বেশ কয়েকদিন আগেই মান শহরের মাঙ্কি ফরেস্ট এ গিয়েছিলাম। এই বনের বানরগুলো দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম সেদিন কারণ এমন পরিচ্ছন্ন আর ভিন্ন প্রজাতির বানর আমি এর আগে কখনও দেখিনি। পরিচ্ছন্ন বললাম এই কারনে যে ঢাকা চিড়িয়াখানা বা সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় যা দেখেছি তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন মনে হয়েছে এই প্রাণীদেরকে ।মাথার কাছে বাদামী রঙয়ের প্যাচ আর সারা শরীর জুড়ে ছাই রঙয়ের আবরণ দেখে সুন্দর না বলে উপায় নেই।
(১)
(২)
যেহেতু প্রজাতি একটু ভিন্ন তাই কৌতূহল বশত বানরের বিভিন্ন প্রজাতি জানার জন্যে ইন্টারনেটে খোজা শুরু করলাম। খুজতেই বের হয়ে আসলো ক্যাম্পবেলস বানর(campbell’s monkey ) নামে এক ধরনের বানর যার সাথে এই বানরের চেহারা আর আকারে হুবহু মিল। তাই আর দেরী না করে ঝাপিয়ে পড়লাম আরও কিছু জানার জন্যে আর তাতেই বের হয়ে এলো অজানা অনেক তথ্য।
উইকিপিডিয়া থেকে ( http://en.wikipedia.org/wiki/Campbell%27s_mona_monkey লিঙ্ক) জানতে পারলাম এই বানরের দেখা কেবল আফ্রিকাতেই পাওয়া যায় । পশ্চিম আফ্রিকার কিছু(আইভরি কোস্ট , মালি, গিনি, বুরকিনা ফাসো, ঘানা, সেনেগাল, লাইবেরিয়া) দেশে এদের দেখা পাওয়া গেলেও অন্য কোথাও এই প্রাণীদের দেখা যায়না আর সে কারনেই এরা আমার কাছে একটু ব্যতিক্রমই মনে হয়েছে। আমি কোন প্রাণী বিশারদ নই তবুও কেন জানি এদের বিষয়ে জানার কৌতূহলকে নিবৃত করতে পারলাম না।
এদের নাম সার্চ দিতেই বের হয়ে আসলো ২০০৯ সালের গবেষণার বিষয়টি(http://www.nytimes.com/2009/12/08/science/08monkey.html?_r=1) লিঙ্ক স্কটল্যান্ডের সেন্ট এ্যানড্রিউস ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ডঃ ক্রস জুবেরবুলারের সাথে একটি দল এই বানর নিয়ে নানা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম গবেষণা চালায় আইভরি কোস্টের তাই(TAI) নামক ফরেস্টে। তারা বের করেছেন যে, বাক্যপ্রকরনে বানরের একটি আদিম রূপ রয়েছে। একটি শব্দের সাথে কিছু প্রত্যয় যুক্ত করে তারা বিভিন্ন ধরণের অর্থ ও ভাবের আদান প্রদান করে।
অডিও লিঙ্ক
(http://news.bbc.co.uk/2/hi/8405806.stm)
এদের ব্যবহৃত কিছু শব্দের উপর গবেষণা করে ডঃ ক্রুস ক্যম্পবেলস বানরের যোগাযোগ ব্যবস্থার কিছু দুরূহ অর্থ উদ্ধার (ডিসাইফারিং) করতে সক্ষম হন। ক্র্যাক , হাক, বুম এই তিনটি শব্দকে মুল বা বেসিক হিসেবে ধরে তারা তাদের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়েছেন। আর এর থেকে বেরিয়ে আসে যে,এই তিনটি শব্দের সাথে কিছু প্রত্যয় যুক্ত করে অথবা একই শব্দের পুনরাবৃত্তি অথবা প্রত্যয় যুক্ত কয়েকটি শব্দ পাশাপাশি প্রতিস্থাপন করে এরা বিভিন্ন ধরণের সিগন্যাল বা সতর্ক সংকেতের আদান প্রদান করে থাকে।
ধরা যাক ক্র্যাক- এই শব্দটি তারা চিতাবাঘ নিকটবর্তী হলে অথবা তাদের নির্দিষ্ট দৃষ্টিসীমার মধ্যে গোচরীভূত হলে ব্যবহার করে। ক্র্যাক এর সাথে উ যুক্ত করে হয় ক্র্যাকউ যার অর্থ চিতা নয় তবে এটি অন্য যে কোন আসন্ন বিপদের একটি সাধারণ সতর্ক সংকেত।
এবার আসি হাক শব্দে যা কোন বাজপাখি দেখা গেলে ব্যবহৃত হয়। হাক এর সাথে উ যুক্ত হলে হয় হাকউ যার অর্থ বাজপাখি নয় তবে আকাশে জড়ো হওয়া অন্য কোন প্রাণীর বিপদসংকুল সমাবেশ।
এরপর ডঃ জুবেরবুলার গুরুত্ব দিলেন সম্মিলিত সিগন্যালের দিকে যা তারা বিভিন্নভাবে কয়েকটি শব্দ একত্রিত করে উচ্চারণ করে থাকে। সেই দিকটি মাথায় রেখে তারা গবেষণা চালিয়ে গেলেন। লক্ষ করা গেল দুইবার বুম বুম এর সাথে ক্র্যাক উজ যুক্ত করে শব্দ উচ্চারণ মানে হল বিশাল কোন গাছের ডাল বা শাখাপতন দৃষ্টিগোচর হওয়া ।
