পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্টে আমার অবস্থান হল বেশ কয়েক মাস। প্রতিদিন নানা বিষয়ের সাথে নতুন করে পরিচয় ঘটছে। নানা আনুষ্ঠানিকতার সাথে পরিচয় হলেও এখানকার ঈদের আনুষ্ঠানিকতার সাথে এই প্রথমবারের মত পরিচয়। কোরবানি ঈদকে এখানে বলা হয় তাবাস্কি। দেশটির উত্তরাঞ্চল মুসলিম অধ্যুষিত। মালি, গিনির মত দেশ প্রতিবেশী হওয়ায় ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা এখানে অনেক বেশী। ঈদ এখানে কেমন ভাবে পালিত হয় তা দেখার একটা আগ্রহ বরাবরই ছিল। ভাবতে না ভাবতেই সেই সুযোগ নিজ থেকেই ধরা দিল। এবার ঈদে আমার সময় কেটেছে আইভরি কোস্টের সর্ব উত্তরের শহর ওদিয়ানেতে।
আমাদের দেশের মতই এখানে কোরবানির ঈদে মুসলমান নারী পুরুষ মসজিদে নামাজ পড়তে যায়।
তবে আমাদের দেশের চেয়ে এদেশের মসজিদে নারীদের উপস্থিতি অনেক বেশী মনে হল।
পুরুষেরা তাদের দেশীয় ট্র্যাডিশনাল জুব্বা পড়ে আর মহিলারা মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে এক ধরনের সাদা পোষাকে নামাজ পড়তে আসে।
নামাজ শেষে শুরু হয়ে গেল কোলাকুলি। মসজিদের সামনে মানুষের ঢল। একজন আর একজনের সাথে কোলাকুলিতে বেশ ব্যস্ত মনে হল। অনেকের মুখে বলতে শুনলাম ‘বোন ফেত’ মানে আপনার অনুষ্ঠান শুভ হোক। রাস্তায় দল বেঁধে ছোট ছোট বাচ্চাদের দখল করে নিতে দেখলাম মুহূর্তেই।
রাস্তার দু পাশ দিয়ে গজে ওঠা বেশ কিছু স্টল চোখে পড়লো। এসব স্টলে বিক্রি হচ্ছে কোমল পানীয়, ভাঁজা মাছ, ডিম ভাজি। বাচ্চারা যার মত এসে এগুলো কিনে নিয়ে বেশ মজা করে খাওয়া শুরু করে দিল।
অন্যান্য দিনের সাথে এই দিনের একটা পার্থক্য হল নতুন পোশাক অথবা পরিচ্ছন্ন ভালো পোশাক। নারী পুরুষ, ছোট বড় নির্বিশেষে যার যার সামর্থ্য অনুসারে নতুন পোশাক কিনেছে সবাই।
(৫)
আর এগুলোই পড়ে নিকট জনের কাছে ছুটে চলেছে ছোট থেকে বড় বিভিন্ন বয়সের ছেলে মেয়েরা। বেশ আলুথালু সাঁজেও দেখা গেল কিছু বাচ্চাদের।
(৬)
রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় চলছে গান।
(৭)
সারা দেশে সরকারী ছুটি তাই রাস্তা ঘাঁটও বেশ ফাঁকা। রাস্তার পাশের বাড়িঘরে শুরু হয়েছে কোরবানি। কেউ গরু, কেউ খাসি, কেউ ভেড়া – অর্থাৎ সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের পশু কোরবানি শুরু হল নামাজের পরপরই। সকাল থেকেই বাসাগুলোতে মাংস কাটাই ব্যস্ত থাকতে দেখলাম অনেককেই।
একটা উৎসবমুখর পরিবেশ যেন ছেয়ে ছিল ওদিয়ানে শহরের চারপাশ। আনাচে কানাচে বাহারি পোশাকে নানা বয়সী ছেলে মেয়েদের পদচারণয় মুখর হয়ে গেল গোটা শহর।
(৮)
ঈদ উপলক্ষে কনসার্ট আয়োজন করা হয়েছে। শহরের স্টেডিয়ামে ঈদের পরদিন ট্র্যাডিশনালী গান বাজনার আয়োজন হয় এখানে। বেশ সংস্কৃতি মনাও এখানকার লোকজন। পেটে যতই ক্ষুধা থাক না কেন বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ এদের কানে গেলেই শুরু হয়ে যায় নাচ। তবে এদেশে নাচ খুব সহজ। শুধু হাত আর পায়ের হালকা নাড়াচাড়া। তাতেই ঘেমে শেষ । আমাদের দেশের নাচ দেখলে না জানি এদের কি প্রতিক্রিয়া হয়।
