ফ্রান্সের তেরঙ্গা পতাকার তিন রং, নীল,সাদা আর লাল যার অর্থ যথাক্রমে লিবার্টি, ইকুয়ালিটি আর ফ্রেটারনিটি...এই তিন রঙ নিয়ে পোলিশ পরিচালক কিয়েস্লোস্কি তৈরি করেন তার কালজয়ী ট্রিলজি থ্রি কালারস, যার প্রথমটি “ব্লু”।
ফিল্মের মূল চরিত্র জুলি, মর্মান্তিক এক সড়ক দূর্ঘটনায় আহত হয়ে হাস্পাতালে যায় আর তার স্বনামধন্য মিউজিক কম্পোজার স্বামী আর তার ৫ বছরের মেয়েকে হারায়। পরবর্তীতে সেখান থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে এবং তার সকল সম্পত্তি বিক্রি করে কাউকে কিছু না বলে শহর থেকে অনেক দূরে চলে যায় এবং পরিচিত সকলের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। পরিবার হারানোর বেদনা ভুলে থাকতে বেছে নেয় সম্পূর্ণ একাকি এক জীবন... চলচ্চিত্রের শুরু এভাবেই।
সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক, অতীত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে জুলির বেঁচে থাকার চেষ্টা। তবে সমস্যা হয় যখন সে টিভিতে দেখতে পায়, তার মৃত স্বামীর শেষ না করে যাওয়া একীভূত ইউরোপের জন্য করা মিউজিক কম্পোজিশান তার বন্ধু এবং সমকালীন মিউজিক কম্পোজার অলিভিয়ার সেই কাজটি শেষ করতে চায়, আর টিভিতে দেখা সেই টক শোতেই যখন প্রথম সে তার স্বামী প্যাট্রিসের অতীত পরকিয়ার কথা জানতে পায়...অতঃপর পুনরায় জুলির ফিরে আসা তার অতীতের কাছে!
আগেই বলেছি, এই ফিল্মের বেস ছিল, লিবার্টি। তবে স্বাধীনতা বলতে আমাদের সবারই সর্বপ্রথমে গোষ্ঠীগত যে স্বাধীনতার কথা মনে আসে, কিয়েস্লোস্কি সেই স্বাধীনতাকেই নিয়ে গেছেন ব্যক্তি পর্যায়ে। ছুড়ে দিয়েছেন সেই প্রশ্ন, প্রকৃত স্বাধীনতা কি কখনো সম্ভব? আমরা নিজেরাই কি স্বাধীন হতে চাই? ভালোবাসা, পরিবার এসব কি এক প্রকার বন্ধন নয়? আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলোর জন্যই আমাদের বেঁচে থাকা, তাদের খুশি, চাওয়া অনুযায়ী আমাদের বদলে যাওয়া কি স্বাধীনতার পথে অন্তরায় নয়? পরিবার, ভালোবাসা সব মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে সত্যিকারের এই স্বাধীনতা কি আমরা চাই? জুলি তাই বার বার গিয়েছে তার মায়ের কাছে, ফিল্মের দেহজীবী মেয়েটা তাই স্ট্রিপ ক্লাবে তার বাবাকে দেখে পালিয়ে থেকেছে, প্যাট্রিসের সন্তান-সম্ভবা প্রেমিকার সাথে জুলি দেখা করেছে,তার স্বামীর অসমাপ্ত মিউজিক কম্পোজিশান শেষ করেছে আর পরিশেষে জুলি ফিরে এসেছে অলিভিয়ারের কাছে। কিয়েস্লোস্কির কাছে সত্যিকারের স্বাধীনতা তাই অবাস্তব পরাবাস্তব মাত্র!
এবার আসি নামকরণের বিষয়ে, অন্য সবার মত আমার মনেও প্রথম এসেছিল, এই ফিল্ম জুলির বেদনা নিয়ে আর বেদনার রঙ নীল, তার ফিল্মের নাম ব্লু! ভুল ভাঙ্গে জুলির সুইমিং পুলের দৃশ্য দেখে। সুইমিং পুলের পানি নীল, সাগরের পানি নীল, কিন্তু তা তো সত্য নয়, পানি তো রঙহীন। তাই সুইমিং পুল কিংবা সাগরের পানি আমাদের বোঝায়, যা দেখছি, যা ভাবছি, তা সত্য নয়। স্বাধীনতা নিয়ে কিয়েস্লোস্কির ভাবনাটাও হয়তো এরকমি ছিল। নীল তাই এখানে বেদনার রঙ নয়, বরং তা ভ্রান্তির কথা বলে, ফরাসী ন্যাশনাল মটোর স্বাধীনতারূপী নীল রঙের ভ্রান্তির কথা!
