যাক সেসব কথা, আমরা অতি অল্প দিন হইল মাধ্যমিকের বেড়া ঘষটাইয়া ঘষটাইয়া টপকাইতে পারিয়াছি,মনে তাই বেজায় ফুর্তি। বিটু আবার ইদানিং কালে রাজনীতির সহিত যুক্ত হইয়াছে, ছাত্রাবস্থা নাকি রাজনীতির প্রকৃষ্ট সময়, উহাতে নাকি বয়স বৃদ্ধির সহিত অধিক লাভবান হউয়া যায়। যদিও আমার এই হৃষ্টপুষ্ট মাথায় ইহা প্রথমে বোধগম্য হইতেছিল না যে উহার রাজনিতিতে যুক্ত হইবার কার্যকারণ কি হইতে পারে। তবে বিটু আমাদিগকে আশ্বস্ত করিয়াছে, একবার রাজনীতিতে সে পাকাপোক্ত হইতে পারিলে ভবিষ্যতে শুধু উচ্চ মাধ্যমিকই নয়, সকল মাধ্যমিকের বেড়াই আমরা লাফাইয়া লাফাইয়া পার হইতে পারিব। ইহাই বড় ভরসার কথা, তাই আমি আর রতন প্রারম্ভিক কালে কিছুটা গাঁইগুই করিলেও পরবর্তীতে বিটুর রাজনীতিতে আমাদের সমর্থন জ্ঞাপন করিয়াছি।
আজিকে আমাদের উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম কেলাস। বিটু বলিয়াছে কেলাস না করিলেও চলিবে, তথাপি প্রথম দিন বিধায় আমরা বেশ উৎসাহের সহিত চলিলাম মক্তব মুখে। আজিকে আবার পটলার মানে পটল স্যারের সহিত সাক্ষাৎ হইবে,উনি শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন যে আমরা কিছুতেই মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হইতে পারিবনা। কিন্তু উনি জানিতেন না এই যবনদেশে থুক্কু বাংলাদেশে একটু ক্ষমতা থাকিলে সবই সম্ভব। আমরা তিন জন এতো চতুরতার সহিত নকল করিয়াছি, কাহারও পক্ষে ধরা সম্ভব হয় নাই।
পটল স্যার গণিতের শিক্ষক, আমার আবার গণিতে বিশেষ ভীতি রহিয়াছে, তবে নিজেকে আগে থেকেই প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছি। ইউটিউব নামক এক খানা বস্তুর সন্ধান পাইয়াছি, উহাতে বেশ রস যুক্ত জিনিষ পাওয়া যায়। উহাতে ঘুরিতে ঘুরিতেই একদা চমক সাহেবের ‘গণিতের রঙ্গে’ পাহিয়াছিলাম, বেশ রসময় জিনিষ হইবে মনে করিয়া ঢুকিয়া দেখি ইহা নির্ভেজাল গণিত, তবে চমক সাহেবের নিজের সারাক্ষণ চমকিত হইবার কারনেই কিনা জানা নাই, বেশ ভালো লাগিয়াছে। আরেক খানা ভিডিও পাইয়াছি, ক্যালকুলাসের অ, আ... ইহাও ভালো লাগিয়াছে যদিও নামখানা আমার পছন্দ হয়নাই । নামখানা ক্যালকুলাসের আলিফ, বে, তে হইলে অধিক যুক্তিযুক্ত হইত বলিয়া আমার মনে হইয়াছে, অথবা ক্যালকুলাসের এ, বি, সি ও হইতে পারিত। আমি এই ভিডিওর সবই বুঝিয়াছি, শুধু ক্যালকুলাসটা ঠিক কি বস্তু তাহা বুঝিতে সক্ষম হইনাই, পটল স্যার এর নিকট জানিতে চাহিতে হইবে।
মক্তবে পৌঁছামাত্র পটল স্যারের গোল চোখখানা আমাদের দেখিয়া আরও গোল হইয়া গেল, “তোরা পাশ করিয়াছিস তবে ?!”
“বেশ বেশ... তা মন দিয়া কেলাস করবি।”
প্রারম্ভিকে গণিতের ক্লাস।
“যদিও আমার বিশ্বাস তোরা তিনটেই মর্কট, তথাপি আমি জানিতে চাহি, ঠিক কোন প্রজাতির গর্দভ তোরা। বলবিদ্যা হইল দ্বিতীয় বর্ষের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত, তথাপি বল দেখি বাপুসকল, বলবিদ্যা কি হতে পারে, তোদের কি মনে হইতেছে এই বিষয়ে?”
আমি বরাবরই ভীত মানুষ, স্যারের নজর আমার দিকে বুঝিতে পারিয়া-
“ইয়ে স্যার, বলবিদ্যা? ......ইহা তো খুবই সরল। বিভিন্ন প্রজাতির বল, যেমন ফুটবল, ক্রিকেট বল, টেনিস বল এই সকল বল লইয়া যে বিদ্যা মানে পড়াশুনা হয়, তাহাই বলবিদ্যা!”
