১.
আমাদের দেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে বর্তমানে যে গ্রেডিং সিস্টেম চালু আছে তাতে একজন ছাত্রের ফোর্থ সাবজেক্টে/ ঐচ্ছিক বিষয়ে (অ্যাডিশনাল সাবজেক্ট) প্রাপ্ত গ্রেড পয়েণ্ট থেকে ২ বিয়োগ করে যা থাকে সেই পয়েণ্টটা বাকি বিষয়গুলোতে প্রাপ্ত মোট গ্রেড পয়েণ্ট গুলোর সাথে যোগ করা হয়। তারপর গড় করে, দেয়া হয় গ্রেড পয়েণ্ট এভারেজ বা জিপিএ। উদাহরণ দিয়ে বলি, তাহলে জিনিসটা বুঝতে সহজ হবে।
ধরা যাক, এস.এস.সি. পরীক্ষায় রহিমের বাংলায় প্রাপ্ত গ্রেড পয়েণ্ট ৪, ইংরেজিতে ৫, গণিতে ৫, সমাজে ৫, ধর্মে ৪, রসায়নে ৫, পদার্থে ৪, উচ্চতর গণিতে ৫। ফোর্থ সাবজেক্ট বায়োলজিতে ৫। তাহলে বায়োলজি অর্থাৎ ফোর্থ সাবজেক্ট বাদে অন্যান্য বিষয়গুলোতে তার প্রাপ্ত মোট গ্রেড পয়েণ্ট ৩৭। বায়োলজি থেকে ২ বাদ দিলে থাকে ৩। তাহলে ঐচ্ছিক বিষয়ের ৩ নিলেই তার মোট গ্রেড পয়েণ্ট হয় ৪০। সাবজেক্ট ৮ টি। গড় করলে জিপিএ আসে ৫। অর্থাৎ এস.এস.সি. তে রহিম জিপিএ ৫ পেল। এইচ.এস.সি. তে ও একই ভাবে জিপিএ হিসাব করা হয়। তখন বিষয় থাকে ৬ টি।
মেডিকেলে ভর্তির ক্ষেত্রে যেহেতু এবার ভর্তি পরীক্ষা না নেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে তাই এবার মেধাক্রম ঠিক করতে হবে পুরোপুরি জিপিএ এর উপর ভিত্তি করে। এটা ঠিক করার জন্য একটা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে যেখানে মেধাক্রম ঠিক করার জন্য ১২ টা ধাপ অনুসরণ করা হবে। আসলে এই নীতিমালাটা নতুন কিছু নয়, প্রতিবারই এই ধাপগুলো ব্যবহার করেই মেধাক্রম ঠিক করা হয়। কিন্তু এবার এই জিনিসটার গুরুত্বটা বেশি এই কারণে যে এবার কোন ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে না।
তো এই নীতিমালার প্রথম ধাপ হল, ফোর্থ সাবজেক্ট/ ঐচ্ছিক বিষয় ছাড়া এস.এস.সি. এবং এইচ.এস.সি. ’র মোট জিপিএ হিসাব করা। আমার ওপরের উদাহরণের রহিমের ক্ষেত্রে তখন জিপিএ আসে ৩৭/৮ = ৪.৬২৫ অর্থাৎ ৪.৬৩। একইভাবে রহিম যদি এইচ. এস.সি. পরীক্ষায় বাংলায় গ্রেড পয়েণ্ট পায় ৪, ইংরেজিতে ৫, গণিতে ৫, পদার্থে ৫, রসায়নে ৫ তাহলে ঐচ্ছিক বিষয় ছাড়া তার জিপিএ হবে ৪.৮০ ।
তাহলে এস.এস.সি. এবং এইচ.এস.সি. মিলিয়ে ঐচ্ছিক বিষয় ছাড়া তার মোট জিপিএ হবে ৪.৬৩ + ৪.৮০ = ৯.৪০ ।
আর করিম নামে আর একজন যদি দুটো পরীক্ষাতেই গোল্ডেন জিপিএ ৫ পায় তাহলে চতুর্থ বিষয় ছাড়া তার দুই পরীক্ষা মিলিয়ে মোট জিপিএ হবে ১০।
তাহলে যে নীতিমালা অনুযায়ী এবার ভর্তি করানো হবে,সে অনুযায়ী করিম, রহিমের আগে সুযোগ পাবে।
কিন্তু ধরলাম বর্ষা নামের একটি মেয়েও করিমের সাথে একই সালে পরীক্ষা দিয়ে দুই পরীক্ষাতেই গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেল। তাহলে করিম আর বর্ষাকে তো এই নীতিমালার প্রথম ১১ টা ধাপের কোনটা দিয়েই আলাদা করা যাবে না। তখন ?
