১
কথায় আছে সর্ব রোগের ঔষধ আছে কিন্তু চিন্তা রোগের কোন ঔষধ নেই। একমাত্র মেয়ে তিলোত্তমার বিয়ের চিন্তায় শ্যামল বাবুর চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেছে। বয়সের ভারে পাতলা হয়ে যাওয়া মাথার চুলগুলো চিন্তায় চিন্তায় আরও পাতলা হয়ে আসছে। তিলোত্তমার বান্ধবীরা লাল শাড়ি পরে একে একে শশুর বাড়ি পাড়ি জমাচ্ছে। অথচ তিলোত্তমার বিয়ের কোন লক্ষনই নেই। আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে এসব কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন শ্যামল বাবু।
তার ঘুম ভাঙ্গে তিলোত্তমার ডাকে, বাবা তুমি এ অবেলায় ঘুমাচ্ছ! শরীর খারাপ নাকি?
শ্যামল বাবু আড়মোড়া ভেঙে বলেন, না রে মা শরীর খারাপ নয়। এই একটু চোখ বুজে এসেছিল।
তাহলে স্নান করে এসো। আমি টেবিলে ভাত দিচ্ছি। আলনার কাপড় ঠিক করতে করতে বলে তিলোত্তমা।
স্নান সেরে শ্যামল বাবু খেতে বসলেন। আগে মেঝেতে বসেই আহার করতেন। কিছুদিন থেকে বাতের ব্যাথা এমন খারাপ পর্যায়ে গেছে যে হাঁটু মোড়ে মেঝেতে বসতে কষ্ট হয়। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই এখন টেবিলে বসতে হয়। তিনি ভাতের চারদিকে লেবুর রস ছিটিয়ে বললেন, তিলো আজ সন্ধ্যায় তোর অনি পিসির বাসায় যেতে হবে। একটু মনে করিয়ে দিস তো।
তিলোত্তমা বাবার দিকে চেয়ে বলে, সেদিন না অনি পিসির বাসা থেকে এলে! আজ আবার কেন?
শ্যামল বাবু যেন কিছু লুকোতে চাইছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, না মানে, একটা কাজ আছে।
কাজটা কি আমার বিয়ে নিয়ে। খানিকটা রাগতস্বরে বলে তিলো।
শ্যামল বাবু যেন ধরা খেয়ে গেছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, না হয়েছে কি, অনির এক দূরসম্পর্কের ভাসুরপোর জন্য ওরা হন্য হয়ে মেয়ে খুঁজছে। ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করেছে। এখন কোন একটা নামী ঔষধ কোম্পানীতে কেমিস্ট হিসেবে কাজ করছে। মাসে বেশ মোটা বেতন পায়। তোর অনি পিসি চাইছে ওরা তোকে দেখুক।
এবার অনেকটা ঝাঁঝমেশানো সুরে তিলো বলল, বাবা আমাকে আর কতো ছোট করবে। কত জনই তো আমাকে দেখেছে। কিন্ত কেউ কি আমায় পছন্দ করেছে? আমি আর কারো সামনে দাঁড়াতে পারবোনা। আমি বারবার অপমানিত হতে পারবোনা। কথাগুলো বলে তিলোত্তমার চোখ জলে ভরে উঠে।
এটা বললে তো হবেনা মা। সারাজীবন কি তুই আঁই-বুড়ো হয়ে থাকবি? শ্যামল বাবু মিনতিমাখা মুখে বলেন।
দরকার হলে তাই থাকবো, তবু আমি আর কারো সামনে দাঁড়াতে পারব না। বলেই এক দৌড়ে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো তিলো।
সন্ধ্যায় তিলোত্তমাকে ডাকতে হয়না। শ্যামল বাবু নিজেই তৈরি হলেন বাইরে যাওয়ার জন্য। বাইরে বেরুনোর সময় ঠাকুর ঘরে উঁকি দিতে দেখলেন তিলোত্তমা সন্ধ্যা আরতি করছে। তিনি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন আর মনে মনে বললেন, ঠাকুর সন্ধ্যা প্রদীপের উজ্জ্বল শিখার মতো তুমি আমার মেয়ের জীবন প্রদীপও উজ্জ্বল আলোয় প্রজ্বলিত করে দাও।
