আগের দুই পর্ব এখানেঃ
পর্ব ১ -
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/46479
পর্ব ২ -
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/46554
~ রাউন্ড ৩ – ‘অন্নপূর্ণার হেঁসেল’ ~
“স্বাগতম! শাস্রিয়াকাল্! খুশ্আম্দিদ! ওয়েল্কাম! ‘ওস্তাদের মার শেষ পাতে’ শোয়ের সীজন টু-এর রাউন্ড থ্রীতে আপনাদের সবাইকে সুস্বাগতম্! আমি আপনাদের বন্ধু রিমি আবার আপনাদের সামনে এসে গেছি আপনাদের পছন্দের সেরা শো ‘ওস্তাদের মার শেষপাতে’র সীজন টু-এর রাউন্ড থ্রী ‘অন্নপূর্ণার হেঁসেল’এ বাংলার সেরা দশজন প্রতিযোগী নিয়ে। আজকে আমাদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষিকা শ্রীমতী প্রতিমা পালিত, হোটেল ম্যানেজমেন্টের ছাত্রী ঝিলম চন্দ্রা, ক্যালকাটা মেডিকাল কলেজের নার্স তনয়া বসু, হোমমেকার রঞ্জনা হালদার, রূপরেখা বুটিকের কর্ণধার সুভদ্রা আগরওয়াল, সরকারী পেটেন্ট অফিসে কর্মরতা শুভ্রা ব্যানার্জী, আই-টি কোম্পানিতে চাকুরিজীবি তানিয়া সরখেল, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সীমা দাস, আর্ট কলেজের অধ্যাপিকা অপর্ণা মিত্র, আর সদ্যবিবাহিতা গৃহবধূ দ্রিমি কাঞ্জিলাল। এঁরা সবাই আগের দুটি রাউণ্ডে অসাধারণ সব রান্না করে আমাদের জাজেদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। আমরা দর্শক বন্ধুদের আরেকবার মনে করিয়ে দি আমাদের অনুষ্ঠানের শর্ত অনুযায়ী আমাদের আজকের পাঁচজন প্রতিযোগীরই প্যশান রান্না, কিন্তু কারোরই রান্নাটা প্রোফেশান নয়। দেখা যাক, তৃতীয় রাউন্ডে কোন তিনজনের ভাগ্যে রাউন্ড ফোর-এর শিকে ছেঁড়ে। তৃতীয় রাউন্ডের নিয়মগুলো আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক!”, প্রতিযোগিনীদের দিকে ফিরে রিমির মন্তব্য, “রাউন্ড ৩ – ‘অন্নপূর্ণার হেঁসেল’এ আপনাদের সীমিত সময়ের মধ্যে তিনটি পদ রান্না করতে হবে। কল্পনা করে নিতে হবে একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে। ইম্যাজিন করে নিতে হবে সংসারের বয়ঃজ্যেষ্ঠ সদস্যের ডায়াবেটিস। চাকুরিজীবি সদস্যের জন্য অফিসের ভাত দিতে হবে কিন্তু মনে রাখতে হবে তার হাই কোলেস্টেরল। স্কুল বা কলেজে পাঠরত কনিষ্ঠতম সদস্যের জন্য বানাতে হবে এমন একটি পদ যা টেস্টিও আবার হেলদিও। জাঙ্ক ফুড বানিয়ে শর্টকাটে কাজ সেরে ফেলা চলবে না আরকি। আপনাদের এই তিনজনের জন্য তিনটি আলাদা আলাদা পদ রান্না করতে হবে এক ঘন্টার মধ্যে। শুধু মেইন ডিশটা রান্না করলেই চলবে। ভাত, রুটি, পাস্তা, চাউমিন ইত্যাদি রান্না করতে হবে না। আপনাদের প্রত্যেকের রান্না চেখে দেখবেন আমাদের বিচারক-মন্ডলী। আরেকবার আলাপ করিয়ে দিই, আমাদের মধ্যে বিচারক হিসেবে রয়েছেন জিবে জল আনা খাঁটি বাঙ্গালি ফাস্ট-ফুড চেইন রেস্টুরেন্ট ‘বেঙ্গল এক্সপ্রেস’এর মালিক বান্টি ঘোষ! রয়েছেন বাজাজ ফাইভ-স্টার গ্রুপ অফ্ হোটেলসের সাথে যুক্ত একমাত্র বাঙ্গালী আমাদের সব্বার ফেভারিট মাস্টার শেফ্ কুনাল গোস্বামি। রয়েছেন ‘এই রাত তোমার আমার’ ছায়াছবির হিট্ এবং হট্ হার্টথ্রব রূপা রায়। আর আমাদের মধ্যে রয়েছেন বিখ্যাত ম্যাজিসিয়ান মেঘনাদ গুপ্তা!”
