উন্নতির সাথে ভোগের সম্পর্ক আছে, তাই বেশি ভোগী জাতি আমরা এখনও না। তাও যেসব দান পেয়েছি প্রকৃতি থেকে বিনামূল্যে তাকে নিয়ে ভাবছি কি? নদীর দেশের মানুষ হিসেবে অকাতরে পানি অপচয় করছি, ফেরি দিয়ে যাওয়ার সময় ডাবের খোসাটা পানিতে ছুঁড়ে দিচ্ছি নিশ্চিন্তে। পানীয় জলের অভাব হবে বা গোসলের জন্য পানি পাব না, এ ভাবনা অলীক আমাদের কাছে। আসলেই কি তাই? এমনকি হতে পারে না যে আজ যেমন জৈব জ্বালানি, তেল বিশেষ করে, নিয়ে দুনিয়াতে এতো কাটাকাটি, পানি নিয়েই ভবিষ্যতে শুরু হল এমন কিছু? আরও ভাবি, ভোগের পরিধি আমাদের বাড়ছে, মাংস (প্রোটিন) খাওয়া বাড়ছে সারা দুনিয়া জুড়ে, প্রযুক্তিগত পণ্য আর সেবা হুহু করে বাড়ছে, ২০ বছর আগে একজন মানুষের জীবনভর যে কার্বন ফুটপ্রিন্ট ছিল পৃথিবীতে, তা আজ অনেক বেশি। পৃথিবীতে সবকিছু আদিম অবস্থায় ফিরে যাক, সকলে পণ্য কেনা বন্ধ করে দিক, সব আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিতে থাকি, তা বলি না। কারণ সে চিন্তা বাস্তবসম্মত না। মানুষ যদি পণ্য না কেনে, তাহলে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে কি করে? মন্দা লেগে থাকবে, তরুণদের চাকরি হবে না, নতুন উদ্যোগও সমাজে মাথা তুলতে পারবে না। তাহলে কি করা যায়? এখানে আমি অপারগ, এ বিষয়ে পড়াশোনাও নাই, তথ্য-উপাত্ত সহ কথা বলতে পারব না, খালি দুশ্চিন্তাটাই করতে পারি। মাথায় এতটুকু কুলোয় যে এমন ব্যবস্থা আমাদের চাই যাতে মানুষের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে পণ্যের সরবরাহ যাতে বাড়ে আবার পরিবেশে প্রভাব পড়ে কম। আশার কথা সারা দুনিয়াই এ নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে, টেকসই প্রযুক্তি নিয়ে, টেকসই জীবনযাপনোপায় নিয়ে।
ভাবি আজ যা পাচ্ছি স্বচ্ছন্দে অনাগতকালেও তা পাব নিশ্চয়ই, অথচ সত্য কঠিন এটা বুঝে উঠলেই বিজ্ঞানীদের কাছে হাত পাতা ছাড়া উপায় দেখি না। বিজ্ঞানীরা এদ্দিন উদ্ধার করেছেন, তাই কালকেও কোন না কোনভাবে নতুন রাস্তা বাতলে দেবেন তাই ভেবে নিশ্চিন্ত হই। অথচ ভীষণ কোন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ছাড়াও তো একটু ভেবে চললেই আরেকটু বেশিদিনের জন্য সুখ আনতে পারি আমরা। দেশের কথা যদি বলি, এতো বেশি নদী আমাদের বুকের মধ্যে দিয়ে গেছে যে মাটি অসম্ভব উর্বর। প্রতিবছরই আগের বছরের চেয়ে বেশি ধান হচ্ছে। যদি নদীগুলো বাঁচিয়ে রাখতে পারি, পানি নিয়েও বিপদে পড়ব না, ধান নিয়েও না। এতো ছোট দেশে যা প্রাকৃতিক সম্পদ পেয়েছি, তা অখুশি হওয়ার মত না। গ্যাস যা পাওয়া গিয়েছে এতদিনে, আগে থেকে পরিকল্পনা করলে আরও অনেক দিন অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়া লাগত না। তা না করে দুই বিদেশী কম্প্যানি কতো গ্যাস উড়িয়ে দিল সেচ্ছাচারি ভুলে, আবার তার বিচারও পেলাম না। কতো কিছু যে কতো কিছুর সাথে যোগ- শিক্ষা, সচেতনতা, রাজনীতি, স্বার্থত্যাগ, মেধাপাচার, বৈষম্য এসবে আন্তঃসম্পর্কের জাল দেখলে কোন মুড়ো থেকে সমাধানের দিকে এগোলে আগে পৌছান যাবে তা ভেবে পাইনা।
