ছোট বেলার ঝাপসা স্মৃতি থেকে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠা মুহূর্তগুলো, আমার বেড়ে উঠার সাক্ষী রাখা সেই ছোট্ট শহর, চিরচেনা পথ-ঘাট, মাঠ-পুকুর, ঝুম বৃষ্টিতে উঠানে দাপাদাপি, গ্রীষ্মে আম খাওয়া ছুটি ও শীতে পিঠা খাওয়া- যদিও কিছুই আর আগের জায়গায় নেই। বদলেছি আমিও, বদলেছে আমার অবস্থান, তবুও স্মৃতির পটে বহু যত্নে এঁকে রাখা সেই মুহুর্তগুলো বদলায় না কখনো, ধুলো জমেনা এর কোনায়, ফিকে হয়ে আসেনা এর কোন রঙ! ছেলেবেলার কথাই বলছি, যখন বাইরের পৃথিবী বলতে আমাদের কাছে ছিলো শুধু গরমের ছুটিতে নানু বাসায় যাওয়া, শীতে্র ছুটিতে দাদু বাসায় যাওয়া। যেকারনে অতি আগ্রহ ও আনন্দের এই ছুটিগুলো আমাদের কাছে ছিলো রীতিমত অমূল্য! ছোট বেলার সরল তীক্ষ্ণ অনুভূতিতে সব কিছুই যেমন বেশী মাত্রায় বড় আর আপন লাগে। তেমনি এই ১২ থেকে ১৪ কিলোর ছোট রাস্তাও তখন আমাদের কাছে ছিলো অনেক বড় এবং তা নিয়ে আমাদের প্রস্তুতিও ছিলো যথারীতি বড়! আর এই পথগুলো ছিলো আমাদের গন্তব্যের মতই অতি আপন। চেনা ছিলো এর প্রতিটি বাঁক, ছোট ছোট দোকান-পাঠ লোকালয়, ফসলের ক্ষেত, আর দুধারে দাঁড়িয়ে থাকা অতি প্রাচীন অভিভাবকের মত বিশাল বিশাল সব গাছ।
ছোট শহরটি থেকে বেরুবার পর থেকে প্রতিটি গাছই যেন আমাদের দেখে আনন্দের অভিবাদন জানাত, আর আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম সেগুলোর দিকে। মুগ্ধ হতাম তাদের বিশালতা দেখে। প্রতিটা গাছই আলাদা করে ঠিক চিনতাম, যেটার ঠিক মাঝে একটা গোল গর্তের মত ছিল সেখানে একদিন একটা কাঠাবেড়ালী উঁকি দিতে দেখেছিলাম, তাই ধরে নিয়েছিলাম গাছটার ভেতর ওই কাঠবেড়লীটার বাসা, কল্পনায় নানা ভাবে তার ঘরদোর দেখে নিতাম। প্রতিবার গাছটা পেরুবার সময় সেই গর্তে উঁকি দিতাম, যদিও আর কখনো কাঠবেড়ালীটার দেখা মেলেনি। আরো দুটো বাঁক পেরিয়ে, পথ থেকে কিছুটা দুরে ছিলো বিশাল এক বটগাছ, যার কাণ্ড আর শাখা আলদা করে চেনা যেতো না। আর গোড়ার দিকে এবড়োখেবড়ো আমগাছটা দেখে আপু বলতো গাছটার ছোট বেলায় বুঝি ঘা হয়েছিলো, তাই ওরকম হয়ে গিয়েছে দেখতে। জোড়া তালগাছে ঝুলে থাকা বাবুই পাখির বাসাগুলো বাতাসে তালপাতার শব্দে কেমন নেচে নেচে দুলতে থাকত, অসংখ্য পাখির কিচির-মিচির শব্দে কানে প্রায় তালা লেগে যেত! খানিক পর পরই আসতো বিশাল