এরপর দশ বারোটা ক্যামেরা প্রতিযোগীদের কার্যকলাপ ফলো করতে লাগল। রিনি কিচেনের বিভিন্ন অংশে ঘুরে ঘুরে এটা ওটা মন্তব্য করতে লাগল। এই একঘন্টার শুটিং এর এডিটিং করে দশ মিনিটের ক্লিপিংস দেখানো হবে অনুষ্ঠানে। জাজেরা এই সময়টা ফ্রি। ক্যামেরা ওদের আর ফলো করছে না। চা, কফি , কোল্ডড্রিংক্স খেতে খেতে হাল্কা গল্প গুজব করছেন।
ম্যাজিসিয়ান গুপ্তা অলস ও উদ্যেশ্যবিহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে সেটের একেবারে পেছনের দিকের একটা বুনো ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলেন। দিনের বেলায়ও ঝিঁঝিঁ ডাকছে। এই ঝিঁঝিঁর ডাক ওনার খুব পছন্দের। এক নিমেষে ছেলেবেলার সন্ধ্যেগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। ঝোপের মধ্যে একটা বহুরুপী গিরগিটি দেখলেন সরসর করে চলে গেল। গিরগিটি নিয়ে ম্যাজিসিয়ানের একটা ম্যাজিক দেখানোর ইচ্ছে আছে। এখনো মাথার মধ্যে আইডিয়াটা অবশ্য খেলিয়ে তোলা হয়নি। এই ক্যামেলিয়ানটার সাথে চারপাশের মানুষের খুব কি তফাত? রঙ যখন তখন বদলানোটা বোধহয় ডারউইন সাহেবেরই ‘সা্ররভাইভাল অফ্ দ্য ফিটেস্ট’ তত্ত্বের একটা সম্পাদ্য। রঙ না বদলালে কি কেউই আজকের দুনিয়ায় বাঁচতে পারবে? ঘড়ির দিকে তাকালেন। নাঃ, এখনো প্রায় চল্লিশ মিনিট বাকি আছে সেটে পৌঁছবার। হঠাৎ একটা চাপা কথোপকথন কানে এলো। জাদুকরের মন স্বভাবতই অনুসন্ধিৎসু। আবার একবারে আড়িপাতাটাও অশোভন। কি করবেন ভাবতে ভাবতে দু-পা এগোতেই গলার স্বরগুলো ধরে ফেললেন। অনেকদিন ‘ভেন্ট্রিলোকুইজম্’ শিক্ষার ফল।
- “আমায় এখানে ডেকে দেখা করতে বলার সাহস তোমার কোত্থেকে হয়?”
- “হয়। আর দেখ, তুই সুড়সুড় করে চলে এলি দেখা করার জন্য।”
- “তাই বলে এই শুটিং-এর মধ্যে?”
