অচিন

ঈপ্সিত আর চম্পাকলি এর ছবি
লিখেছেন ঈপ্সিত আর চম্পাকলি [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৮/০৮/২০১২ - ১:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(১)
-"হ্যালো হলধরবাবু, আমি সমীর বলছি, মিত্র আন্ড সন্স মিউজিক গ্যালারি থেকে। আপনার জন্য একটা দারুন জিনিস জোগাড় করেছি"
-"হ্যাঁ হ্যাঁ ক্লাসিকালের লং প্লেয়িং, খোদ ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের গাওয়া।"
-আরে না না, খাঁ সাহেবের গাওয়া হলেই কি জনপ্রিয় হতে হবে? আপনাকে তো আগেও খাঁ সাহেবের গাওয়া কয়েকটা লং প্লেয়িং দিয়েছি, কলকাতায় কজন সে সব রাগ শুনেছে হাতে গুনে বলতে পারবেন।"
-“আরে না, এখনকার কেউ এসব গাওয়া দূরে থাকুক নাম পর্যন্ত শোনেনি। খাঁ সাহেব নিজেও মনে হয় না কোনো জলসায় এই রাগ টা গেয়েছেন, শুধু লং প্লেয়িং রেকর্ডটাই যা আছে।"
-হ্যাঁ আমার কাছে এল.পি. রেডি আছে, আমি হাতে নিয়েই কথা বলছি। আজই পেয়ে যাবেন।"
-"ও আসতে পারছেন না? তা কাউকে পাঠিয়ে দিন।"
-"ও আচ্ছা, সে নাহয় আমি যেতে পারি, কিন্তু আজ তো হবে না, কাল হলে হবে?"
-"সকাল দশটার মধ্যে? আচ্ছা সে পেয়ে যাবেন, আমি সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়ব।"
-"রাগের ডিটেলস? সেটা তো এক্ষুনি দিতে পারছি না। আচ্ছা আমি একবার পন্ডিত উল্লাস চক্রবর্তীকে ফোন করে দেখি, উনি বলতে পারবেন।"
-"দামের কথা আপনাকে আর কি বলব। আপনার সাথে তো রেগুলার বেচাকেনা করছি। আজকাল এসব জিনিসের কদর কজনই বা করে বলুন। আপনি করেন বলেই জিনিসটা হাতে আসতেই আপনাকে প্রথম ফোন করলাম। অন্য কারোর সাথে দরদাম করতেই যাই নি।"
-"এসব জিনিসের দাম তো আর টাকায় হয়না স্যার, আপনার মত জহুরীকে সে কথা আর কি বলব। তা আপনি নাহয় দশহাজার দেবেন। প্রায় কেনা দামই বললাম।"
-"ধন্যবাদ স্যার। রাখছি এখন; কাল দশটার আগেই নাগেরবাজারে পৌঁছে যাব।"
ফোনটা রেখে সমীর দোকানের কর্মচারী সুরেশবাবু কে বলল "পন্ডিত উল্লাস চক্রবর্তীর ফোন নাম্বারটা বার করুন তো।"
সুরেশবাবু একটা খাতা খুলে নাম্বারটা খুঁজতে খুঁজতে বললেন "খাঁ সাহেবের লং প্লেয়িংটা তা'লে হলধরকেই গছালে? পুরো দশ না দরদাম কিছু হল?"
সমীর একগাল হেসে বলল "পুরো দশ, এবং কালই পুরো পেমেন্ট করবেন ক্যাশে, এসব জিনিস নিয়ে হলধরবাবু দরাদরি করেন না।"
সুরেশবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন "তা ঠিক, তবে ও জিনিস কদর করার এলেম হলধরের নেই।"
সমীর একটু অবাক হয়ে বলল "কেন? হলধরবাবু ত প্রায়ই ক্লাসিকালের সিডি, রেকর্ড কেনেন। কথাবার্তা শুনে মনে হয় এসব ব্যাপারে বেশ ওয়াকিবহাল।"
সুরেশবাবু বললেন, "আরে দূর জ্ঞান মানে তো বইপড়া বুলি কপচানো। তার বারোআনা আবার তোমাদের ওই এঁচড়েপাকা রজতবাবুর থেকে শেখা। এসব হল তোমাদের ওই বিদগ্ধ সমাজ না কি বলে, তাতে কল্কে পাবার চেষ্টা। হলধরদের আমি চিনি না? আগে এক পাড়ায় ভাড়া থাকতাম, পরে ওরা নাগেরবাজারে জমি কিনে বাড়ি করে উঠে গেল। দমদম এয়ার্পোর্টের কাস্টমস ডিপার্টমেন্টে সেই ক্লার্ক হয়ে ঢুকে এই বিশ বছরে ঘষে ঘষে এখন অফিসার হয়েছে, ঘুষের টাকায় সংসার চলে আর মাইনেটা ব্যাংকে জমা হয়, শুধু ঘুষের টাকাই বা বলি কেন, আটক করা সব ইম্পোর্টেড বিদেশী সামগ্রীতেই তো ঘর ভর্তি, মায় নেমন্তন্ন বাড়িতেও ওই জিনিসই 'উপহার' বলে মুড়ি-মুড়কির মত বিলায়। বউ তো কবেই মরেছে, থাকার মধ্যে শুধু এক মেয়ে, তাও শুনি মামাবাড়িতে মানুষ হয়। কাজেই পয়সার যে গাছ-পাথড় নেই, বুঝতেই পারছ, এবার নাম কামাবার ধান্ধায় ক্লাসিকালের জগতে ঢোকার চেষ্টা করছে। কি জানো, এসব লোক ভালো মার্গ সংগীত শুনলে বাহা বাহা বলতে পারে, কিন্ত আহা বলতে পারেনা।"
সমীর একটু হাল্কা গলায় বলল "আহা চটছেন কেন দাদু, হলধরবাবু নিজে রসগ্রহণ না করলেও রজতবাবুর মত পাঁচজন বোদ্ধাকে তো ডেকে এই সব রেকর্ড শোনান। এই তো গতমাসের পত্রিকাতে রজত বাবু লিখেছেন হলধরবাবুর দুর্লভ মার্গ সংগীত সংগ্রহের কথা।"
সুরেশ বাবু একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন "আরে রাখো, জানো না তো হলধরের কান্ডকারখানা। ওই তো তোমাদের অলকবাবু বলছিলেন হলধর নিজের বাড়িতে মাসে দুমাসে বড়সড় পার্টি দেয়। তোমাদের রজতবাবু, অলকবাবুর মত গায়ক, সমালোচকরা যান। তখন নাকি এইসব দুস্প্রাপ্য লং প্লেয়িং এর সংগ্রহ নিয়ে হলধর বাজী ধরে। বাজ়ী জিতলেই পাওয়া যায় দামী বিলিতি মদের বোতল বা মোবাইল ফোন বা এম.পি.থ্রী প্লেয়ার বা ওইধরণের কিছু। বাজী জিতলেও ওর লাভ, হারলেও লাভ।"
সমীর অবাক হয়ে বলল "হারলেও লাভ কেন?"
সুরেশবাবু বললেন "আরে বুঝলে না? তাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে ওর সংগ্রহ কতটা সমৃদ্ধ, এবং হারলেও ওর সংগ্রহের সেই অপ্রসিদ্ধ রাগিণী বা কোন প্রাচীন ঘরানার গায়িকার রেকর্ডের কথা রজতবাবু লিখে দেন কোনো পত্রিকার 'পেজ থ্রী'-তে। বাজী হারলে যে জিনিসটা খোয়াতে হয়, সেটাও পয়সা দিয়ে কিনতে হয়নি, মনগড়া আইনের ভয় দেখিয়ে কোন ভ্যাবাচ্যাকা-খেয়ে-যাওয়া বিদেশী টুরিস্ট-এর থেকে আত্মস্মাৎ করা হয়েছে হয়ত! এর চাইতে সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে কেউ কোনদিন বাজী ধরেছে বলে আমার জানা নেই।"
সমীর বলল "তা রজতবাবু যখন লিখছেন তার একটা দাম আছে বইকী। উনি হলেন বাংলার উচ্চাংগ সংগীতের জগতের একজন নামকরা সমঝদার আর সংগীত সমালোচক। কত পত্রপত্রিকায়, খবরের কাগজে ওনার সঙ্গীত সমালোচনা নিয়মিত বের হয়। একেকটা নামকরা কাগজে ওনার রীতিমত নিয়মিত বিভাগ আছে। আজকালকার দিনে শাস্ত্রীয় সংগীতের সমালোচক হিসাবে এত নাম করা মুখের কথা নয়, লোকটার এলেম আছে।"
সুরেশবাবু বিরক্ত স্বরে বললেন "ছাড়ো তো, সেই নাইটিন ফিফটি থেকে এই সব সমালোচকদের দেখে আসছি। সে সব লোক ছিলেন তোমার ঠাকুর্দার আমলে। বড় বড় ওস্তাদদেরও ভুল হলে ছেড়ে কথা কইতেন না। তোমাদের রজতবাবুকে কেউ এক বোতল মদ গেলালেই তার হয়ে চার কলম লিখে দেবেন।"
সমীর হেসে বলল "তা সে যাই হোক, রজতবাবুই কিন্তু হলধরবাবুর মত মক্কেলদের ধরে আনেন। আর নিজেও বেশ কেনাকাটা করেন। আপনিই বলুন না কজন সংগীত সমালোচক পয়সা খরচ করে সিডি কেনেন। সবাই যেখানে বাড়ি বয়ে এসে নিজেদের গানের সিডি দিয়ে যায়।"
সুরেশবাবু মোটেই খুশি হলেন না, শুধু বললেন, "তুমি শুধু ব্যাবসাই চিনেছ, তোমার ঠাকুর্দা কিন্তু গানটা ভালবেসে এইলাইনে এসেছিলেন।"
