পাস্তুর এবং জলাতঙ্কঃ একটি সাক্ষাৎকার

সজীব ওসমান এর ছবি
লিখেছেন সজীব ওসমান (তারিখ: সোম, ০৮/১০/২০১২ - ২:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সহলেখকঃ কোয়েল দাশ

আমাদের কথা

মহতি লুই পাস্তুরের জীবন ছিল বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বর্ণীল। ব্যবহারিক দিক দিয়ে একজন মাত্র মানুষের গবেষণার ফসল এত ব্যাপকভাবে মানবজাতির উপকারে এসেছে যে এদিক দিয়ে তাঁর সাথে কারো তুলনা করা প্রায় অসম্ভব। অণুর অসমতা পর্যবেক্ষণ, রেশমি পোকার রোগের কারণ নির্ণয় এবং এর প্রতিরোধ, বাছুরের এনথ্রাক্স রোগের নিরাময়, দুধের পঁচন রোধ, সাশ্রয়ী পানীয় উৎপাদন, মানুষের জলাতঙ্ক রোগের নিরাময় কত কিছুই না করেছেন। রবার্ট কক এর সঙ্গে একসাথে প্রস্তাব করেছেন জীবাণু তত্ব, যেখানে প্রথমবারের মত বলা হয়েছে প্রাণীর রোগের সঙ্গে জীবাণুর সম্পর্কের কথা। এখান থেকেই শুরু হয় জীববিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাখা, মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজি। তাঁর নামের সঙ্গেই অমর হয়ে আছে পাস্তুরাইজেশান প্রক্রিয়া, দুধের পঁচন ঠেকানোর এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত সবচেয়ে কার্যকরি উপায়গুলির একটি। তাঁর আবিস্কার ইউরোপ, বিশেষ করে ফ্রান্সের অর্থনীতিকে যেমন বেগবান করেছে তেমনি সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করেছে কিছু মরণঘাতি রোগ থেকে। গত ২৮শে সেপ্টেম্বর ছিল এই মহান বিজ্ঞানীর মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতেই এই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করা হয়েছে। লেখাটি অনুবাদ করা হয়েছে জন ইল্লো কর্তৃক ফরাসী থেকে ইংরেজীতে অনুদিত পাস্তুরের সাক্ষাৎকার থেকেঃ মেডিকেল হিস্ট্রি, ১৯৯৬; ভলিউম ৪০, পৃষ্ঠাঃ ৩৭৩-৩৭৭। লেখাটির সূচনাটিও ইল্লো লিখেছেন। তবে সূচনার কিছু অংশ অপ্রাসংগিক হবে বিধায় এখানে উল্লেখ করা হলোনা। ছবিগুলো মূল সাক্ষাৎকারে ছিলোনা। এখানে সংযোজন করা হয়েছে।

মূল লেখাঃ ক্লেমেন্ট বেরটাই-মের্রিওট
ইংরেজী অনুবাদঃ জন ইল্লো

সূচনা

সাক্ষাৎকারটি ১৮৮২ সনে নেয়া হয়েছে, পাস্তুর এর বয়স তখন ছিল ৬০ বছর। রসায়ন এবং ক্রিস্টালোগ্রাফিতে অবদানের পাশাপাশি তাঁর দীর্ঘ গবেষণা জীবনে পাস্তুর ওয়াইন এবং বিয়ারের পঁচনরোধ, রেশমিপোকার রোগ নিরাময়, ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে জীবনদানের মত অভুতপূর্ব আবিস্কার করেছেন যা ফ্রান্সের অর্থনীতিকে বেগবান করতে অতুলনীয় ভুমিকা পালন করেছিল। আকাদেমি ফ্রান্সেইস উপাধি অর্জন করেছেন ১৮৮২ সালের ২৭ এপ্রিল। নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন অসাধারন বৈজ্ঞানিক অর্জনের লক্ষ্যেঃ জলাতঙ্ক (rabies) রোগের প্রতিষেধক উদ্ভাবন। তিন বছরের মাথায় সফল হলেন। মানুষের ইতিহাসে প্রথমবারের মত জলাতঙ্ক-আক্রান্ত রোগী সেরে ওঠে ১৮৮৫ সনে। এই ইন্টারভিউটি যখন নেয়া হয় তখনও পাস্তুর দূর্বলীকৃত ভাইরাস দিয়ে কুকুরের জলাতঙ্ক রোগ সারাতে পারেননি।