- “তুই নিজেও ভালোই বুঝেছিস এই কাঁটাঝোপে কেউ আসবে না। যাইহোক, পরের ইন্সটলমেন্টটা কবে দিবি সেটা বলে দিলে তো আর তোকে ডাকতে হত্না। আমি অনেকদিন ধরেই লক্ষ্য করছি যে তুই এড়িয়ে যাচ্ছিস।”
- “এড়িয়ে যাওয়ার কি আছে? তুমি আগের টেপটা এখনো দাওনি মনে আছে নিশ্চয়ই। তবে এটাই শেষ কিস্তি।”
- “তা আছে। হ্যাঁ, এটা শেষ কিস্তি। তবে সোনার হাঁসকে মেরে ফেলার আগে শেষ সোনার ডিমটার দামটা একটু বাড়বে।”
- “শোনো, এখন আমার যা স্ট্যাটাস, তাতে ওই পাব্লিসিটিও আমার পরের ফিল্মের পক্ষে ভালোই হবে।”
- “হ্যাঃ হ্যাঃ, জানিস তো, হিরোইনের ততক্ষন বাজারদর যতক্ষন দর্শকের কল্পনা করে নেওয়ার সুযোগ থাকে যে চোলি কে পীছে কেয়া হ্যায়। কল্পনার অবকাশ ঘুচে গেলে ঠিক বলা যাচ্ছে না কতদিন দর থাকবে।”
- “চুপ! ইতরের মত কথা বলনা। আমি পোলিস কমিশানারকে ফোন করে এই পুরো ব্যাপারটা ফাঁস করে দিতে পারি, ভুলে যেওনা।”
- “কমিশানার দেখাসনা। তার আগে, ইউটিউবে দেখবি তোর ভিডিওই সবথেকে বেশীবার স্ট্রীমিং হচ্ছে। তোর তখন কাঁচা বয়েস, মোমের মত চামড়া, ইউটিউবে আমি আপ্লোড করে রেখেছি প্রাইভেট অ্যাকাউন্টে, পাব্লিকের জন্য খুলে দেব সোনার ডিমের ঠিকমত দাম না পেলে।”
- “সোনার ডিম শুধু তোমার কাছে আছে তার কি গ্যারান্টি? হয়তো প্রোডিউসার জালাল ও এককপি রেখেছে হয়্তো। না হলে নামী দামী হোটেল ছেড়ে তোমার ওচা হোটেলে কেন রাত কাটাতে বলবে? তোমার সাথে নিসচই ষড় ছিল, আমি বুঝতে পারিনি।“
- “বুঝতে পারলেই বা কি করতিস? জালালের সাথে শুতিস না নাকি? তখন ব্রেক পাবার জন্য তুই যা মরিয়া ছিলি , রাস্তায় কাপড় খুলে দাড়াতে বললেও দাঁড়িয়ে যেতিস।“
- “সে চান্স ছিল না, আমি কি করতাম পরের কথা, তুমি বা জালাল ওরকম প্রোপসাল দিয়ে আখের খোয়াতে না। আমি শুধু ব্রেক পাবার জন্য জালালের সাথে কয়েকটা রাত কাটিয়েছি , তারপর অনেকের সাধ্য সাধনাতেও ওমুখো হইনি। কিন্তু তুমি সেই রকম ছ্যঁচড়া ব্ল্যাকমেলার রয়ে গেলে। আগে পাতি বি গ্রেড হোটেলের মালিক ছিলে, তখন ব্ল্যাক্মেলিং করতে তাও মানাতো। এখন ফাইভস্টার হোতেলের মালিক , বড় বর রেস্টুরেন্ট আন্ডারটেক করতে যাচ্ছ , কিন্তু মেন্টালিটি সেই ছ্যাঁচড়ের মত।“
- “আমাকে গাল পেড়ে লাভ নেই, কথায় বলে কর্মফল, তোমার কর্মের ফল তোমাকেই ভোগ করতে হবে, হ্যা , হ্যা হ্যা”
- “তোমার কর্মের ফলও তুমি হাতে নাতে পাবে। ব্ল্যাকমেলারদের পরিণতি হল অপঘাতে মৃত্যু।“
ম্যাজিশিয়ান গুপ্তার আর বাকিটা শোনার ইচ্ছে হলনা। দু;খই হল পুরো ব্যাপারটায়। সেই সনাতন ব্যাবসা আর ব্ল্যাক্মেইলিং। হর্লিক্স বেবীর সেই নিষ্পাপ মুখের সাথে আজকের কথোপকথনটা মেলাতে গিয়ে ম্যাজিশিয়ান গুপ্তার খুব খারাপ লাগছে। নিজেরও মেয়ে আছে বলেই বোধহয়।
ধীর পদে আবার পৌঁছে গেলেন সেটে। যদিও আরও মিনিট কুড়ি বাকি আছে, তবে ক্যামেরা রোল করার আগে কিছু কাজ থাকে বলে আস্তে আস্তে অনেকেই জমা হচ্ছেন সেটে।
একঘন্টা শেষ। প্রতিযোগীরা রান্না শেষ করে প্রস্তুত বিচারের অপেক্ষায়। বিচারকদের মঞ্চে ডাক পড়ল। হাল্কা মেকআপ সেরে নিয়ে সবাই আবার মঞ্চে হাজির হলেন। রিমি জানালো প্রথম পর্বের মত এবারও বিচার হবে দুটি পর্বে। প্রথমে ঝাড়াই তারপর বাছাই। ঝাড়াই পর্বে বিচারকেরা রান্নাটি সব নিয়ন মেনে হয়েছে কিনা। কোনো একটি নিয়ম না মানলে ততক্ষনাত বাতিল হয়ে যাবে। বাছাই পর্বে বিচারকরা খেয়ে দেখে রান্নার গুনাগুন বিচার করে নম্বর দেবেন। তিনটি রান্নার নম্বর যোগ করে প্রতিযোগীদের মোট নম্বর স্থির হবে। প্রথম পাঁচজন যাবেন চতুর্থ রাউন্ডে।
ঝাড়াই পর্বে বেশ কয়েকটি রান্না বাতিল হয়ে গেল। বয়োজেষ্ঠ্য ডায়াবেটিস রোগীর খাবার হিসাবে একজন রেঁধেছেন পাঁচমশালি তরকারী। তাতে আলু পড়েনি, কিন্তু কুমড়ো দিয়েছেন। কুমড়োও ডায়াবেটিসে বারণ কাজেই পদটি বাতিল হয়ে গেল। আরেকজন কম তেলে বেকড ফিস বানিয়েছেন কোলেস্টরল রোগীর কথা ভেবে। কিন্তু মুখোরোচক করতে গিয়ে কাজুবাঁটা দিয়ে ম্যারিনেট করেছেন। যার ফলে রান্নায় টোটাল কোলেস্টরল আর স্যাচুরেটেড ফ্যাট এর পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে, যেটা পুরোপুরি কোলেস্টেরল রোগীর অনুপযুক্ত। বাচ্চাদের মুখোরোচক খাবার হিসাবে দুজন ভাজা বানিয়েছিলেন। যথেষ্ঠ পুষ্টিকর নয় বলে সে দুটি পদও ঝাড়াই পর্বে বাদ পড়ল। দেখা গেল দুজন প্রতিযোগী একঘন্টার মধ্যে তিনটি রান্না শেষ করে উঠতে পারেননি। কাজেই তাঁরা ঝাড়াই পর্বে বাদ পড়ে গেলেন।
বাছাই পর্বে চারজন প্রতিযোগীর বারোটা রান্না সিলেক্টেড হয়েছে। স্বাদ হিসাবে বেশীরভাগ –ই অতুলিনীয়। তবে তিন চারটে পদ মুখে দিয়ে বোঝা গেল তাড়াহুড়ো করা হয়েছে। হয় সুসিদ্ধ হয়নি, বা তাড়াতাড়িতে কাজ সারার জন্য বেশী তেল দেওয়া হয়েছে। বিচারকরা গুরুত্ব দিচ্ছিলেন স্বাদ এবং নতুনত্বকেও।