আবার একইভাবে বুম বুম এর সাথে ক্র্যাক উজ এবং হাক উজ যুক্ত হওয়া মানে বুঝতে হবে একই বানরের আর একটি দল খুব নিকটে একত্রিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন যে, শব্দের এই বিভিন্ন বিন্যাস এক একটি ঘটনা ও পারিপার্শ্বিকতার যে বিষয় গুলো ইঙ্গিত করে তার সাক্ষ্য কেবল ওই বানরেরাই বহন করে। গবেষকরা মনে করে বানরের এই ভাষা তাত্ত্বিক জ্ঞান নিয়ে আরও গবেষণার মাধ্যমে হয়ত ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
এতকিছু জানার পরে বানরের এই প্রজাতি আমার কাছে একটি বিশেষ প্রাণীই মনে হল। তবে এদের সাথে দেখা হওয়া আসলে কিছুটা কাকতালীয় বলা চলে। এই জায়গা এবং বানরের গল্প শুনেছি দুই একবার তবে বানরের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ না থাকার কারনে এখানে আসা হয়নি। সেদিন রাস্তা দিয়ে যেতেই চোখে পড়লো ঝুলন্ত কিছু বানর যারা একেবারে গাছের রঙয়ের সাথে মিশে আছে। সাথে সাথেই জানতে পারলাম এই সেই ফরেস্ট আর একটু নেমে হাত নাড়ালেই দেখা পাওয়া যাবে বানরের। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ানোর সাথে সাথে আমাদের মত কিছু আগ্রহী মানুষকে নানা রকমের খাবার নিয়ে এদিকেই আসতে দেখলাম। এইসব মানুষদেরকে দেখে বুঝতে আর বাকী রইলো না যে তারা নিয়মিতই এখানে খাবার দিয়ে যায় ।
(৫)
ফরেস্ট এর আয়তন দেখলে আসলে এটাকে ফরেস্ট বলে মনে হবে না কারন আয়তনে বেশ ছোট এই জায়গাটি ছোট টিলার উপর অবস্থিত।
(৬)
(৭)
আমাদের চারপাশে জমে থাকা মানুষদের দেখলাম কলা হাতে নিয়ে ইশারা করতে । দেখে মনে হবে বাড়িতে পোষা কোন প্রাণীকে তার প্রভু খাবার খাওয়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাথে সাথেই গৃহপালিত প্রাণীর ন্যায় ছুটে আসলো ক্যাম্পবেলস গুলো । কেউ একা আবার অনেকেই অগাধ মমতাই জড়িয়ে নিয়ে আছে তার পুচকি শিশুটিকে। বাচ্চাগুলোও একেবারে আঁকড়ে ধরে আছে তার মাকে। দেখে মনে হবে যেন এক্ষুনি কেউ তাকে ছিনিয়ে নিতে আসবে তার মায়ের কাছ থেকে। মায়ের মমতা তার সন্তানের জন্য যে সমান তার আরও একটা প্রমান পেলাম এই প্রাণীকুলে ।
(৮)
(৯)
(১০)
(১১)
দর্শনার্থী অনেকেই দেখলাম পরম আনন্দ নিয়ে উপভোগ করছে বানরের সাথে মানুষের হৃদ্যতা। কেউ রুটি কেউ কলা আবার অনেককেই দেখলাম মেইজ বা ভুট্টা ছুড়ে দিতে। সুবোধ বালকের ন্যায় তারাও একেবারে ভদ্রবেশে এক একজনের কাছ থেকে অনেক দিনের পাওনা খাবার যেন বুঝে নিচ্ছে। খুব ভালো লাগছিল মানুষ আর বানরের মাঝের এই হৃদ্যতা ।
অনেককেই আবার দেখলাম মনে মনে কিছু একটা বলছে যেন কিছু চাইছে এদের দিকে তাকিয়ে। একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল যে এই জায়গাটাকে কেউ কেউ পুজাও করে। একটি পবিত্র স্থান হিসেবেই এখানকার মানুষেরা এই জায়গার পরিচর্যা করে।
(১৪)
(১৫)
(১৬)
(১৭)
(১৮)
সেদিন অবশ্য এই প্রাণীদেরকে তেমন আওয়াজ করতে শুনিনি যেমনটি ওই গবেষণায় বলা হয়েছে। পরে অবশ্য বুঝেছি যে তাই(TAI) ফরেস্টের ন্যায় এখানে লেপার্ডের ভয় নেই আবার ক্ষতি করার মত সেই বাজপাখির দেখাও কদাচিৎ । মানুষের ভালোবাসায় এখানে জয় করে নিয়েছে ক্যামপবেলস বানরের হৃদয় আর সেই ভালোবাসায় সিক্ত হয়েই তারা মুক্ত বাতাসে নিরঝঞ্জাট লাফিয়ে চলেছে এ গাছ থেকে ওগাছ।
(১৯)
আইভরি কোস্ট নিয়ে আমার অন্যান্য লেখা
১। http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44877
২।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/45222
৩।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/45337