বিশাল সেগুন, মেহগনি, শিমুল আরোও নাম না জানা অসংখ্য সব গাছ। শীতকালে লাল শিমুল ফুলে ভরে থাকতো পথ। ছোটমামা বলেছিলো শিমুল গাছে ভুত থাকে, তাই ভয়ে গাছগুলোর দিকে তাকাতাম না। কিন্তু পথে ছড়ানো ফুলগুলো দেখে মন আনন্দে ভরে উঠত, মনে হত আমাদের জন্যেই বুঝি গাছগুলো তার ফুল বিছিয়ে অপেক্ষা করছে। পুরো পথ নিমেষেই শেষ হয়ে আসত বিচিত্র সব গাছে্র ভিন্ন রঙ, রূপ আর ঘ্রাণ চোখ ও মন ভরে দেখতে দেখতে! যেন এখনও চোখ বন্ধ করে ফিরে পাই সে অনুভূতি।
মাঝে অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। জীবনের তাগিদে আমাদের শুধু সামনেই ছুটে চলতে হয়, পেছন ফিরে তাকানোর অবসর খুব কমই মেলে। এবার অনেক দিন পর যাওয়া হয়েছিলো সেই চেনা পথে। কিন্তু হায়! কোথায় আমার ছোট্টবেলার ফেলে আসা সেই স্মৃতিপট! কোথায় আমার কাঠবেড়ালীর বাসাওয়ালা বুড়ো আম গাছটা! কোথায় এবড়োখেবড়ো ঘা-ওআলা গাছটা, কোথায় সেগুন আর শিমুল, কোথায় ফুল, কোথায় গন্ধ! নেই কোনো রঙের ছড়াছড়ি, নেই কোথাও রূপের বৈচিত্র! দুধারে শুধু একঘেয়ে আগাছার মত লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছে দীর্ঘকায় ইউক্যালিপটাস-এর জঙ্গল! এ কোন পথ ধরে চলেছি, আমি চিনিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে! অনেক কষ্টে এই জঙ্গলের ফাঁকে খুঁজতে থাকি, একটু আশা- হয়ত অন্তত একটা চেনা গাছ পাবো, কিন্তু নাহ! কোথাও নেই! মনে পরে গেলো ক্লাস ফাইভে সামাজিক বিজ্ঞানের সালাম স্যারের কথা, "বাংলাদেশ বনায়নের গাছ চুরির নব্য কর্মসূচি চালু হয়েছে, আমাদের সব ভালো ভালো পুরোনো গাছে কেটে সেখানে আগাছা লাগানো হচ্ছে। আগাছা চেনো তো? যা মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি ও সার শুষে নিয়ে নিজে দ্রুত বেড়ে ওঠে, ফলে ফসল অর্থাৎ উপকারি গাছগুলোই আর বাড়ার সুযোগ পায়না! অথচ বিনিময়ে আমরা এর থেকে কিছুই পাইনা!" স্যারের আশংকাই সত্যি হয়েছে, অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কিভাবে ২৫% বনায়ন কর্মসূচী সফল করতে, আগাছায় ভরে ফেলা হচ্ছে পুরো দেশ! অদ্ভুত সে দেশ যেখানে খাবারে অবাধে মেশানো হয় বিষ, পানিতে প্রকাশ্যে ঢেলে দেয়া হয় শিল্প-কারখানার বর্জ্য কেমিক্যাল, বাতাসে কার্বন মনো-অক্সাইড আর মাটিতে লাগানো হয় ক্ষতিকর ইম্পোর্টেড আগাছা!