১৮৮২ সনে ব্যাকটেরিয়া সম্বন্ধে পাস্তুরের ধারনা আমাদের সময়ের চেয়ে অসচ্ছ এবং অপরিপক্ক ছিল। এখনকার উচ্চমাধ্যমিক ছাত্ররা কোষের গঠন এবং কার্যপ্রণালী নিয়ে যা জানে তার চেয়েও কম জানতেন তিনি সে সময়ে। কিন্তু রোগ নিরাময় এবং প্রতিষেধক আবিস্কারে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি এই সীমাবদ্ধতা। আসলে এখনও, মানবশরীর এবং তার কার্যবিধি নিয়ে আমরা সবটুকু জানিনা, কিন্তু তবুও চিকিৎসা ঠিকই করতে পারি।

এই অনুবাদে 'ভাইরাস' শব্দটি দিয়ে যা বোঝানো হচ্ছে ইন্টারভিউটিতেও ঠিক একই জিনিস বোঝানো হয়েছে, যদিও ভাইরাসের ধারনা নিয়ে লুই পাস্তুরের সাথে আমাদের বর্তমান ধারনার মিল নেই। এখানে ভাইরাস শব্দটির যায়গায় 'বিষ' বা 'বিষাক্ত উপাদান' বলা যেত, যেরকম পাস্তুর মনে করতেন। কিন্তু আমার মনে হল পাস্তুর যেই শব্দটি যেই অর্থে ব্যবহার করেছিলেন তা একইরকম রেখে দেয়া শ্রেয়।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ফরাসি সাংবাদিক ক্লেমেন্ট বেরটাই-মের্রিওট, যিনি ডি'এলবার্টি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। ১৮৪৮ সনে জন্ম নিয়েছিলেন, সম্ভবত এসেক্স এ। মার্কিন এবং বিলেতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করার পাশাপাশি তিনি ফ্রান্সের একজন প্রধান সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিজ্ঞান নিয়ে জানাশোনার দিক দিয়ে ডি'এলবার্টি যদিও একজন এরিস্টোটল ছিলেন না, কিন্তু তাঁকে মূর্খও বলা যাবেনা। তবে, এই সাক্ষাৎকারে তাঁকে গবেষণার অসাধারনত্ব এর চেয়ে পাস্তুরের খ্যাতি এবং তাঁর ল্যাবের বৈচিত্র নিয়ে বেশি প্রভাবিত হতে দেখা যায়। অথবা হয়তো পাঠকদের কথা চিন্তা করেই এভাবে লিখেছেন ডি'এলবার্টি। তিনি আসলে থিয়েটার কলাকুশুলিদের সাক্ষাৎকার নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন, মানে যারা খ্যাতি এবং বাহ্যিক অর্জনটাকেই বেশি গুরুত্ব দেন। এই লেখাটি এরকমই কিছু সাক্ষাৎকারের একটি বড় সংগ্রহের সঙ্গে প্রকাশিত যার নাম ছিল Pasteur, Parisiens et parisiennes: mes entretiens। এই বইটিতে আরো একটি ইন্টারভিউ আছে জেমস গর্ডন বেন্নেট এর, যিনি জলাতঙ্ক-আক্রান্ত কুকুর কামড়ে দেয়া ছেলেটিকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন পাস্তুর ইনস্টিটিউটে। পরবর্তি অংশটি ডি'এলবার্টি যেভাবে শুনেছেন এবং লিখেছেন সেভাবেই উপস্থাপন করা হল।

ছবি: পাস্তুর (বামে), প্রথম জলাতঙ্ক থেকে সেরে ওঠা বালকটি (মাঝখানে) আর জেমস গর্ডন বেন্নেট (ডানে)