আমার আগ্রহ লাগে, যে তিনচারশ বছর পরে যারা বাংলাদেশ নামক ভুখন্ডে থাকবে, তারা কি আমাদের বোকা ভাববে? ভাববে যে কি করেই না আমরা একে একে অপচয় করেছি যে আশীর্বাদগুলো আমাদের ছিল তা। ভাবতেই পারে, আমরা যেমন ভাবি, ইস সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরকে কি করে বিশ্বাস করেছিল। ভালো সময়ে জন্মেছি আমি, জন্মানোর পরে কোন বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি। যুদ্ধ ছিল না বলেই আনন্দে বেড়ে উঠেছি, যুদ্ধ নেই বলেই গল্প লিখতে পারছি, যুদ্ধে যেতে হয়নি বলেই ফুল ভালো লাগছে। তাই চাই তিন-চারশ বছর পরে যারা দেশের মাটিতে ঘুরে বেরাবে, তাদেরও যেন খাবার থাকে, পানি থাকে, আনন্দ থাকে। পাখি শিস দিলে মনে অনির্বচনীয় অনুভূতি হয়, বনের সবুজের মধ্যে দৌড়তে গিয়ে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া বেগুনি ফুল দেখে বিস্ময় লাগে। বিশেষ করে এসব ভেবেছি দ্য হাঙ্গার গেম মুভি দেখার পরে। দেখলাম, সেই যে ১২ প্রদেশ, যারা একবার কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে আর হেরে যায়। তারপর সে ঘটনার প্রতিফল হিসাবে প্রতি বছর প্রতি প্রদেশ থেকে এক জন তরুণ আর এক জন তরুণীকে খেলায় অংশ নিতে হয়। এ খেলা জীবনমৃত্যুর খেলা। ২৪ জনের বাকি সবাইকে হত্যা করে শেষ জন হিসেবে টিকে থাকাই এর উদ্দেশ্য। সিনেমার এক দৃশ্য মনে ভাসে আমার, যখন প্রচণ্ড গরিব এক প্রদেশ থেকে বাছাই করা এক তরুণ-তরুণী জোড়াকে নিয়ে আসা হচ্ছে রাজধানীতে। তখন তারা দেখতে পায় রাজধানীর রূপ, সাঁসাঁ করে ট্রেন বয়ে চলেছে, হাশিখুশি নরনারী, চারদিকে ভোগবিলাসের প্রাচুর্য, কোথাও অস্থিরতা-অশান্তির চিহ্নমাত্র নেই। বাৎসরিক এই নিষ্ঠুর খেলা, এই হাঙ্গার গেমস, তাদের কাছে বিনোদনের অনুষঙ্গ। কে শেষ পর্যন্ত বাঁচবে তা নিয়ে বাজি ধরা চলে, প্রতিযোগীদের নিয়ে রিয়েলিটি শো ধরনের অনুষ্ঠান হয়, অথচ এরাই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এমন এক প্রতিযোগিতায় যাচ্ছে যা অমানবিক, অকল্পনীয়।
মানি সিনেমায় যা দেখায় তা বাড়াবাড়ি, এমন ঘটনা কখনও ঘটবে না। তারপরেও যখন ওই চব্বিশটা দুঃখী প্রদেশকে দেখায়, তখন আমার বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে। এখনও আমরা খালি উৎসর্গের উপকরণ হয়ে উঠিনি, এখনও পৃথিবীতে সব দেশ একগাদা নিয়মকানুন দিয়ে রেখেছে, যাতে ছোট দেশ, দরিদ্র দেশ বড় দেশের সেবাদাসে পরিণত না হয়। কিন্তু নিয়মকানুন তো কেবল শান্তির সময়ে প্রযোজ্য, যখন ধনীর ঘরে খাবারের টান পড়ে তখন গরিবের খাবার