না, আমি কোনো পরিবেশবাদী বা গাছ বিশারদ নই! দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আওতায় অন্তর্ভুক্ত কোনো নির্দিষ্ট গাছের গ্রহনযোগ্য পরিসংখ্যান ও উপকারিতা অপকারিতা নিয়ে গবেষণা করার মত যথেষ্ট জ্ঞানী ও সচেতন মানুষ দেশে আছে বলেই আমি মনে করি, এব্যাপারে আমার জ্ঞানের শীমাবদ্ধ স্বীকার করেই বলছি- যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে বৃক্ষরোপণ দিবস উদযাপন করেন দেশীয় ফলজ গাছ লাগিয়ে, এবং সাধারণ মানুষকেও এসব উপকারী ফলজ গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন। সেখানে একটা প্রাপ্তবয়স্ক ফলজ বা পরিবেশ-অনুকূল স্বজাতীয় গাছের শেকড় উপড়ে কেন দশটা বিদেশী আগাছা লাগানো হচ্ছে, এটা বুঝতে আসলেই আমার কষ্ট হয়!
আমাকে শুধু তাড়ায় আমার চেনা গাছগুলোর দীর্ঘশ্বাস! ভাবতে পারিনা কতটা নিরব অভিমান বুকে নিয়ে তাদের চলে যেতে হয়েছিলো! তাদের বাঁচাবার জন্য কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয়নি, তাদের শূন্যতা অনুভব করে কারো চোখে নেমে আসেনা দুফোঁটা অশ্রু! অথচ এই স্বার্থপর মানবজাতি এবং পৃথিবী নামক গ্রহটার ঋণ তাদের কাছেই বরং অনেক বেশী ছিলো। কোন মফস্বল শহরের অজপাড়ার পথের কিছু বুড়ো গাছের খোঁজ নাহয় কেউ নাই রাখলো। আমার বিস্ময় আরোও বাড়ে যখন দেখি বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা হাইওয়েতে শুধু ইউক্যালিপটাসের দৌরাত্ব! শুধু হাইওয়ে নয় একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় কিভাবে গ্রামের মেঠো পথ, স্কুল-কলেজ, পকুর পাড়, ধান ক্ষেত সর্বত্র ভরিয়ে ফেলা হয়েছে এই বিদেশী গাছ দিয়ে। তাহলে কি এসব জায়গা থেকেও অবাধে উপড়ে ফেলা হয়েছে প্রাচীন সব স্বদেশী গাছের শেকড়! বিভিন্ন সাইজের এই গাছ দেখলে সহজে অনুমান করা যায়যে এ প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন মনে আসে,
ইউক্যালিপটাস বা এই প্রজাতির গাছগুলোর কি এমন মহত্ব ও গুরুত্ব আছে যে কারণে এই এক টাইপ গাছ দিয়ে পুরো বাংলাদেশ ভরে ফেলা হচ্ছে? এটা বাংলাদেশের জলবায়ুর প্রেক্ষিতে এটি একটি উপযুক্ত প্রজাতি কিনা? এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্বদেশী গাছগুলো রক্ষা ও বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বনবিভাগের কোন নীতিমালা আছে কিনা, থাকলেও তা কতটা কার্যকর?
(এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুর পাক খাচ্ছিলো অনেকদিন। শেষে নিজেই এর উত্তরের আশায় কিছুটা ঘাটাঘাটি করে যা পেলাম, তা আমার মত করে নিচে তুলে ধরলাম। আগেই বলেছি আমি কোন পরিবেশবাদী বা বৃক্ষ গবেষক নই, বাংলাদেশের জলবায়ুর প্রেক্ষিতে ইউক্যালিপটাস বা এই প্রজাতির গাছের উপকারিতা বা অপকারিতার ব্যাপারে তেমন কোন নির্দিষ্ট তথ্য আমি পেলাম না, আশা করছি আপনাদের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও তথ্যে বিষয়টি আরোও পরিষ্কার হবে।)
যদিও বাংলাদেশে প্রকৃতি ও জলবায়ুতে নির্দিষ্টভাবে ইউক্যালিপটাস এর প্রভাব এখনো অবধি কোন গবেষণার আওতায় আনা হয়নি, শুধু ধরে নেয়া হয় যেহেতু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই গাছরোপণ কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে নাই তাই বাংলাদেশের জলবায়ুতেও অনুরূপভাবে এর প্রভাব একই থাকবে। FAO এর দেয়া তথ্য মতে, মানুষ প্রতি দশ হেক্টর প্রাকিতিক বন উজাড় করে কেবল এক হেক্টর কৃত্রিম বনায়ন করছে, সেক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে ক্রমবর্ধ্মান জনসংখ্যার খাদ্য, জ্বালানী ও আশ্রয় চাহিদা পুরনে ইউক্যালিপটাসের মত দ্রুত বর্ধ্মান এবং পারিপার্শিকতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম গাছকে বিকল্প হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। অন্যদিকে বৃক্ষরোপণ অভিযানে নোবেল লরিয়েট কেনিয়ার Wangari Maathai এর মতে, শুধু মাত্র বাণিজ্যিক কারনে এই আগন্তুক গাছকে অতিউৎসাহিত করা হয়েছে। তিনি ইউক্যালিপটাসকে 'ওয়াটার ড্রিংকার' এবং অন্য প্রজাতির প্রতি শত্রুভাবাপন্ন একটি ক্ষতিকর গাছ বলে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, “When you go into these monoculture plantations, they look like dead forests because it’s only them, you don’t see birds, butterflies, other trees, animals—anything other than them because they don’t allow any other growth.” কেনিয়াতে ইউক্যালিপটাস রোপণ সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে এবং জলাশয় বা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল থেকে এই গাছ তুলে ফেলতে সরকারী নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকাতেও এই প্রজাতির গাছগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মাথাই এর ভাষায়, “God had a reason to put some species somewhere so that we have appropriate habitats for particular parts of the world, so when you bring eucalyptus from Australia, you are killing yourself.” যেমন আফ্রিকার পথে প্রান্তরে সবত্র প্রকাণ্ড ভুতুড়ে বাওবাব গাছগুলো শত শত বছর ধরে নিজের ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সেখানে বাংলাদেশে সর্বত্র বিভিন্ন সাইজের আগন্তুক এই ইউক্যালিপটাস দেখে মনে হয় যেন এটাই বাংলাদেশের আদি ও একমাত্র গাছ! গেলো বিদেশী গাছের কথা, শেষ করি আমার নিজ দেশের ছোট থেকে দেখে আসা চিরচেনা প্রিয় গাছ আর প্রিয় পথগুলোতে- রূপবৈচিত্রে ভরা এই বাংলাদেশ, যার প্রতিটি ঋতুর সাথে সাথে পথে প্রান্তরে ফুটে উঠে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও তার গন্ধ। কবির ভাষায়, "পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা আমার এই দেশ ভাইরে" অথবা "পলাশ ফুটেছে শিমুল ফুটেছে এসেছে প্রিয় মাস", কোকিলের ডাক শুনিনা বহুদিন! বাংলাদেশের পথে ঘাটে এখন আর পলাশ-শিমুল ছড়ানো থাকেনা, বটতলিতে বটগাছ নেই যেমনটি কাঁটাবনে কাঁটাগাছ নেই; আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে এসব রূপকথার গল্প নয়তোবা শুধুই নাম হয়ে থাকবে!
............
রংতুলি
মন্তব্য
এই জিনিসের বাস্তব প্রমাণ দেখেছিলাম আমার শৈশবের শহর রাজশাহীতে। রাজশাহী শহরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে চলা পদ্মা নদীর উত্তর পাড় পুরোটাই উঁচু মাটির বাঁধ দিয়ে ঘেরা। কল্পনার মোড় থেকে তালাইমারী শহীদ মিনার পর্যন্ত বাঁধের পাশ দিয়ে রাস্তা - এই রাস্তাটি রুয়েট ও ভার্সিটির সাথে শহরের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। খুব ভালো লাগতো রাস্তাটি দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেতে, কারণ পাশের মাটির বাঁধ ঘাসে ঘাসে ছেয়ে থাকতো সারা বছর - যেন যত্নের সাথে পাতা সবুজ একটা ঢালু কার্পেট!