সাক্ষাৎকার

প্রতিবছর ঠিক এই সময়টাতে সমগ্র প্যারিসবাসী এক ভীতিকির অবস্থার মধ্য দিয়ে বাস করে। সূর্যের উত্তাপ ক্রমশ অসহনীয় হয়ে ওঠে। এখন জলাতংক আক্রমণের মৌসুম! ফলে, আপাতভাবে নিরীহ হলেও প্রত্যেকটি কুকুরকেই নির্বিচারে সন্দেহের চোখে দেখা হয়।

তাই আমার মনে হল আমাদের সময়ের একজন প্রধান বিজ্ঞানী পাস্তুরের সঙ্গে জলাতঙ্ক নিয়ে কথা বলা এবং এবিষয়ে তাঁর চলমান গবেষণার ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন করাটা পাঠকদের জন্য কৌতুহলকর হবে। সেই লক্ষ্যে, আমি জনাব পাস্তুরের ৪৫, রু ডি-উল্ম গবেষণাগারে গিয়ে হাজির হলাম। আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন গবেষণাগারের পরিচালক জনাব চেম্বারল্যান্ড। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে পাস্তুরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

প্রাজ্ঞ পাস্তুর মশাই বসেছিলেন হাজারো যন্ত্রপাতি আর খাঁচায় বাঁধা ছোট ছোট প্রাণীর সামনে। তাঁর বাদামী, কিছুটা ঘোলাটে, চোখ চেহারায় একধরনের অদ্ভুত আবহ তৈরি করেছে। ছোট-বাদামী টুপির নিচে দীর্ঘ লম্বা কপাল ক্ষীণ মুখটায় আলো ছড়াচ্ছে। পরিমিতভাবে ছাটা গোঁফ আর ছোট ছোট দাড়ি তাঁর মাঝে একটা ভারিক্কি ভাব এনে দিয়েছে। কিন্তু যখন এই প্রাজ্ঞ কথা বলা শুরু করেন তখন তাঁর সহজ এবং সরাসরি কথার ঢঙে দর্শক এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে চেহারার দিকে মনোনিবেশ করার কথা আর মনেই থাকেনা। তবে আরেকটি বৈশিষ্টে্যর কথা এখানে না বলে পারছিনা- পাস্তুরের মুখের সাথে হেনরি রচেফোর্ট আর ভিক্টর হুগোর বেশ সাদৃশ্য পাওয়া যায়। রাজনীতি এবং রোমান্টিকতার এক চমৎকার সংমিশ্রণ।

লুই পাস্তুর তাঁর কথা শুরু করলেন এভাবে–
‘অবেনাস (Aubenas) থেকে আমি মাত্র ফিরেছি, এবং আপনাকে দেখে আমি যারপরনাই খুশি কারণ (আপনার মাধ্যমে) আমি আমার প্রিয় অবেনাসবাসীকে আবার জানাতে পারব যে তাদের অভ্যর্থনায় আমি কি ভীষণ গর্বিত, আনন্দিত। আকাদেমি ফ্রান্সেইস উপাধি অর্জনের পর আমি এখন খুবই উৎফুল্ল, তবু আমার চিরকাল মনে থাকবে তাদের আন্তরিক, উষ্ণ, অত্যুৎসাহী ব্যবহার, যারা আমার সাফল্যের প্রতিক্ষণে, প্রতিস্তরে ছয়টি বছর আমার কাজের সঙ্গী হয়েছেন, আমার সাথে থেকেছেন। রাত–দিন জেগে আমি তাদের কাজে (রেশমি পোকা চাষে জীবাণুর উপদ্রব নিরশনে) সাহায্যের উপায় খুজেঁছি। এতে আমার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পরেছে, হেমিপ্লেজিয়া-তে (Hemiplegia, একধরনের প্যারালাইসিস রোগ) আমার শরীর অবশ হয়ে পরেছে, কিন্তু আমি সফল হয়েছি, আমাদের সুপ্রসিদ্ধ রেশম-শিল্পকে মরতে দেইনি, এ-যে আমাদের দেশের গর্ব, আমাদের অর্থনীতির হাতিয়ার।’