কোরবানির ঈদ এদেশে তিন দিন ধরে পালিত হয়। প্রথম দিন মূলত পশু কোরবানি আর পরের দুই দিন কাটে আত্মীয় স্বজনের বাড়ী ঘোরাঘুরির মধ্য দিয়ে। ছোট ছোট বাচ্চারা যার যার মত করে একেবারে যেন বড় হয়ে যায় এই দিনে। দুই তিন জনের এক একটা গ্রুপ করে হেটে যাচ্ছে কোন এক অভিন্ন উদ্দেশ্য।
(৯)
(১০)
শহর আর গ্রামের ঈদে রয়েছে কিঞ্চিৎ পার্থক্য। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের দূরত্ব অনেক। ২০-২৫ কি মি যাবার পর হঠাৎ দেখা মেলে একটা গ্রামের। গ্রাম ছোট হওয়ায় প্রায় সকলেই সবার পরিচিত। এ বাড়ী থেকে ও বাড়ী চলে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিবেশী। বাচ্চারা হয়তো কোন এক দোকানের পাশে গেড়ে নিয়েছে আড্ডা।
(১১)
বাহারি পোশাকে চলছে নানা কথার লেনাদেনা। চলছে সখ্যতা, নানান কথার চালাচালি।
(১২)
একই সাথে চলছে ফুটবল নিয়ে ড্রিবলিং। ঈদের কারণে সকাল থেকেই জমে উঠেছে ফুটবল। অনেকে আবার সাইকেলে করে বিশেষ পোশাকে রওনা হয়েছে বিশেষ কারো সাক্ষাতের আশায়।
(১৩)
আসতে আসতে পথে দেখলাম এক রাখাল বালককে।প্রতিদিনই যেন তার কাছে সমান। হাতে ছড়ি নিয়ে গরুদের সাথে তার সখ্যতার যেন কোন শেষ নেই তার। আবার অনেক সময় দুষ্টু দু একটা গরুকে লাইনে আনতে ব্যবহার হচ্ছে ছড়ি। ঈদ তেমন কোন বৈচিত্র্য আনতে পারেনা এই রাখাল বালকের। গরুর পাল নিয়ে মাইলের পর মাইল চড়িয়ে বেড়ানোতেই যেন তার আনন্দ।
(১৪)
এক গ্রামে গিয়ে দেখা হল সেখানকার ভিলেজ সেফের সাথে। সেই ট্র্যাডিশনাল আলখাল্লা পড়ে অনেক পুরনো একটা ভাঙ্গা চেয়ারে তিনি বসা আর তার চার পাশ ঘিরে রাখা অপেক্ষমান মানুষ। সবাই তার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন।
(১৫)
দেশটিতে বিভিন্ন সমস্যা লেগেই আছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, রক্তপাত, মারামারি এগুলো এখানকার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু তারপরও সব ভুলে গিয়ে কেন জানি এই দিনে সবাইকে বেশ সুখীই মনে হল।
(১৯)
গায়ের নোংরা কাপড় ফেলে একটু সুগন্ধি মাখা জামা, অন্তত এক বেলার জন্যে হলেও ভালো কিছু খাওয়া, শত দুঃখের মাঝেও একটু হাই পিচ গানে ক্ষণিকের জন্যে হলেও অন্য ভুবনে হারিয়ে যাওয়া, অনেক যত্নে বানানো বাহারি রঙয়ের আলখাল্লা গায়ে চেপে নিজেকে ক্ষণিকের জন্যে হলেও রাঙিয়ে নেয়ার চেষ্টায় মাতহারা থাকতে দেখলাম এই অঞ্চলের মানুষকে।
আইভরি কোস্ট নিয়ে আমার অন্যান্য লেখা
১। http://www.sachalayatan.com/guest_writer/45222
২। http://www.sachalayatan.com/guest_writer/45337
৩। http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44877
৪। http://www.sachalayatan.com/guest_writer/45698#comments
৫। http://www.sachalayatan.com/guest_writer/46302#comments
৬। http://www.sachalayatan.com/guest_writer/46490#comments
অমি_বন্যা
মন্তব্য
লেখায়
ঈদ মোবারক অমি ভাই।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
আপনাকেও ঈদের শুভেচ্ছা। ভালো থাকবেন।
অমি_বন্যা
ছবি আর ক্যাপশন একটু আগে পরে মনে হল।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
শেষের দিকের দু একটা হতে পারে। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ,মরুদ্যান।
অমি_বন্যা
আমিও চইলা আসমু নাকি ভাবতেছি
কি সুন্দর গরম দ্যাশ!
