আমার জাগরণগুলি স্বপ্নের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে কমজোরি তথা অনির্ভরযোগ্য হয়ে উঠছে।
-সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সম্পূর্নরূপে ন্যাচারাল ডায়েরী পড়ে আমারও সাধ জাগলো যে কিছু লিখি(ক্লিশে কথায়, এই এইরকম ডায়েরী বা দিনলিপির “পাঠ অভিজ্ঞতা হয়ে রইলো” )।
জীবনে আবেগের বশে বা স্বাভাবিক তাড়নায় কাগজ-কলম ছুঁই না, কিন্তু আমার আজকে নিজেকে একটু বানিয়ে-বাঁকিয়ে-ফাঁপিয়ে কিছু লিখতে মন চাইলো(notebook-এ লেখা বাহুল্য যে, সন্দীপনের ভেতর কোনো রকমের মেকিত্ব বা বানিয়ে তোলার ব্যাপার একটুও ছিলো না, তিনি সর্বদাই, সব বিষয়ে, সে যৌনতা হোক বা মাছের বাজারের প্রসঙ্গ হোক,“একদম সরাসরি” ছিলেন—কি লেখায়, কি কথায়, কি এই ডায়েরীতে) । এটা আত্মপ্রতারণাই বটে। একইসাথে রীতিমতো অসহ্য ভোজবাজীও। যদিও লেখা নিয়ে মাতাল করে দেবার নিপুণ কেরামতিটা সন্দীপনের। মানুষটার নির্মম জীবনঘোর ও ভাবনাক্রিয়ার সাথে নিজের অস্থির স্বভাবের কিঞ্চিৎ মিল তাঁর ডায়েরী পড়তে পড়তে জোরপূর্বক আবিস্কার করলেও, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম এই ভেবে যে, সন্দীপন তো একজনই ছিলেন/আছেন।ওইরকম পাগল, দীপ্তিধারী আশ্চর্য পাগলের মতো সম্ভবত কলকাতায় দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না।...
...সন্দীপনের সাথে নিজের মিল খুঁজে নেবার ব্যাপারটা অতীব কষ্ট-কল্পনা, সেটা আমি খুব করেই জানি। সবই আমার ভণ্ড-লড়াই আত্মসত্ত্বার ভেতরে—উদ্ভট রকমের স্ববিরোধীতার সাথে মেশামেশি করে পথ চলতে থাকা ক্রমাগত। বিস্মরণে, বিস্ময়ে, দানাদানা বিষাক্ত-বাস্তবতার সাথে বোঝাপড়া করে নেওয়ার একটা পর্যায় হিসেবে পরিগণিত হয় এগুলো কখনো কখনো। আবার কখনোবা পরিণত হয় বাস্তব-পৃথিবীকে ভাঙবার হাতিয়ারে। দ্বন্দ্ব, শেষ অব্দি সবটাই দ্বন্দ্বে পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে। ভাবনা-জগৎ, মানসিক অস্থিরতা, শারীরিক অসুখ— সবই দ্বন্দ্বাকীর্ণ, দ্বন্দ্বে জীর্ণ। মনে হলো, এটা আরেকখানা ভয়ানক সত্যিকথা যে, সন্দীপনের ডায়েরী পড়ে অশরীরি অথবা ছায়াবিহীন আরোগ্যের দিকে ফেরা যাবে না, কোনো পাঠকই, তিনি যতই দুঁদে হন না কেন, পারবেন না। মানুষটা কী একরকম দাঁত-কিড়মিড় অসমাপিকা-ক্রিয়ার মধ্যে নিজের লেখাটা চুবিয়ে এনেছেন, ফলত, ডায়েরীর পিলপিলে কালো অক্ষরগুলো তুলনা-রহিত— চোখ ও মন-ঝলসানো। ডায়েরীর একটি অংশে খুঁজে পাই হাটুভাঙা আর্তনাদ, তো আরেকটি অংশে পাই ঋজু সিদ্ধান্তের তালিকা ...কোথাও বা জমাটি জৈবনিক সাসপেন্সে পূর্ণ, কোথাও আবার জোরালো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ( পাঠক জানবেন, অবশ্যই তা প্রজ্ঞাময় ও সন্দীপনের স্বতন্ত্র-নিজস্ব চিন্তা দ্বারা জারিত-নির্মিত)।