‘১৫ বছর আগে যখন রেশমি পোকা নিঃসরিত লালা নিয়ে গবেষণা করছিলাম, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমি পোকাগুলির সুস্থ ডিমগুলোকে অসুস্থ ডিম থেকে আলাদা করতে পারব। তখন অনেকে উপহাস করে বলেছিল – এই মূর্খ চাষিগুলোর হাতে অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে শিল্পরক্ষা হবে? দিবাস্বপ্ন বটে! কিন্তু সময়ে অভিজ্ঞতার প্রমাণ মিলেছে। রেশমি পোকার চাষের প্রতিটি ক্ষেতেই এখন অনুবীক্ষণ যন্ত্র একটি অপরিহার্য সঙ্গী। আর এই কাজের দক্ষতায় বিশেষত মহিলারাই পারদর্শী।’

পাস্তুর বলে চললেন, ‘আর সেজন্যে এখানে একটি কথা বলতে চাই- অতি-ক্ষুদ্র জিনিসের গুরুত্ব মাঝেমাঝে অতি-বৃহৎ হতে পারে! অতি ক্ষুদ্রাকায় জীব যেমন সংক্রামক রোগ সৃষ্টি করতে পারে বা বস্তুর পঁচন ঘটাতে পারে, তেমনি এরা মৃত জিনিস পঁচিয়ে আবার পরিবেশে ফিরিয়ে দিতে পারে। এই তত্বের উপর ভিত্তি করে আমি ওয়াইন আর বিয়ারের পঁচন রোধ করতে সক্ষম হয়েছি, বের করতে পেরেছি ভিনেগার প্রস্তুতির সঠিক উপা। ফলস্বরূপ আমি বুঝতে সক্ষম হয়েছি জৈব–বস্তুর সংরক্ষণ ও তার বানিজ্যিকীকরণে এসব ক্ষুদ্র জীবকে জানা কতটা জরুরী। এর আগে এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব, যেমন ব্যাকটেরিয়া, নিয়ে কেউ আগ্রহ দেখায় নি। ভাবা হত স্পন্টেনিয়াস জেনারেশান (spontaneous generation, প্রাণের উৎপত্তির একটি তত্ব) এর মাধ্যমে এদের জন্ম হয়। এদের সম্বন্ধে জেনে এখন, পুরোপুরি না হলেও বুঝতে পারি, জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধিই অধিকাংশ রোগের সৃষ্টি করে, বিশেষত খামার, আস্তাবল, পোলট্রি এসবের ক্ষতিসাধনের মূলকারণ হল জীবণু। কিন্তু আশার কথা এই যে, কি করে কালচার উৎপাদনের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত করা যায় তার উপায় আমি খুঁজে পেয়েছি। ভাইরাসের কোন কালচারকে দূর্বলীকরণ প্রক্রিয়ায় ক্রমশ দুর্বল করে প্রতিষেধক তৈরি করা সম্ভব। যদি কোন পোষক দেহে ওই দূর্বলীকৃত ভাইরাস রোগ বিস্তারের আগেই প্রবেশ করানো যায়, তবে সেই পোষক দেহে ঐ ভাইরাস সৃষ্ট রোগ হবার সম্ভাবনা কমে যায়, আর এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে আমি এনথ্রাক্স (anthrax) রোগের ভ্যাক্সিন (টীকা) আবিষ্কার করেছি। আশা আছে-অদূর ভবিষ্যতে প্লেগ, ইয়েলো ফিভার, জলাতঙ্কসহ ভাইরাস বাহিত এই রকম আরও অনেক দুরারোগ্য রোগের ভেক্সিন আমরা তৈরি করতে পারব।’

এরপর হঠাৎ করেই পাস্তুর মশাই আমাকে বললেন, ‘ও-হ্যাঁ! কথায় কথায় ভুলেই গিয়েছিলাম, চেম্বারল্যান্ড আমাকে অবহিত করেছে আপনার জলাতঙ্ক সংক্রান্ত গবেষণা দেখার অভিলাষের কথা। চলুন দেখবেন আমার পরীক্ষাগার। এতে আমার কাজের ধারাটি আপনার কাছে বোধ করি পরিস্কার হবে।’