এটার জন্যও ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা কি এতই বোকা নাকি ?
তখন দেখা হবে করিম আর বর্ষার ‘ডেট অব বার্থ।’ অবশ্য বড় কে চান্স দেয়া হবে, না ছোট কে-সেটা আমি যে কাগজটা পেয়েছি তাতে লেখা নেই । অবশ্য টকশোতে মন্ত্রী বলেছেন, যে ছোট তাকে সুযোগ দেয়া হবে।
২.
রহিম, করিম, বর্ষা ’র সাথে সেই বছরই মেডিকেলে ভর্তির জন্য আবেদন করেছিল সুমন। এস.এস.সি. তে সুমনের বাংলায় গ্রেড পয়েণ্ট ছিল ৪। বাকি সবগুলো বিষয়ে ওর এ+ ছিল, অর্থাৎ ৫ করে গ্রেড পয়েণ্ট ছিল। অন্যদিকে করিম আর বর্ষা দুজনেই এস.এস.সি. এবং এইচ.এস.সি. দুই পরীক্ষাতেই গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছিল। সুতরাং দেখা যাবে হয়ত নীতিমালা অনুযায়ী করিম আর বর্ষা চান্স পেলেও সুমন কোন মেডিকেল বা ডেণ্টাল কলেজেই চান্স পেল না। অর্থাৎ বাংলায় এ+ না পাওয়াতেই তার মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। অথচ ভর্তি পরীক্ষা হলে কিন্তু সুমন চেষ্টা করে দেখতে পারত।
২০১২ সালের উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট দেয়ার পর দেখা গেল, জিপিএ ৫ পেয়েছে ৬১ হাজার ১৬২ জন। দেখা যাবে এদের মাঝে পাঁচ ছয় হাজার ছেলেমেয়ের মাধ্যমিকে ও উচ্চ মাধ্যমিক দি পরীক্ষাতেই গোল্ডেন আছে। আমি নিশ্চিত, এই ৬১ হাজারের মাঝে শুধু বাংলায় এ+ পায়নি এমন ছেলেমেয়ে আছে কমপক্ষে ২০০০০। যখন ঐচ্ছিক বিষয়ের গ্রেড পয়েণ্টটা বাদ দিয়ে হিসাব করা হবে তখন কিন্তু এরা বাদ পড়ে যাবে বা পেছনে পড়ে যাবে। অথচ যদি ভর্তি পরীক্ষাটা নেয়া হয়, তাহলে বাংলায় এ+ পায়নি এমন একটা ছেলে বা মেয়েরও কিন্তু চান্স পাওয়ার বা ভালো মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। অথচ এই নিয়মে সুযোগটা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
বারে বারে বাংলার কথা কেন বলছি? বাংলার কথা এই কারণেই বলছি, কারণ বাংলায় নম্বরের হেরফেরটা সবচেয়ে বেশি হয়। দেখা গেল, উত্তরপত্র নিরীক্ষণের দায়িত্বে আছেন যে শিক্ষক, স্ত্রী’র সাথে ঝগড়া করায় তার মেজাজ খারাপ। সেইদিন সব ছাত্রকে তিনি ১০ এর মাঝে ৫ করে দিলেন। পরেরদিন মন ভালো থাকার কারণে দিলেন ৭ করে। ফলে দেখা গেল, একই রকম পরীক্ষা দিয়ে কেউ এ+ পেল, কেউ পেল না। এরকম ঘটনাকে কাল্পনিক বলে হেসে উড়িয়ে দেবার কিন্তু সুযোগ নেই। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা অহরহই ঘটে। সায়েন্স এর সাবজেক্ট গুলোতে এই ডেভিয়েশন কিছুটা হলেও কম।
রসায়ন/ পদার্থ/ জীববিজ্ঞান/ গণিতে এ+ না পেয়ে কেউ যদি জিপিএ ৫ পায়, তাহলে তাকে গোল্ডেন জিপিএ ৫ ধারীদের চেয়ে একটু কম মেধাসম্পন্ন মনে করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলা/সমাজ/ধর্মে এ+ না পেয়ে কেউ যদি মেডিকেলে ভর্তি না হতে পারে বা ভর্তি হবার চেষ্টাটাও না করতে পারে তাহলে তার মত দুঃখজনক ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না।
তাহলে, বাংলা-ই কী মেডিকেলে ভর্তি’র সুযোগ পাওয়ার মাপকাঠি হয়ে উঠল?