তবে এই মুভির সবচেয়ে অভুত সৌন্দর্্য্য তার মেকিং এ। আমার খুব সীমিত চলচ্চিত্র জ্ঞানে, কুবরিকের পর কেবল কিয়েস্লোস্কির ফিল্মেই দেখেছি, যেখানে প্রতিটি শট কথা বলে, ইছ এন্ড এভ্রি ওয়ান। বুনুয়েলের সিনেমাটিক সাররিয়েলিজম, বার্গম্যানের মেটাফর প্রভাবিত নীল রঙের ব্যবহারের সাথে কিয়েস্লোস্কির নিজস্ব এক্সপ্রেশানিজমের কাজ এই ফিল্মকে পরিণত করেছে চলচিত্র ইতিহাসের অন্যতম সেরা কাজে। কয়েকটা দৃশ্যের কথা না বললেই নয়। ডাক্তার যখন মাত্র জ্ঞান ফিরে আসা জুলিকে তার স্বামী আর মেয়ের মৃত্যুর কথা বলে, সেই দৃশ্যে, ক্যামেরা চলে যায় এক্সট্রিম ক্লোজ শটে জুলির চোখে, তার চোখের মনির রিফ্লেকশানে ডাক্তারকে দেখা যায় কথা বলতেছে, তার স্বামী আর মেয়ের মারা যাওয়ার কথা। চোখের মনির রিফ্লেকশানে কোন দৃশ্যের চিত্রায়ন, অসম্ভব সুন্দর এই চিত্রায়ন সুদূর কল্পনাতেও কখনো ছিল না!!
আরেকটা দৃশ্যের কথা বলি, জুলি যখন প্রথম তার মায়ের সাথে দেখা করতে যায়, সেই সময়ে টিভিতে দেখা যায়, কিছু লোক পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ছে, তারা নিচে পড়ে যাচ্ছে না কারণ তাদের পা দড়িতে বাঁধা। কিয়েস্লোস্কির স্বাধীনতা ভাবনারি প্রতিফলন, অতীত, আমাদের সম্পর্কগুলো আমাদের বেঁধে রাখে, আমরা কখনোই পরিপূর্ণ স্বাধীন নই! দুটো দৃশ্যে হটাত করেই স্ক্রীন পুরোপুরি কালো হয়ে যাওয়া আর কয়েক সেকেন্ড পরেই আবার ঠিক আগের দৃশ্যেই ফিরে আসার দৃশ্যটাও ছিল অভিনব। তবে ফিল্মে চমৎকৃত হয়েছি আরেকটা দৃশ্যে, যেখানে জুলি একটা কোর্টরুমে্র শুনানিতে গিয়ে ঢুকে আর সেই একি শুনানি পরে দেখা যায়, পরবর্তী ফিল্ম “হোয়াইট”এ।
ফিল্মে নীল রঙের ব্যবহার ছিল খুব তাৎপর্যময়। কেবল স্বাধীনতা ছাড়াও তা ফুটেয়ে তুলেছে জুলির মেলানকোলি, তার বিষাদ, হতাশা। প্রায় পুরো ফিল্মে জুলির নীল রঙের পোষাক, প্যাট্রিসের তার প্রেমিকার সাথে ছবিতে প্রেমিকার নীল রঙের পোষাক, শুরুর দৃশ্যে মেয়ের নীল ললিপপ, পরবর্তীতে ব্যাগে পাওয়া নীল ললিপপ যা সে তীব্র হতাশায় চিবিয়ে খায় আর সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ ছিল সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে কেবল তার মেয়ের নীল রঙের ঝাড়বাতি রেখে দেয়া আর সেই ঝাড়বাতি নিয়ে তার অনুভূতি ফুটে উঠে যখন পাশের ফ্ল্যাটের দেহজীবী মেয়েটা তাকে এই ঝাড়বাতি নিয়ে কথা বলে সেই সময়কার এক্সপ্রেশনে। এছাড়াও পুরো ফিল্মে নীল রঙ আর নীলচে শেডের ব্যবহার ফিল্মটাকে দেয় অন্যরকম এক স্নিগ্ধ সৌন্দর্্য্য ।
মডার্ণ ক্লাসিক্যাল মিউজিকের অনিন্দ্য সুন্দর ব্যবহার এই ফিল্মের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিককে করেছে সতন্ত্র। আর জুলি চরিত্রে অভিনয় করা জুলিয়েট বিনোচের অভিনয়, একে সংজ্ঞায়িত করার বিশেষন আমার জানা নেই!
এই ফিল্ম সম্পর্কে পরিশেষে একটা কথাই বলি, আগে কেউ আমার দেখা বেষ্ট ট্রিলজির কথা বললে আমি নির্দিধায় গডফাদারের কথাই বলতাম, কিয়েস্লোস্কির এই ফিল্ম দেখে আমি এতোটাই মুগ্ধ, এখন কেউ এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে এখনো হয়ত গডফাদার ই বলবো, তবে একটু ভেবে!
পরিশেষে, ট্রিবিউট টু দিস আনসাং হিরো অফ ফিল্ম, ক্রিজোসটফ কিয়েস্লোস্কি। গুরু তোমায় লাল সালাম।
লেখক পরিচিতিঃ The Shaikat Debnath
মন্তব্য
ভালো লাগলো।
চেষ্টা করবো শীঘ্রই দেখতে।
সৌরভ কবীর
ছবিটি দেখার আগ্রহ জাগলো এই রিভিউ পড়ে।
তিনটা ছবিই আমার অসম্ভব প্রিয়। প্রিয় মুভি নিয়ে লিখেছেন সেজন্য ধন্যবাদ। বাকি দুটা নিয়েও লিখে ফেলুন। ক্রিজোসটফ কিয়েস্লোস্কির 'ডেকালগ' মুভি ১০ টাও চমৎকার লেগেছে। আমি ভাল রিভিউ লিখতে পারলে লিখে ফেলতাম ।
নতুন মন্তব্য করুন