আমি পাস্তুরের সাথে প্রবেশ করলাম একটি বৃহদাকার কক্ষে। বড় বড় জানালার কারণে ঘরটি আলো বাতাসে পরিপূর্ণ। দেয়াল ঘেঁষে সারি সারি লোহার শক্ত খাঁচা। আর প্রতিটি খাঁচার ভিতরে নানান জাতের কুকুর। বুলডগ, পুডল, টেরিয়ার্স , গ্রিফন্স – কি নেই সেখানে ! খাঁচার উপরে লেবেল দিয়ে সাঁটানো আছে দিন-তারিখ অর্থাৎ কবে তাদের শরীরে ভাইরাসের জীবাণু প্রবেশ করানো হয়েছে তার সময়।

ছবি: পাস্তুরের গবেষণাগারের ভেতরটা

পাস্তুর বলতে আরম্ভ করলেন, ‘জলাতঙ্ক নিয়ে এখন পর্যন্ত আমার গবেষণা হয়তো খুব বেশি এগোয়নি, কিন্তু প্রথম ধাপটা অন্তত নেয়া হয়েছে। আগে মানুষের ধারণা ছিল কেবলমাত্র কুকুরের লালার কারণেই জলাতংক সংক্রামিত হয়। কিন্তু এমনও অনেক ঘটনা হয়েছে যে রোগগ্রস্থ কুকুর কামড়েছে কোন মানুষকে কিন্তু দেখা গেল সেই ব্যাক্তির কিছুই হলনা, দিব্যি বেঁচে-বর্তে আছে রোগের কোন লক্ষণ ছাড়াই। কৌতুহলকর বিষয় হল, জলাতঙ্ক ভাইরাস আমি পেয়েছি কুকুরের মগজে, স্নায়ুরজ্জুতে; আসলে পুরো স্নায়ুতন্ত্রেই ভাইরাসটির বিস্তার দেখা যায়। যদি এই ভাইরাস কোনরূপ অন্য ভাইরাসের সংস্পর্শ এড়িয়ে একটি সুস্থ কুকুরের মগজে খুব অল্প পরিমানেও প্রবেশ করান হয়, তবে কুকুরটির জলাতঙ্ক হবেই এবং ১৫ দিনের মধ্যেই মৃত্যু অবধারিত।’

পাস্তুর এবার আমাকে কয়েকটি কুকুর দেখিয়ে বলে চললেন, ‘আসুন আপনাকে কয়েকটি নমুনা দেখাই, এই যে কুকুরটি দেখছেন – ১০ দিন হল এর শরীরে ভাইরাস দেয়া হয়েছে। এবার আপনার পা-টি ওর খাঁচার কাছে আনুন। ওই দেখুন, আপনার জুতো টি চাটছে। আর ২-৩ দিন পরে ও মারা যাবে, ও এখন আবেগহীন অবস্থায় আছে যা দুদিন পর রূপ নেবে ক্রঢ়তায়। তখন আর চাটবেনা, সবকিছুই কামড়াতে শুরু করবে। এখানে আরেকটি কুকুরের নমুনা আপনাকে দেখাই – দেখুন আপনি কাছে আসায় ও কেমন লম্ফঝম্প আরম্ভ করেছে। তার ক্রোধান্বিত গর্জন শুনতে পাচ্ছেন ? ও এখন সম্মোহিত প্রায়, কাউকেই দেখতে পারছেনা, চিনতে পারছেনা। প্রায় ১৪ দিন হয়ে গেল, কালকেই কুকুরটির মৃত্যু হবে।’
‘মানুষের ক্ষেত্রেও জলাতঙ্কের একই রকমের লক্ষণ দেখা যায় তবে এক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা যায় প্রায় ৩০-৪০ দিন পরে। আর সেই সাথে জল–আতঙ্ক বা পানিকে ভয় পাওয়ার লক্ষণ দেখা দেবে, যা কুকুরের মধ্যে বিরল।’