৪।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/45569
সচলায়তনে আমার অন্যান্য লেখা
১। http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44520
২।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44468
৩।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44326
৪।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44581
৫।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44739
৬।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44786
৭।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44899
৮।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44952
৯।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/45000
১০।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/45149
১১।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/45282
১২।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/45370
১৩।http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44652
অমি_বন্যা
মন্তব্য
পঞ্চতারকাখচিত একখানা স্যালুট নিন। বহুপ্রজাতির দেখা বানরের মধ্যে এই ক্যাম্পবেলকে দারুন লাগে।
ক্যাম্পবেল বানর সম্ভবত পশ্চিম আফ্রিকার স্পেশালিটি কারন আমি কেনিয়ার মাসাই মারা, নাকুরু ন্যাশনাল পার্ক, নাইরোবি সাফারী পার্ক এবং মালাওইর লিয়ন্ডে ন্যাশনাল পার্কে গিয়ে এদের দেখা পাইনি। তবে বিভিন্ন প্রাণীশালায় এদের অনেক দেখেছি। একবার এক ক্যাম্পবেল বানর গ্রীলের ফাক দিয়ে হাত বের করে আমার গৃহকর্মী লিয়ার শিশুপুত্র আন্ডির হাত খামচে ধরেছিলো ওর হাতের বাদামের ঠোঙা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে। আমার স্ত্রী সাহস করে বানরের হাত ছাড়িয়ে শিশুটিকে মুক্ত করেছিলো। আপনার এই লেখা পড়তে পড়তে সেই ২০০৫ সালের ঘটনাটি মনে পড়ে গেলো। ধন্যবাদ।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ , রাত দা। সেই সাথে ভালো লাগলো আপনার অনেক পুরনো কথা মনে করিয়ে দিতে পেরে। ভালো থাকবেন।
বানরগুলো বাঁদরামি করেনা মোটেও। দেখলেই কেমন যেন মায়া হয়। লেখা আর ছবির জন্য
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
হুম বাঁদরগুলো বেশ শিষ্টাচারী তবে কলা দেখলে তা আবার ভুলে যাই । মন্তব্যের জন্য দাদা।
বুঝলেন, এই বানরকুল হচ্ছে আসলে মানুষেরই এক উপজাতি, দেবতার অভিশাপে তাদের আজ এই দশা। তাই তারা ভাষার ব্যবহার জানে।
লেখা ও ছবি চমৎকার।
ইন্টারেস্টিং লেখা।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
ধন্যবাদ আপনাকে।
খাসা-
খাসা-
ছবিতেই তো বেশ পরিস্কার- পরিচ্ছন্ন দেখা যাচ্ছে, অবশ্য এরা যদি ফটোজেনিক হয় তা হলে অন্য কথা-
হুম এরা বেশ ভদ্র। ছবি তোলার সময় একেবারে নড়াচড়া নেই। মনে হয় যেন পোজ দিচ্ছে।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
জটিলস্য জটিল সব ফটুক!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
চমৎকার! খুব ভাল লাগল, এদের নিয়ে আরো জানা গেলে বিস্তারিত লিখুন।
facebook
আপনার ভালো লেগেছে তাতেই ভালো লাগা , অনু দা। বিস্তারিত জানলে জানাবো ।
শব্দে ভাবের আদান প্রদান জিনিসটা জেনে খুব অবাক হইছি,
আরও অবাক হইছি এইগুলা ডিসাইফার করল ক্যামনে এইটা ভেবে।
(আসলে আমি এইসবের কিছুই জানিনা,অবাক হওয়াই উচিত)
আর ছবিগুলা ভাল লাগছে
শব্দে ভাবের আদান প্রদানের ব্যাপারটা আসলেই অবাক করার মত।
এত্ত বড় লেজ!!!
আপনার তো দেখি অনেক পোস্ট, আমার মত মডুদের চোখে পড়ছেন না।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
আশা করছি অতি তাড়াতাড়ি মডুরা আমাকে দেখবে।
নতুন মন্তব্য করুন