এভারেস্ট

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০২/০৯/২০১২ - ৩:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার ফেইসবুক নিউজফিডে মাঝে মধ্যে Wasfia Nazreen এর বিভিন্ন পোস্ট আসে। উনি এবং নিশাত মজুমদার প্রথম দুই বাংলাদেশি এভারেস্ট জয়ী নারী। মোটামুটি একই সময়ে তারা এভারেস্টে ওঠেন। বাংলাদেশী মেয়ে এভারেস্টের চূড়ায় উঠবে আমরা বেঁচে থাকতে, কেন জানি এটা কোনদিন ভাবিনি। একবার ৫-৭ দিনের জন্য ট্রেকিং করতে গিয়েছিলাম কেওকারাডং এবং তাজিনডং এর দিকে। ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। বলা যায়, সেটা ছিল আমার জীবনের একমাত্র রিস্কি এডভেঞ্চার। একটা গোপন ইচ্ছা জেগেছিল, যদি কোনদিন হিমালয়ের বেইস-ক্যাম্পে যাওয়া যেত! যাইহোক, একদিন সকালে নিউজে নাজরিন এবং নিশাতের এই খবর দেখে আমার বেইস-ক্যাম্পে কোনদিন যেতে না পারার গোপন কষ্টটা হালকা হয়ে গেল। ওয়াসফিয়া আরো কঠিন পর্বত-চূড়ায় ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ফেইসবুকে নিয়মিত আপডেট আসে, দেখে একধরনের ব্যক্তিগত জয়ের আনন্দ পাই। উনাদের জন্য অভিবাদন এবং শুভকামনা থাকল।

একদিন উদ্ভট একটা চিন্তা মাথায় এল। ওয়াসফিয়া নাজরিনের সাথে তুলনা করলে আমার নানীর জীবনের অর্জনগুলো কি? তুলনাটা একটু সহজ কারণ আমার নানী মারা গেছেন কিছুদিন আগে, এভারেস্টে উঠে নাজরিনের সাথে পাল্লা দেয়ার সুযোগ তার আর নেই। নানীর স্মৃতি বলতে আমার শুধু রান্না-বান্না আর খাওয়া-দাওয়ার কথা মনে আসে। আমার মামা-খালারা অনেকেই বছর শেষে বাচ্চাদের স্কুল ছুটি হলে হাজির হতেন সারাদেশ থেকে। আমরা ছোটবেলায় পুরো বছর জুড়ে অপেক্ষা করতাম সেই সময়ের জন্য। আমার নানী একাই তিরিশ-চল্লিশজনের রান্না করতেন একসাথে। উনি নাতি-নাত্নিদের জন্য এখানে সেখানে খাবার লুকিয়ে রাখতেন - যে নাতি মিষ্টি পছন্দ করে তার জন্য মিষ্টি, যে আম খেতে পছন্দ করে তার জন্য আম। জীবনে প্রথমবার আমি বড়শী দিয়ে মাছ ধরেছি। ছোট একটা মাছ - টেংরা কি শিং ঠিক মনে নেই। সবাই বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে যেন আমি বিশ্বজয় করে এসেছি। এদিকে আমি টেনশনে আছি, একটা মাত্র মাছ অথচ এতগুলো মানুষ! নানী সমস্যার সমাধান করলেন আস্ত মাছটাই আমার প্লেটে তুলে দিয়ে। রাতে ঘুমানোর আগে উনি আমাদের গল্প শুনাতেন। ভূতের গল্পই বেশী বলতেন। কখনো সখনো ছড়া। উনি ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল খুব ছোটবেলায়। আবার পুরনো প্রশ্নে ফিরে আসি, উনার জীবনের অর্জনগুলো কি? সত্যি বলতে, আমি ঠিক জানিনা। আমার শুধু মনে পড়ে বড় হবার পরে শেষ যে ক'বার দেশের বাড়িতে গেছি প্রতিবার উনি নানাকে বাজারে পাঠিয়েছেন আমার জন্য বাতাসা কিনে আনতে। উনি হয়তো মেনে নিতে চাননি আমি বড় হয়ে গেছি, আমি আর বাতাসা খেতে পছন্দ করিনা। আমি জানিনা উনি কখনো হিমালয়ের নাম শুনেছেন কিনা, তবে উনার জীবন আমার চোখে এভারেস্টের বেইস-ক্যাম্পে যাওয়ার মতই আনন্দের ব্যাপার বলে মনে হয়।