‘আগেই বলেছি জলাতঙ্ক আক্রান্ত কুকুরের কামড় খেয়েও অনেক মানুষ বেঁচে আছে। এরকম ঘটনা কম নয়। এই প্রসঙ্গে আমার ব্যাখ্যা হচ্ছে, কুকুরের লালা নিঃসৃত ভাইরাসটি যখন বাতাসের সংস্পর্শে আসে তখন বাতাসে থাকা অন্যান্য জীবাণুর সাথে তাদের এক ধরনের প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। ফলতঃ জলাতঙ্ক ভাইরাসটি দূর্বল হয়ে পরে। কিন্তু কোনভাবে যদি ওই ভাইরাস অন্য অনুজীবের সংস্পর্শ এড়িয়ে কোনো প্রাণীদেহে প্রবেশ করে তবে মৃত্যু নিশ্চিত। এখন পর্যন্ত শোচনীয় এই মরণব্যাধির কোন নিরাময় পাওয়া যায় নি।’

‘আমি আশাবাদী, আর যদি আমার শরীর সহায় হয় তবে আমার তথ্য, গবেষণা দিয়ে জলাতঙ্কেরর প্রতিষেধক আমি আবিষ্কার করবই।’

‘কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁঝাবার আগে আমাকে অবশ্যই এই ভাইরাসটির জৈবিক গঠন সম্বন্ধে নির্ভুল ধারণা পেতে হবে। এসব অদৃশ্য জিনিসগুলো একটার চেয়ে আরেকটা এতটাই ভিন্ন যে একে তুলনা করা যায় মানুষের সাথে ঘোড়া বা ঘোড়ার সাথে হাতির পার্থক্যের সঙ্গে। এদের প্রকৃতি খুবই ভিন্ন, আর তাই একটা জীবাণু দিয়ে আরেকটা জীবাণু বর্ণনা করা বা বোঝা খুব সহজ কাজ নয়। যে জিনিসটা দিয়ে একটা জীবাণু ধ্বংস করা যায় সেটা দিয়েই হয়তো আরকটা জীবাণু শক্তি সঞ্চয় করে। দূর্বলীকরণের ফলে ভাইরাসের রোগ উৎপাদনের ক্ষমতা কমে যায় কিন্তু তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ থাকে। এনথ্রাক্স এর ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আমি একই পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। পদ্ধতিটি হচ্ছে অনেকটা এইরকম – প্রথমে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এ রেখে ভাইরাসটিকে দুর্বল করে দেয়া হয়। এরপর অল্পমাত্রায় এই দূর্বল ভাইরাসটিকে পোষক দেহে রোগপ্রকাশের আগেই প্রবেশ করান হয়। যার ফলে এই জীবাণুর বিরুদ্ধে পোষক দেহে কোন রকম রোগপ্রকাশের লক্ষণ ছাড়াই এন্টিবডি তৈরি হয় আর পোষক বা প্রাণীটিকে ওই মরণব্যাধির হাত থেকে চিরকালের জন্য রক্ষা করে।’

‘আমার পদ্ধতিটি অনুসরণ করে ডক্টর জেনারও চেষ্টা করছেন স্মলপক্স এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের। এইক্ষেত্রে তিনি ভাইরাসটি নমুনাটি সংগ্রহ করেছেন বাছুর থেকে। গরুর রোগ সৃষ্টিকারী স্মলপক্সের বীজাণু থেকে চেষ্টা চলছে মানুষের স্মলপক্স সারানোর। চারিদিকে এই বিষয়ে তর্ক-বিতর্কও কম চলছেনা। এই সেইদিন আকাদেমির এক আলোচনার মধ্যভাগে ডক্টর জুলস গুয়েরিন আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বললেন যে ‘যখন সকল গো–সম্প্রদায় এই স্মলপক্স থেকে সেরে উঠবে, তখন মানুষের রোগ সারাবে কোন জীবাণু (কারণ গুয়েরিনের ধারনা ছিল স্মলপক্সের জীবাণু শুধু বাছুরেই জন্মানো যায় এবং রোগাক্রান্ত বাছুর না পাওয়া গেলে মানুষের জন্য আর ভ্যাক্সিন তৈরি করা যাবেনা, কারন তখন আর জীবাণুও পাওয়া যাবেনা)? প্রকৃত বিষয়টি আসলে এখনো অনেকে বুঝতে পারছেন না।’

