নীলক্ষেতের রাস্তার পাশের দোকান থেকে ‘উইজডোম অফ বোনস’ বইটা কিনছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়ে গেল ‘ইস্পাতে’র (How the steel was tempered) ওপর। সাথে সাথে মনে প্রচন্ড ক্ষোভ জেগে উঠলো । রাগের চোটে হাতে একটা বই নিয়ে মুচড়ানো শুরু করেছিলাম। আর দোকানদার মামা না ঠেকালে হয়ত ঝাপিয়েই পড়তাম ‘ইস্পাতে’র ওপর।
ঝামেলাটা প্রথম লাগিয়েছিল সেই ই।নয়তো কেউ এর আগে কোন কথা বলে নি কখনো। মুখই খোলার সাহস পাই নি। এত রকম অত্যাচার নির্যাতন এদের ওপর চলত যে কেউ বিদ্রোহ করার কথা ভেবেই দেখেনি।
সেদিন ছিল ১৪ই ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস, আমার জন্মদিন এবং শনিবার। অফিসের এক কলিগ খুব ভাল হাত দেখেন। উনি কিভাবে যেন বুঝে গিয়েছিলেন ব্যাপারটা। বলেছিলেন আজ আপনার গৃহদাহ হবার সম্ভাবণা আছে। সাবধানে থাকবেন। হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম। একা মানুষ, ব্যাচেলর তার আবার গৃহদাহ!! আমি ব্যাচেলর শোনার পর তিনিও একচোট হেসে নিয়েছিলেন। কিন্তু শব্দটা যে আক্ষরিক অর্থেই ফলে যাবে কে জানত!
অফিস থেকে ফেরার পথে রোমান ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলাম আমার সর্বনাশ, অস্ত্রোভস্কির ইস্পাত, ধার হিসেবে। যদিও বাকিরা সবাই এতদিনে জেনে গেছে যে আমাকে বই ধার দিলে ফেরত পাওয়া যায় না, রোমান ভাই নতুন তো, এখনো বুঝে উঠতে পারেন নি। সাথে উনি বার্থডে গিফট করেছিলেন খুশবন্ত সিং এর ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’। মনের আনন্দে বাসায় ফিরে এলাম। দুই দুইটা বই আজকে রাতে পড়ব সে আনন্দে হয়ত বাসায় ফিরে একটু গান গাওয়ারও চেষ্টা করেছিলাম। পাশের বাসায় হই হল্লা শুনে বুঝলাম কাজটা মনে হয় ঠিক করিনি।
স্টোভে খিচুড়ি বসিয়ে দিয়ে শেভ করতে ঢুকে গেলাম বাথরুমে। আমি ভাই গরীব মানুষ, মার্ক টোয়েনের মত। বই হয়ত মেরে দেয়া যায়, কিন্তু বুকশেলফ তো মেরে দেয়া যায় না! তাই বইগুলো সব একের ওপর এক পরে স্তুপ হয়ে আছে। রুমের এক দেয়াল জুড়ে ছাদ অবধি।আমি যখন ট্যাপ ছেড়ে মনে মনে চিন্তা করছিলাম রোমান ভাইয়ের শেলফে ডালরিম্পেলের ‘লাস্ট মোঘল’টাও দেখেছি, আমার ক্যারেকটার উনি বুঝে ওঠার আগেই মেরে দিতে হবে তখন ইস্পাত আমার বুক শেলফে প্রথম বিদ্রোহের আগুনটা জ্বালাল।
সে প্রথম খোচাটা দিয়েছিল ‘একাত্তরের চিঠি’কে।
‘কি ব্যাপার! তুমি না এই...সেই...তা এভাবে পড়ে আছ যে! তোমার শরীর জুড়ে কাল দাগ! এখনে সেখানে উইপোকার তৈরি ছিদ্র! মলাটের এক অংশ ছিড়ে ঝুলছে! এতো অমানবিক!’
চিঠি ভাল মানুষ, সে বলল, ‘ভাই ছেলেটার তো বেশি টাকা পয়সা নেই। তাই ঠিক আমাদের দিকে নজর ওইভাবে দিতে পারে না। এমনিতে সে বই পড়ে। কিন্তু পড়ার পর আমাদের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ে এটা ঠিক।‘
‘তাই বলে এভাবে ফেলে রাখবে!’ ইস্পাত গরম হতে শুরু করল। এরপর সে তাকাল আসিমভ আর ক্লার্কের বইগুলোর দিকে। ‘তোমাদের কি কষ্ট হয় না! এক এক জনের মরমর দশা! পাতা খুলে পড়ে যাচ্ছে। মলাটের কোন বালাই নেই!’
