দেবতার গল্প
সে অনেককাল আগের কথা। কত আগের কথা তা আজ আর মনে নেই। তুমি আজগুবি গল্প বলে যদি উড়িয়ে দেও, দিতেই পারো। এমন কোন শক্ত প্রমান ও আমার নেই যা দিয়ে গল্পটাকে বাস্তবের জমিনে পুঁতে রাখতে পারবো। আর এত সত্য শুনেই বা কি করবে, ভায়া! ওই ধাঁধাটা কি ভুলে গেছো, সবচে ভালো মিথ্যাটা হয় সত্যের খুব কাছাকাছি আর সেই হিসেবে সত্য নিজেই হচ্ছে সবচে বড় মিথ্যা।
যাহোক বাদ দেও এসব সত্য-মিথ্যার বৃত্তান্ত। গল্পটা শোনো।
সে অনেক কাল আগে। তখন আমার হাত ছিলো লোহার মত শক্ত। চোখ ছিলো বাজের মত তীক্ষ আর ক্ষুধা ছিলো আগুনের মত সর্বগ্রাসী। আমরা ছিলাম ছয় কুড়ি শিকারী। শিকার করতাম, নাচতাম, আর ঘুরে বেড়াতাম সেই বরফের রাজ্য থেকে ওই সমুদ্র পারের বালির রাজ্যতক। ছয় কুড়ি শিকারী আর দুই গন্ডা পোনা বাচ্চা। মাংস শেষ হলেই আমরা ছয় কুড়ি শিকারী বেড়িয়ে পড়তাম চারদিকে।কেউ গেলো দক্ষিন কেউ বা উত্তর আর কেউবা ডুব দিলো জলে। আমরা কুড়িজন গাছের ডাল বেয়ে উঠে যেতাম উপরে । আসল শিকারতো আর মাটিতে চড়েনা। তাকে ধরে আনতে হয় আকাশের মেঘ চিড়ে। তখনও দেবতারা আমাদের ছেড়ে যায়নি। গাছের চূড়ায় উঠে দেখা যেত দেবতাদের বাসা। আশে পাশে চড়ে বেড়াতো নধর ভেড়ার পাল। ভেড়াগুলো ধরা ছিলো খুব সহজ। কোন চিৎকার নেই, দৈাড়-ঝাপ নেই। খপ করে ধরো আর নিচে নেমে আসো। শুধুই একটাই ভয়। যদি দেবতাদের চোখে পড়ে, তবে আর রক্ষা নেই। তোমাকে ধরে, বুক চিড়ে বের করে নিবে হৃৎপিন্ড আর মাথাটা আটকে দিবে দড়িতে। তারপর কি হতো কেউ জানতো না। শুধুই একবার জেনেছিলাম আমি আর আজ তার খাজনা দিয়ে বেড়াই এক সময় থেকে আরেক সময়ে।
সে'বার গরম পড়েছিলো ভীষণ। মনে হচ্ছিল সূর্য যেন নেমে আসছে মাটিতে। আমরা সবাই ছুটছিলাম সমুদ্রের দিকে। সে কি দৈাড়! যেনো হাতির তাড়া। মাথার উপর সূর্য , পায়ের নিচে গরম মাটি, পিঠে পানি আর খাবারের বোঝা। বালির রাজ্য পাড়ি দিয়ে যেতে হতো সমুদ্রে। আমাদের ভাগ্যটা ছিলো বেজায় খারাপ, দুই দিনের পথ বাকি থাকতেই খাবার ফুরিয়ে এলো। তখন সবাই ক্লান্ত। তারপরও পথ বদলে আমরা শুরু করলাম বনের দিকে হাটা; এ পথে সমুদ্রে পৌছতে দিন চারেক বেশি লাগলেও কিছু খাবারের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।
অর্ধেক পথ না যেতেই দেখি, এক বিশাল গর্ত আর গর্তের কিছু দূরেই দেবতার ঘর। এর আগে কখনো মাটিতে দেবতার ঘর দেখিনি আমরা। প্রথমে দৌড়ে পালালেও, আবার ফিরে আসি ভেড়ার মাংসে লোভে। সারা রাত সারা দিন অপেক্ষা করেও যখন ভেড়া পেলামনা তখন ঠিক হলো, আমরা কুড়ি জন থাকবো এখানে পাহারায় আর বাকিরা খাবারের জন্য এগিয়ে যাবে। যদি আমাদের খাবার শেষ হয়ে যায়, তবে আমরা হাটা দিবো সমুদ্রের দিকে। তার আগ পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করবো ভেড়ার।