সমীর আর কথা বাড়ালো না । সুরেশবাবু ঠাকুর্দার আমলের কর্মচারী। মার্গসংগীতের সত্যিকারের বোদ্ধা। আজকালকার গানবাজনা, কালচার কিছুই পছন্দ হয়না। আধুনিক রক্‌, পপ্‌ ওঁর দুচক্ষের বিষ। সমীর নিজেও অবশ্য এইসব গান বিশেষ পছন্দ করেনা। যদিও সে আধুনিকীকরণ করে ঠাকুর্দার আমলের পুরোনো লং প্লেয়িং রেকর্ডের দোকান কে আধুনিক সিডি, ক্যাসেট এর দোকানে পরিনত করেছে। সাবেকি ফরাস, তক্তপোশ তুলে দিয়ে এখনকার শো-রুমের স্টাইলে এসি, সুন্দরী স্মার্ট সেলসগার্ল, কম্প্যুটারাইজড ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট, ক্রেডিটকার্ডে পেমেন্ট আমদানি করেছে। পেটের দায়ে এবং যুগের সাথে তাল মেলাতে রক্‌, পপ্‌, হিন্দী সিনেমার সিডি সবই দোকানে রাখে। কিন্তু ঠাকুরদার আমলের লং প্লেয়িং গ্রামাফোন রেকর্ডই সমীরের এই ব্যবসায় আসার মূল কারণ। তাই হলধরবাবুর মত ক্রেতাদের সে বিশেষ খাতির করে। সমীরের কাছে ইনি একজন শাঁশালো মক্কেল। প্রায়ই সমীরের দোকান থেকে উচ্চাংগ সংগীতের সিডি ক্যাসেট কেনেন। তবে ভদ্রলোকের আসল নেশা হল দুষ্প্রাপ্য উচ্চাংগ সংগীতের লং প্লেয়িং গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ। পুরোন দিনের বিস্মৃতপ্রায় গায়ক গায়িকাদের গাওয়া গান; কোনো বিখ্যাত গায়কের প্রথম যুগের গাওয়া অধুনালুপ্ত রাগরাগিনী এইসমস্তই হলধরবাবুর পছন্দের তালিকায়। আর কলকাতায় লং প্লেয়িং গ্রামাফোন রেকর্ড পাওয়া যায় এমন দোকান বোধহয় হাতে গোনা যায়, তাই সাধারণ ক্রেতার সাথে সাথে "নীশ্‌ ক্লায়েন্টেল"-এর একটা বড় অংশই আসে সমীরের দোকানে।
(২)
এই নিয়ে তৃতীয়বার সমীর নাগেরবাজারে রেকর্ড পৌঁছতে আসছে। হলধরবাবুর বাড়িতে কলিংবেল নেই। বাগান পেরিয়ে বারান্দায় উঠতেই একটা অতি পরিচিত ঠুংরী একদম অপরিচিত গায়কীতে শুনতে পেল। "ক্যা করুঁ সজনী, আয়ে না বালম" ঠুংরী টা চিরকাল খাঁ সাহেবের গম্‌গমে গলায় শুনতে অভ্যস্থ, এরকম বিরহ মলিন হাহাকার মেশানো ঢঙ্গে প্রথম শুনল। গাওয়ার ধরন এতটাই অন্যরকম যে মনে হয় না গায়িকা ঠুংরীটা কখনো খাঁ সাহেবের গলায় শুনেছে।
সমীর ভেতরে ঢুকে দেখল একটা বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে তানপুরা হাতে বসে তন্ময় হয়ে গাইছে। ওর পায়ের শব্দে মেয়েটি চমকে উঠে ওর দিকে তাকালো।
সমীর বলল "হলধরবাবু আছেন? আমি সমীর, মিত্র আন্ড সন্স মিউজিক গ্যালারি থেকে আসছি। একটা ডেলিভারি আছে।"
মেয়েটি বলল "আপনি বসুন, বাপিকে ডেকে দিচ্ছি"। মেয়েটির রিনিরিনি স্বরে যেন ঘরে জলতরঙ্গের বাজনা বেজে উঠলো। ওকে ঘরে বসিয়ে মেয়েটি বেড়িয়ে গেল। সেদিকে সমীর মুগ্ধদৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। মেয়েটাকে কি সুন্দরী বলা চলে? আমাদের দেশে সুন্দরীর প্রথম শর্তই হল গৌরবর্ণ। কিন্তু একে ঠিক ফর্সা বলা চলে না। ইনফ্যাক্ট ওই পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপণের পাতার বর্ণনার মত উজ্জ্বল শ্যামবর্ণও নয়, ওর গায়ের রঙটা মাটি আর সবুজের মেলামেশায় তৈরী। সতেজ, সবুজ এবং সরস। ওর চোখদুটোয়, একটা অতল গভীরতা আর উচ্ছল প্রাণশক্তির অদ্ভূত মিশ্রণ। মেয়েটাকে দেখে মনে হয় ওর মধ্যে আলো আছে আগুন নেই। দীপ্তি আছে, তেজ নেই।
"এই যে সমীর কতক্ষন বসে?" হলধরবাবুর গলার আওয়াজে সমীর চমকে ফিরে তাকাল। "কই কি জিনিস আনলে দেখি" বসতে বসতেই হলধরবাবু ওর হাত থেকে রেকর্ডের প্যাকেটটা নিয়ে নেন। বোঝাই যাচ্ছে উনি বেশ উত্তেজিত। সমীর জিজ্ঞাসা করল "রেকর্ডটা চালিয়ে শুনবেন তো? আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।" হলধরবাবু হাত নেড়ে বললেন "আরে না না তুমি যখন বলেছ ভাল কন্ডিশনে আছে তখন আর শোনার দরকার নেই। তুমি বরং আমাকে রাগটা সম্পর্কে ভাল করে বুঝিয়ে দাও।" মুশকিল হল সমীর উচ্চাংগ সংগীতের বিশেষজ্ঞ নয়, শুনতে ভালবাসে এই পর্যন্ত। আগে দুচার বার অবশ্য ও হলধরবাবুকে বিভিন্ন রাগিনী সম্পর্কে এটা ওটা বলে দিয়েছে। কিন্তু আজকে মুশকিল হল এই রাগটি একেবারে অপ্রচলিত, বলতে গেলে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে, তাই সমীর এই রাগের বিষয়ে কিছুই জানেনা। তবে হলধরবাবুর প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে জানত বলে ও তৈরী হয়েই এসেছিল। কাল সন্ধ্যাবেলাতে দোকান থেকেই ও পরিচিত পন্ডিত উল্লাস চক্রবর্তীকে ফোন করে এই রাগের পুরো ডিটেইল নিয়ে রেখেছিল। প্রবীণ পন্ডিত উল্লাসজী ওর বাবার আমল থেকেই ওদের এই দোকানের যাকে বলে 'পেট্রন'। বহুদিনের সম্পর্ক আছে ওদের সাথে। উল্লাসজী ফোনে রাগটার নাম শুনে প্রথমে মনে করতে পারেননি এটার সম্পর্কে কোন তথ্য, বলেন যে খানিক পরে নিজেই ফোন করে ওকে জানিয়ে দেবেন। এবং তাই করেন। 'রাগ চন্দ্রিকাসার', 'অভিনব রাগমঞ্জরী'র মত সব প্রাচীন কিন্তু প্রামাণ্য পুঁথি ঘেঁটে অনেক কষ্টে খুব সামান্য ডিটেলসই দিতে পারেন শেষ পর্যন্ত। সামান্য কয়েকটা তথ্য, কাজেই হলধরবাবুকে মুখে মুখেই বলে দিল রাগের নাম, কোন ঠাট, কোন রাগাঙ্গের রাগ, বাদী, সম্বাদী, বিবাদী স্বর, রাগের চলনটা কিরকম, আর কোন, কোন রাগের সাথে মিল আছে ইত্যাদি খুঁটিনাটি তথ্য। হলধরবাবু সন্তুষ্ট হলেন। রাগটি যে খুবই দুস্প্রাপ্য এটা শুনে ওঁনার মুখের হাসি বেশ চওড়া হয়ে উঠল। চাকরকে ডেকে চা জলখাবার আনতে বললেন।
চা খাবার নিয়ে চাকরের সাথে সেই মেয়েটিও ঘরে ঢুকলো। হলধরবাবু আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন "এই যে সমীর আমার মেয়ে সোহিনী, ও কিন্তু শুধু শ্রোতা নয়, নিজে ক্লাসিকাল গায়। লখনৌ এ বছর দশেক তালিম নিয়েছে।"
সমীর জিজ্ঞাসা করল "কার কাছে শিখতেন আপনি?"
সোহিনী জানালো প্রথম কয়েক বছর মামার কাছে শিখেছে। তিনি প্রায় চল্লিশ বছর উচ্চাংগ সজ্ঞীতের চর্চা করছেন, তবে সুযোগের অভাবে নাম করতে পারেন নি। গত চার বছর প্রসিদ্ধ ঠুংরি গায়িকা নীরজাদেবীর কাছে তালিম নিয়েছে। হলধরবাবু বললেন "ওর এখানে জলসা টলসায় গাওয়ার ইচ্ছা আছে, কিন্তু ও তো আবার গোঁ ধরে বসে আছে ক্লাসিকাল ছাড়া আর কিছু গাইবে না। আজকাল কি লোকে অত ক্লাসিকাল শোনে না বোঝে? গান গেয়ে নাম করতে হলে সবরকমই গাইতে হবে।"
সোহিনী শান্ত কিন্তু দৃঢ় ভাবে বলল "যা গাইতে ভাল লাগে না সেসব গাইব কি করে, তাতে যদি জলসায় গাওয়া না হয় নাই হবে।"
হলধরবাবু বললেন "আরে আজকাল কি আর পিওর ক্লাসিকাল চলে রে, দেখিস না বড় বড় ক্লাসিকাল শিল্পীরাও সব বলিউডে গান গাইতে দৌড়চ্ছে।"
সোহিনী বলল "দেখ বাপি, টাকা তো আমাদের ঢের আছে, নামডাকের মোহ একেবারে নেই সেটা বলব না, তবে সেটাই আসল কথা নয়, আমার গানের একটা নিজস্ব স্টাইল আছে, শুধু গায়কী নয় , তাছাড়াও আরো কিছু। ক্লাসিকালটা আমি শুধু চর্চা করিনি, এই নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি, ভাবনাচিন্তা করেছি, নিজের গানে সেই ভাবনা, চিন্তা, বিদ্যাকে রূপ দিতে চেষ্টা করেছি। আমি চাইছি পাঁচজন শ্রোতা, সমঝদারের মধ্যে সেই ভাবনা ছড়িয়ে দিতে। আমি শুধু গান গেয়ে নাম করতে চাই না , চাই আমার নিজস্বতার স্বীকৃতি।"
এটা সমীর আগেও দেখেছে। বেশীরভাগ নবীন শিল্পী মনে করে তার স্টাইলটা একেবারে ইউনিক, একবার একটা ব্রেক পেলেই বাজারে হইহই পড়ে যাবে। ও হাল্কা ভাবে বলল "আজকাল কিন্তু বলিউডেও অনেক ভাল এক্সপেরিমেন্টেশান হচ্ছে, এই তো "দিল্লী সিক্স" নামের একটা অভিষেক বচ্চনের ফিল্মে এ আর রহমান একটা গানে বড়ে গোলাম আলী খাঁ সাহেবের গলায় টোড়ী রাগটার সাথে শ্রেয়া ঘোষালের গলাটা এমন ভাবে যান্ত্রিক কারসাজীতে মিলিয়েছেন, ঠিক মনে হচ্ছে যেন দুজনে পাশাপাশি বসে রেওয়াজ করছে। পারভিন সুলতানা, অজয় চক্রবর্তী, রশিদজী সব্বাই আজকাল ফিল্মে গান গাইছেন বা গেয়েছেন।"
সোহিনী হেসে বলল "কিন্তু তাই বলে এঁদের কাউকেই 'কালে কালে বাল, গোরে গোরে গাল' টাইপের গান গাইতে হয়নি নিশ্চই।"
হলধরবাবু বললেন "আরে এসব গেয়ে একবার বিখ্যাত হয়ে যা, তখন তুই যা করবি তাই স্টাইল হয়ে যাবে।"