তিলোত্তমার শোবার ঘরের খাটটা নতুন কেনা হয়েছে। ঘরের অন্য সব আসবাবের মধ্যে এই খাটটা আলাদাভাবে চোখে পড়ে। বিশেষ ধরণের নাইজেরিয়ান কাঠে তৈরি এই খাট বানাতে অনেক খরচ হয়েছে। খাটের চারপাশ বেশ সুন্দর কারুকার্যময়। মাথার সামনের দিকে ওভাল আকৃতির একটা বৃহত আয়না বসানো। আয়নার কাঁচ স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ। সেই স্বচ্ছ স্ফটিকে সাদা আলো প্রতিফলিত হয়ে পুরো ঘর আরো বেশী আলোকিত হয়ে উঠেছে। তিলোত্তমা উপুড় হয়ে নোটবুকে কিছু লিখছিলো। হঠাত খাটের আয়নায় চোখ পড়তে তিলোত্তমা সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। নোটবুক পাশে সরিয়ে সে সোজা হয়ে বসলো। ডিম্বাকৃতির আয়নায় সে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। তিলোত্তমার মনে হচ্ছে স্বচ্ছ স্ফটিক এ আয়নাটি তাকে যেন বিদ্রুপ করছে।
সাতাশ বছর বয়সী তিলোত্তমা উচ্চতায় পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। কৃ্ষ্ণবর্নের অধিকারিনী তিলোত্তমার স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালো। আঁখিদ্বয়ের মাঝে একটা নিরীহ ভাব রয়েছে। নাক আর যাই হোক বোঁচা বলা যাবেনা। সব চেয়ে আকর্ষনীয় হচ্ছে তিলোত্তমার অধর। কমলার কোয়ার মতো ফুলানো অধরদ্বয় যে কাউকে সহজে আকৃষ্ট করবে। চেহারার গড়ন যেমন-তেমন রংটা আরেকটু ফর্সা হলে কোনরকমে শ্যামলাবর্ণ বলে চালিয়ে দেয়া যেত।
তিলোত্তমা যার আভিধানিক অর্থ, তিল তিল করে সুন্দরী হয়ে ওঠে যে রমণী। এ কথা মনে হলে তিলোত্তমার ভীষণ লজ্জা ও রাগ লাগে। এ নাম তার ক্ষেত্রে যেন কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখার মতো। তার মা জয়ন্তি এ নাম রেখেছিলেন। তিলোর ভীষন রাগ হয় মায়ের ওপর। কি দরকার ছিলো এমন বিপরীত নাম রাখার!
ফাল্গুনের এই সময়টায় কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। ফাল্গুনি হাওয়ায় ফুলগুলো যখন নড়তে থাকে তখন মনে হয় গাছের মাথায় কে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তিলোত্তমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে চেয়ে মনে মনে ভাবে নামের মতো ফুলগুলোও কত সুন্দর। কৃষ্ণচূড়ার পানে চেয়ে তিলোত্তমা এক অন্য জগতে হারিয়ে যায়। শ্যামল বাবুর ডাকে তার ঘোর ভাঙ্গে। শ্যামল বাবু মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে মা এতো সকালে এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?
তিলোত্তমা পাশ ফিরে বললো, না বাবা হঠাত করেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তারপর মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো, কাল রাতে ফিরতে এত দেরী হলো কেন?
ওই তোর অনি পিসি না খাইয়ে ছাড়ল না। তাই ফিরতে দেরী হয়ে গেছে। হাতে রাখা চশমার গ্লাস পরিষ্কার করতে করতে শ্যামল বাবু বললেন।
তিলোত্তমা বললো, বাবা তুমি চা খাবে নাকি?
শ্যামল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। তিলোত্তমা চা আনতে ঘরে ঢুকলো।
কিছুক্ষন পর ট্রেতে করে দুই কাপ চা নিয়ে এসে বারান্দার একটি চেয়ারে বসল তিলোত্তমা। নিজে এক কাপ চা নিল, আরেক কাপ বাবার দিকে এগিয়ে দিল।
শ্যামল বাবু ভয়ে ভয়ে আছেন। কীভাবে তিলোত্তমার কাছে কথাটি তুলবেন! চায়ে এক চুমুক দিয়ে মুখ তুলে পরিতৃপ্তির সাথে শ্যামল বললেন, বা! চা তো বেশ ভালো হয়েছে। তিলোত্তমা মৃদু হাসলো।
চায়ের কাপে আরেক চুমুক দিয়ে ইতঃস্ততার সাথে শ্যামল বললেন, তিলো আগামী সোমবার ছেলেপক্ষ তোকে দেখতে আসবে।
নিমপাতার রস মুখে দিলে মুখটা যেমন তেতো আর বিস্বাদে ভরে যায়, তিলোত্তমার মুখ তেমনি হয়ে গেলো। সে পানসে কন্ঠে বললো, বাবা তোমাকে না বলেছি আমি আর কখনো কারো সামনে যাবোনা।
শ্যামল বাবু মিনতি করে বললেন, মা এসব বললে তো চলেনা। এ সংসারে আমি ছাড়া তোর আপন বলতে কেউ নেই। একবার চিন্তা কর আমি মরে গেলে তোর কি অবস্থা হবে? মারা যাওয়ার আগে আমি তোকে ভালো একটা ঘরে দেখে যেতে চাই। তোকে একটা ভালো ঘরে না দেখে যেতে পারলে মরে গিয়েও আমি শান্তি পাবোনা। তোর বিয়ে নিয়ে আমার এই ছুটোছুটিকে কোনভাবেই অনধিকার চর্চা বলে ভাববি না। তোর ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করা বাবা হিসেবে আমার অধিকার ও কর্তব্য। তবে তোকে কথা দিচ্ছি এই শেষ। এবার যদি কোন ব্যবস্থা না হয় তবে আমি আর কখনো বিয়ের কথা বলবোনা। তুই যেভাবে তোর জীবনকে গড়ে নিতে পারিস সেভাবে গড়ে নিবি। শ্যামল বাবু চশমা খুলে অশ্রুসিক্ত চোখ মুছেন।
অনধিকার চর্চা কথাটা তিলোত্তমার কানে কাঁটার মতো বিঁধলো। বাবার সহজ অথচ তীক্ষ্ণ কথাগুলো তার মর্মমূলে কুঠারের মতো আঘাত করলো। তার নিজের চোখও জলে ভিজে উঠলো। কিন্তু চোখের জল আড়াল করে সে বাবার পেছনে এসে দাঁড়ালো। তারপর বললো, বাবা এভাবে বলে তুমি আমাকে ছোট করে দিওনা। মা মারা যাওয়ার পর থেকে তোমাকেই মা বলে জেনে এসেছি। আমার সমস্ত আবদার মায়ের মমতায় তুমিই পূরণ করেছো। এতোটা পড়াশোনা করিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছো। আমি শুধু বলতে চাই এই যে এতো পড়াশোনা তার কি কোন মূল্য নেই! নারী জীবনে বিয়েটাই কি শেষ কথা?
