ঘুমকাতুরে এক বালকের বাবা ভোর থেকে তাকে ডেকেই যাচ্ছে কিন্তু বালকের তাতে কোন রা নেই। একটু পরে বালকের বাবা প্রমাণ করলেন শুধু শ্রবণ করাই কানের একমাত্র কাজ নয় বরং এটির উপযুক্ত ব্যবহার করে মানুষকে ঘুম থেকেও ওঠানো যায়। বালক চোখ ডলতে ডলতে ওয়াশ-রুমে যায় এবং হাড় কাঁপানো শীতে গরম পানি দিয়ে রগড়ে রগড়ে গোসল করে। গোসল শেষে তাকে পাঞ্জাবী পায়জামা পড়ান হয় এবং বালকের বাবা তার গায়ে আতর মেখে দেয়। তারপর পিতা পুত্র একসাথে বেড়িয়ে যায় ঈদগাহের উদ্দেশ্যে।
নামাজ পড়তে দাঁড়িয়েছে বালক যদিও তার মন মোটেও সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিবদ্ধ নয় বরং নামাজ পরবর্তী পোশাক পরিবর্তন এবং মুখরোচক খানাদানাই তার সকল চৈতন্য দখল করে রেখেছে। নামাজ শেষ হওয়ার পর সে ইমাম সাহেবের দেয়া খুৎবা শোনার চেষ্টা করে। আশেপাশের অনেকের মতো সে শুধু শোনারই চেষ্টা করে কিন্তু আরবি ভাষা না জানার কারণে সে কিছু বুঝতে পারে না। খুৎবা শেষে আবেগাক্রান্ত ইমাম সাহেবের দোয়া যখন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে বালক তখন উসখুস করতে থাকে। তার কাছে পাপমোচনের চেয়ে দোয়ার অবসানই বেশি প্রার্থিত হয়ে ওঠে।
নামাজের পরে আসে কোলাকুলি; এই অংশটুকু সবার ভালো লাগলেও বালক একটু অস্বস্তি বোধ করে। কারণ বালক একটু নাদুস-নুদুস হওয়ার কারণে বালকের সাথে সবাই প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি আন্তরিকভাবে কোলাকুলি করতে চায়। সবাইকে কম বেশি সন্তুষ্ট করে বালক তার কিছু পরিচিত পাপীর সমভিব্যাহারে এগিয়ে চলে তার এক কাকীর বাসায়। সেখানে পেট মহাশয়ের পূজোটা একটু ভক্তিভরে করে বালক চলে যেত আপন গৃহে। তারপর সেখানে ত্রাস সৃষ্টি করে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজ মাতা পিতার কাছ থেকে সে আদায় করে নিত মোটা অংকের সেলামি যদিও সে কোন ঈদেই তাদেরকে সালাম করে নি।
বালকের গায়ে থাকা পাঞ্জাবী সরোষে খুলে ফেলে সে। ধুর, ঈদের দিন কেউ পাঞ্জাবী পড়ে? এর চেয়ে তার ঐ সূর্যের কার্টুন ওয়ালা গেঞ্জি আর জিন্সের প্যান্টটা কত সুন্দর! ঝট করে ওগুলো পড়ে ফেলে সে। তারপর মাকে দেখিয়ে নিশ্চিত হয় যে, তাকে খুব মানিয়েছে। গেঞ্জির গায়ে লেগে থাকা ট্যাগ নিয়ে হাসাহাসি করে বালকের মা। কিন্তু বালক ঐদিকে ভ্রুক্ষেপ করবে কেন? গেঞ্জির গায়ে যদি ট্যাগই না থাকে তাহলে সেটা নতুন গেঞ্জি হল কিভাবে, বালকের নিরেট যুক্তি।