কেড়ে নিলে কে প্রতিবাদ করবে। বেশি চিন্তা করতে গিয়ে গুবলেট করে ফেলছি হয়তো, কিন্তু কোন কারণে বিজ্ঞান যদি দৌড়ে হেরে যায়, বিকল্প উদ্ভাবনের আগেই যদি আমাদের পানি আগে ফুরিয়ে আসে, যদি চুলার আগুন আগেই নিভে যায়, যদি এরোপ্লেনে রানওয়েতে মন্থর হয়ে থাকে জ্বালানির অভাবে তাহলে কি যুদ্ধ হবে না? পানির জন্য, ভূমির শেষ বিন্দু উর্বরতার জন্য, মাছের শেষ ভাণ্ডারটার জন্য। সম্পদে, স্বচ্ছন্দে, ভোগে যখন অভাব আসবে তখন আইন বলে কিছু যে থাকবে না তা জানি। এতো যে নিয়ম আছে আজ, উন্নত দেশের সম্পদের একটা অংশ দিতে হবে অনুন্নত দেশকে, মানবাধিকার রক্ষা করে চলতে হবে, কোথাও গনহত্যা হলে সব রাষ্ট্র মিলে প্রতিরোধ করা হবে এসব লোপ পাবে, থাকলেও তা হবে প্রহসন। কতদিন পরে হবে এসব? চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরে হয়ত না, তাই নির্বিঘ্নেই পার হয়ে যাবে আমাদের সময়টা। কিন্তু পাঁচশ বছর পরে দেশ বলতে এখন যে ভুখন্ডটা চিনি তার মানুষেরা লড়ছে হাঙ্গার গেমের মত এটা ভাবতে পারি না। হয়তো তখন আমাদের ভূখণ্ড যে মেয়ে জন্মাবে সভ্যতায় তার কোন অধিকার থাকবে না , আজ যেমন ঢাকার বস্তিতে যে মেয়ের জন্ম তার পরিণতি গার্মেন্টসের আধো-অন্ধকার সূর্যের আলোবিহীন ঘরে মাথা গুঁজে খেটে যাওয়ায় সীমাবদ্ধ অনেকাংশেই। ক্ষুধায় তাকে হয়তো বেছে নিতে হবে সভ্যতার আদিমতম পেশা। যে ছেলে জন্মাবে অন্যের খাবার কেড়ে নিতে পারলে বাহবা জুটবে তার। যে যুবক থাকবে তাকে বাধ্যতামূলক যুদ্ধ করতে হবে, কবিতা লেখা হবে নিষেধ। অরওয়েলের ১৯৮৪ ও ছিল হতাশার গল্প, প্রকট রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে কি করে মানুষের অধিকার, স্বপ্ন, আশা, ভবিষ্যৎ হেরে যেতে থাকে প্রতিনিয়ত সেই কাহিনী। আজ এতো বছর পরে দেখছি বিজ্ঞান আমাদের অন্তর্জাল দিয়ে, মুক্তজ্ঞান দিয়ে, পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষকে কাছে এনে সংস্কৃতির দেয়াল গুঁড়িয়ে দিয়ে বলছে, ভয় নেই। তাই বিজ্ঞানকে আঁকড়ে ধরি যাতে পরের প্রতিটা প্রজন্ম যাতে আজকের পৃথিবীর চেয়ে সুন্দর, সবুজ, আনন্দময় পৃথিবী পায়। সে পথে যদি কিছুটা অবদান রাখতে পারি, তাহলেই খুশি, স্মৃতিতে টিকে থাকার দরকার নেই। যে জন লিখন-পদ্ধতি সূচনা করছিলেন তাকে মনে রেখেছে কে? অথচ কি ভীষণ আবিষ্কারই না ছিল তা।
দীপ্ত
মন্তব্য
লিখন পদ্ধতি কোন একজনের একদিনের আবিষ্কার নয়। মানুষের লিখন পদ্ধতি সুসংহত হয়েছে সময়ে সঙ্গে সঙ্গে।
লিখতে থাকুন। সচলায়তনে স্বাগতম।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
পড়ে মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
হ্যাঁ, শেষ উদাহরণটা জুতসই হয়নি। আরও উপযুক্ত কিছু দেয়া যেত। ভুল শুধরে দেয়াতে ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন