রাজ্জাক সাহেব একজন লেখক। বড় মাপের কিছু নন, মাঝারি মানের হয়তোবা বলা চলে। প্রতিযোগিতার বাজারে প্রকাশকদের ফরমায়েশি লেখা লিখেই একরকম টিকে আছেন। এ এক গুণ তাঁর স্বীকার করতেই হয়; কখনও বাংলা টেক্সট বইয়ের নোট লেখা, কখনও সংবাদপত্রের সাহিত্য পাতার জন্য চটুল প্রেমের উপন্যাস, আবার কখনও ছোট্ট মণিদের মন রাঙাতে রূপকথার মনভুলানো গল্প, সবকিছুতেই সমান দক্ষতায় হাত চলে তাঁর! বেছে লেখার মতো কৌলীন্য যে তাঁর সাজে না, সহজ ভাবে সে সত্য অনেক আগেই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আজকাল অলস দুপুরগুলোয় মনের মাঝে যেন কার দীর্ঘশ্বাস বড় অস্থির করে তোলে। সিলিং এ আটকে পড়া পুরনো ফ্যানটার নিয়ম মেনে ঘুরপাক খাওয়া দেখে নিজের কথাই কেন বারবার মনে পড়ে যায়?
চারটি প্রাণীর এই সংসার চালাতে লেখার পাশাপাশি কিছু বাড়তি কাজও করতে হয়, প্রাইভেট পড়ানো, মাঝেমাঝে অন্যের বইয়ের প্রুফ দেখে দেয়া, এইরকম টুকটাক আর কি। হয়তো আরও কিছু সচ্ছল ভাবে সংসারটা চালানো যেত, যদি তাঁর স্ত্রী একটু সুস্থ থাকতেন। ওঁর ডাক্তারের খরচ যোগাতেই হিমশিম খেতে হয় যে! ছেলে দুটিও সবে কলেজে ঢুকেছে, তাদেরও নানান খরচা। সংসারের কার কি শখ, তা জানার সুযোগ আর হয় না, প্রয়োজনগুলোর যোগান দিতেই জমা খরচের হিসেব গুলিয়ে যায়। নাহ, টলমল করে জীবন চালাতে আর ভাল লাগে না। ঘুম ভাঙ্গা মাঝ রাত্তিরে ভুলে যাওয়া স্বপ্নগুলো ভূতের মতো তাড়া করে ফেরে, আয়নায় বলিরেখাময় মুখ ভ্রুকুটি হানে, "দিন যে ফুরিয়ে গেল হে, তোমার নিজের জীবনটা আর কবে বাঁচবে?"
সত্যি তো, নিজের মতো করে বাঁচা, সে পথ তো কতদিন আগে পেছনে ফেলে এসেছেন। একসময়কার নীতি আদর্শগুলো জলের দরে কবে বিকিয়ে গেছে। সাহিত্য আসরের সেই মধ্যমণি, জঞ্জাল লেখার বিরুদ্ধে তেড়েফুঁড়ে ওঠা সেই যুবক, সে কি এই দেহেই একদিন বাস করতো?আদৌ বিশ্বাস হয় না। টিউশনির টাকায় টেনেটুনে চলা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, দিনের পর দিন লিটল ম্যাগাজিনের জন্য সেই সংগ্রাম মনে পড়ে, অবিরত স্বপ্ন গেঁথে চলা স্মৃতিগুলো মনে পড়ে। পোড়া মনের অবশ ব্যাথ্যাগুলো মোটা চশমার আড়াল বেয়ে একসময় নেমে আসে, কিন্তু মনের ভার যে নামে না। নিজের পরিত্যাক্ত লেখার খাতাগুলোয় পরম মমতায় হাত বুলান; যে লেখাগুলো একদিন সাহিত্য সভার গুণীজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে, কিন্তু কোনদিন কোন প্রকাশকের মন ভুলাতে পারেনি। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী সেই যুবক একসময় ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে, ব্যবসার ফর্মুলা মেনে লেখক থেকে ফরমায়েশি লেখার যোগানদারে পরিনত হয়েছে।
আজ বড় ইচ্ছে হচ্ছে অতীতের সেই যুবকের কাছে ফিরে যেতে। চাইলে কি পারবেন না তিনি? হয়তো সংসারের চাকাটা আরও ভারী হয়ে পড়বে, হয়তো অভাবে স্ত্রীর চিকিৎসা আরও দীনভাবে হবে, হয়তোবা ছেলে দুটির ভবিষ্যতকে আরও অনিশ্চিত করে দেবেন তিনি। কিন্তু তারপরও আজ স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করছে। একটু স্বস্তি নিয়ে বাঁচা, নিজের বিবেকের সামনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বলা, "দেখ আমি বিকিয়ে যাইনি, ফুরিয়ে যাইনি, এখনও আমি আমার স্বপ্নগুলো জিইয়ে রেখেছি"।
রাজ্জাক সাহেব কলম তুলে নিলেন। এবারের ঈদ সংখ্যায় কোন আপোষী সস্তা লেখা যাবে না, তিনি নিজের মনের মতো একটা লেখা লিখবেন। এতদিন বেঁধে রাখা বোবা মনটার আগল খুলে দেবেন আজ। চাইলে নিশ্চয়ই তিনি পারবেন পাঠকের মন ছুঁতে, নিশ্চয় পারবেন। নিজের ভেতর প্রচণ্ড এক ভাললাগা আজ মনটা ভরিয়ে দিচ্ছে।
সারাদিন তিনি লেখার টেবিলে বসে রইলেন, মাথায় কোন মৌলিক প্লট এলো না। চারপাশের এতো মানুষ, কেউ তাঁর গল্পের চরিত্র হয়ে ধরা দিল না। মনের কোন অনুভূতিই তিনি সাদা কাগজে মূর্ত করতে পারলেন না। তাঁর তরল উপন্যাসের চটুল নায়িকারা চারপাশে হাসতে লাগলো, নকল গল্পের বানানো সুখ দুঃখগুলো বিদ্রুপ করতে লাগলো। মাথার উপর ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ তোলা সেই সিলিং ফ্যানটার শব্দে একসময় সম্বিত ফিরে এলো, রাজ্জাক সাহেব বুঝতে পারলেন তাঁর আর কোনদিনই ফেরা হবে না।
এক জোনাকি
মন্তব্য
এত রাতে মনটা খারাপ করে দিলেন? আপনি বড় খারাপ মানুষ।
রাজ্জাক সাহেবের জন্য খারাপ লাগছে।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
রাজাদের মন এতো দুর্বল হলে কেম্নে কি
ভাল লাগলো
..................................................................
#Banshibir.
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ইয়ে মানে এই ফেরা দেখে আপনার ফেরার কথা মনে পড়ে গেল
আপনি তো ফিরলেন না
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
কারো কারো কোনদিনি ফেরা হয়না।
লেখা ভাল লেগেছে জোনাকি।
ধন্যবাদ বন্দনা। অনেকদিন আপনার কোন লেখা পাচ্ছি না সচলে, তাড়াতাড়ি ফিরুন
ভালো লেগেছে
ধন্যবাদ
একটা মজার ব্যাপার, সচলে ফেরা শিরোনামে অ-নেকগুলো লেখা আছে।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
তিথী। এই লেখাটা লিখতে যতটা সময় দিয়েছি, তার প্রায় সমান সময়ই দিয়েছি একটা নাম খুঁজে পেতে। কিন্ত
ধন্যবাদ পড়বার জন্য।
-এক জোনাকি
ফেরা হয়, ফেরা হয়না - বাস্তবতার ঘেরাটোপে অবিরত ঘুর্নিপাক খেয়ে যায় বুকের গহনে সযত্নে সাজিয়ে তোলা ইচ্ছেগুলো ---
ভালো লাগলো।
-অয়ন
........
রংতুলি
ছোট্র অবয়বে জীবনের অনেক বড় সত্য তুলে এনেছেন। যদিও একজন লেখককে কেন্দ্র করে ঘনীভূত হয়েছে, গল্পটি সবাইকেই স্পর্শ করবে, কারণ প্রায় সবার জীবনেই রয়েছে না ফেরার গল্প, ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। প্রায় প্রত্যেকেরই রয়েছে একান্ত দীর্ঘশ্বাস, অন্তর্গত পরাজয়ের তীব্র রক্তক্ষরণ।
আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমার নিজের না ফেরার দীর্ঘশ্বাস থেকেই হয়তো গল্পটা লেখার তাগিদ অনুভব করেছি ।
না ফেরার গল্প...
ধন্যবাদ করিকাঠুরে।
ভাল লাগল।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
থিমটা ভালো লাগল।
বেশ লেখা
facebook
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
ভালো লেগেছে , আপন লেগেছে , ভালো থাকুন আর ফিরে আসতে না পারলেও নিজের ভেতর ফিরে আসার তাগিদ টা বজায় রাখুন , সেটাই আপনাকে প্রেরণা যোগাবে ।
নতুন মন্তব্য করুন