প্রথম দুটো পর্বের পরেই বোঝা গেছে এবারের সীজনে দুজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগী হলেন প্রবীনা ঘরোয়া প্রতিমা পালিত এবং তন্বী, স্মার্ট, আধুনিকা নবীনা ঝিলাম। দুজনেরই আছে নিজস্ব রান্নার স্টাইল এববগ তার সাথে মানান্সই ব্যাক্তিত্ব। প্রতিমা মাসিমার বাবা বাছা করে কথা বলার ভঙ্গী, ঘরোয়া বাঙালি ধরণে কাপড় পরা, সাবেকী প্রথা, রান্নার প্রতি ভালোবাসা, লুপ্ত প্রায় বাঙালি রান্না ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা অনেকের মনে সাড়া ফেলেছিল। মহিলা দর্শকদের একটা বড় অংশ ওঁনার ফ্যান হয়ে পড়েছিল। অপরদিকে ঝিলামের নিজস্ব একটা ফ্যান সার্কল তৈরী হয়েছিল। তার প্রথা ভাঙ্গা রেসিপি, দেশ বিদেশের রান্নার সম্পর্কে জ্ঞান, পরীক্ষামুলক রান্না নতুন প্রজন্মের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল।
এছাড়া যে জিনিসটা দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল সেটা হল নবীনা এবং প্রবীনার ঠান্ডা লড়াই যেটাতে রিমি ক্রমাগত ইন্ধন যোগাচ্ছিল। আজ দেখা গেল প্রতিমা পালিত বানিয়েছেন বেগুনের হিং টক, রসুন , হলুদপাতা, ধনেপাতা সহযোগে বিউলির ডাল এবং ছানার কালিয়া। সমস্ত নিয়ম মেনেছেন কিন্তু স্বাদে অসাধারণ। এরকম সাধারন রান্না যে কেউ প্রতিযোগীতায় করার সাহস দেখাতে পারে সেটাই আশ্চর্যের। অন্যদিকে ঝিলাম বানিয়েছিল ফায়ারক্র্যাকার এগপ্ল্যান্ট, ফরাসী সুপ ‘বুইয়াবেইস্’, আর কটেজ চীজ সহযোগে স্পিন্যাচ ক্যাসেরোল।
বাছাই পর্বের সমাপ্তির পর সকলের নাম্বার যোগ করে দেখা গেল প্রথম হয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষিকা শ্রীমতী প্রতিমা পালিত, দ্বিতীয় স্থানে আছে হোটেল ম্যানেজমেন্টের ছাত্রী ঝিলাম চন্দ্রা, তৃতীয় হয়েছেন ক্যালকাটা মেডিকাল কলেজের নার্স তনয়া বসু, চতুর্থ হোমমেকার রঞ্জনা হালদার এবং পঞ্চম রূপরেখা বুটিকের কর্ণধার সুভদ্রা আগরওয়াল।
রিমি মাইক হাতে ঝিলামের কাছে গিয়ে বলল আচ্ছা ঝিলাম তুমি বাঙালি হয়েও ফায়ারক্র্যাকার এগপ্ল্যান্টের মত চাইনীজ রান্নার খবর রাখো এটা বেশ প্রসংশার ব্যাপার, কিন্তু বাঙালি রান্না বেগুনের হিং টকের কথা শুনেছিলে কি?”