সোহিনী সজোরে বলল "না বাপি, ওভাবে বিখ্যাত হয়ে লাভ নেই। একবার বাজার চলতি গান গেয়ে পপুলার হয়ে গেলে তখন আর ফেরা মুশকিল। লোকে যদি আমার গলায় আইটেম নাম্বার শুনতে অভ্যস্থ হয়ে যায় তখন আর সিরিয়াস গান শুনতে চাইবে না। যেরকম কমিক অভিনেতারা সিরিয়াস পার্ট করলেও লোকের হাসি পায়।"
হলধরবাবু হতাশ হয়ে বলেন "তবে আর কি তোর মামার মতই হবে শেষকালে, অত ভালো গেয়েও নাম করতে পারল না।"
সোহিনী বলল "না বাপি, মামার ব্যাপার আলাদা। মামা কাউকে শোনানোর জন্য ব্যস্ত ছিলেন না, গাইবার আনন্দে গেয়ে গেছেন। কিন্তু আমি পুরোপুরি প্রফেশনাল। ভালো ব্রেক পাবার জন্য ধরাকরা যা করার সবই করব। আর আজকাল হল মার্কেটিং আর প্যাকেজিং এর যুগ। সেই কাজটা ভালো করে করলে ব্রেক পেতে দেরী হবে না। এই সমীরবাবুকেই দেখো না, স্রেফ প্যাকেজিং এর জোরে কবেকার পুরোনো ধুধ-ধুরে লং প্লেয়িং তোমাকে দশ হাজার টাকায় বেচে দিলেন, আর আমি তোমার মত হাই-প্রোফাইল বাবা থাকতে কলকাতায় কয়েকটা পিওর ক্ল্যাসিকালের প্রোগ্রাম পাব না!"
সোহিনীর এতটা খোলাখুলি কথায় সমীর আর হলধরবাবু দুজনেই একটু লজ্জিত হলেন।
হলধরবাবু বললেন "আচ্ছা সে হবেখন। এখন একবার দেখ্‌ তো মা বিকেলের খাওয়া দাওয়ার কতদুর কি হল। রজতবাবুরা সবাই ছটা নাগাদ এসে পড়বেন।"
সোহিনী ভেতরে চলে গেলে সমীরও ফেরার পথ ধরল । সোহিনীর শেষ কথা গুলো ওকে একটু অপদস্থ করলেও সমীর ওর নজর আর বুদ্ধির তারিফ না করে পারল না। গানবাজনার দোকানের সুবাদে উঠতি গায়িকা সমীর অনেককেই দেখেছে। বেশীরভাগ-ই যেকোনো উপায়ে নাম করতে চায়, আপোষ করতে আপত্তি নেই। তবে সঙ্খ্যায় নগন্য হলেও দুএকজন আছে সত্যিকারে শিল্পী। কোনোমতেই কোনো আপোষ করে না। কিন্তু সোহিনীকে কোনো ছাঁচেই ফেলা গেল না। গানের ব্যাপারে এতটা আপোষহীন অথচ ব্রেক পেতে মরিয়া এই মেয়েটা কোন ধরণের? মেয়েটার সাহস আছে। না হলে খাঁ সাহেবের "আয়ে না বালাম" এর মত সুপরিচিত ঠুংরী কে সম্পুর্ন অন্য স্টাইলে গাইতে পারত না। গলাটা আহামরি কিছু না হলেও নিজের স্টাইল নিয়ে বড়াই সে করতে পারে বটে। ঠিক বড়াই বা অহংকার নয়, সোহিনীর কথায় মনে হয় ও খুব আত্মবিশ্বাসী। ওর কথার ধরন এমন স্পষ্ট অথচ কৌতুকপূর্ণ, যখন বলছিল সমীরের মনে হচ্ছিল আর একটু বলুক। ওর সাথে কার যেন একটা মিল আছে। পরিচিত কারোর নয়। কোনো একটা বইতে কার যেন একটা বর্ণনা ছিল- "কৃষ্ণবর্ণা, দীর্ঘাঙ্গিনী, ভ্রমরাক্ষী" - সেই চরিত্রটাও এরকম-ই ঋজু, দৃঢ়, দীপ্তিময়ী।
(৩)
হলধরবাবুর বাড়ি তে বিকেলের মজলিস বেশ জমে উঠেছিল। রজতবাবু, প্রনববাবু, অলকবাবু কলকাতার তিনজন নামকরা সংগীত সমালোচক, প্রখ্যাত তবলাবাদক সঞ্জয় সেনরায় এবং উঠতি কিন্তু রজতবাবুর কৃপাধন্য উচ্চাংগ সংগীত গায়ক প্রমিত নাগ হলধরবাবুর সাবেকি আমলের বৈঠকখানায় জমিয়ে বসেছিলেন। গল্পগুজব চলছে, প্রমিত মালকোষ রাগে একটা ছোট খেয়াল গাইল। সোহিনী খাম্বাজে একটা ঠুংরী শোনালো। সঞ্জয় দীপচন্দী তালে লহরা পরিবেশন করে। সোহিনী চা জলখাবার পরিবেশন করল। সোহিনীর লখনৌ এ মামারবাড়ীতেও গানবাজনার আসর বসত। মামা আর মামার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ছিলেন সেই আসরের গায়ক। ওঁরা সকলেই খুব ভালো গাইতেন কিন্তু কেউই পেশাদার নন। আজকের আসরে যাঁরা এসেছেন তাঁরা কলকাতার নামকরা গায়ক, বাদক বা সমালোচক। এঁদের লেখা নাম করা পত্রপত্রিকা তে ছাপা হয়। প্রমিত বাবু, সঞ্জয়বাবু বড় জলসাতে নিয়মিত গান বাজনা করেন। সোহিনীর ইচ্ছা উচ্চাংগ সংগীতের পেশাদার গায়িকা হবার। তাই এঁদের সাথে আলাপ পরিচয় হবার সুযোগ পেয়ে সোহিনী সামান্য উত্তেজিত ছিল।
চা খাবার সময় আসরের সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছিল। হলধরবাবু একবার ভেতরে গেলেন। সঞ্জয় তবলায় ঠুকঠাক করছে, অন্যরা এদিক ওদিকে ঘুরছে, রজতবাবু চায়ের কাপ নিয়ে সোহিনীর পাশে এসে বসলেন। এটা ওটা কথা চলছিল। সোহিনীর ছোটবেলার কথা, গান, রজতবাবু কোন্‌ কোন্‌ পত্রপত্রিকায় লেখেন, কত লোকে ওনাকে বই লেখার জন্য ধরেছেন এইসব আলোচনা হচ্ছিল। রজতবাবু তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসেছিলেন, কথাবার্তার মধ্যে পা ছড়িয়ে প্রায় আধশোয়া হয়ে পড়েছিলেন। সোহিনী ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে দেয়ালের দিকে সরে বসছিল। রজতবাবু মোটা মানুষ, বোধহয় বেশীক্ষন পা মুড়ে মাটিতে বসতে পারেন না। কিন্তু সোহিনীর বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। সঞ্জুয় হঠাৎ বলে উঠল "একটু পাউডার হবে?" সোহিনী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াবার সু্যোগ পেয়ে বেঁচে গেল। কিন্তু দাঁড়ালেও রজতবাবু কে না ডিঙ্গিয়ে ও এগোতে পারছিল না। রজতবাবু সরবার কোনো লক্ষণ না দেখিয়ে সঞ্জয়কে বললেন "আরে চাকরটাকে বলনা, ওই যে বাইরে বসে আছে। সব কাজে মেয়েদের হুকুম করার প্রিমিটিভ অভ্যাস টা বদলাও। তুমি বস তো সোহিনী।" সঞ্জয় একটু লজ্জা পেয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু সোহিনীর পক্ষে বসা সম্ভব হচ্ছিল না। উঠে দাঁড়াবার পর আর বসার মত জায়গা অবশিষ্ট ছিল না। ও ইতস্তত করছিল। রজতবাবু হঠাৎ ওর হাতে হাল্কা টান দিয়ে বললেন "বস বস। হ্যাঁ যা বলছিলাম..." হাতে টান পড়তে সোহিনী চমকে উঠল।
তখুনি একগাল হাসি নিয়ে হলধর বাবু ঘরে ঢুকলেন। ওঁর হাতে একটা লং প্লেয়িং রেকর্ড, তবে রেকর্ডের বাক্সটা নেই। সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন "দেখুন একবার কি জিনিস পেয়েছি। আপনাদের অপেক্ষাতেই ছিলাম। আজকের মজলিশে ইনিই হলেন মধ্যমণি।"
হলধরবাবু ধীরে সুস্থে তাঁর গ্রামোফোনে সমীরের দেওয়া সেই দুষ্প্রাপ্য রেকর্ড চড়ালেন। পিনটা ছেড়ে দেওয়ার আগে বললেন, "আজকে আপনাদের একটা অতি দুষ্প্রাপ্য রেকর্ড শোনাব। বড়ে গোলাম আলী খাঁ-এর গলায়। দেখি আপনারা কেউ এই রাগটিকে সঠিক পেহচান করতে পারেন কিনা। এ জিনিস বাজারে পাবেন না, এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। খাঁ সাহেব কোনদিন এই রাগ কোন জলসায় নাকি পরিবেশন করেননি। শুধুমাত্র একবার-ই 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস' থেকে তাঁর এই রেকর্ড বেরিয়েছিল। তাও বেশী না। সে যাই হোক, মোটের ওপর এই রাগ এখনকার দিনে আর গাওয়া হয়না, খাঁ সাহেবও তাঁর জীবদ্দশায় আর কখনো গাননি। আমি বাজী ধরে বলতে পারি যে এ জিনিস আপনারা আগে শোনেননি, বা আজকে শুনেও ঠিক মত চিনতে পারবেন না। এর জন্য আমি ‘জ্যাক ড্যানীয়েলসের’ ইম্পোর্টেড ‘টেনেসী হ্যুইস্কী’ বাজী ধরতে পারি। ও জিনিস আপনারা এখানে হাজার খুঁজলেও পাবেন না।"
প্রমিত বলল, "হলধরবাবু, আমি রাজী। আমার কাছে পটমঞ্জরী রাগের এক দুষ্প্রাপ্য বন্দীশ আছে, হেরে গেলে আপনাকে দিয়ে যাব। তা দাদা জ্যাক ড্যানীয়েলসটা আসলী চীজ তো? ওই ব্ল্যাক লেবেলটার আসলে এত ডুপ্লিকেট বেরিয়ে গেছে!"
