই প্রাসংগিক। NHS এর সমালোচনা আছে সত্যি, কিন্তু সবার জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার এই প্রকল্প এখনো ভাল-ই কার্যকর, অন্ততঃ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাই বলে। চিরন্তন ইয়াঙ্কি- বৃটিশ রাইভালরির একটা সূক্ষ্ম রেশ-ও বোধহয় থাকল এতে! আটলান্টিকের ওপারের বন্ধুদের একটু বার্তা দেওয়া গেল যে, এখনো আমরা সবাইকে ফ্রিতে চিকিৎসা দেই, তোমাদের মতো বীমার মহাজন হয়ে বসি নি! বর্তমান সরকার যখন এই কর্মসূচিতে নানা কাটছাঁটের পাঁয়তারা কষছে, সেখানে বয়েল ডাক্তারদের জাতীয় বীর বানিয়ে সরকারের কাজ অনেকটাই কঠিন করে দিলেন! এই পর্বের লাইটিংটা আমার অসাধারণ লেগেছে!
এর সাথে ইংলিশ শিশু সাহিত্যের দত্যি-দানো আর শুভ শক্তির লড়াই পর্বটাও দেখার মত ছিল। যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি, রোলিং সেই এক্সটারেরই শিক্ষার্থী ছিলেন, আমার বাসা থেকে তাঁর শিক্ষা-জীবনের বসবাসস্থল দুমিনিটের রাস্তা! ফলে তাঁকে পর্দায় দেখা মাত্র একটা উচ্ছ্বাস শোনা গেল!
মিস্টার বিন তো হাসিয়ে মারলেন সবাইকে! পিয়ানো পর্ব আর চ্যারিয়টস অফ ফায়ারের রিমেকে মিস্টার বিন অনবদ্য! বেকহামকেও বুদ্ধিমত্তার সাথে বয়েল ব্যবহার করেছেন। নতুন- পুরানো যুগেই আইকনদের একমঞ্চে ভালভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। মিউজিক পর্বে ধারাবাহিকভাবে গানের ইতিহাস তো| ছিল-ই, আমার মন কেড়ে নিয়ে বয়েলের ডিটেইল এর কাজ। শনিবারের সন্ধ্যায় ডিনারের পর বাজানো গান কিংবা টিনেজারের আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে প্রেম কাহিনী কিংবা গানের সিলেকশনে উঠে আসা ক্লাপটন, সেক্স পিস্তলস, রোলিং স্টোন, পাংক রক সব কিছুই একদম বাস্তব লেগেছে। এ আর রহমানের গান আর আকরাম খানের নৃত্য মাল্টিকালচারিসমের পতাকা তুলে ধরল আরেকবার।
পুরো অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়ে লাভ নেই, যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে- বেইজিং আর লন্ডনের তুলনা করা বৃথা। জলসাঘরের পুরোনো জমিদারের মত-ই বৃটেনের রাজকোষ বাড়ন্ত তবে বনেদিয়ানার ছাপ এখনো যায় নি; আর সেটাই বয়েল তুলে ধরতে চেয়েছেন।আর সেটা তিনি সফলভাবেই পেরেছেন বলেই আমার বিশ্বাস। আসার সময় এক বৃটিশ দাদুকে জিজ্ঞেস করলাম, ''কেমন লাগল আপনার?'' দিব্যি বুড়ো ক্লাপটন থেকে চোথা মেরে দিল, It was wonderful tonight!
রাশিক
মন্তব্য
দুটো দুরকম রিভিউ এল, ভালো। আমি নিজে দেখার সময় পাই নি, কেবল এত আলোচনা শুনে মিস্টার বীন-এর অংশটুকু ইউটিউবে দেখলাম।
বিবিসি আই-প্লেয়ারে পুরোটা দেখে নিন!
ভাল লাগল আপনার বর্ণনা
অনেক ধন্যবাদ।
অন্যরকম একটা রিভিয়্যু পড়লাম। ভাল লেগেছে খুব।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ধন্যবাদ!
একটা ট্রু রিভ্যু হইছে।
চিয়ার্স মেইট!
এখন ও দেখতে পারিনি, ইউটিউবের লিঙ্কটা কাজ করছেনা কেন যেন।তবে আপনার ছোট্ট রিভিউটা ভালো লেগেছে রাশিক।
অনেক ধন্যবাদ!
কুইন এর গান ভাল লেগেছে, আর মাইকেল মুর দেখেছিলাম "সিকো" তে ব্রিটিশ চিকিৎসা ব্যাবস্থার বেশ সুনাম করেছিলেন।
নতুন মন্তব্য করুন