কেউ আবার ভেবে বসবেন না আমার পরিচিত অপরিচিত সব বাঙ্গালী নারীকেই আমি কোন না কোন ভাবে হিমালয়ে পাঠাচ্ছি। অবশ্য, বাংলাদেশে মেয়ে হয়ে বড় হওয়াটাই একটা ছোটখাট এডভেঞ্চার। ক্লাশ ফাইভে পড়ি তখন, আমাদের সাথে এক মেয়ে ফুটবল খেলতে আসে। সে একদিন আচমকা আসা বন্ধ করে দিল - বড় হয়ে গেছে, এই বয়সে আর ছেলেদের সাথে খেলা যাবেনা। এরপর অসংখ্য মেয়েকে দেখেছি, পড়াশোনা করছে ভালো বিয়ের জন্য। ঘর-সংসার করবে, ছেলে-মেয়ে মানুষ করবে, স্বামী-সেবা করে জীবন পার করে দেবে। হয়তো চাকরির বাজার ভাল না হওয়াটা এর পিছনে অন্যতম কারণ, হয়তো ব্যক্তিগত রুচিটাই প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু এটাও সত্য যে, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সৃষ্টি করা ফানেলে জীবনের আকার-আকৃতি ঠিক হয়ে যাচ্ছে বেশীরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের। মড়ার উপরে খাড়ার ঘার মতো আবার আছে আমাদের হুজুরগোষ্ঠী, মেয়েরা যাদের চোখে উর্বর শস্যক্ষেত্র ছাড়া আর কিছুই না। নিম্নবিত্তদের কথাতে আর নাইবা গেলাম - বেঁচে থাকাটাই তাদের জন্য বেশীরভাগ সময় অভিশাপ।

প্রতিটি বাঙ্গালী নারী, যে নারী হওয়ার আগে একজন মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখে, যে মেনে নেয়না চাপিয়ে দেয়া নিয়ম, যে নিজের মতো করে গুছিয়ে নেয় তার জীবন, সে অলরেডি এভারেস্টের কোন না কোন লেভেলে উঠে গেছে। তাদের সবার জন্য অভিবাদন এবং শুভকামনা।

-----------------
পাভেল মাহমুদ


মন্তব্য

দীপ্ত এর ছবি

পড়ে ভালো লেগেছে। গোছানো চিন্তা, সোজা ভাষায় একটানা লেখা- পড়ে আরাম পেয়েছি। আর বিষয়, ভাষা, শব্দচয়ন, অনুচ্ছেদের পারম্পর্যও সুন্দর। আরও লিখুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ দীপ্ত। অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল এই ধরনের কিছু একটা লেখার। একটু কষ্ট হয়েছে আমার মাকে এই গল্পে না ঢুকাতে। নাহলে লেখা হয়ত উপন্যাস হয়ে যেত হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লেগেছে। আপনার ভাবনাগুলো সুন্দর। এমন করে সবাই যদি ভাবতে পারত! সচলায়তনে আপনার লেখা কী আগে পড়েছি? মনে হয় না। সচলায়তনে স্বাগতম হাসি

ব্যাঙের ছাতা

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ 'ব্যাঙের ছাতা'। অসাধারণ নিক নিয়েছেন হাসি । দৌড়ের উপরে থাকি ভাই, মাঝে মধ্যে এসে বিভিন্ন লেখা পড়ে যাই। 'ঘরে ফেরা' নামে একটা গল্প লিখেছিলাম মাসখানেক আগে। দুই একটা কবিতা আছে অবশ্য সচলায়তনের চিপা-চুপায়, বছর এক-দুই আগে ছাপানো হাসি