পটমঞ্জরীর দুষ্প্রাপ্য বন্দীশ হলধরবাবুকে খুব একটা আকৃষ্ট করল না। হলধরবাবুর মূল লক্ষ্য রজতবাবু। প্রমিত তো আর তাঁর সংগ্রহের কথা কাগজে দুকলম লিখবে না। পটমঞ্জরীর বন্দীশ সমীর কে বললেই জোগাড় করে দেবে। কিন্তু রজতবাবু আজ কেমন যেন অন্যমনস্ক আছেন। ওঁদের কথাবার্তা ঠিক কানেই যাচ্ছে না। হলধরবাবু বাজ়ী ধরার উত্তেজনায় খেয়াল করেননি, রজতবাবুর দৃষ্টি বার বার সোহিনীর মুখে, বুকে, কোমরে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল। হলধরবাবু আবার বললেন "বাকী সবাই চুপ কেন? কি হে রজত তুমি কি বল? গতবার বাজ়ী হেরেছিলে বলে ভয় পেয়ে গেলে না কি?"
রজতবাবু একটু বিরক্ত গলায় বললেন, "আরে, রাখো তোমার সেই চোরাই মদের কারবার। ওহে প্রমিত, ও এমন কিছু হবে না হে, বড়জোর একটা চাঁদনি-কেদার অথবা মালিয়া-মারোত্তম বেরুবে। ও তুমি চিনেই ফেলবে। পটমঞ্জরী তোমায় খোয়াতে হবেনা।"
হলধরবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, "বাজে বোকো না, রজত, এই রাগ যে-সে রাগ নয়। তুমি হাজার ঘুরলেও বাজারে পাবে না। তোমায় বলি শোন, বুড়ো ওস্তাদ, পন্ডিত-রাও সবাই এর নাম শোনেনি, তোমার সন্দেহ থাকলে তুমি নিজেই লড় না কেন?"
রজতবাবু স্থির চোখে একবার হলধরবাবুর দিকে আর একবার সোহিনীর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, "তা হলে স্টেক বাড়াও হে। পুরোনো মদের বাজী লড়ে চাঁদনি-কেদার ধরে দেওয়া যায়, এ যদি অতই দুষ্প্রাপ্য তাহলে তোমার বাজীর দর আরও ওঠা উচিৎ!"
- "হ্যাঁ, বল, কি বাজী ধরলে তোমার মনে ধরবে? আমি আজকে শীওর যে কেউ এ চীজ আগে শোনেনি।"
- রজতবাবু কাটা কাটা স্বরে বললেন "যদি বলি বাজী জিতলে সোহিনীকে বিয়ে করতে চাই?" একটু থেমে বললেন "রাগ চিনতে না পারলে, আমি আমার সবকটা পত্রিকায় সোহিনীর একটা ডিটেইল রিভীউ লিখে দেব, যাতে ওর রাগদারি, রাগ উন্মোচন, তানকারি সবকিছুর থাকবে ভূয়সী প্রশংসা। ভেবে দেখো হলধর, সোহিনী যতই ভালো গাক, কোনদিনই কিন্তু সেভাবে কোন ব্রেক পাবে না। আমি ওকে সেই ব্রেক পাইয়ে দেব। আনন্দবাজার, বর্তমান, এমনকি আমার বন্ধুদের বলে টাইমস অফ ইন্ডিয়া, স্টেটসম্যান, টেলীগ্রাফ, সব কটা কাগজে পরপর বেরুবে ওর সমালোচনা। হৈ হৈ পড়ে যাবে বাংলায়। সোহিনী রাতারাতি স্টার বনে যাবে। সঙ্গীতচক্র, জলসা, মজলিস, টেলিভিসন, রেডিও এক চান্সে সব কটা দরজা একসাথে খুলে যাবে হে। রাজী থাক তো বল? চেষ্টা করে দেখতে পারি তোমার এই রাগ পেহচানের।"
সব্বাই একেবারে অবাক হয়ে গেল এই অদ্ভূত প্রস্তাবে। প্রণববাবু দৃশ্যতই খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন, বললেন, "ওসব থাক রজতবাবু, এই মজলিসে মেয়েছেলে নিয়ে টানাটানি করে লাভ নেই, তার চাইতে প্রমিতের বাজ়ীটাই বহাল থাক বরং।"
সঞ্জয় অবশ্য নির্বাকই রইল। প্রমিত কিন্তু বেশ মজা পেয়েছে এই প্রস্তাবে, সে যদিও মুখে কিছু বলল না, ব্যাপারটা কোন দিকে গড়ায় না দেখে এই বাড়িতে আসার রাস্তা বন্ধ করতে চাইল না সে, তবু বোঝা গেল যে এতে তার অমত নেই, বরং সে এতে খুশীই হয়েছে। একবার শুধু মৃদুভাবে বলে উঠল, "হ্যাঁ, আমার পটমঞ্জরী তো বাঁধা রইলই।"
(৪)
সব্বাইকে চমকে দিয়ে হুলধরবাবুই বরং রজতবাবুকে বললেন, "ঠিক আছে, আমার আপত্তি নেই। তোমাকে কিন্তু তোমার কথা রাখতে হবে। কাগজে যেন এক সপ্তাহের মধ্যে আমার সোহিনীর গায়কীর প্রশংসা দেখতে পাই। ভাষার মারপ্যাঁচে না গিয়ে সোজা-সাপ্টা লিখতে হবে যে একালের উদীয়মান উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে সোহিনী অগ্রগণ্যা।"
সোহিনী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "বাপি, তুমি তো ধরেই নিচ্ছ যে তুমি বাজী জিতে গেছ, আর আমার রিভীউ বেরিয়ে গেছে, অন্যদিকের অসম্ভব প্রস্তাবটার কথা তোমার মাথায় আছে?"
"আরে হ্যাঁ রে মা, হ্যাঁ। সব দিক না ভেবে কি আর আমি রাজী হয়েছি? তোর কোন চিন্তা নেই। শোন তোকে বলি, তুই নিজেই হয়ত আমার থেকে বেশী ভালো জানিস যে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ পুরানো আইনকানুন মেনে বড় একটা চলেন না। ধৈর্য ঠাহরানের সাথে বিস্তার করে রাগ উন্মোচন ওনার ধাতে নেই। তুই তো জানিস-ই যে এর জন্য অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে ওনাকে। অনেকে মনে করেন যে উনি রাগদারির দিকে নজর না দিয়ে তাঁর গলার সার্কাস দেখিয়ে কাঁচা শ্রোতাদের উত্তেজনার সুড়সুড়ি দিতে বেশী ভালোবাসতেন। আর এ রাগ যা আজকে শোনাব, তা একেই অপ্রচলিত, তায় খাঁ সাহেবের নিজস্ব স্টাইলে গাওয়া। কাজেই চেনা সত্যিই কঠিন, কারণ চেনানোর জন্য উনি রাগটাকে পরিবেশন করেননি।"
"বাপি, এসব-ই কারো না কারো মতামত। আমার তো মনে হয় ওনার গাওয়া রাগেই সব থেকে বেশী করে সেই রাগের রঙ ধরে। না বাপী, রজতবাবুর কথায় যেও না। সে আমার ব্রেক পেতে হয় আমি এখানে বসেই পাব।
"না মা, বাড়ি বসে কেউ কোনদিন ব্রেক পায়নি, পাবেওনা, বিশেষ করে আজকালকার দিনে। আগে হলে তাও বা কথা ছিল। তোর কোন ভয় নেই রে, বলছি তো, এ রাগ একেবারে অপ্রসিদ্ধ। না হলে আমি কখনও বাবা হয়ে এই শর্তে রাজি হই?"
সোহিনী গোঁজ হয়ে বসে রইল। বাপি যখন বলছেই এতটা নিশ্চিন্ত হয়ে, তখন্ কি আর একেবারে না ভেবেচিন্তে বলছে? হয়ত এই ভবিতব্য। আজকের এই সন্ধ্যাই হয়ত তার জীবনকে অন্য খাতে বইয়ে দেবে। কিন্তু রজতবাবুর থলথলে মাঝবয়সী চেহারা আর লোলুপ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে, হেরে গেলে কি হবে ভেবে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। বাপির মত অত নিশ্চিত হতে সে পারছে কই? অবশ্য বাজী ধরাটা বাপির শখ, আর বাপী অনেক বেশী অভিজ্ঞ এ ব্যাপারে, কোনটায় কতটা ঝুঁকি সেটা বাপির থেকে কেউ বেশী বোঝে ব'লে তো মনে হয়না। দেখাই যাক না, কি হয় শেষ পর্যন্ত।
মধ্যলয়ের একতালায় বড়খেয়াল শুরু হ'ল। খাঁ সাহেবের রাগদারি যথারীতি ঐতিহ্যের গন্ডি ছাপিয়ে গেল তেরেকেটে ধিন পেরোতে না পেরোতে। মিড় ছিল, কিন্তু গমক, মুড়কিও ছিল। মন্দ্র সপ্তকের সা থেকে সপাটে অতিতারার সা অবধি পৌঁছে আবার খরজের সা-তে তড়িদগতিতে নেমে মুখড়ায় এসে পড়লেন সমে। শ্রোতৃবৃন্দের ধৈর্যচ্যূতি ঘটিয়ে এক ঘন্টা ধরে আলাপ করে রাগ উন্মোচনের কোনরকম চেষ্টাই খাঁ সাহেব করলেননা। ফলে পকড় অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠল। পরে ঝাঁপতালে নিজের তৈরি বন্দীশই 'সবরঙ্গ' ছদ্মনামে পরিবেশন করলেন। হলক সহকারে ভারী তান, তারসপ্তকে উঠে ফোয়ারার মত তান করে আবার শুদ্ধ ভাবে মুখড়ায় ফিরে আসা, এসবই এত অনায়াস ভঙ্গিমায় করলেন, যে অলকবাবু, রজতবাবুর মত বাঘা বাঘা সমঝদারেরাও হায় হায় করে উঠল। গান শেষ হলে মনে হল যেন ঘর থেকে ধূপের গন্ধ বেরুচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোন কথা বলল না, বা বলতে পারল না, এমনই সে গায়কীর রেশ।
হলধরবাবু গর্বভরে সবার মুখের দিকে একবার করে দেখে নিয়ে রজতবাবুর দিকে ফিরে বললেন, "হ্যাঁ, তো কি যেন বলছিলে, রজত, বলে ফেল। কি রাগ?"