হঠাৎ কোন এক পৌর পিতার উর্বর(!) মস্তিস্ক এক অভুতপূর্ব আইডিয়া প্রসব করলো - পুরো বাঁধ ছেয়ে গেলো শিশু গাছে। কিছু সচেতন মানুষের প্রতিবাদ কেউ গায়েই মাখলোনা। পৌর কর্তৃপক্ষ বোধহয় বৃক্ষরোপণের জন্য জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়ে গেলো।
কিন্তু কত ধানে কত চাল তা বোঝা গেলো পরের বর্ষাতেই। শিশু গাছ নিজে দ্রুত বাড়ে ঠিকই, কিন্তু আশেপাশের কিছুকে বাড়তে দেয় না - ঘাসকে তো বাঁচতেই দেয় না। ফলে গাছ লাগানোর কিছুদিনের মধ্যে ঘাসের রাজত্ব শেষ, পুরো বাঁধ জুড়ে ন্যাড়া মাটি আর শিশুগাছ। বর্ষাকাল আসা মাত্র বৃষ্টির পানিতে বাঁধের মাটি ধুয়ে নেমে যেতে থাকলো রাস্তায়। এমনকি কর্মকর্তাদের সাধের শিশুগাছের শেকড় পর্যন্ত উন্মুক্ত হয়ে পড়লো!
এবার টনক নড়লো সবার। তাড়াতাড়ি করে শিশু গাছ কাটার ব্যবস্থা নেয়া হলো। কিন্তু তা করলে কি আর হয়? ক্ষতি যা হবার তার বেশিরভাগই হয়ে গেছে! যেখানে মাটি ধরে রাখা দরকার, সেখানে লাগাতে হয় গুচ্ছমূল সম্পন্ন গাছ। আগাছা লাগালে সস্তা বাহবা হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু আখেরে কতখানি লাভ হয়, তা বিবেচনা সাপেক্ষ।
-অয়ন
ধন্যবাদ আপনাকে! আমি রাজশাহী গিয়েছি, পদ্মার বেড়িবাঁধ টাতে হেটেছি। সুনেছি একসময় পদ্মার বিশালতার গল্প। বর্ষায় পদ্মানদীর গর্জন নাকি শহর থেকে শোনা যেত! কিন্ত সেই পদ্মাকে নিজের চোখে দেখে আমি হতাশ হয়েছি, পানির অভাবে এই বিশাল নদীটি এখন একটি সরু নালায় পরিনত হয়েছে, চারদিকে বিস্তির্ন মাঠের মত জেগে উঠছে নদীর তলদেশ যা একসময় এই মরা নদীটার জৌলুশের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে!
মানুষ প্রকৃতিকে নিজের স্বার্থে ইচ্ছা মাফিক ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু ভুলে যায় প্রকৃতি মানুষের খেয়াল খুশি মত চলেনা, বরং মানুষ নিজেই প্রকৃতির বিশালতার কাছে খুব তুচ্ছ। এর পরিনতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, এই ধারনা আমরা কেউ রাখিনা! যতদিনে মানুষের টনক নড়ে ততদিনে করার আর কিছুই থাকেনা!
শুধুই সস্তা বাহবা নয়, এই ধরনের এক একটা প্লান্টেশন প্রজেক্টের সাথে বিলিওন বিলিওন টাকাও জড়িত!
শুরুটা খুবই ভালো হয়েছে। রাজশাহী মেডিকেলের ইউক্যালিপটাসগুলো রহস্যজনকভাবে কাটা হয়নি। যদিও অন্য অনেক ক্যাম্পাস থেকে এসব জঞ্জাল হটানো হয়েছে। রা,মে,ক আমতলার আম গাছটা ঝড়ে উপড়ে গেল বছর তিনেক আগে, বোধহয় এই রাক্ষুসে গাছগুলোর জন্যই! রাজশাহীর সব নগর-পিতাই অদ্ভুত!