“না না স্যার”, রতন আমার মুখের কথা কাড়িয়া নেয়, “আবুল ঠিকই বলিয়াছে তবে কিনা এইখানে বিভিন্ন প্রজাতির বলের জাইগায় বিভিন্ন রঙের, রং বেরঙের বল হইবে। যেমন, লাল বল, নীল বল, হলুদ বল... ”
বিটু বেশ অনেক্ষন যাবত উসখুস করিতেছিল, রাজনীতির মানুষ সে বেশিক্ষণ ধৈর্য রাখিতে সক্ষম হয়না,এবার সজোরে বলিয়া উঠে, “স্যার, স্যার, উহারা সব নিরেট মূর্খ, বল মানে হল গিয়ে শক্তি।”
এতক্ষন স্যার আমাদের উত্তর শুনিয়া রাগিয়া উঠিতেও ভুলিয়া গিয়েছিলেন, এবার রতনের দিকে উৎসাহিত দৃষ্টিনিক্ষেপ পূর্বক কহিলেন, “এই তো বেড়ে হচ্ছে বলিতে থাক- ”
“জি স্যার, যা বলিতেছিলাম। বল মানে হইল শক্তি দ্য পাওয়ার, কিভাবে অন্য মানুষের জমি জবর দখল করিতে হবে, কিভাবে মন্দির, বৌদ্ধ বিহার, গির্জা ভাঙিতে হইবে, কিভাবে বিধর্মীদের পিটাইয়া লাল বানাইতে হইবে, ধর্মের মহিমা বুঝাইতে হইবে, পেশী শক্তি প্রদর্শন করিতে হইবে, জোর করিয়া অন্য মানুষের জিনিষ কুক্ষিগত করিতে হইবে, ঋণ খেলাপি হইতে হইবে, বিশ্ববিদ্যালয় ভাংচুর করিতে হইবে, দুর্নীতি করিতে হইবে এই সকল গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা যেইখান হইতে পাওয়া যায়, সেইটাই স্যার বলবিদ্যা!”
বিটুর কথা শুনিয়া বন্ধুগর্বে আমার বুক ফুলিয়া উঠিল, নাহ রাজনীতি করিয়া বন্ধু আমার কত্ত কিছু শিখিতে পারিয়াছে! বছর দুয়েক আগে এক বিশেষ কর্ম সম্পাদনের উদ্দেশে আমি শহিদুল্লাহ হলে গিয়েছিলাম গজলু ভাই এর নিকট। সেখানে অপেক্ষামান কক্ষে অপেক্ষা করিতে করিতে দেখিতে পাইলাম এক মাঝবয়েসি ভদ্রলোককে, বেশ মনে হইল উনিও যেন ছাত্র, কিছুটা অবাক হইয়া গজলু ভাই কে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করিয়াছিলাম, উনি ছাত্র হন কিভাবে, উনার তো ছাত্রের পিতা হবার বয়স। গজলু ভাই বলিয়াছিলেন, উনি নাকি ছাত্রনেতা, আর ছাত্রনেতাদের একটু আধটু বয়েস বেশি হইয়া যায় বিদ্যা অর্জন করিতে করিতে... আজ বেশ বুঝিতে পারিতেছি বিটুর কথা শুনিয়া, বলবিদ্যা যে কঠিন রকমের বিদ্যা, ইহা অর্জন করিতে কিঞ্চিত বয়েস বাড়িবে, ইহা আর এমন কি আশ্চর্য !!!
আমার চিন্তার মাকড়জাল ছিন্ন হইল স্যারের বিষম চিৎকারে, “বটে রে গণ্ড মূর্খ, এই যদি হয় বলবিদ্যা, তবে স্থিতি বিদ্যা আর গতিবিদ্যা কি হইতে পারে?”
“আবুল”, স্যার মেঘস্বরে গর্জন ছাড়িলেন আমার পানে চাহিয়া-
“স্যার আপনার আল্লার কসম লাগে”, আমি তোতলাইতে থাকিলাম, “আমি স্থিতি বিদ্যা, গতিবিদ্যা এদের কাহারেও চিনিনা, শুধু বিদ্যা বালান নামক অভিনেত্রী টিকে চিনি, আহা কি নৃত্য স্যার, ডারটি পিকচার মুভি টা যা মনোহরিনী হইয়াছে না, ঘুম হারাম হইয়া যাইবে! স্যার আপনিও সুযোগ মতন দেখিয়া লইয়েন, আর স্যার বিদ্যা সাগরের নামও শুনিয়াছি আমি, উনি নাকি বিদ্যার নিমিত্তে সাগরের তলে চলিয়া গিয়াছিলেন, যদিও চীন দেশে না গিয়া সাগরের তলে উনি কী বিদ্যা অর্জন করিতেছিলেন, আমার সঠিক জানা নাই। তথাপি, আহা, কি মহান বিদ্যা শিক্ষক উনি!”