রজতবাবু শান্তস্বরে শুরু করলেন, "প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে আমাদের ধাপে ধাপে এগোতে হবে। তাড়াহুড়ো করলেই বিপদ। প্রথম ধাপ হবে ঠাট চেনা। এইটা খুব একটা কঠিন কাজ নয়, তার অন্যতম প্রধান কারণ এই যে আমাদের হিন্দুস্থানী পদ্ধতিতে মাত্র দশটি ঠাট আছে। ভৈরব, ভৈরবী, বিলাবল, কল্যাণ, কাফী, পূর্বী, টোড়ী, খাম্বাজ, মারোয়া এবং আশাবরী। এই চীজ-এ স্পষ্টতই আন্দোলিত কোমল রে নেই, কোমল ধা-ও নেই, কাজেই ভৈরব, ভৈরবী আর আশাবরী ঠাট তিনটিকে আমরা সহজেই বাদ দিলুম। গোলাম আলী বারেবারে কোমল নি লাগিয়েছেন, কাজেই বিলাবল ঠাট-কেও বিসর্জন দিয়ে দিলাম কারণ বিলাবলে তো সবই সুদ্ধ স্বর লাগে। আর তীব্র মধ্যম ব্যাবহ্রত হয়নি, তাই কল্যাণ, পূর্বী, মারোয়া ঠাটকেও বাদ দিলাম। তাহলে হারাধনের দশটি ঠাটের থেকে সাতটি বাদ হয়ে গেল। রইল বাকি তিন। কে কে পড়ে রইল? খাম্বাজ, কাফী, আর টোড়ী। এখানে ওস্তাদজী সা, কোমল রে, কোমল গা কখনই লাগাননি পরপর, কাজেই টোড়ী-কেও বাদ দিয়ে দিলাম।। পড়ে রইল খাম্বাজ আর কাফী। কিন্তু আমরা জানি যে খাম্বাজ রাগে গান্ধার সুদ্ধ আর বেশ প্রবল। সুতরাং আমরা কি কি বাদ দিলাম? কাফী ছাড়া সব। এই পর্যন্ত বেশ সহজ ছিল। ভুল করাটাই বরং কঠিন ছিল। কী হলধর? ঠিক ধরেছি না ঠাট-টা?
হলধরবাবুর মুখটা একটু গম্ভীর হল, চোয়ালটা একটু যেন শক্ত। তবে উনি জানেন যে একটা ঠাট চেনা আর তার অন্তর্গত অসংখ্য রাগের মধ্যে থেকে সঠিক রাগটি নির্ধারণ করার মধ্যে অনেক পার্থক্য। তাও একটু অস্বস্তি তো বাড়লোই, ঠিক ঠাটটা রজতবাবু চিনে ফেলায়। তবে একেবারে প্রথম ধাপেই বাজী হেরে গেলে খেলার কোন মজা থাকে না এও ঠিক। আর রজতবাবু অতটা আনাড়িও নন যে ঠাটেই হোঁচট খাবেন। হলে কখোনই ঐ অদ্ভূত বাজী নিজে যেচে ধরতেন না।
রজতবাবু বলে উঠলেন, "আরে হলধরের মুখ শুকিয়ে গেল কেন? ছাদনাতলায় যেতে এখনো দেরী আছে তো, সবে তো রাগ-পেহচানের starter-এ আছি আমরা।" প্রমিত ফস করে বলে বসল, "রজতদা, dessert-টা কি ফুলশয্যায়?" হাসির একটা হড়্‌রা পড়ে গেল।
- "বাজে কথা রাখো! এ পর্যন্ত তো হারমনিয়ামে নতুন গলা সাধতে শুরু করা একটা বাচ্চাও বলে দেবে হে। এতে বাহাদুরিটা কোথায়?" হলধরবাবু গর্জে উঠলেন।
রজতবাবুকে দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে না যে উনি বিশেষ চাপ-এ আছেন, বেশ খোশমেজাজেই বললেন, "এবারে আমরা কাফী ঠাট থেকে উৎপত্তি যে সব রাগাংগ আছে, সেইগুলো বিশ্লেষণ করব। কাফী ঠাট থেকে উৎপন্ন রাগগুলি বিশিষ্ট রাগাঙ্গের পাঁচটি বর্গের অন্তর্গত। ধনাশ্রী, কাফী, সারংগ, মাল্লার আর কানাড়া রাগাংগ। ধনাশ্রী অঙ্গের রাগে সাধারণত পঞ্চম বাদী হয়। এটা ধনাশ্রী অঙ্গের নয় বলেই মনে হচ্ছে, কারণ ওস্তাদজী এটাতে পঞ্চমের উপর ন্যাস করেননি। আমি প্রথমে একবার ভাবছিলাম যে এটা ধনশ্রী রাগাঙ্গের হংসকংকণী রাগটা হতে পারে কারণ এটাও খুব অপ্রচলিত। কিন্তু সে চান্স নেই কারণ ধনশ্রী রাগাঙ্গটাই বাদ দিয়ে দিচ্ছি। কি হে হলধর? ধনাশ্রী ছেড়ে ভুল করলাম নাকি? আচ্ছা, ওই আলাপের জায়গাটা আরেকবার একটু বাজাবে?"
প্রমিত বলে উঠল, "না না, রজতদা, ঠিক-ই আছে মনে হচ্ছে, আপনি main course-এ চলে এসেছেন। সূপ, স্টার্টার, আপেটাইজারে যখন ভুল হয়নি, তখন আপনি নিশ্চিন্তে entree-তে মনোঃসংযোগ করুন দেখি। এতো সুন্দর বিদগ্ধ বিশ্লেষণ শোনার সুযোগ বা সৌভাগ্য তো আমাদের সচরাচর হয়না, বেশ লাগছে। আজকাল তো আসরে ইমন, দরবারী কানাড়া বা বেহাগ ছাড়া অন্য কিছু গাইলে আশাও করিনা যে শ্রোতৃবৃন্দ ঠিকঠাক চিনে নেবে। সব ছুঁচোর মত কানা হয়ে গেছে দাদা।"
রজতবাবু আবার স্মিতমুখে আরম্ভ করলেন, "কাফী অঙ্গের রাগ খুব সহজেই ছেলে-ছোকরারাও চিনে নিতে পারে, কারণ সা, সা, রে, রে, কোমল গা, কোমল গা, মা, মা, পা লাগালেই একেবারে প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে এটি কাফী রাগাঙ্গের। এই ক্ষেত্রে তা হয়নি, হলে অবশ্য হলধর এত নিশ্চিন্তে বাজী ধরে নিত না। তাহলে এই রাগাঙ্গে আর বিশেষ সময় না নষ্ট করে আমরা বরং বিখ্যাত মল্লার রাগাঙ্গ হাতড়ে বেড়ানো আরম্ভ করি। মল্লার রাগাঙ্গের কয়েটা অপ্রচলিত রাগের কথা আমার জানা আছে রূপমঞ্জরী মল্লার, মীরাবাঈ কী মল্লার, চরজূ মল্লার চঞ্চলসস মল্লার। মা রে পা - এই স্বরবিন্যাস এতই প্রসিদ্ধ যে একে মল্লারের signature বললেও ভুল হবে না। কিন্তু এখানে গোলাম আলী এই স্বর সঙ্গতি সেভাবে ব্যাবহার করেননি। মনে হচ্ছে মল্লার ছেড়ে দেওয়াই ভাল। উফফ, কোত্থেকে এই খাস মাল পেলে বলত হলধর?"
হলধরবাবুর মুখ কিঞ্চিত উজ্জ্বল হল। উদ্ভাসিত হয়ে বললেন, "তাহলে কি হাল ছেড়ে দিচ্ছ রজত? হ্যাঁ, মানছি যে এই রাগ খুব-ই প্রাচীন আর অপ্রচলিত। তবে এখনও প্রবীণ ওস্তাদরা এর পেহচান ঠিক-ই করতে পারেন, সে খবর আমার কাছে আছে।"
মেয়ের দিকে ফিরে চাপমুক্ত কন্ঠে বললেন, "কি মা, বলেছিলাম না, কোন ভয় নেই। আরে, আমি কি আর জেনেশুনে তোর কোন বিপদ ডেকে আনব?"
সোহিনী কিন্তু এখনো বেশ শক্ত হয়ে বসে আছে।
রজতবাবু অবশ্য থেমে যাননি। কতকটা নিজের মনেই যেন বলে চলেছেন, "এরপর তাহলে আমরা শক্তিশালী কানাড়া রাগাঙ্গের দিকে হাত বাড়াই। কানাড়া অঙ্গে গান্ধারের ওপর যে আন্দোলন হয়, তা এখানে একেবারেই নেই। তবে মুশকিল হচ্ছে যে গান্ধার একটু বক্র ভাবে কিন্তু খাঁ সাহেব লাগিয়েছেন, আর তাতে করেই আমাদের কাজটা ভয়ানক শক্ত হয়ে উঠেছে। তাহলে একবার রিভাইজ করে নেওয়া যাক এই কানাড়া প্রকারের একটু অপ্রচলিত রাগ-গুলি। যেমন সুঘরাই, সূহা, দেবসাখ, নায়কী-কানাড়া। যদিও কানাড়া অঙ্গের, তাও এদের উত্তরাঙ্গ কিন্তু সারঙ্গকে মনে করিয়ে দেয়। বহুশ্রুত রাগগুলি আমরা এমনিতেই ধর্তব্যের মধ্যেই ধরছি না, কাজেই খাঁ সাহেব-এর সম্ভবত সবথেকে popular দরবারী কানাড়া-কে পত্রপাঠ বিদায় জানালাম। কিন্তু অপ্রচলিত রাগ নিয়েই যত ঝামেলা, কানাড়া আর সারঙ্গের মধ্যে গুলিয়ে ফেলার সম্ভবনা প্রবল। সুঘরাই-এর গা থেকে খুব সারাঙ্গ সারাঙ্গ গন্ধ বের হয়। হয় এইটে হবে, নয় সারঙ্গের কোন অপ্রসিদ্ধ রাগ হবে। সুঘরাইকে তাই আমরা semifinalist করে রাখলাম।"
হলধরবাবুর বৈঠকখানা তখন নিস্তব্ধ। হলধরবাবুর অকালপক্ক উল্লাস-ও নিবে এসেছে। সবার মধ্যেই টানটান উত্তেজনা।
রজতবাবু বলে চললেন, "সব শেষে আমরা তাহলে পৌঁছলাম সারঙ্গ প্রকারের রাগে। বৃন্দাবনী সারঙ্গ, মিঁঞা কী সারঙ্গ আর সুদ্ধ সারঙ্গকে প্রথমেই বাদ দিয়ে দিলাম। মধ্যমাদিসারঙ্গে ধা আর গা বর্জিত, তাই তাকেও বাদ দিলুম। একই কারণে বড়হংস-সারঙ্গও বাদ। ওঃহওঃ, একটা সারঙ্গের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, তা হোল সামন্ত-সারঙ্গ। হ্যাঃ, এটা নিশ্চয়ই ঐ সামন্ত। কোমল নি থেকে মীড় দিয়ে পা-তে আসছে, মা থেকে রে, অবরোহণে সামান্য ধৈবত লাগছে, হ্যাঁ, এ সামন্ত না হয়ে যায়না। কিন্তু একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে, সামন্তে আমি যদ্দুর জানি, গা একেবারেই ব্যাবহার হয়না, অবশ্য খাঁ সাহেব-এর মত গুণী কখন কখন একটু সৃজনী license নিয়ে থাকেন। কি জানি বাপু, সুঘরাই আর সামন্ত - এই দুই রাগের মধ্যেই একটা হবে নিশ্চিত। একটা কানাড়া অঙ্গের, অন্যটা সারাঙ্গের, কিন্তু হলধর বোধহয় টোপটা এইজন্যেই দিয়েছে যে সারাঙ্গ প্রকারের মত শুনতে লাগবে অথচ কানাড়া অঙ্গের রাগ হবে, এটা চট করে কেউ অনুমান করবে না। ঠিক বলেছি কিনা? কি হল হলধর? শুধু মুচকি হাসলে চলবে? তোমার কিছু হিন্টস দেওয়া উচিত, নতুবা এইরকম শক্ত রাগ চেনা সত্যই দুষ্কর। বাকিদের কি মত শুনি? সুঘরাই নাকি সামন্ত? কোনটা বেশী কাছাকাছি লাগছে? তানের অংশটা আরেকবার একটু শুনলে ভালো হত।"