অলয়
ধন্যবাদ আপনাকে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা ব্যাপক হারে বাড়াতে হবে এর বিকল্প মনে হয় কিছু নাই, এইসব নগর-পিতার দৌরাত্ব রুখতে।
ভাল আলোচনা। ইউক্যালিপটাসের এই বদভ্যাস অ্যাটেনবুড়োর ভিডিওতে দেখার পর সচলে হিমুদা ইত্যাদিরা কিছু আলোচনা করেছিলেন বোধহয়।
আর কলকাতা থেকে যশোর রোড ধরে উত্তর দিকে যেতে যেতে যে বহু দশকের পুরোনো বিশাল বিশাল গাছগুলো অত চওড়া রাস্তাটার পুরোটার উপর চাঁদোয়ার মত ছেয়ে থাকত, সেইসব গাছ আজ আর অধিকাংশই নেই। খবরে পড়েছি, এক শ্রেণীর অর্থগৃধ্নু লোকেরা গরীব মানুষদের টাকা দিয়ে ওই গাছগুলোয় বিষ দেওয়া করায়।
আমাদের বাড়ির পাশে একটা পড়ে থাকা জমিতে বাবা-দাদু অনেক গাছ বসিয়েছিলেন, ওখানেই গাছপালা থেকে শুরু করে ব্যাঙের বাসস্থান ইত্যাদি কতকিছু সম্পর্কে প্রত্যক্ষ শিক্ষালাভ করেছি, যেটা শহরের ছেলেদের পক্ষে ব্যতিক্রমই। সেটাও বহুদিন বহুতল হয়ে গেছে...
ধন্যবাদ আপনাকে! আমি ব্লগে নিয়মিত না, কেউ যদি দয়া করে আগের লেখাটার লিঙ্ক দিতেন, তাহলে হয়ত এব্যাপারে আরো অনেক কিছু জানা হত!
বিষ দিয়ে গাছ মেরে ফেলা, কতটা ভয়ংকর আর নিকৃষ্ট কাজ হতে পারে! মানুষের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিজের অস্তিত্ব, নিজের মা-বাপ বেঁচে খেলেও বুঝি পূরণ হবেনা!
আপাতত এইটা খুঁজে পেলাম, পুরোনো একটা লেখা
http://www.sachalayatan.com/yoothochari/26300
ধন্যবাদ। লেখাটা পড়লাম। শুধু বেছে বেছে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোতে এই গাছ লাগানো হচ্ছে, ব্যাপারটা বোধহয় এরকম না। সারা দেশেই এই প্রক্রিয়া চলছে, যার মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোও বাদ পরেনি। তবে উনি যেটা বলেছেন এই গাছের কারণে প্রাচীন স্থাপনাগুলোর কোন ক্ষতি হচ্ছে কিনা, এই বিষয়টা অবশ্যই গুরুত্ব রাখে। বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ দেশের যা আছে সেগুলো আগে রক্ষা করা। ইউক্যালিপটাস এর ক্ষতিকর দিকগুলো নির্দিষ্ট গবেষণার আওতায় আনা, এবং স্পর্শকাতর অঞ্চলগুলো থেকে এই গাছ তুলে ফেলা।
লেখা ভালো লেগেছে, ভালো একটি ছবিও দিয়েছেন।
ইউক্যালিপ্টাস একটা দুইটা করে অনেক আগে থেকেই ছিলো, কিন্তু আশির দশক জুড়ে বেশ কয়েকটি বড় সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের আওতায় দাতারা বন বিভাগকে পরামর্শ দেয় ইউক্যালিপ্টাস লাগাতে। আর সেসময়ই মূলত এ গাছ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু মাত্র ১০-১২ বছরেই ব্যবহারযোগ্য হয়ে পড়ে, তাই সরকারী প্রকল্পের বাইরে সাধারন মানুষের মধ্যেও এ গাছ নিয়ে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। বন বিভাগ এখন কোনো ইউক্যালিপ্টাস লাগাচ্ছে না, কিন্তু মানুষের আগ্রহের রাশ টেনে ধরার চেষ্টাও করেনি। কিছু কিছু এনজিও/বেসরকারি প্রতিস্ঠানও ভূমিকা রেখেছে এর ব্যাপক বিস্তারে।