আমাগো এই খানে বরফ পইড়া ফাটায় ফেলতাছে
অক্টোবরে বরফ দেখতে ভাল্লাগেনা
চইলা আসেন লগে লগে ।
দেশটা সুন্দর তবে শীতল , ভালো থাইকেন।
অমি_বন্যা
খুব ভাল লেগেছে পড়তে, অমি_বন্যা। আপনার বর্ণনায় এক আফ্রিকান ঈদ উদযাপনের একটা সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে।
এইজন্যই উৎসবের দিনগুলো এত ভাল লাগে। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার মুখেই লেগে থাকে অমলিন হাসি। আর উৎসবের এই আবেদন সার্বজনীন। আপনার এই বর্ণনা বাংলাদেশের ঈদ উৎসবের সাথে মিলে যায়, প্রযোজ্য হয় মাত্র দিন কয়েক পূর্বে সমাপ্ত হওয়া দুর্গা পুজোর ক্ষেত্রেও।
আমাদের দেশেও কিন্তু মানুষজন গান পাগল, ক্ষুধা ও সংস্কার সত্বেও মানুষ গান শুনলে নেচে উঠে। তবে আপনি যে হাত-পা নড়াচড়ার নাচানাচির কথা বললেন, সে তো সব জায়গার আমজনতারাই করে। ওদের পেশাদার শিল্পিরাও এভাবে নাচে নাকি?
এসব স্টলের খাবারের বাইরে আফ্রিকান ঘরে ঘরে বিশেষ ডিস নিশ্চয়ই হয়? যেমন, আমাদের দেশে ঈদের সেমাই, ঈদের পোলাও ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। যাহোক, উৎসব ভিত্তিক আফ্রিকান রান্নার কিছু নিদর্শন থাকলে আরও সমৃদ্ধ হত।
মামুন ভাই মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আসলে এখানকার নাচ একটু ভিন্ন ধরনের। কেমন যেন খুব ধীর তালের মনে হয়। আমাদের দেশের মত না। ওদের বেশ কিছু পার্টি দেখেছি সেখানেও এদের নাচের ধরণটা আমার কাছে বেশ ধীর মনে হল। আর সে কারনেই নিচের লাইনটা বলা।
আমাদের দেশের নাচ দেখলে না জানি এদের কি প্রতিক্রিয়া হয়।
কোন বাসায় যাওয়া হয়নি তাই রান্না করা ছবি দিতে পারিনি। দেখি পরে যোগাড় করতে পারলে জানিয়ে দেব।
অমি_বন্যা
অন্য রকম ঈদ।নতুন অভিজ্ঞতা।ঈদ মোবারক।
আসলেই অন্যরকম বিশেষ করে তোমার অসুস্থতা। ভালো থেকো, সুস্থ থেকো। ঈদের শুভেচ্ছা।
অমি_বন্যা
লেখা আর ছবি, দুটোতেই
আফ্রিকা আমাকে সর্বদা টানে। আপনার লেখায় আফ্রিকাকে দেখতে পাই।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
রাত দা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার যে কোন মন্তব্য আমাকে প্রেরণা দেয়।
আমার লেখায় যদি আফ্রিকা দেখা যায় তবে তা আমার সৌভাগ্য। ভালো থাকবেন।
অমি_বন্যা
আহ! মানুষ সব জায়গায় একই রকম।
১৪ নাম্বার ছবিটা দুর্দান্ত!
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
আপনাকে ধন্যবাদ সজল। ভালো থাকবেন।
অমি_বন্যা
একেবারে আমাদের গ্রামের ঈদের বর্ণনার মতো লাগলো!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ধন্যবাদ ধুসর গধুলি। ভালো থাকবেন।
অমি_বন্যা
ভালো লাগল, কিন্তু ছবিগুলোতে আলোর কিছু একটা কম-বেশী হচ্ছে, পরেরবার খেয়াল রেখেন তো।
সেখানে বুনো জন্তু নিয়ে কোন পোস্ট দিবেন কি?
facebook
ধন্যবাদ অনু দা। পরেরবার খেয়াল রাখবো ছবি তোলার ব্যাপারে।
বুনো জন্তুর সন্ধানে আছি, খোঁজ পেলে পোস্ট দিবো।
অমি_বন্যা
ভাল লাগলো। জানতে ইচ্ছে করছে কোরবানী কিভাবে হয়। মানে আমাদের মতই কি রাস্তা ঘাটে যেখানে সেখানে কতল করা হয়? আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনাটা?
যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ...
আমাদের মতই তবে লোক কম তাই রাস্তা ঘাটে যেখানে সেখানে করতে হয় না। আমার দেখা কয়েকটা বাড়ীর মধ্যেই বেশ গোছালভাবেই করতে দেখলাম। তবে যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলেনা তারা। রক্ত আর অন্যান্য বর্জ্য রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া ড্রেনের ভিতর দিয়ে পরিষ্কার করতে দেখলাম। যেখানে সেখানে অন্তত এটা করতে দেখলাম না।
অমি_বন্যা
এই দ্যাশে কি পানজাবি-উনজাবি নাই না-কি। এ্যরা বেস্তে যাইব ক্যামনে? মাইয়াগ মাথায় হিজব ঠিকই আছে-কিন্তু বুক খোলা-এইডা কিরম ফ্যাশন অইল। তোবা, তোবা।
এইডা আফনার দেখা যেইভাবে দ্যাখেন আর কি
অমি_বন্যা
নতুন মন্তব্য করুন