এইদিকে হারামী ফরমান আলির বইটাও চান্স পেয়ে গেল। বলে কিনা,’ নোমান ব্যাটাতো একটা আস্ত খাটাশ! একে তো বই চোর তার ওপর এনে এনে সে কি অত্যাচার! আমি এসেছিলাম তার এক সুন্দরী ছাত্রীর বাসা থেকে। অথচ দেখ!আমাকেও সে ছাড় দিল না!’ আর কি আশ্চর্য! সে সাথে সুর মেলাল কিনা ‘গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে’র মত বই!
ইস্পাত বলে ‘সে কি! ওই ব্যাটা তো আমাকেও ধার হিসেবে এনেছে! আমাকেও কি ফেরত দিবে না নাকি!’ চারদিক থেকে হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল। গার্ডারের সোফির জগৎ বলল,’ আমাকে আনা হয়েছিল এক সুন্দরীকে গিফট দেয়ার জন্যে। তাও এনেছিল কে জান! নোমানের ভার্সিটির লেকচারার! এই ব্যাটা কাউকেই ছাড় দেয় না।শিক্ষকের বই পর্যন্ত মেরে দিসে!’ সাথে হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউড, ওয়ার এন্ড পিস, এমনকি আমার প্রসেস কন্ট্রোলের মত বই গুলো সুর মেলাল! অথচ এদের আমি কত ভালবাসতাম! হলই বা চুরি করা!
ইস্পাত ঘেমে গিয়েছিল এগুলা শুনতে শুনতে। পাতা নাড়াতে নাড়াতে বলল, আমাদের কিছু একটা তো করা উচিত। এভাবে তো সহ্য করা যায় না। আর তোমারা তো জানোই আমি প্রতিবাদী। আমি তো এটা মানতেই পারছি না। মাঝখান থেকে মার্ক্সের ক্যাপিটাল হঠাৎ উঠে বলে, ‘দেখ! আমাকে এনেছে হল লাইব্রেরী থেকে। ফেরত দিচ্ছে না, যার জন্যে একটা নিরীহ ছেলের রেজাল্ট আটকে আছে। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমি আত্মহত্যা করতে চাচ্ছি অনেক দিন ধরেই। কিন্তু আমার সাথে কেউ নেই।‘
মাওলানা হিফজুর রহমানের ‘ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবাস্থা’ লাফ দিয়ে উঠে বলে, ‘ সুইসাইড! ওরে না না! এইটা ভয়াবহ পাপের কাজ। তোমরা এইটা কইর না! আমারেও তো সে এক হুজুরের কাছ থেইকা মাইরা নিয়া আসছে। আমি দিনে পাচ বার ওরে এই জন্যে অভিশাপ দেই। কষ্ট আমারো হইতাছে। কিন্তু তাই বইলা সুইসাইড! তোবা তোবা!’ মাওলানা টাইপের বইগুলা তার পক্ষ নিল। কে জানত যে এই ব্যটাগুলা, যাদের আমি দুই চোখে দেখতে পারি না, তারাই আমার বইগুলাকে বাচানোর চেষ্টা করবে!
কিন্তু ইস্পাত ব্যাটা বদ। সে বলে, ‘তাই সই। কেউ যদি না যায় তাহলে তুমি আর আমি একলাই স্টোভে ঝাপ দেব। চল।‘ হকিং এর গ্র্যান্ড ইউনিভার্স আর ব্রিফ হিস্টরী অফ টাইম বলল তারাও যাবে। সাথে চলে আসল নিউরনে অনুরনন গুলা। একে একে সবার বই লাইন ধরা শুরু করল। জাফর ইকবালের বই সব চলে আসছে দেখে হুমায়ুনের বই গুলাও চলে আসল।সব মিলিয়ে চারশ আটাত্তর টা বই। মাওলানা বই গুলা আসতে চাচ্ছিল না। তখন হিটলারের ‘মাইন ক্যাম্পফ’ বলল না আসলেও অসুবিধা নাই। আমরা নিজেদের গায়ে আগুন ধরিয়ে স্তুপে ঝাপিয়ে পড়ব। সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল দোয়া দরুদ পড়া।
আমি তখন শেভ করতে করতে চিন্তা করতেছি ফ্রেঞ্চকাট রাখব না থুতনিতে ছাগল দাড়ি রাখব। আজকালকার মেয়েগুলা যে কখন কোনটা পছন্দ করে! সে সময় হঠাৎ মনে হল চার পাশ যেন একটু উজ্জ্বল হয়ে এল। তাও কিছু বুঝি নি। একটু পর দেখি ধোয়া আসছে। আমি ভাবলাম খিচুড়ি পুড়ে ফেলেছি। দৌড়ে বের হলাম। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুন দেখেই মাথা গেল খারাপ হয়ে। লুঙ্গিতে গিঠ দিতে দিতেই বাইরে দৌড় দিলাম। আর দরজার লকে লেগে কব্জিতে দশাশই একটা গর্ত হয়ে গেল। এত রক্ত দেখে আর স্থির থাকতে পারলাম না। পাশের বাসায় দুই একটা ধাক্কা দিয়েই অজ্ঞান হয়ে গেলাম।জ্ঞান ফিরে দেখি আমি হাসপাতালে। হাতে তিনটা স্টিচ লেগেছে।
পুরো ঘটনাটা আমি শুনেছিলাম নিকোলাস উইন্সটেনের ‘সাম্থিং কল্ড নাথিং’ এর মুখে। এই বেচারা আমার বালিশের পাশে পড়েছিল।তাই বেচে গেছে। আর স্কলার বই গুলা একটু ভীতু টাইপেরই হয়।
এজন্যেই আমার আজ নীলক্ষেত থেকে বই কিনতে হয়। নয়ত আমি, নোমান, বই কিনে পড়তাম!!!!
(এটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক গল্প, কেউ এর সাথে নিজের মিল খুজে পেলে গাঞ্জা খাওয়া ছেড়ে দিন)
কোয়াসিমোডো
মন্তব্য
অনেকদিন পর একটা পোস্ট আমাকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। চমৎকার লেগেছে আপনার লেখাটা।
ধন্যবাদ
___________________
রাতের বাসা হয় নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি
বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি
ধইন্যাপাতা
বেশ হয়েছে
আপনার লেখা এই প্রথম পড়লাম।
ভালো থাকবেন।
অমি_বন্যা
ধন্যবাদ
দারুণ!
ধন্যবাদ দেঁতো হাসি
ব্যাপক মজা পেয়েছি পড়ে। তবে এইরকম বই চোর আমার বাসার আশেপাশে না আসলেই হয়! কেউ বই নিয়ে ফেরত না দিলে তাকে আমার কিলাতে ইচ্ছা করে
লেখা ভাল হয়েছে
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
আমারো এইরকম বই চোর ভাল্লাগেনা। ধন্যবাদ
ভাল লাগলো!
কিন্তু গল্পের নাম জাপানীজ রিচুয়াল সুইসাইড, যার অর্থ হল 'পেট কেটে ফেলা' , তার নামে কেন? অন্য কোন অর্থ বহন করছে নাকি 'সুইসাইড' বলেই দেয়া?
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ধন্যবাদ শুধু সুইসাইড বলেই
চমৎকার
ওরে নারে! জব্বর আইডিয়া। আপনে মিয়া কই লুকায়ে ছিলেন এতদিন? প্রথম লেখাতেই নিশ্চয়ই এই জিনিস বাইর হয় না?
নাকি হয়?
হয় না অসংখ্য ধন্যবাদ।
হেব্বি লাগলো সুইসাইড কাহিনি..
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
অনেকেরই অনেক বই হারিয়ে যায় যারা আর কখনই ফেরত আসে না।
দারুন লিখেন তো আপনি। গল্প ভাল লাগল।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
অসংখ্য ধন্যবাদ
তাইতো কই আমার ওই বইটা গেলো কই!
প্লটটা খুব মজার। খুব ভালো লাগল।
- ঈপ্সিত/চম্পাকলি
ধন্যবাদ
বাঃ
অনেক আগে কিছু লেখছিলাম,লিংক পাই কিনা দেখি
এ ক্লাস!!
সচলে আর কোন লেখা আছে?
ধন্যবাদ
অনেক আগে কিছু লেখছিলাম,লিংক পাই কিনা দেখি হাসি
দারুণ...
অসাধারণ লাগল।
--- ঠুটা বাইগা
অসংখ্য ধন্যবাদ
বইতো আর আল্লাহর দুনিয়ায় কম মানুষের থেকে চুরি করো নাই। আমার কাছ থেকেও একটা মাইরা দিছস।
লেখা কঠিন হইছে, তয় আমার বইটা ফেরত দিলে আরও ভালো লিখতে পারবি।
_____________________
Give Her Freedom!
মজা পাইলাম
খুব ভালো লেগেছে
অসংখ্য ধন্যবাদ
পুরাই
দারুণ লাগল, বেশ মজাদার।
facebook
অসংখ্য ধন্যবাদ
আরে দারুণ
..................................................................
#Banshibir.
ধন্যবাদ
দারুণ দারুণ!!
..........
রংতুলি
চমৎকার লাগলো। আরো লিখুন।
দারুন লিখেছেন। চালিয়ে যান !!
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
মারাত্মক হইছে দোস্ত।
নতুন মন্তব্য করুন