শ্যামল বাবু কোন কথা বলেন না। একটু থেমে তিলোত্তমা আবার বলে, বাবা আমি কখনোই বলিনি বিয়ে করবোনা। কিন্তু বাবা, বিয়ে নামক বস্তুটার জন্য আমি আজ দোকানে সাজানো পণ্যে পরিণত হয়েছি। পাত্রপক্ষের সামনে বসে ইন্টারভ্যু দিতে দিতে আমি আমার ব্যক্তিসত্ত্বা বিসর্জন দিতে বসেছি। আমাকে সামনে রেখেই পাত্রপক্ষের লোকেরা যখন নিজেদের মধ্যে কানাকানি শুরু করে তখন মানসচক্ষে স্পষ্টভাবে আমি দেখতে পাই ওরা আমাকে বিদ্রুপ করছে। জানো বাবা তখন মনে হয় এ জীবনের কোন মূল্য নেই। তখন ইচ্ছে করে গলায় দড়ি দিতে।
শ্যামল বাবু এবার উঠে দাঁড়ান। পেছন ফিরে তিলোত্তমার মুখোমুখি হোন। তিনি কিছু বলার আগেই তিলোত্তমা বলে, তবে এবার আমি শেষবারের মতো পাত্রপক্ষের সামনে বসবো। এরপর আর যদি তুমি আমাকে বিয়ের কথা বলো তবে আমি সত্যি সত্যি গলায় দড়ি দিবো। কথাগুলো বলেই আঁচলের কোণে ভেজা চোখ মুছতে মুছতে তিলোত্তমা দৌড়ে পালিয়ে যায়।
শ্যামল বাবু দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকেন। ভেজা চোখের আড়ালেও তাকে যেন খানিকটা আনন্দিত দেখায়। তার মন বলছে এবার একটা হিল্লে হবেই।
অনেকক্ষণ ধরে টেলিফোনে রিং বেজেই যাচ্ছে। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরল তিলোত্তমা। ওপাশ থেকে অনি পিসির ঝাঁঝালো কন্ঠ ভেসে এলো, কিরে এতক্ষন কোথায় ছিলি? আমি সেই কখন থেকে ফোন করছি।
আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে তিলোত্তমা বলে, পিসি আমি রান্না ঘরে ছিলাম তাই শুনতে পাইনি।
তা শুনতে পাবি কীভাবে! তোর তো আর চিন্তা নেই। বুড়ো বাপ চিন্তায় মরচে, আর সাথে আমাকেও জ্বালিয়ে খাচ্ছে। অনি পিসি ঝাঁঝালো উত্তর দিলেন।
তিলোত্তমা চুপচাপ রিসিভার ধরে থাকে। ওপাশ থেকে অনি পিসি বলেন, শোন সোমবার আসতে এখনও দিন কয়েক বাকী। দেখ এর মধ্যে গায়ের রঙ এর একটু এদিক-সেদিক করতে পারিস কিনা! বাব্বা! তোর গায়ের যা রং! মেয়েদের চোখেই লাগবেনা, আর ছেলেদের চোখে যে কীভাবে লাগবে! তারপরও আমি সব ঠিক করে নেব।
এতো এতো অপমানমূলক কথা শোনে তিলোত্তমা কেঁদে ফেললো। বাবার প্রতি ওর ভীষন রাগ হলো। বাবার জন্যই আজ অনি পিসি এত কথা শোনাচ্ছে। সে রাগ ও লজ্জ্বায় ফোনের লাইন কেটে রিসিভার নামিয়ে রাখল।
তিলোত্তমার ইচ্ছে করছে সমস্ত পৃথিবীকে চিৎকার করে জানায় হে পৃথিবী, হে সমাজ তোমরা আমাকে আর কত অপমান করবে? এ সমাজে কি কোন মেয়ে বিয়ে না করে থাকতে পারেনা? স্বামীর সেবাদাসী না হয়ে যদি সমাজে না থাকাই যাবে তবে কেন এতো পড়াশোনা! তিলোত্তমার দু চোখ বেয়ে শ্রাবনের অবিরাম ধারার মতো অশ্রু ঝরছে। সেই সাথে ঝরছে আকুতি, ভগবান তুমি এতো নির্দয় কেন? আমার প্রতি তোমার যদি সামান্য পরিমাণও মায়া থাকে তবে এ সংসার থেকে চিরতরে আমাকে তুলে নাও।
২.