প্রমিত বলল, "আমার মনে হচ্ছে সুঘরাই। আপনি ঠিক-ই ধরেছেন রজতদা, কানাড়া অঙ্গের রাগ অথচ সারঙ্গের মত চলন বলেই এটা এরকম উদ্ভুট্টে রকম কঠিন। আপনি সুঘরাই বলে দিন, ঠিক-ই হবে।"
তবলিয়া সঞ্জয় মিতভাষী, সে বলল, "আমার অবশ্য রাগ সম্পর্কে অত জ্ঞান নেই, কাজেই আমি দুটোর মধ্যে কোনটাকেই ভোট দিতে পারবনা, মাপ করবেন রজতবাবু।"
প্রণববাবু প্রথম থেকেই ব্যাপারটার সাথে নিজেকে জড়াতে চাইছিলেন না। এটা ওনার কাছে এক কান্ডজ্ঞানহীন ছেলেমানুষীর পর্যায়ে পড়েছে। কাজেই উনি পুরো সময়টাই গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন, কোনভাবেই অংশগ্রহণ করতে রাজী হননি। অলকবাবু অবশ্য ব্যাপারটা বেশ স্পোর্টিংলি নিয়েছেন। যদিও প্রমিতের ফাজলামিতে যোগ দেওয়াটা সমিচীন মনে হয়নি ওনার, কিন্তু পুরো ব্যাপারটাকে উনি বেশ উপভোগ করেছেন। উনি বললেন, "আমার কিন্তু মনে হচ্ছে সারঙ্গ-ই হবে, কানাড়া অঙ্গের রাগ হলে খাঁ সাহেব এইভাবে গাইবেন না। কাজেই আমি সামন্ত-এর পক্ষপাতী।"
ব্যাপারটা অমিমাংসীতই রইল। হলুধরবাবুর অস্বস্তিতে উশখুশ করছিলেন। এইবার শেষ হলেই হয়, এই যেন ওঁর মনের ভাব। অসহিষ্ণুভাবে বলে উঠলেন, "আচ্ছা, এবারে বলে ফেল দেখি। অনেক সময় দেওয়া হল। এটা না, ওটা না, অনেকক্ষন ধরে শুনছি, চলেই যাচ্ছে, চলেই যাচ্ছে পৌণপুণিকের মত। কি কি রাগ নয়, সেটা জানার আমাদের কোন আগ্রহ নেই, যদি চিনে থাক, বলে ফেল, না চিনে থাকলে এবার কাটো, অনেক হয়েছে।"
- “আরে চটছ কেন হলধর? এ হল গিয়ে আমার জীবিত-বিবাহিত-ধাঁধার উত্তর, একটু সময় না দিলে চলবে কি করে। এখন ভাবতে ভাবতে আরেকটা কথা মনে পড়ছে। বহুকাল আগে রামপুর থেকে এক প্রাচীন পুঁথি উদ্ধার হয়েছিল এবং সেখানে এক সারঙ্গের কথা বলা হয়েছিল। ভাতখন্ডেজীর হিন্দুস্থানী সঙ্গীত পদ্ধতিতেও তার উল্লেখ আছে, তবে বিশেষ কিছুই বলা নেই। আমাদের এম.এ.তে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে যে কোনোদিন এই রাগটা কানে শুনিনি। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা আছে এই রাগের সম্বন্ধে। এই মুহূর্তে নামটা পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না। বেশ একটা বড়সড় নাম। এই রাগটা শুনে সেইটের কথা মনে পড়ে গেল।“ চোখ থেকে চশমাটা খুলে পকেট থেকে রুমাল বের করে আলতো হাতে কাঁচটা মুছতে লাগলেন রজতবাবু।
হলধরবাবুর রক্তচাপ অকস্মাৎ যেন অনেকটা বেড়ে গেল, উনি দরদর করে ঘামতে লাগলেন। রুমাল দিয়ে মুখটা মুছলেন। সোহিনীকে বললেন, "এক গ্লাস জল খাওয়াবি?" সোহিনী অবশ্য ওঠার কোন লক্ষণ দেখালনা।
রজতবাবু হঠাত চীৎকার করে উঠলেন, "ইউরেকা, মনে পড়েছে ওই রাগটার নাম। লঙ্কাদহন সারঙ্গ। লঙ্কাদহনই কি? নাকি সুঘরাই? নাকি সামন্ত? এত করে আমরা যখন সারঙ্গের দিকে ঝুঁকছি, তখন কানাড়া অঙ্গের সুঘরাই রাগটাকে নাহয় বাদ-ই দিয়ে দিই শেষ পর্যন্ত, পড়ে থাকল শুধু লঙ্কাদহন সারঙ্গ আর সামন্ত সারঙ্গ। না, এটা সামন্ত সারঙ্গ নয়, প্রথমেই আমি একটা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম, যে সামন্ত সারঙ্গে ‘গা’ লাগে না, আর এখানে খাঁ সাহেব দিব্যি ‘গা’ লাগিয়েছেন। কাজেই সেইভাবে সূক্ষভাবে বিচার করলে সামন্তও বাদ পড়ে যায়। তাহলে পড়ে রইল একমাত্র রাগ - লঙ্কাদহন সারঙ্গ। হলধর, নাও, দেখত ঠিক মত চিনতে পারলাম কিনা। কই রেকর্ডের বাক্সটা বার করো হে দেখি আমার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল কিনা।
হলধরবাবু খানিকক্ষণ স্থানুর মত বসে রইলেন। ঘরে তখন সুঁচ পড়লেও বুঝি শব্দ হবে। সোহিনী বলে উঠল, "বাপি, কি হল বাপি, বল যে এটা ভুল রাগ, বাপি, নিশ্চয়ই এটা লঙ্কাদহন সারঙ্গ নয়, তাই না বাপি? কিছু বলছ না কেন? চুপ করে থেকো না বাপি, বল যে এটা ভুল!"
হলধরবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, "তুই একটু ও ঘরে যা। রজত, বরং আমরা অন্যভাবে ব্যাপারটা মিটিয়ে নি। তুমিও নিশ্চয়ই এমনিই মজা করে বলেছিলে, তো সে কথা যাক, তোমাকে ওই জ্যাক ড্যানীয়েলসটার সাথে আরও একটা শীভাস রীগালের বোতল আর কুড়ি জিবির আইপডও নাহয় গিফট করছি, এই কঠিন রাগটা চিনতে পারার জন্য।"
রজতবাবু একটা বাঁকা হাসি হেসে বললেন, "হলধর, আমার কাছে কিন্তু আ প্রমিস ইজ আ জেন্টলম্যান্স প্রমিস। সবাই শুনেছে আমরা কিসে দুজনেই রাজী হয়েছিলাম। কাম অন, বি স্পোর্টিং, এখন বিদেশী মদ গিলিয়ে বা ফোন বিলিয়ে ব্যাপারটাকে জোলো করে তুলো না। তোমাকে তো ভদ্রলোক বলেই জানি।"
একটা কাশীর শব্দে সাত-টা ঘাড় একসাথে দরজার দিকে ঘুরল।
(৫)
সমীর এসেছে। কলিংবেল নেই তাই দরজা খোলা পেয়ে বৈঠকখানার ঘরে ঢুকে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে মৃদু কেশেছে। "রজতবাবু এখানে থাকবেন জেনে এসেছি, একটু কথা বলা যাবে?"
রজতবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, "না না, এখন তুমি যাও, পরে আমি তোমার দোকানে যাব'খন।"
হলধরবাবু অবশ্য কিছুটা সময় কেনার প্রত্যাশায় বললেন, "তা কেন, অতদূর থেকে সমীর এসেছে যখন, নিশ্চয়ই কিছু দরকারী কথা আছে তোমার সাথে। আমরা বসছি, তুমি বরং কথাটা সেরেই নাওনা। কতক্ষন আর লাগবে?"
সমীর তাড়াতাড়ি বলল, "না না, বেশী না, এক মিনিট লাগবে। রজতবাবু আমার একটা ভুল হয়ে গেছে। কালকে আপনি দোকান থেকে চলে আসার পর দেখলাম যে আপনার বিল হয়েছিল পনেরশ টাকা, আর আমার দোকানের এক বয়স্ক কর্মচারী ভুল করে আপনার ক্রেডিট কার্ডে পনেরো হাজার টাকা সোয়াইপ করে বসে। আপনি দোকানে অতক্ষন সময় কাটালেন কিন্তু পেমেন্টের সময়টায় তাড়াহুড়োয় ছিলেন তাই নজর করেননি। আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, তাই একটা সাড়ে তের হাজার টাকার চেক নিয়ে এসেছি, ভাবলাম ফেরার পথে হলধরবাবুর বাড়ি হ'য়ে যাই, তাহলে আপনার সাথে দেখা করে আপনাকে চেকটা দিয়ে দিতে পারব। কিছু মনে করবেন না।"
রজত বাবু চেকটা পকেটস্থ করে বিরক্ত গলায় বললেন, "আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে এবার তুমি যাও। thank you।" রজতবাবুর আর তর সইছে না বাজীটার ফয়সালা করার। এইসব অনাহূতদের জ্বালায় ব্যাপারটার আর নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
সমীর অবশ্য যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখাল না। একে একে ঘরের সকলের দিকে তাকালো। তারপর খুব স্পষ্ট ভাবে কেটে কেটে বলল, " একটা কথা, রজতবাবু ,আপনি যদি হাজার আষ্টেক খরচ করতে রাজী থাকেন তাহলে লঙ্কাদহন সারঙ্গের একটা কপি জোগাড় করে দিতে পারি"। রজতবাবু চকিতে সমীরের দিকে ফিরে তাকালেন তারপর ব্যাস্ত গলায় বললেন "আচ্ছা, আচ্ছা, সে পরে কথা হবে, এখন এস"। সমীর ধীর গলায় বলল "নিলে এখনি বলুন স্যার, আটের কমে পারব না, আপনাকে তো কাল বলেইছি হলধরবাবুকে এক কপি দশে দিলাম, আপনি পুরোনো কাস্টমার তাই...।"
ঘরে একটা বাজ পড়লেও বোধহয় সকলে কম বিস্মিত হত। সাত-জোড়া ক্রুদ্ধ দৃষ্টি এখন রজতবাবুর ওপর নিবদ্ধ। সমীরের এতক্ষনে মনে পড়েছে সেই "কৃষ্ণবর্ণা, দীর্ঘাঙ্গিণী, ভ্রমরাক্ষী" কন্যার নাম। কিন্তু এবারের বাজীতে আর দুর্যোধন তাকে জিতে নিতে পারল না।