তারেক অণু এর ছবি

প্রতিটি বাঙ্গালী নারী, যে নারী হওয়ার আগে একজন মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখে, যে মেনে নেয়না চাপিয়ে দেয়া নিয়ম, যে নিজের মতো করে গুছিয়ে নেয় তার জীবন, সে অলরেডি এভারেস্টের কোন না কোন লেভেলে উঠে গেছে। তাদের সবার জন্য অভিবাদন এবং শুভকামনা। উত্তম জাঝা!

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ তারেক অণু, আপনাদের মতো এডভেঞ্চার প্রিয় মানুষদের চোখে লাইফ দেখার ছোট একটা চেষ্টা করলাম হাসি

সৌরভ এর ছবি

আপনার লেখার শেষ বাক্যের সাথে একমত। তবে পুরো লেখা পড়ে মনে হল, আপনি অন্যান্য বাঙালি নারীর এবং এভারেস্ট বিজয়িনীদের জীবনের সাফল্যকে একই কাতারে রাখতে চাচ্ছেন। লেখার শেষ বাক্যটি আপনার নানীর ক্ষেত্রে কি আসলেই সত্য ? এদেশের অনেক নারীকেই কিন্তু বাধ্য হয়ে চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম মেনে নিতে হয়। হউতো উনাকেও এ সব স্থুল নিয়মের বেড়াজালে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হয়েছিল। ওয়াসফিয়া বা নিশাতেরা কিন্তু হারিয়ে ফেলেননি। আপনার ক্লাস ফাইভের সেই বান্ধবী ফুটবল খেলতে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল, এদেশের মহিলা জাতীয় দলের ফুটবলাররা যেটা করেননি। এখানেই সত্যিকার এভারেস্ট বিজয়িনীদের সাথে অন্যদের পার্থক্য। এদেশের প্রতিটি মেয়েদের মত তাঁদেরকেও অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে, অনেক চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম আর ধর্মের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করতে হয়েছে। আপনার লেখানুসারে এসবই যদি এভারেস্ট বিজয়ের সমতুল্য হয় তবে তো তাঁরা দুইবার এভারেস্ট বিজয় করেছেন। এক্ষেত্রে গণিতের ভাষায় বলা যায়, ২ কখনই ১ এর সমান হতে পারে না।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি ঠিক লজিকাল দিক থেকে দেখতে চাইনি। অবশ্যই মাত্র দুইজন বাঙালি নারী এভারেস্টে ওঠার সাফল্য পেয়েছেন। বাকিরা যারা বিভিন্ন ভাবে ফাইট দিচ্ছেন তাদেরকে এপ্রিশিয়েট করাটাই আমার মূল উদ্দেশ্য, তূলনার ব্যাপারটা একেবারেই গৌণ। এভারেস্টে ওঠার ব্যাপারটা প্রথম প্যারার পরে একরকম রূপকার্থে ব্যবহার করেছি। আমাদের নানী-দাদীদের ক্ষেত্রে তাদের সময়টা দেখতে হবে। আমার কাছে তাদের অর্জন তাদের ছড়িয়ে দেয়া ভালবাসা।

সৌরভ এর ছবি

এভারেস্টে ওঠার ব্যাপারটাকে আমিও রূপকার্থে ব্যবহার করেছি; ভালবাসা ছড়ানো, কেবল পরিবারের সেবা করে জীবন পার করা ইত্যাদির চেয়ে বৃহত্তর অন্য যে কোন অর্জনকে বুঝাতে। খেয়াল করবেন আমি মেয়েদের ফুটবল ক্ষেলার প্রসঙ্গও এনেছি হাসি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

লেখার মূল বিষয়বস্তুটি চমৎকার। ভাল লেগেছে আপনার চিন্তাচেতনা। চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।