ঝিলাম অপ্রভিত না হয়ে বলল “না শুনিনি, চার্লি চ্যাপলিন আমেরিকান কিন্তু তার নাম আজকের বাঙ্গালিরাও সবাই জানেন। প্রায়সমসাময়িক ছিলেন তখনকার দিনের নাম করা বাঙালি অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়া। কিন্তু আজকের জেনারেশনের অনেক বাঙালি তাঁর নাম শোনেনি। কারন তিনি যথেষ্ঠ প্রতিভাবান ছিলেন, নিজের সময় সেরা ছিলেন কিন্তু চার্লি চ্যাপলিনের যা আছে তা হল চিরকালীন আবেদন, তা সকলের থাকে না। সেই রকম বাঙালি রান্না অনেক আছে যা বাঙ্গালিদের খুবই প্রিয়, কিন্তু আমি প্রেজেন্ট করতে চাই এমন কিছু রান্না যা সব দেশের মানুষের মন জয় করেছে।“
ঝিলামের বক্তব্যের যুক্তি এবং বাঁধুনিতে সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। দর্শকরা তো বটেই বিচারকেরাও হাততালি দিয়ে উঠলেন। সব থেকে বেশী তালি দিলেন কুনাল। সিনেমার জগত থেকে উদাহরণ দেওয়ায় রুপারও বেশ ভাল লেগেছিল। শুধুমাত্র বান্টি প্রমথেশ বড়ুয়ার নাম শোনেননি বলে সম্পূর্ন রসগ্রহণ করতে পারলেন না। ঝিলামের দৃপ্ত বাচনভঙ্গী ম্যাজিসিয়ান গুপ্তার বেশ পছন্দ হয়েছিল কিন্তু ফায়ারক্র্যাকার এগপ্ল্যান্টের চিরকালীন আবেদন আছে আর বেগুনের হিং টকের নেই; প্রতিমা মাসিমার হাতে বেগুনের হিং টক খাওয়ার পর একথা তিনি মানতে পারলেন না।
রিমি প্রতিমা মাসিমার দিকে মাইক ফিরিয়ে বলল “আপনার কি মনে হয় মাসিমা, বাঙালি রান্না এতো সুস্বাদু হওয়া সত্বেও বিশ্বের দরবারে কেন জায়গা করে নিতে পারছে না?”
প্রতিমা মাসিমা বললেন “তার কারণ হল রান্নার ক্ষেত্রে কোনো নোবেল বা অস্কার পুরস্কারের ব্যাবস্থা নেই। বাঙালি কোনোকালেই গেঁয়ো যোগীকে পাত্তা দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাবার পর বা সত্যজিত রায় অস্কার পাবার পর বাঙালি তাদের মাথায় তুলে নাচে। কিন্তু বিদেশ থেকে স্বীকৃতি না নিয়ে এলে বাঙালি নিজের কালচারকে হেয় করতেই ভালবাসে। তুমি নাম শুনলে না, মুখে দিয়ে দেখলে না, রান্নাটা শেখার কোনো চেষ্টাও করলে না কিন্তু অবলীলায় বলে দিলে এই রান্নাটা বিদেশীদের মুখে রুচবে না। কারণ এটা আমাদের অশিক্ষিত ঠাকুমা দিদিমাদের আবিস্কার, বিলেতী রেস্টুরেন্টের মাস্টার শেফের ইনোভেশন নয়। বাঙালি নতুন প্রজন্ম যদি বাঙালি রান্নাকে বিশ্বের সামনে না তুলে ধরে তবে কি আমি সত্তর বছরের বুড়ি হাজার চেষ্টা করলেও আমাদের সাবেকী রান্না হারিয়ে যাবেই।“
রিমি বলল “এটা তো ঠিক চাইনীজ রেস্টুরেন্ট সারা বিশ্বে পাবেন কিন্তু বাংলার বাইরে বাঙালি রেস্টুরেন্ট হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র।“