- ঈপ্সিত/চম্পাকলি


মন্তব্য

সুরঞ্জনা এর ছবি

বাহ! হাততালি

অনেক খানি বড় গল্প, সুন্দর লেখা, ছুটির দিনে পড়তে খুব ভালো লাগল।
শেষে এমন হবে এটা অবশ্য আন্দাজ করা গিয়েছে আড্ডা জমে ওঠার পরপরই, সেটা সন্দেহবাতিক মনের কারণেই সম্ভবত। খাইছে

কিন্তু আপনাদের মাঝে কে গান করেন বলুন দেখি? গানের আলোচনা উপভোগ্য ছিল, এবার নমুনা দিন, শুনি। দেঁতো হাসি

অনেক লিখুন আপনারা, অনেক অনেক অনেক। শুভকামনা রইলো। হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখার সময় ভাবছিলাম বোধহয় লোকজনকে বোর করব। কিন্তু সুরঞ্জনাদি, আপনার ভালো লেগেছে শুনে ভরসা পেলাম।
বর-বউ-এর মধ্যে বর গান গায় আর বউ শোনে।

- ঈপ্সিত/চম্পাকলি

সুরঞ্জনা এর ছবি

তাহলে বউ এর অনুমতিক্রমে বরের গান একটু শুনতে পেলে মন্দ হয় না। আপলোডকৃত গানের লিংক দিয়ে ফেলেন, শুনি। হাসি

আপনাদের সাথে সচলের বাইরে পরিচিত হতে পেলেও ভালো লাগবে, পড়ুয়া, সুরসিক (আবার সুররসিক), ভালো লেখেন, এমন মানুষ যত বেশি চেনা থাকে তত ভালো। দেঁতো হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

যাক সুরঞ্জনা 'সুরারসিকটা' বাদ রাখছে।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

কৌস্তুভ এর ছবি

এইটা তো কয়েক হাজার বছর আগের ভারত না যে সে আইনত বাধ্য, তবে অমন আধুনিকা সোহিনী কেন একটু মিনমিনে আপত্তির পরে বাজির বস্তু হতে রাজি হয়ে গেল? বাস্তবসম্মত লাগছে না।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আমারও না। তারপরেও মোটের উপর গল্পটা ভালোই লেগেছে। সম্ভবত বিষয়বস্তুর কারণে।

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংখ্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
লেখার সময় বিষয়বস্তু নিয়ে ভয়ে ছিলাম, পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে ভেবে।
- ঈপ্সিত/চম্পাকলি

আবছায়া এর ছবি

সম্ভবত একটা ব্রেক পাবার আশায়।।

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক ধরেছেন।

- ঈপ্সিত/চম্পাকলি

অতিথি লেখক এর ছবি

উদীয়মান শিল্পী ব্রেক পেতে মরিয়া, আর বিয়ে করতে হবেনা এরকমটা ধরেই নিয়েছিল। হয়ত বাজী হারলেও বিয়ে করতে হবে না সেটাও মনে মনে জানত। ঠিকই তো, আদালতে কি আর এইসব টিকবে? তাই রাজি হতে আপত্তি কোথায়?
- ঈপ্সিত/চম্পাকলি

পুতুল এর ছবি

পাভারতি (ইটালিয়ান উচ্চঙ্গ গায়ক) জার্মান কন্সার্ট করে ৪ মিলিয়ন মার্ক জরিমানা দিয়েছিলেন। অবশ্য তাতে পাভারতিকে চোর বলা যায় না। খাজনা আদায়কারী কর্মচারীদের ভুলে ঐ টাকা খাজনা কম নেয়া হয়েছিল। পাভারতি পরে তা শোধও করে দিয়েছেন। আমাদের উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীদের জন্য এই মানের সম্মানী স্বপ্নই থেকে যাবে।