ল্যাবের অন্যদিক দেখিয়ে পাস্তুর মশাই বললেন, 'সে যাইহোক, এইদিকে দেখুন – এখানে রয়েছে মোরগ, মুরগী, গিনিপিগ, খরগোশ, ইঁদুর আর বানর। এদের প্রত্যেকের শরীরে দেয়া হয়েছে এমন কোনো না কোনো রোগের বীজ যা মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে । এই কাজের লক্ষ্য হল রোগের বিভিন্ন স্তর, এদের ক্রমবিস্তার এবং প্রতিষেধক আবিষ্কার, নিদেনপক্ষে প্রতিষেধকের কাছাকাছি কোন বস্তু খুঁজে বের করা।’

ছবি: খরগোশ হাতে পাস্তুর

‘ছোট রুমটিতে যাই চলুন। এইযে এখানে দেখছেন হাজার হাজার কাঁচের শিশি, এরা এমন সব মহামারী রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস দিয়ে ভর্তি যা এক নিমিষে পুরো প্যারিস শহরের সবাইকে মেরে ফেলতে পারে! অথবা পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম মহামারী সৃষ্টি করতে পারে। আমাকে সেজন্য খুব যত্ন নিয়ে এদের দেখাশোনা করতে হয় আর একটি চুল্লী দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে রাখতে হয় যেন জীবাণুগুলি নিরাপদ থাকে।’

রুমটিতে যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ একটি রুমাল দিয়ে নাক চাপা দিয়ে রাখতে হয়েছে, কেমন অদ্ভুত তীব্র গন্ধ! জনাব লুই পাস্তুরের সাথে আমার আলোচনা মোটামুটি এখানেই সমাপ্তি ঘটে। মনে হলো এক মৃত্যু পুরী থেকে কোন রকমে প্রাণ নিয়ে বের হয়ে আসতে পেরেছি। আশংকা হচ্ছে আমার সাথে খাঁচা ছেড়ে কিছু জীবাণুও সঙ্গী হয়েছে! একটু আগে যা দেখলাম, পুরো মানব জাতিকে এক নিমিষে উড়িয়ে দিতে এর চাইতে ভয়ংকর কি আর কিছু হতে পারে? কোনক্রমে দরজা পেরিয়ে পরীক্ষাগারের সামনে থাকা ফুলের বাগানের দিকে এগুতে লাগলাম।

ফিরতি পথে দেখতে পেলাম ল্যাবের কর্মীদের অদ্ভুত যত কাণ্ড, শুনতে পেলাম দুটি কুকুরের আর্তনাদ যাদের মধ্যে জলাতঙ্কের জীবাণু সংক্রামিত করা হচ্ছে। কলেরায় আক্রান্ত একটি মোরগের প্যাঁচার মত করে কান্না, ভেড়ার হাহাকার। আর রঙ্গমঞ্চের প্রধান, বানর মহাশয় খাঁচার গায়ে হেলান দিয়ে সমস্ত কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছেন। বানরটিকে গতকাল মাত্র ইয়েলো ফিভারের বিষ সংক্রামিত করা হয়েছে- রোগের লক্ষণ এখনো তাই প্রকাশ পায় নি। এহেন পরিবেশে অতি বড় বীরও বোধ করি টলায়মান না হয়ে পারবেনা। হয়ত প্রানীকুল আমাকে এভাবেই অভিবাদন জানাচ্ছিল, যদি হায় এদের ভাষা আমার বোধগম্য হত! সত্যি অপূর্ব এক সাক্ষাৎকার বটে আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের সাথে, যা কোনদিনই ভুলবার নয়।


মন্তব্য

লাবণ্যপ্রভা  এর ছবি

চলুক

সজীব ওসমান এর ছবি

হাসি

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

চমৎকার। লেখা চালু থাকুক।

রোগের জীবাণু তত্ত্ব পাস্তুর প্রস্তাব করেন। কখ প্রমাণ করেন। কখের স্বীকার্যই সেই প্রমাণ। পাস্তুরের আইডিয়া থেকে সেই সময়ে জীববিজ্ঞানের মারাত্মক সব আবিষ্কার হয়েছে। লিস্টারের জীবাণুমুক্ত শল্যচিকিৎসার অভ্যাসও পাস্তুরের আইডিয়া থেকে আসা। কত কোটি মানুষ যে পাস্তুর বাঁচিয়েছেন তার কোন ইয়াত্তা নেই।