প্রতিমা পালিত বললেন “সারা বিশ্ব দেখার সুযোগ হয়নি কিন্তু কলকাতা দিল্লিতে দেখেছি বেশীরভাগ চাইনীজ হোটেল চালায় অল্পবয়সীরা। কিন্তু আমাদের ছেলেপুলেরা বাঙালি হোটেল বলতে ভাবে রাস্তার ধারে ভাতের হোটেল। কলকাতাতেই দেখো বড় বড় শপিং মলে আমাদের ছেলেরা ফুডকোর্ট খুলে বিলিতি জাঙ্কফুড বিক্রি করে, কেক পেস্ট্রী বিক্রি করে। কখোনো দোসা বা ছোলা ভাতুরাও বিক্রি করে কিন্তু কক্ষোনো কচুরি আলুরদম, কুচো নিমকি , চন্দ্রপুলি , রসবড়া বিক্রি করে না। ওসব বিক্রি হয় লো প্রোফাইল মফস্বলের মেলায়। এই যদি আমাদের বাঙ্গালিদের মানসিকতা হয় তবে বাংলার বাইরে বাঙালি রেস্টুরেন্টের আশা সত্যি আকাশকুসুম।“
প্রতিমা পালিতের বক্তব্য শেষ হবার পর সঙ্গে সঙ্গে হাততালি শোনা গেল না। দর্শকরা যেন একটু আত্মমগ্ন। সকলেই যেন তলিয়ে ভাবছে প্রতিমা মাসিমার কথা গুলো আর বুকের ভেতর থেকে কেউ বলে উঠছে ঠিক, ঠিক , ঠিক-ই তো।
রিমি বলল “চমৎকার বিশ্লেষন প্রতিমা মাসিমা, অসংখ্য ধন্যবাদ।“ বলে নিজেই হাততালি দিয়ে উঠল। দর্শকরা সম্বিত ফিরে পেয়ে হাততালিতে হল ভরিয়ে দিল।
ক্যামেরা প্রতিমা পালিতকেই বেশী ফোকাস করছিল। ফোকাস থেকে সরে যাওয়া ঝিলাম মনে মনে বুঝতে পারল রান্নার মত তর্কযুদ্ধেও এই পর্বে প্রতিমা মাসিমা বাজী মেরে বেরিয়ে গেলেন।
রিমোটে ভিসিডি প্লেয়ার পজ করে বাকিদের দিকে ফিরে অরুণ বাসু বললেন, “রূপার মোটিভটা সত্যিই অধরা থেকে যেত যদি আপনি না বলে দিতেন মেঘনাদবাবু।”
- “তবে একটা জিনিসে একটু খটকা লাগছে,” ম্যাজিশিয়ান গুপ্তা কি যেন একটু চিন্তা করে বললেন।
- “কি বাবা?” তিষ্যার প্রশ্ন।
- “যা বোঝা গেল, এই ‘ওস্তাদের মার শেষ পাতে’ শো-এর বাইরেও বান্টির সাথে রূপার যোগাযোগ ছিল। ওর যদি খুন করতেই হত তাহলে অন্য যেকোন জায়গায়ই করতে পারত। বেছে বেছে এই শো-এর সেট বেছে নেওয়ার কি কারণ?”
- “কারণ আছে মেঘনাদবাবু। কোন ভিড়ের মধ্যে খুন করার যেটা প্রধান অ্যাড্ভান্টেজ সেটাই এক্ষেত্রে রূপারও মনে ধরতে পারে। রূপার বাড়িতে ডেকে কি আর সে খুন করবে? অতটা বোকা কেউই হয়না। এখানে রূপা জানে এত লোকের মাঝে খুন করলে চট্ করে ওর ওপর সন্দেহটা পড়বে না”, অরুণ বাসুর অভিজ্ঞ মন্তব্য।
- “তা ঠিক, তবে কি জানেন অরুণবাবু, আমার যেটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না সেটা হল, এই এতগুলো ক্যামেরা ফাঁকি দিয়ে কি করে খুনটা করা হল”
- “হ্যাঁ, সেটা একটা ধাঁধা বটে। দেখি অটোপ্সি রিপোর্ট কি বলে। হয়ত খুন নয়।”
- “আচ্ছা বাবা, তোমরা শুধুই সেটের লোকেরদের মোটিভ নিয়ে আলোচনা করছ। কিন্তু বান্টির ফ্যামিলির কেউও তো কোন ভাবে আগে থেকে বিষ খাইয়ে থাকতে পারে, পারে না? এমন বিষ যেটার এফেক্ট হতে হয়ত সময় লাগে, তাই সেটে সেটার এফেক্ট হল”, রনির প্রশ্ন।