যে স্কেলে লাগালে (মানে যেটাকে বলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেল) ইউক্যালিপ্টাস মাটির পানির স্তর কমিয়ে ফেলবে সেই স্কেলে হয়তো আমাদের দেশে ইউক্যালিপটাস প্লান্টেশন করা হয়নি। কাজেই এই ব্যাপারটা আমি নিশ্চিত না। আমি বরং অন্য একটা সমস্যার কথা বলি। যেহেতু অন্যান্য গাছপালা-পশুপাখির সাথে ইউক্যালিপটাসের সিম্বায়োটিক সম্পর্ক নেই, কাজেই বিশেষ করে গ্রামীন ইকোসিস্টেমের আন্ত:প্রজাতিক সম্পর্কের চেইনে দীর্ঘমেয়াদে এটা প্রভাব ফেলতে পারে। আর তাতে করে একসময় গ্রামীন জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়বে। দ্বিতীয়ত, মানুষ সবসময় আর্থিক লাভটার কথাই বেশি চিন্তা করে। কাজেই, দেশীয় ফলমূলের গাছের পরিবর্তে এ ধরনের দ্রুতবর্ধনশীল বনজ (মানে ফলজ নয়) সব জায়গা দখল করে নিলে সেটা একসময় স্থানীয় খাদ্য ও পুস্টি নিরাপত্তায়ও প্রভাব ফেলতে পারে।
এতো গেলো একদিক, এবার অন্য একটা দিক বলি।ইউক্যালিপ্টাসের সব যে খারাপ তাতো না। বিদেশি হলেও এটা তো শেষ পর্যন্ত একটা গাছই। পৃথিবীর সব দেশেই বিদেশী গাছ লাগানো হয়, কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রিত। কোথায় কতটুকু লাগানো হবে, কতবছর পর কাটা হবে, তারপরে কি হবে তার একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকে। যেটা আমাদের নাই। গ্রামে গ্রামে আমাদের কাঠের/জ্বালানী কাঠের যোগানে স্বল্পতা আছে। কিছু কাগজ ও লাম্বার ইন্ডাস্ট্রিও আছে যেগুলোর জন্য কাঠ দরকার। কিছু কিছু ফাঁকা বনভূমি (বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে) আছে যেগুলো দ্রুত বনায়নের আওতায় আনা দরকার, কিন্তু পরিবেশ/জলবায়ুগত কারনেই দেশীয় প্রজাতি দিয়ে সম্ভব না। সর্বোপরি, ব্যাপক জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের প্রাকৃতিক বনকে রক্ষা করতে এর চারপাশে দ্রুতবর্ধনশীল গাছ দিয়ে 'বাফার-স্ট্রীপ' বানানো এখন বিভিন্ন দেশে সফল একটি মডেল। এই সব কিছু বিবেচনায় ইউক্যালিপ্টাস ও অন্যান্য দ্রুতবর্ধনশীল গাছের যথাযথ ব্যবহারের জন্য সরকারের পরিকল্পনা ও গাইডলাইন থাকা দরকার। সেই সাথে দরকার চলমান গবেষনারও, যেন পলিসিগুলো অনুমাননির্ভর বা দাতাদের পরামর্শনির্ভর না হয়ে গবেষনার ফলাফলনির্ভর হয়।
--
মাথাইয়ের গ্রীনবেল্ট মুভমেন্ট সম্পর্কে জেনেছিলাম কেনিয়ায় তাঁরই এক কিনোট প্রেজেন্টেশনে। এখন পর্যন্ত দুজন নোবেল লরিয়েটের কিনোট শোনার সুযোগ হয়েছে (আরেকজন এলিনর অস্ট্রম), দুজনই মহিলা, দুজনই স্বল্প ব্যবধানে সম্প্রতি মারা যান।
অনেক অনেক ধন্যবাদ! আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানা হলো! এনজিও অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপরও সরকারি নিয়ন্ত্রন থাকার কথা।
বাংলাদেশের জলবায়ুর উপর এই টাইপ গাছগুলো কতটা হুমকিস্বরূপ বা আদৌ ক্ষতিকর কিনা এব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট গবেষণা না করেই, ব্যাপক ভিত্তিতে এই মনোকালচার প্লান্টেশন দেশের নীতিনির্ধারকদের কতটা বিচারবুদ্ধির পরিচয় দেয়!