দিন যেন বড্ড তাড়াতাড়ি যায়। চোখের পলকে সোমবার চলে এলো। তিলোত্তমা শোবার ঘরের জানালার পর্দা একটু ফাঁক করতে দেখলো বসার ঘরে চারজন লোক বসে আছে। ঘরের অস্পষ্ট আলোতেও যুবক বয়সের ছেলেটিকে দেখে তিলোর চোখের পাতা যেন নড়ে না। সে অনুমান করল এ যুবকই সেই কেমিস্ট। একথা ভাবতেই সে ভীষন লজ্জ্বা পেলো। হঠাত করেই তার হার্টবিট বেড়ে গেছে। নার্ভগুলো যেন হঠাত করেই অবচেতন হয়ে পড়েছে। এ রকম সুদর্শন ছেলের সামনে সে কিভাবে দাঁড়াবে ভাবতেই তার লজ্জ্বা ও ভয় দুটোই লাগছে। নিজেকে তুচ্ছ ভাবতে ভাবতে এক গভীর বিব্রতবোধ ওর মনে বাসা বেঁধে ফেলেছে।
অনি পিসি গতকাল সন্ধ্যাতেই এসেছেন। তিনি একদিকে তিলোত্তমাকে বকছেন আর অন্যদিকে ঘরের সব কাজ নিজেই করছেন। তিলোত্তমাকে ঘরের কোন কাজই করতে দিচ্ছেননা। পেছন থেকে অনি পিসি ডেকে বললেন, কী রে তিলো এখনও তৈরি হোস নি! ওরা সবাই অপেক্ষা করে আছে। তাড়াতাড়ি তৈ্রি হয়ে নে।
কিছুক্ষন পর ফিরে এসে অনি পিসি যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। হালকা আকাশি রংয়ের শাড়িতে তিলোকে একেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছে। কপালে একটি ছোট টিপ আর কানে ছোট দুল পরিহিত তিলোকে সাধারন সাজে অসাধারন দেখাচ্ছে! গায়ের কালো রংও কোথায় যেন অনেকখানি লুকিয়ে গেছে! অনি পিসি চোখ কপালে তুলে বললেন, এ কী রে তিলো! তোকে যে চেনাই যাচ্ছেনা! আজ তোর একটা হিল্লে হবেই! তিলোত্তমার নাকের ডগায় ঘামের কণা চিকচিক করছে দেখে আবার বললেন, তোর নাকের ডগায় ঘাম জমেছে দেখছি। দেখিস তোর বর তোকে অনেক আদরে রাখবে, অনেক ভালোবাসবে।
তিলোত্তমা লজ্জ্বা পেয়ে বলে, কি যে বলো পিসি! তোমার মুখে কোন কিছুই আটকায় না। বলেই সে মুখ সরিয়ে নেয়। অনি পিসিকে ভীষন খুশি দেখায়।
তিলোত্তমাকে নিয়ে অনি পিসি বসার ঘরে প্রবেশ করলেন। একজন বৃদ্ধ লোক চেয়ার দেখিয়ে বললেন, মা এখানে বস। বসার সময় তিলোত্তমার সাথে যুবকটির চোখাচোখি হলো। তিলোত্তমা মৃদু হেসে চোখ সরিয়ে নিলো। তারপর মাথা নিচু করে বৃদ্ধ লোকটির পাশে বসলো।
অনি পিসি সেই বৃদ্ধ লোকটিকে বললেন, দাদা ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে করতে পারেন।
বৃদ্ধ লোকটি মাথার টাকে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, আমার বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। অপূর্ব তোমার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে করতে পার। আমার কিন্ত তিলোত্তমাকে পছন্দ হয়েছে। এখন তোমার সিদ্ধান্তই আসল। তোমার মতামত কি?