তবু্ও, আন্তরিকতাহীন তিনি আদপেই নন। রসবোধও ছিলো নির্ঘাত যথেষ্ট।নিজের ডায়েরীর হারিয়ে যাওয়া অংশটুকু নিয়ে যে গদ্যখানি লিখেছিলেন, সেটা পড়লে তাঁর যুগপৎ সূক্ষ্ণ ও তীক্ষ্ণ রসবোধ টের পাওয়া যায়। নানাবিধ রোগে কি ভুগতেন তিনি? রক্ত, হাসপাতাল,নার্স, ওষুধ — এসবের উল্লেখ মাঝে-সাঝে ফিরে ফিরে এসেছে চুপিচুপি। লক্ষণীয় : আরেকটা জিনিসের আগমণ ঘটেছে এই ডায়েরীতে, বারংবার, তীব্ররূপে— মদ এবং মদ্যপান।
আমার মনে হয়, সন্দীপনের মাতলামি-বোধের মধ্যে তথাকথিত দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য বালখিল্য উন্মাদনা অবস্থান করতো না। বরং সেখানে উপস্থিত ছিলো এক ধরণের অপরূপ বিষণ্ণতা, দ্রোহের কারুকাজ অথবা নিজের পরিপার্শ্ব আর জগতকে চুরমার করে দেবার পর যতটুকু অভিনব সারকথা জমা থাকে — সেইটাও ছিলো ১৬আনা। পড়ার সময় এসবই মনে হচ্ছিল। অবশ্য, সংশয়ী চিন্তা, বা কিছূ প্রশ্নও জাগে মনে — সন্দীপন, আমাদের কি ইচ্ছাকৃতভাবেই এক বিষম আজগুবি পরীক্ষার ফাঁদে ঠেলে দিয়ে গেলেন তাঁর ডায়েরীর মাধ্যমে? নাকি সবটাই তাঁর সুচারু অসচেতনা, কিম্বা জটিল অবচেতনার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিলা?
যাহোক, মনোহর এই গোলকধাঁধা, বিভ্রমের নিশিডাক, অপার্থিব বধ্যভূমি বা রক্তাপ্লুত রূপকথাময় পাঠক্রম — যাঁর অপর নাম কিনা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরী, সেইখানে, পাঠক, আপনাকে অবগাহন করার জন্য অনুরোধ জানাই।
[আমার ডায়েরী থেকে, সন্দীপনের ডায়েরী বিষয়ে কিঞ্চিৎ। প্রিয় অদ্রীশদা, ডায়েরীটার সম্পাদক অদ্রীশ বিশ্বাস কিছুই সেন্সরড করেন নি এখানে। কিন্তু আমি নিজের লেখা হুবহু তুলে দিলাম না, বরং একটু সম্পাদনা করেই দিলাম, হা হা হা! আর, প্রকাশ থাক, শাহরিনা রহমানের উৎসাহ ব্যতিত এটুকুও লেখা হতো না।]
বই : সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরী ।। সম্পাদনা : অদ্রীশ বিশ্বাস।। প্রকাশক : প্রতিভাস, কলকাতা।।
===
দিগন্ত চৌধুরী
===
মন্তব্য
সচলায়তনের নীতিমালায় রয়েছে--
কিন্তু এই লেখাটি ফেসবুকের একটি গ্রুপে আজই প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে মডারেটরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
--সাদাচোখ
sadঅ্যাট1971এটymailডটcom