দ্রুত বনায়ন হয়ত দেশী প্রজাতি দিয়ে সম্ভব না, কিন্তু আমার কষ্ট এই সো কল্ড বনায়নের নামে কত শত দেশী প্রজাতি যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে তার হিসাবও হয়ত কোথাও রাখা হয়না!
এই গাছ লাগানোর প্রাকটিস বহুত আগে শুরু হইলেও এখনো বহাল তবিয়তে চলে। আমাদের সরকারি কর্মচারিদের মাথায় যে কি পরিমান আবর্জনা থাকতে পারে তার প্রমাণ বৃক্ষরোপন কর্মসূচির নামে এখন অব্দি লাগানো এই রাক্ষুসে গাছ! তাড়াতাড়ি বাড়ে, বড়কর্তাদের দেখানো যায় যে আমরা কিছু একটা করেছি। চলুক বনায়ন।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
সাথে মিলিওন বিলিওন টাকার প্রজেক্টও দ্রুত পকেটে ভরা যায়! আমার কষ্ট সেই দেশী গাছগুলোর জন্য, যেগুলো এই এক তরফা প্লান্টেশনের শিকার হচ্ছে।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লিখেছেন, এই সমস্যা এখন সারা বিশ্ব জুড়েই আছে, কিন্তু কিছু কিছু দেশে বেশী- শুধুই গাছ নয়, যে কোন প্রাণীকে এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়, এই ভাবে নিয়ে যেয়েই মানুষ বারোটা বাজিয়েছে সব কিছুরই।
শুধু সবুজ হলেই প্রকৃতি হয় না, বিদেশী একটি গাছে কক্ষনোই দেশের পোকা আসবে না, দেশীয় পাখি খাবে না তার ফল, স্থানীয় প্রাণীর কাছে তার কোন মূল্য নেই--- এই বেসিক বোধ না নিয়ে কি করে বন কর্মকর্তারা কাজ করে উনারাই জানে।
ইউরোপের অনেক দেশেই চামড়ার এবং শিকারের জন্য অন্য দেশের প্রাণী আমদানি করা হয়েছিল, অনেক অনেক বছর পরে এখন বিপদের মাত্রা বোঝা যাচ্ছে
facebook
এই সোজা সত্যটা মানুষ বুঝেনা! প্রকৃতির আমারা ভালোটা নাহয় না করলাম অন্তত একে ধ্বংস না করি।
বন কর্মকর্তারা তো কোন গাছ বেচলে কত টাকা হবে সেইটার কয় ভাগ করা লাগবে এই হিসাব নিয়েই ব্যস্ত, তাদের অন্যকিছু ভাবার সময় কোথায়।
প্রকৃতির শোধতো আর একদিনে হয়না!
নতুন মন্তব্য করুন