এবারের মিশন হচ্ছে উপার্জিত টাকার একটা গতি করা। বালক গুনে দেখে কত হল সেলামি, সব যোগ করে। আপাতত প্রায় তিরিশ টাকা যোগার হয়েছে। তাহলে কি করা যায়, কি করা যায়, ও হ্যাঁ দশ টাকা দিয়ে একটা টিনের পিস্তল কেনা যায় আর পাঁচ টাকার কোবরা গুলি। হাতে থাকল পনের টাকা; আচ্ছা এইটার হিসেব পরে হবে খন। বালক এইবার তার বৈধ অস্ত্র আর গোলা বারুদ নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। দুষ্টু বালকদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে তার এলাকাকে। শুরু হল দুর্ধর্ষ গোলাগুলি; টাস টাস শব্দে প্রকম্পিত এলাকা। বালক এই বিল্ডিং এর পেছনে লুকায়, ঐ বিল্ডিং এর পেছনে লুকায় আর কড়া নজরদারিতে শত্রুপক্ষদের একে একে ঘায়েল করে। শান্তি নেমে আসে এলাকায়।
পরিশ্রান্ত বালক এইবার তৎপর হয়ে ওঠে বাকি পনের টাকার ব্যবস্থা করার জন্য। দশ টাকার একটা ইগলু কাপ আইসক্রিম কেনে সে। আইসক্রিম খাওয়া শেষ হয়ে যায় কিন্তু বালকের ঠোঁটের চারপাশে তার রেশ লেগে থাকে। হাতে থাকল পাঁচ টাকা। এবার বালক পরে দোটানায়; ঐ টাকা দিয়ে সোলেমানের চটপটি খাবে নাকি পাঁচমিশালী চাটনি খাবে। চাহিদা আর যোগানের একটা নিখুঁত অংক কষে সে। যেহেতু অনেকের বাসায় চটপটির যোগান আছে তাই সে পাঁচ টাকার চাটনি নিয়ে মনের আনন্দে যাত্রা করে চটপটি আছে এমন কোন বাসার উদ্দেশ্যে।
অনেক অনেক দিন বা বছর পরে বালক যখন বিশেষণ পরিবর্তন করে যুবক হয়ে যায় তখন ঐরকম একটা সকালে তার বাবা তাকে ডাকে এবং ডাকতেই থাকে কিন্তু কেন জানি আর কান ধরে তোলে না। এরপর আগের মতোই সে তার বাবার সাথে ঈদগাহের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু বিপত্তি বাধে ঈদের নামাজ শেষে। সরকারি চাকুরে পিতার বদলির কারণে নামাজ শেষে সে কোলাকুলি করার জন্য চেনা কাঁধ খুঁজে পায় না। ভেতরে ভেতরে ডুকরে ওঠে যুবক। পুরনো স্মৃতি জাবর কাটতে কাটতে বাসায় ফিরে আসে বালক। রিমোট চেপে বিভিন্ন চ্যানেলের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় সে। কিন্তু প্রতি চ্যানেলে উপর্যুপরি অতি অভিনয় আর সুড়সুড়ি দেয়া অনুষ্ঠান দেখে কেবল বিরক্তই হয় সে। তারপর হয়তো তার কষ্টের বোঝাটা সে নামিয়ে দেয় কী-বোর্ডের উপর। তারপর হয়তো সৃষ্টি হয় এই লেখাটা...
#হিল্লোল
মন্তব্য
বন্ধু বান্ধব ছাড়া ঈদ, বড়ই একঘেয়ে আর নির্মম। এইবারের মত এত খালি আর যায় নাই কোনদিন। আপনের বোঝাটা একটু আল্গাইলাম
পড়ার জন্য এবং বোঝা আলগানোর জন্য ধন্যবাদ
হিল্লোল
ধন্যবাদ।
হিল্লোল
পিস্তল তো পেলাম না, নিন টিনের তলোয়ার।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
উপহারের জন্য অনেক ধন্যবাদ রিফাতাপু
হিল্লোল
আবার সেই শিশুবেলায় যদি যেতে পারতাম!!!! মনের মধ্যে শুধু সেই সময়ে ফিরে যাবার হাহাকার!!!
ইগলু কাপ ভাই এখন ২০ টাকা।
মনের রাজা টারজান,
হ
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
নতুন মন্তব্য করুন