স্যার এবার রতনের দিকে অঙ্গুলি হেলান, “রতন বাবাজি, তোমার মতামত খানা শুনি?”
“স্যার, আবুলদের কথায় কর্ণ দিবেন না ।আবুলগুলো কেন জানিনা সর্বদা আবুল হইয়াই থাকিয়া যায়। স্থিতি বিদ্যা হল গিয়ে, যে বিদ্যা ঘরে বসে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া স্বপ্নের মধ্যে প্রাপ্ত হয়, যেমন কিনা,পীর বাবাজি আর সাধুদের হয়... আর গতিবিদ্যা হইল বিদ্যার উদ্দেশে, কষ্ট করিয়া হাঁটিয়া মক্তবে আসিয়া বিদ্যাগ্রহন, অর্থাৎ কিনা গতির দ্বারা বিদ্যা হইল গতিবিদ্যা, যাহা কিনা এখন আমরা অর্জন করিতেছি।” আবারো বিটু কথার মাঝখানে গুল্লি চালান পূর্বক,
“অকাট মূর্খ তোরা, ওহে বরবুক, স্থিতি বিদ্যা হইল বিরোধীদল যখন গদিতে বসিবার সুযোগ না পাইয়া ভবিষ্যৎ নির্বাচনে গদির স্বপ্ন দেখিতে থাকে আর নানান কুচক্রী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করিতে থাকে, তখন উহাই স্থিতিবিদ্যা, স্থির থাকিয়া গোপনে নানান জাতের বিদ্যা। আর গতিবিদ্যা হইল সরকারী দল যখন, মনের হরষে ক্ষমতায় বসিয়া দেশটাকে নিজের বাপের সম্পত্তি ভাবিয়া আর জনগণকে নিজেদের চাকর সমতুল্য বিবেচনা করিয়া, সকলের নিকট নিজেদের বলবিদ্যা প্রদর্শন করিতে থাকে...তখন উহাই গতিবিদ্যা, উহাদের বলবিদ্যার চাপে দেশ গতিবিদ্যা প্রাপ্ত হয়।” বড়সড় বক্তিতা শেষ করিয়া বিটু স্যারের সম্মতির আশায় কহে- “এইবার সঠিক হইয়াছে ঠিক না স্যার?”
স্যার আর ধৈর্য রাখিতে পারেননা, খেপিয়া গিয়ে বলিয়া উঠেন,
“এই কে কোথায় আছিস, এই শাখামৃগ গুলরে কানে ধরিয়া শ্রেণিকক্ষের বাহিরে অবস্থান করিতে বল-”
আমাদের ফার্স্ট বয় স্বপন এতক্ষন পাশে দাঁড়াইয়া সকল কথা মন দিয়া শুনিতেছিল, এইবার থাকিতে না পারিয়া কহিয়া উঠে, “আমি একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে চাই স্যার, উহাদের বল সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নাই, দেখি উহাদের প্রথম থেকে কিছু শিখাইতে পারি কিনা, হাজার হোক, স্যার, ওরা এই ক্লাসের ছাত্র, উহাদের শিখানোর দায়িত্ব আমাদের সকলের কিনা!!”
“দ্যাখ বাবা স্বপন, কিছু পারিস কিনা করিতে” এই বলিয়া স্যার হতাশায় মাথা নাড়িতে নাড়িতে চলিয়া যান। আমি উনার গমন পথের দিকে তাকাইয়া ভাবিতে থাকি- বলবিদ্যা সহজ ব্যাপার নহে।
(চলিবে)
(বাড়তি কথা : কাহিনীর প্রয়োজনে চমক হাসানের "গণিতের রঙ্গের" বর্ণিল আগমন। উনার গঠনমূলক টিউটোরিয়াল গুলিকে উপহাস করিবার মত ধৃষ্টতা লেখকের মধ্যে বিন্দুমাত্র বিরাজমান ছিলনা, ইহা আমি নিশ্চিত করিয়া কহিতে পারি !)
সাফিনাজ আরজু
(safinaj_arju09@yahoo.com)
মন্তব্য
ভাল হয়েছে। চলুক।
অপেক্ষায়
- কাজী
অপেক্ষায় থাকুন, সবুরে মেওয়া ফলে
ভাল লাগল।
চলুক।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
চমৎকার। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
-এক জোনাকি
অপেক্ষায় থাকুন, আসিতেছে
বেশ ভালো লাগলো, পরেরটার অপেক্ষায় থাকলাম
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
আপনার মন্তব্য উৎসাহিত করলো ওডিনদা !
ভালো থাকবেন।
বলবিদ্যা সহজ বিষয় নহে!! আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি!
জি, আমিও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি
নতুন মন্তব্য করুন