এবার অন্য একটা প্রসঙ্গে আসি। যদি এই নীতিমালা অনুযায়ীই ভর্তি হয়, তাহলে যে কোন দুর্নীতি হবে না-সেটার গ্যারাণ্টি কী ? কারণ আমাদের কাছে তথ্য আছে, গতবছর অর্থাৎ ২০১১ সালের ভর্তি পরীক্ষার সময় মার্ক টেম্পারিং করা হয়েছে এবং এই তথ্যকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করার মত যথেষ্ট প্রমাণ ঢাকা মেডিকেল কলেজেই ছড়িয়ে আছে। এই বারও যে এরকম দুর্নীতি হবে না, টাকা খেয়ে মেধাক্রম উলটাপালটা করা হবে তার নিশ্চয়তা কী ?
এই জন্যই কি জিপিএ ৮ পর্যন্ত আবেদনের সুযোগ দেয়া হয়েছে ? কারণ যেখানে জিপিএ ১০ ধারী সবাইকেই সুযোগ দেয়া যায় কিনা সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, সেখানে জিপিএ ৮ ধারীদের আবেদন করতে উৎসাহিত করা কি ভর্তি বাণিজ্যের সুবিধার্থে ?
৩.
যে ধাপগুলো ব্যবহার করে এবার মেধাক্রম ঠিক করা হবে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো নিচে দিয়ে দিলাম সবার বোঝার সুবিধার্থে।
1. CGPA (without additional) SSC+HSC
2. HSC in 2012 superior than 2011
3. CGPA in HSC (without additional)
4. CGPA (with additional) SSC+HSC
5. CGPA (with additional) in HSC
6. GP(Physics+Chemistry+Biology) in HSC
7. GP in Biology in HSC
8. GP in English in HSC
9. GP(Physics+Chemistry+Biology) in SSC
10. GP in Biology in SSC
11. GP in English in SSC
12. Birth date of candidate
মন্তব্য
তত্থ্যবহুল লেখা কিন্তু অতিথি লেখকের নামটা পেলাম না
আপনি যে কাগজটা পেয়েছেন সেটি আমাদের দেখালে খারাপ হত না..
তবে ব্যাপারটা এমন / কাছাকাছি কিছু হবে তেমনটিই মনে হচ্ছে. ডিএমসি তে 'কচি-কাচা'র মেলা হবে ভেবে 'পুলকিত' হলাম...
শেষ পর্যন্ত হাতের লেখা সুন্দর এবং বাংলায় পারদর্শী এমন এক ঝাঁক ডাক্তার পেতে যাচ্ছি।
যে ছেলে সবগুলোতে কোনমতে ৮০ তুলেছে (বাংলা সহ) সে টিকে যাবে।আর যে ছেলে বাংলা বাদে বাকি সব বিষয়ে ৯০-৯৯ করে পেয়েছে কিন্তু বাংলায় ৭৫ সে প্রথমেই বাদ।
"যে জায়গাতে উকিল বেশী সে জায়গাতে চোরও বেশী বলে ধরে নিবে" - প্রসিদ্ধ একটা প্রবাদ। এটার আলোকে বলা যায় যে জায়গাতে সিস্টেমের কপচানি বেশি ওই জায়গাতে দুর্নীতির চান্সও বেশি। প্রচুর ফাঁক - ফোকরওলা পাবলিক পরীক্ষাকে ভর্তি প্রক্রিয়ার প্রধানতম "মাপকাঠি" হিসাবে ধরার জন্য এতকিছুর দরকার আছে কি ? যখন এর থেকে বর্তমান ভর্তি প্রক্রিয়া অনেক বেশী সহজ ও কার্যকরী ?
মেডিক্যাল অথবা ভার্সিটি - বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে দেশে কিন্তু খুব বেশী অভিযোগ উঠে না, যতটা উঠে আমাদের এসএসসি - এইচএসসি পরীক্ষার সিস্টেম নিয়ে। আমাদের উচিত আগে বড় সমস্যাগুলো মার্ক করে ওগুলোর দিকে নজর দেয়া। আগে পাবলিক পরীক্ষার সিস্টেম উন্নয়নের দিকে আমাদের সময় ও মেধা ব্যয় করা উচিত। তারপরেই ওটাকে আমরা মানদণ্ড হিসাবে ধরতে পারবো।
এই অতিথি লিখক আগেও একটা কলাম লিখেছিলেন ( সচলে ) স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার সিস্টেম বাদ দেয়ার জন্য। আমার মনে হয় উনার উচিত তার সময়- মেধা আরও ভাল কিছুতে ব্যয় করা। যে সিস্টেম এমনিতেই বেশ ভাল কাজ করছে ওটা নিয়ে গবেষণা করার চাইতে অকেজো অথবা তুলনামূলক কম কার্যকরী সিস্টেম নিয়ে চিন্তা করা, কাজ করা বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
যথেষ্ঠ ভুল তথ্য। বাংলার কোন অবস্থান এবার নেই
নতুন মন্তব্য করুন