সংগীত সম্পর্কে গভীর জ্ঞান, লেখার দূর্দান্ত হাতের কল্যানে আমার মতো গান-অন্ধ পাঠকও লেখাটা একটানে পড়লাম। অনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে নাকী ইমন রাগে। ইমন রাগে আর আনন্দের ছোঁয়া ধরতে পারি না। বা এসো শ্যামল সুন্দরের পরশ দেশ রাগে পাই না। অরুণ কান্তির আহীর বৈরভীর কথা ছেড়েই দিলাম।

আশা করি এই ধরণের লেখা আপনার কাছ থেকে আরো পাব। কিছু হয়তো জানতে পারব আমাদের সংগীত সম্পদ সম্পর্কে। সচলায়তনে স্বাগতম।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অতিথি লেখক এর ছবি

আনন্দধারা গানটা মালকোষ রাগে পুতুল ভাই। আমরা এই লেখাটা ইয়ে ভয়ে ছিলাম, ভাবলাম একগাদা রাগের কচকচি পড়তে হয়ত কারোর ভালোলাগবেনা। আপনার মন্তব্য পড়ে বুক বাঁধলাম, এর পরে আরও কচকচে বিষয়ে লিখব। দেঁতো হাসি
- ঈপ্সিত/চম্পাকলি

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আনন্দধারা হইল তীব্র মধ্যমযুক্ত মিশ্র মালকোষ।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

গোলাম আলী বারেবারে কোমল নি লাগিয়েছেন, কাজেই বিলাবল ঠাট-কেও বিসর্জন দিয়ে দিলাম কারণ বিলাবলে তো সবই সুদ্ধ স্বর লাগে।

আলৈয়া বিলাওয়লেই কোমল নি লাগে তো। নাকি? (গ ম ণ ধধ প, ধ গ, গ ম প, গ ম প ম গ র সরস - চলনটা এইরকম) যাই হোক, পড়তে পড়তে নানা কিছু ভাবতেছিলাম। প্রথমে ধরে নিছি শুব্ধ গান্ধার। গা কি উঠার সময় লাগাইছে না নামার সময় এইটা ভাইটাল মনে হইল। কারণ নামার সময় শুদ্ধ গা হয়া আসলে আরো কিছু রাগ পাওয়া যায়। ঝিঞ্ঝোটির চলন স র প ম গ র স ণ ধ্ প্ ধ স র ম গ । সুতরং নামার সময় ধ পাওয়া যাইতেছে। কিন্তু ণ-ম মীড় আর প-র মীড় ঝিঞ্ঝোটিতে চলে না। এমনেতে গৌড় সারংয়ে গা লাগে। যদিও ঐটা খাটি সারংয়ের প্রকার না, নামেই সারং (ভুলও হৈতে পারে)। ইত্যাদি নানা চিন্তা অনেক অনেক অনেক দিন পরে মাথায় খেলল। আপনাদের ব্যাপক ধন্যবাদ।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

পুতুল এর ছবি

অনিন্দ্যদা ও দেখি ওস্তাদ লোক!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আরে নাহ। আমি খালেদা স্কেলে ৫ এর মধ্যে সোয়া এক।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

খালেদা স্কেলটা কি অনিন্দ্যদা?
- ঈপ্সিত/চম্পাকলি

অতিথি লেখক এর ছবি

বর-বউ-এর কেউই লঙ্কাদহন সারং শেখেওনি, শোনেওনি। দেঁতো হাসি
ভাতখন্ডেজীর দশ খন্ডের বই পড়ে সবথেকে অপ্রচলিত রাগটি বেছে নিয়ে গল্পে লাগালাম।
হ্যাঁ, আলাহিয়া বিলাবলে কোমল নি লাগে। কিন্তু আমরা ধাপে ধাপে এলিমিনেশান টেকনিক লিখব বলে নির্মম ভাবে শুদ্ধ বিলাবল নিয়ে 'ইতি গজ' টাইপের বলেছি।
ব্যাপক ধন্যবাদের জন্য আবার ব্যাপক ধন্যবাদ অনিন্দ্যদা।
- ঈপ্সিত/চম্পাকলি

হাসান এর ছবি

এইটা কি জেফ্রী আরচার এর The Wine Taster অবলম্বনে লেখা?

আপনাদের লেখা এত ভাল, আপনারা মৌলিক লেখা দেন না কেন?

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসান ভাই, এটা ওয়াইন টেস্টার অবলম্বনে লেখা নয়। জেফ্রী আর্চার যার গল্প থেকে ওয়াইন টেস্টার লিখেছেন, এটাও সেই গল্পের কাঠামো থেকে নেওয়া। জেফ্রী আর্চার বরং একেবারে ওয়াইনের বিশ্লেষণটাও ওখান থেকেই নিয়ে নিয়েছেন। দেঁতো হাসি

- ঈপ্সিত/চম্পাকলি

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

পড়তে পড়তেই নামটা মনে পড়ে গেলো, দা ওয়াইন টেস্টার! হাসি

ভাবানুবাদ খুব ভালো হয়েছে! দেঁতো হাসি

আর বিলাবলে তো সব শুদ্ধ না, কোমল স্বরও লাগে! উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের নেশাটা মাথাচাড়া দিলো আবার! হাসি আপনাদের ধন্যবাদ! দেঁতো হাসি

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ, মাথাচাড়া দিলেই চলবে? গলা, কান, তানপুরা সবকিছুই চাড়া দিক! আবার শুরু করুন।
গল্প ভালো লেগেছে বলে আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
- ঈপ্সিত/চম্পাকলি

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

মধু!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

ঈপ্সিত/চম্পা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

আর্য এর ছবি

অসাধারন লাগল গল্পটা পড়ে। একটানে পড়ে ফেললাম। গল্পের গাঁথুনি আর গতি দুটোই ছিল অসাধারন। ঠিক মনে হচ্ছিল ওপার বাংলার কিছু ছোট সাইজের বই আছে না (আনন্দ প্রকাশনীর বোধ করি), তা পড়ছি।

ভাবানুবাদ হলেও অনেক অনেক অভিনন্দন লেখকবৃন্দকে। নিজস্ব লেখা যদি হত, তাহলে বাহবার কোন সীমা থাকত না।

পথিক পরাণ এর ছবি

রাগ বুঝিনা মোটেও। কিন্তু গল্পটা এমনভাবে সুরের ভেতর ঢুকিয়ে দিল!
রজতবাবুর ভাব দেখেই সন্দেহ হয়েছিল- রাগটা তিনি আগে থেকেই জেনে বসে আছেন- এবং সমীরের কাছ থেকে।

অসাধারণ লাগলো।

ঈপ্সিত/চম্পা এর ছবি

গান নিয়ে একটা কিছু লেখার তাগিদ থেকেই এই গল্পটির সৃষ্টি। সুরের বিশ্লেষন উপভোগ করেছেন জেনে ভাল লাগল।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

জী, ভাল হয়েছে। যদিও বেশ বড়সড়।

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংখ্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সত্যপীর এর ছবি

যথারীতি ব্লাডি অছাম!

আপনাদের ৬টা দুর্দান্ত গল্প হয়ে গেল দেখতে দেখতে, হাচল হয়ে যাওয়া উচিৎ

..................................................................
#Banshibir.

ঈপ্সিত/চম্পা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- । কয়টা পোস্ট দিলে হাচল হওয়া যায় বলুন তো?

হিমু এর ছবি

আপনারা নিজের পোস্ট ছাড়া আর কোথাও কোনো সাড়াশব্দ করেন না। এরকম আত্মমগ্ন লোকজন সাধারণত হাচল হয় না।

অতিথি লেখক এর ছবি

ওহো, আচ্ছা। এইবার এই ভুলটা হবে না। আমরা দুজনেই দুজনকে আজকে খুব গালি দিয়েছি এই অলসতার জন্য। আমার স্পাউজ প্রমিস করেছে পরেরবার থেকে সব লেখা পড়ে খুব সরব হয়ে উঠবে। দেঁতো হাসি

- ঈপ্সিত/চম্পাকলি

চরম উদাস এর ছবি

সঙ্গীতে জ্ঞান নেই তেমন, তারপরেও দারুণ লাগলো চলুক ।আপনার গল্পগুলার ডিটেইলস এর কাজ খুব ভালো লাগে। বোঝা যায় অনেক যত্ন করে লেখা। যদি সচল ফ্যামিলিতে ঢুকে পড়তে চান তাহলে একটু অন্যদের লেখা পড়ে একটু কমেন্ট টমেন্ট করুন। এইখানে আসলে লেখালেখির পাশাপাশি সবাই একসাথে হাসি মজা করে থাকতে চায়, এজন্য নিজের লেখালেখির পাশাপাশি অন্যের লেখায় কমেন্ট করাকে উৎসাহিত করা হয়। নিজেকে একটু জানান, সবাইকে একটু জানুন, আপনার (আসলে আপনাদের) যা লেখার হাত দেখবেন চোখের নিমিষে সচল হয়ে গেছেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

উদাসদাদা - এই ভয়টা খুবই ছিল যে বিষয়বস্তুটা খুব গুরুপাক এবং মোনোটোনাস লাগবে পাঠকের। আপনার ভালো লেগেছে শুনে ভরসা পেলাম, পরেরবার অ্যানালিসিস অফ অ্যালগরিদ্‌ম্‌ নিয়ে লিখব। একটা জটিল অ্যালগরিদ্‌মের অর্ডার বের করা নিয়ে গল্প লিখব।
ভয় নেই। এমনিই বললাম।
আর হ্যাঁ, এইবার আমরা দুজনেই ঠিক করেছি সময় পেলেই লিখতে বসে যাবনা। হাচল হওয়ার রেসিপিটা জেনে আজকে থেকেই তার প্রয়োগ করব।
প্রথমে তো নিজের লেখাতেও কমেন্ট করতাম না। তারপর সেটা শুরু হল। এটাও হবে। হাচল হব কিনা জানিনা। নিবন্ধান করার সময় এই ব্লগ এতটাই নতুন ছিল যে কিছুই জানতাম না। শুধু একজনের নামে লগিন করেছিলাম। যাইহোক দেখা যাক।
- ঈপ্সিত/চম্পাকলি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।