তারপর প্রহরের পর প্রহর কেটে গেলে, একজন এর পর একজন পাহারা দিতে লাগলাম দেবতার ঘর, যদি ভেড়ার দেখা মেলে। রাত নেমে এলো তবু কিছু পেলামনা। সবাই তখন ক্লান্ত, অবসন্ন। এমন সময় শুনি, কিসের যেন শব্দ। আধারে বুক চিরে সূর্যের আলোর চিকন রেখার মত ক্ষীন শব্দ। চারদিক অন্ধকার। হঠাৎ নকশার মত ফুটে উঠলো দেবতার শরীর। দেখলাম দেবতা যেন কি ছুড়ে ফেলছেন গর্তে। হাল্কা আলোয় ঠাওর হলো না জিনিষটা। আমি প্রায় ছুটে গিয়েছিলাম, কিন্তু দেবতার ভয়ে আবার পিছিয়ে আসলাম। অবশেষে একসময় দেবতা ঘরে ঢুকলেন। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম গর্তের দিকে, মনে ভয় আর দুর্বার কৌতূহল। উকি দিয়ে দেখি কিছুই মালুম হয়না। তারপর কৌতূহলেরই জয় হলো ঝাপ দিলাম গর্তে।
শুরু হলা এক অন্তহীন যাত্রা। পড়ছি তো পড়ছিই। একসময় মনে হল আর বুঝি কোনদিন মাটি ছুতে পারবো না। একসময় হুশ হারালাম।
জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি চারপাশে মৃত মানুষের স্তূপ। তাদের মাথায় মগজ নেই, বুকে কলজে নেই আর কোটরগুলো চোখশুন্য। কী বিভৎস সে দৃশ্য। আজো আমি চমকে উঠি। হাজারো মৃতদেহে স্তূপে আমি পাগলই হয়ে যেতাম। হঠাৎ দেখি একটা আলো আসছে আমার দিকে। তখন আমার হাত পা ঠান্ডা। আমি পাথরের মত বসে। কাছে আসলে দেখি আমারই মতো এক মানুষ যদিও ওর বুকে বসানো অদ্ভুত আলো, চোখে কাঁচ আর মাথায় লোহার টুপি। ওই বললো আমায়,
"মূর্খ কিসের লোভে পা দিয়েছে এই মৃত্যু গুহায়? কি চা্ও? মাংস। কষ্ট করে শিকার করতে চাওনা। আরামে উপরে উঠে দেবতার ভেড়া ধরতে চাও। শোন ভেড়াগুলো লোভী মানুষ ধরা ফাদ। দেখতে পাচ্ছো আমাকে ভেড়া ধরতে গিয়ে ধরা পরি ওদের হাতে। আমাদের হৃৎপিন্ড ওরা বসিয়ে দেয় আলোর যন্ত্র যাতে খাবার ছাড়া কাজ করে যেতে পারি আমি। আমার মগজ শুষে নিচ্ছে এই মাথায় লাগানো দড়ি দিয়ে যাতে আমি ভুলে যাই আমার স্ত্রী, বাচ্চা আর বাবা-মা'র কথা; যাতে আমি ওদের জন্য কাজ করে যেতে পারি অর্হনিশি। চোখ তুলে পড়িয়ে দিয়েছে রংগিন চশমা যাতে পথ চিনতে না পারি। ওদের ভয় খালি মাটি আর সবুজ, তাই বাসা বানায় গাছের উপরে। আর অন্ধকারে চুপিসারে নেমে আসে মাটিতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে আমার বুকের আলো আর আমি শেষ হয়ে যাবো। তাই ওরা আমাদের ফেলে দিয়েছে গুহায় যাতে আমার মাংস পচিয়ে বানাতে পারে জৈবশক্তি। তুমি পালাও। দেবতারা তোমাকে পেলে একই পরিনতি হবে তোমারও।"
হায় চাইলেই কি পালানো যায়? কে পালাতে পারে লোভ আর দেবতার সর্বগ্রাসী দৃষ্টি হতে? দেবতাদের হাতে ধরা পড়ে গেলাম আমি। তবে নিষ্ঠুর দেবতারা আমার হৃদয় উপড়ে নিলো না, চোখে বসালো না কাচ বরং কৌতূক করে আমায় দিলো অমরত্ব।
আমি যুগ থেকে যুগে সাবধান করি মানুষদের। বাচাতে চাই লোভের আগুন থেকে।
কিন্তু হায় বার বার মানুষ লোভের ফাদে পা দিয়ে ঘর ভুলে, নিজেকে শেষ করে ফেলে। তুমি ঠিক করো তুমি কি পা দিবে নাকি লোভে ফাদে?
___
আইলসা
মন্তব্য
ভাল। তবে কেন যেন অনুবাদ অনুবাদ মনে হচ্ছিল।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ধন্যবাদ সুমাদ্রী ভাই। গল্পটা অনুবাদ নয়, তবে ভাষাটা কেমন যানি আটকে আটকে গেছে...
নতুন মন্তব্য করুন