অপূর্ব লাজুক ভঙ্গিতে বলল, বাবা তোমার মতই আমার মত।
বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, এটা কোন কথা হলোনা। যেখানে তোমার জীবনের পথচলার প্রশ্ন সেখানে সিদ্ধান্তটাও তোমার নিজের হওয়া উচিত। তবে আমি এতোটুকু বলতে পারি শিক্ষা-দীক্ষায় তিলোত্তমা তোমার চেয়ে কোন অংশে কম হবেনা। তোমাকে আমি সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তুমি উপযুক্ত সিদ্ধান্তই নিবে। তোমার ওপর আমার সে আস্থা আছে।
অনি পিসি বললেন, ঠিক বলেছেন দাদা। বাবা সংসার যেহেতু তুমি করবে সেহেতু তোমার পছন্দ-অপছন্দের একটা ব্যাপার আছে। এক কাজ করো তোমরা দুজন আলাদা কথা বলো। তিলোত্তমার সাথে কথা বলে তুমি তোমার শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তটি জানাও। এ ঘরে আমরা সবাই একটা শুভ সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইলাম। ঘরে উপস্থিত সবাই এ প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন।
তিলোত্তমা এবং অপূর্ব মুখোমুখি বসে আছে। দুজনেই চুপচাপ। দুজনেই লজ্জা পাচ্ছে। কেউ কোন কথা বলছেনা। তিলোত্তমা নিচের দিকে মুখ করে বসে আছে। বেশ খানিকটা সময় পর অপূর্ব প্রথম আগ বাড়িয়ে বললো, আপনার নামটা বেশ সুন্দর। তিলোত্তমা শুধু মৃদু হাসলো, কিছু বললোনা।
অপূর্ব আবার বললো, এখানে আসার আগে আপনার সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছি, কিন্ত আপনাকে দেখার পর মনে হচ্ছে লোকমুখে শোনা সব কথাই বানানো। আমি সত্যি বলছি আপনাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। আমি আমার মতামত জানিয়ে দিলাম। এখন আপনার পালা।
এবার প্রথম তিলোত্তমা কথা বললো, আপনি মনে হয় কিছু একটা ভুল করছেন?
অপূর্ব অবাক হয়ে তিলোত্তমার দিকে তাকালো। ভুল! কি ভুল করেছি?
তিলোত্তমা মৃদু হেসে বললো, আপনি বোধহয় আমার গায়ের রং খেয়াল করেননি!
এবার অপূর্ব বেশ জোরে হেসে উঠলো। হাসির রেশ মুখে ঝুলিয়েই বললো, ও এই আমার ভুল! আমি ভাবলাম আরো কী না কী! তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বললো, আপনার গায়ের রং আমার কাছে মুখ্য নয়। আপনার মনের রংটাই আমার কাছে আসল। আমি একজন প্রকৃত নারীকে আমার জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পেতে চাই। তা সে কালো কিংবা ফর্সা হোক আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। তাছাড়া রং ফর্সা হলেই কি তাকে সুন্দরী বলে?
তিলোত্তমা এতোক্ষণ মাথা নিচু করেই কথা বলছিলো। এবার অপূর্বর করা প্রশ্নের উত্তর দিতে মুখ তুলে তাকাতে সরাসরি অপূর্বর চোখে চোখ পড়লো। সাথে সাথে ওর সমস্ত কন্ঠস্বর যেন বাকযন্ত্রে এসে আটকে গেলো। তার মনে হচ্ছে সে কোন স্বপ্নলোকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘি রঙ্গা মুখে হাসির আলোকচ্ছ্বটা ছড়িয়ে অপূর্ব তিলোত্তমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ক্লিনসেভ করা ভরাট সবুজাভ গাল থেকে যেন রংধনুর আলো ছিটকে পড়ছে। জোড়া ভ্রুর নিচে জ্বল-জ্বল করছে দুটি চোখ। সবকিছু ঠিক থাকলে এই সৌম্যদর্শন যুবকের সাথেই তার বিয়ে হবে! ভাবতেই তিলোত্তমা বিষ্মিত হচ্ছে। তার বিষ্ময়ের ঘোর কাটলো অপূর্বর ভরাট কন্ঠস্বরে। কি হলো! আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি।
তিলোত্তমা লজ্জ্বা পেয়ে বললো, কি যেন জিজ্ঞেস করেছিলেন?
অপূর্ব আরো বিষ্মিত হয়ে বললো, সে কি এরই মধ্যে ভুলে গেছেন!
তিলোত্তমা ইষৎ হাসি দিয়ে বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। বলছিলেন গায়ের রঙ আপনার কাছে মুখ্য নয়। তাহলে তো বলতে হয় আপনি এই প্রচলিত সমাজে বসবাসকারী কোন ব্যক্তি নন।
অপূর্ব অবাক অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলল, এমনটি মনে হলো কেন!