- “হ্যাঁ। এটা ঠিকই ধরেছিস। তবে কি জানিস, এই সম্ভাবনা আমাদের মাথায় আগেই এসেছিল। বান্টির ফ্যামিলি বলতে বৃদ্ধা বিধবা মা। ভাই বোন, পরিবার, সন্তান কেউ নেই বান্টির। সেদিক থেকে কোন নতুন মোটিভ কিছু বেরোয়নি।”
- “একটা কথা বলি ফোর্থ রাউন্ড শুরুর আগে আরেকটা শুরু আছে যেটা অলক্ষ্যেই থেকে যায়। প্রদীপের তলার অন্ধকারটুকু ক্যামেরায় ধরা পড়েনা। কিন্তু আমাদের আরেকটা মোটিভ পর্যালোচনা করতে সুবিধা হবে”, ম্যাজিশিয়ান গুপ্তা ভুরুটা কুঁচকে বলে উঠলেন।
- “ও। তাহলে তো শুনতেই হয়। এইটা শুনে নিয়ে তারপর নাহয় আবার ফোর্থ রাউন্ডের ভিডিওটা দেখা যাবে।”
[ক্রমশঃ]
- ঈপ্সিত/চম্পাকলি
পরের পর্ব আগামী শুক্রবার।
মন্তব্য
দারুন। জানেন, পুরো সপ্তাহ বসে ছিলাম এই পর্বের জন্য। কিন্তু কেন জানি মনে হলো একটু তাড়াহুড়ো করেছেন এই পর্বে।
পরের শনিবারের অপেক্ষায়
খুব ভালো লাগল প্রশংসা শুনে।
তাড়াহুড়ো করিনি কিন্তু। আসলে পর্বগুলো একটু অসমান।
পরের শুক্রবার রাতে পরের পর্ব আপ্লোড করব। লেখা হয়েই গেছে।
তবে শুধু নিশিতা আপনি আর অগ্নিরই পড়েছেন। বেশী মন্তব্য পাচ্ছিনা। তাই ভাবছি হয়ত বাকিদের ভালো লাগছে না।
পড়ছি , ভালোও লাগছে
সত্যিই ! এই সিরিজটা দারুন লাগছে ! আপনাদের লেখার ভক্ত হয়ে গেছি এত টানটান লেখা আর প্লট ! পরের পর্ব জলদি চাই !
প্রশংসার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
পরের পর্ব পরের সপ্তাহে। আগের শুক্রবার আপ্লোড করেছিলাম কিন্তু আসেনি, তারপর শনিবার আবার করে আপ্লোড করতে হয়েছিল। চম্পাকলি তো ভয় পেয়ে গেছিল, ভেবেছিল মডারেশানের মানোত্তীর্ণ হয়নি।
আশা করি পরের শুক্রবার কোন প্রব্লেম হবে না।
সঙ্গে থাকুন।
লেখা হয়ে গেছে তো আমাকে আর কষ্ট দিচ্ছেন কেন ভাই?
আমার কিন্তু ধারনা সবাই পড়ছেন। সিরিজটা টান দিয়ে নিয়ে যায় যে।
সবুরে-মেওয়া-ফলেষু নিশিতা,
একসাথে সবটা পোস্ট করে দিলে অনেকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটতে পারে। আমাদের আগের একটা বড় গল্প "হাড়ে হাড়ে যায় চেনা" বেশী বড় ছিল বলে অনেকেই থান ইঁট রেখে গিয়েছিলেন, কিন্তু মনে হুয় না পরে ফিরে এসেছিলেন বলে।
আপনার লেখা ত ছবির মত মনে ছাপ পড়ে যায়! দারুণ সিরিজ।
যারপরনাই আহ্লাদিত হলাম শুনে। অনেক
অসাধারণ লাগছে! চালিয়ে যান।সব ময় পড়া হয় কিন্তু মন্তব্য করা হয়না।
অসংখ্য ধন্যবাদ পড়ে মন্তব্য করার জন্য।
পরের পর্ব দেন।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
আর ৪ দিন বাদেই।
ভালো হচ্ছে যথারীতি। চালিয়ে যান।
ভুলে যাওয়া অনেকগুলো খাবারের নাম স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য অভিনন্দন আর জিভে জল কাটার পর আগামী পর্বের জন্য তীর্থের কাক বানানোর জন্য মৃদু তিরস্কার। (স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিসট )
নতুন মন্তব্য করুন