প্রসঙ্গত, Robert Koch = রবার্ট কখ। র-এর উচ্চারণ মৃদু 'গ'-এর মত। গলার ভেতর দিয়ে র উচ্চারণ করলে যেমন হবে তেমন। তবে এতো জটলতায় না গিয়ে কেবল রবার্ট কখ বললেই হবে। জার্মান উচ্চারণ শেখার আগে আমিও কক বলতাম হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অতিথি লেখক এর ছবি

ফ্রেঞ্চ নামের উচ্চারনগুলিও এখানে নির্ভুল নয়। ফ্রেঞ্চ জানিনা বলেই। নামটার আসল উচ্চারন জানানোর জন্য ধন্যবাদ। বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে একটা সিরিজ করার ইচ্ছা আছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সারা দুনিয়া নানা জাত-বেজাতের মেসাইয়া নিয়ে মত্ত থেকেছে, থাকছে এবং থাকবে। কিন্তু আসল মেসাইয়াদের নিয়া তেমন কোন রা নেই। পাস্তুর নিঃসন্দেহে মানব-ইতিহাসের আসল মেসাইয়াদের একজন। এপর্যন্ত সবচে বড় ত্রাতা বললে মনে হয় না কোন ভুল হবে।

কতকিছুই না করে, ভেবে গিয়েছেন আমাদের জন্য! তাঁর কীর্তি জানলে শরীর তাঁর সোয়ান-নেকড ফ্লাস্ক পরীক্ষার ফ্লাস্কের বাঁকানো গলার মত বেঁকে গিয়ে মাথা মাটিতে ঠেকতে চায়!

রব

সজীব ওসমান এর ছবি

একদম ঠিক।

পরমাণুঅণুজীব এর ছবি

প্রাঞ্জল ভাষার এই সাক্ষাৎকার পরে ফেললাম একটানে ! ফেঞ্চ থেকে ইংলিশ হয়ে বাংলা ! বেশ ঘুরেই এসেছে লিখাটা ! এমন আরও কিছু আশা করছি তাড়াতাড়ি !

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। বেশ খটোমটো ইংরেজী ছিল। হয়তো ১৩০ বছর আগের ফ্রেঞ্চকে ইংরজীতে অনুবাদ করতে গিয়েই ইংরেজীটা খটোমটো হয়েছে।

পরমাণুঅণুজীব এর ছবি

পড়ে, ফ্রেঞ্চ = ২ বাক্যে ২-২টা বানান ভুল করলাম !!!! গুল্লি মারা উচিত !!

ক্লোন৯৯ এর ছবি

চলুক চমৎকার!!
চলুক

আমরা মনে হয় বলতাম রবার্ট কচ @অস

অতিথি লেখক এর ছবি

১৮৮২ সাল থেকে কখ এবং পাস্তুরের মধ্যে মনমালিন্য চলেছিল কিছুদিন, যা প্রায় ঝগড়ার পর্যায়ে পৌঁছায়! http://en.wikipedia.org/wiki/Koch%E2%80%93Pasteur_rivalry

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

ভাল লেগেছে চলুক কিন্তু "পরে" আর "পড়ে" এর বিভ্রাট চোখে একটু বেশি লেগেছে। পরেরবার ঠিক হয়ে যাবে আশা করি হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

তিনটা ক্ষেত্রে 'পরে' এর জায়গায় 'পড়ে' হবে। আরও কিছু ছোটখাটো ভুল অবশ্য আছে। ধন্যবাদ ধরে দেয়ার জন্য।

সজল এর ছবি

ভালো লাগল। সচলায়তনে স্বাগতম।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

সজীব ওসমান এর ছবি

হাসি

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
সজীব ওসমান এর ছবি

হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।