তিলোত্তমা সাথে সাথেই উত্তর দিলো, আপনি যদি প্রচলিত সমাজে বসবাসকারী কেউ হতেন তবে কনে দেখতে এসে কোনভাবেই শরীরের রঙ এর মোহ অস্বীকার করতে পারতেন না।
অপূর্ব জবাব দিলো, তাহলে আমাকে প্রচলিত সমাজের একজন নাইবা মনে করলেন। মনে করুন আমি অন্য কোন গ্রহ থেকে ছুটে এসেছি।
তিলোত্তমা একটু হেসে বলল, হুম আমি তাই ভাবছি।
তিলোত্তমা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু অপূর্ব থামিয়ে বললো, সমাজ বহির্ভূত জীব ভাবুন সমস্যা নেই কিন্তু দয়া করে অসামাজিক বিবেচনা করে দূরে ঠেলে দিবেন না প্লীজ।
অপূর্ব এমনভাবে কথাটি বলল যে দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো। দ্রুত হাসি থামিয়ে তিলোত্তমা জিভে কামড় দিয়ে বললো, ছি! ছি! এ কি বলছেন! আমি কি আপনাকে অসামাজিক বলেছি?
অপূর্ব জবাব দিলো, সরাসরি বলেননি কিন্তু অগোচরে নিশ্চয় বলছেন।
তিলোত্তমা বললো, আপনি মাইন্ড রিডার নাকি?
অপূর্ব তড়িত জবাব দিলো, যদি বলি হ্যাঁ।
তিলোত্তমা বলল, আপনি মাইন্ড রিডিং এর কিচ্ছুটি জানেননা। যদি জানতেন তবে বুঝতে পারতেন আমি মোটেও আপনাকে অসামাজিক ভাবছিনা।
অপূর্ব নিচুস্বরে বললো, যাক শুনে খুশী হলাম।
একটু গম্ভীর হয়ে তিলোত্তমা জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বলুন তো সমাজে বসবাস করেও মানুষ কতোটা সামাজিক হতে পেরেছে?
অপূর্ব বললো, প্রশ্নটা বেশ কঠিন।
তিলোত্তমা বলল, মোটেও কঠিন নয়। তবে আমরা কঠিন বলে এড়িয়ে যেতে চাই।
অপূর্ব বললো, এখন ওসব বাদ দিন। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। পাশের ঘরে সবাই অপেক্ষা করছেন। আপনি কি সিদ্ধান্ত নিলেন বলুন।
তিলোত্তমার শুষ্ককন্ঠে বললো, আমার ভীষণ ভয় করছে।
অপূর্ব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ভয় কিসের?
তিলোত্তমা উত্তর দিলো, সবকিছু আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। দিবালোকের উজ্জ্বল আলোতেও আমার কাছে সবকিছু ভ্রমের মতো মনে হচ্ছে। আমার মতো তুচ্ছ মেয়ে কোনভাবেই আপনার উপযুক্ত নয়। আশায় বুক বেঁধে যদি শেষ পর্যন্ত আশাহত হতে হয়?
অপূর্ব এতোক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো। তিলোত্তমার কথা থামতেই সে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো, আপনি নিজেকে এতো তুচ্ছ-তাচ্ছ্বিল্য কেন করছেন? আপনার মতো বোধজ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষিত রমনীর কাছ থেকে এমন কথা আশা করিনি। আগেই বলেছি সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাছে শরীরের রঙটাই সৌন্দর্য্যের মূল মাপকাঠি হলেও আমার কাছে তা নয়। আপনার ও দুচোখে আমি যে মায়াবী আবেশের প্রকাশ দেখেছি তা আমি অন্য কারো চোখে দেখিনি। আমি আপনার মনের সমস্ত রঙ আপনার চোখের মণিকোঠায় স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি।
তিলোত্তমা কোন উত্তর দিতে পারেনা। তার দু-চোখ জলে ভরে ওঠেছে। সে ধরা গলায় কিছু উত্তর দিতে চাইছিলো কিন্তু অপূর্ব থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনার আর কোন কথা আমি শুনছিনা। আমি সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি বিয়েটা হচ্ছেই।
তিলোত্তমার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। তার চোখে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে অপূর্বর অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানি। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছেনা অপূর্বর মতো ছেলে তার বর হবে। সবার সিদ্ধান্তমতে এই ফাল্গুনেরই বিশ তারিখ অপূর্ব-তিলোত্তমার বিয়ের দিন ধার্য্য করা হয়েছে। প্রকৃতির বসন্তের মতো আজ তিলোত্তমার মনের বাগানেও যেন বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। আর সেই বসন্তের একমাত্র অংশীদার অপূর্ব ও তিলোত্তমা!
তিলোত্তমার এখন অফুরন্ত অবসর। বিয়ের এখনও সপ্তাহখানেক বাকি। এরই মধ্যে অনি পিসি পুরো সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তিলোত্তমা কিছু করতে গেলেই বাধা দিয়ে বলেন, তোর কোন কাজ করতে হবেনা। তোর মা মারা যাওয়ার পর পুরো সংসারটা তো তুই দেখে রেখেছিস। এখন বিয়ের আগে কিছুদিন বাপের বাড়িতে আরাম আয়েশে কাটিয়ে যা। অনি পিসির স্নেহ আর্দ্র মাখানো কথাগুলো শুনে তিলোত্তমার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। পিসি বাইরে যতোই রাগ দেখাননা কেন আসলে ভেতরে ভেতরে অনেক ভাল। বিয়ের দিন যতোই এগিয়ে আসছে তিলোত্তমার উত্তেজনা ততোই বেড়ে যাচ্ছে। একটা চাপা ভাললাগা ও ভয় দুটোই কাজ করছে মনের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত অপূর্বের সাথে বিয়ে হবে তো! ঘরপোড়া গরু সিদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়।
আজ শ্যামল বাবুর বুক থেকে যেন এক টন ওজনের একটা পাথর নেমে গেছে। একটু আগেই তিলোত্তমা শশুর বাড়ী চলে গেছে। নিস্তব্ধ ঘরে দিকে চোখ পড়তেই শ্যামল বাবুর বুক ফেটে কান্না আসছিলো। কিন্ত সে কান্নার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে, পি্তৃদায় থেকে মুক্ত হওয়ার আনন্দ। শ্যামল বাবুর চোখ থেকে পড়া প্রতিটি অশ্রুকণাই যেন বলছে, তিলোত্তমা তুমি হয়তো রূপে তিলোত্তমা হয়ে উঠতে পারোনি, কিন্ত তুমি তোমার গুণে তোমার নতুন জীবনকে তিল তিল করে ঘরে তুলবে। প্রমান করবে রূপে নয় কর্ম ও গুনেও তিলোত্তমা হওয়া সম্ভব।
রিপন ঘোষ
মন্তব্য
গল্পটার কিছুই ভালো লাগে নাই, দুঃখিত।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
খুব ক্লিশে প্লট। ভাবছিলাম পড়তে পড়তে এবার বোধহয় কিছু একটা অন্য মোড় নেবে, কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত সেই ক্লিশেই থেকে গেল।
একটু অন্যরকম কিছু নিয়ে লিখতে চেষ্টা করুন, নিশ্চয়ই ভালো হবে।
ক্লিশে বললাম বলে মনে কষ্ট পাবেন না। লিখতে লিখতে লিখিয়ে।
ধন্যবার আপনার মন্তব্যের জন্য। গল্পটা আমার প্রথম দিকের লেখা। স্বাভাবিক ভাবেই অনেক ভূল-ত্রুটি আছে। আপনারা সাথে থাকলে আগামীতে ভালো লেখার চেষ্টা করবো।
লিখতে থাকুন।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
লেখাটি পড়লাম, কিছুটা বনফুলের তিলোত্তমা গল্পটির মতন । তবুও শুভকামনা, প্রথম দিকের লেখায় একটু আধটু এমন হবেই সবারই হয়ে থাকে । লিখতে থাকুন, আরো লেখা পাওয়ার প্রত্যাশায়
নতুন মন্তব্য করুন