আমি কোনোদিন মরতে চাই না

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৯/১০/২০১২ - ৪:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই ক্বীন ব্রীজ দিয়ে হাঁটতে গেলে একটা মজার ব্যাপার চোখে পড়বেই; ধনুকের মত বাঁকা ব্রীজকির উপর দিয়ে রিক্সা জাতীয় কিছু পার হতে গেলে চারপাশ থেকে কয়েকটা ছেলে ছোকরা কিংবা বয়স্ক লোক এসে রিক্সার কাছে এসে ভীড় জমাবেই, আর চেঁচিয়ে উঠবেঃ

"ঠ্যালা লাগবে, ঠ্যালা?"

নাহ! আমাদের আগেও কখনো ঠ্যালা লাগে নি, আজও লাগবে না। কারণ, বরাবরের মত আজকেও আমরা বেশ কয়েকজন হেঁটে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত পাড়ি দিচ্ছি।

একটা প্রোগ্রাম করতে সিলেটের একটু ভেতরে যেতে হয়েছিল। আসার সময় অবশ্য আমরা যে কয়েকজন ইয়ারম্যাট আছি, বেশ মজা করতে করতে আসছি... ব্রীজের মাঝপথে আসার পর রিক্সার টংটাং আর মানুষের কোলাহল হট্টোগোলের মাঝেও একটু পরিচিত হাসির শব্দ কানে এসে ঠেকলো।

"হিহিহিহি... হিহিহি....
মামা দেহো এইডা কী? চাচা, চাচা,- এইদিকে আসো, দেহো কী ভাসতেছে..."

ডানদিকে দৃষ্টি সরাতেই আমাদের এক বন্ধুকে দেখতে পাই, লোহার রেলিং ধরে অনেক নিচে বয়ে যাওয়া নদীর জলের দিকে মাথা কাত করে হাসসে তো হাসসে... আমরা যারা ব্রীজের ডানপাশে ছিলাম তাদের সবার আকর্ষণ ঐ দিকে চলে গেলো আর দলে দলে ঐ পাশে চলে গিয়ে নিচে ঝুঁকে কী যেন দেখে- খানিকক্ষণ পর চলে যাচ্ছে।

"মিয়া, ইয়ার্কি মারাও... কই মিয়া কিছুই তো দেখা যায় না!"

এই ভীড় আর কোলাহলের মাঝে আমার কথাটা সম্ভবত শুনতে পায় নি, ব্যাপার বুঝতে পারলাম যখন দেখলাম, যাকে উদ্দেশ্য করে আক্রোশটা ছুঁড়ে দিয়েছিলাম, দেখছিসে কিছুটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আবার সামনে দৌড় দিল।

এত উপর থেকে সুরমার জল বেশ নীল দেখাচ্ছে। ঝিরঝিরে বাতাস যখন ঐ নীল জলের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে কোথাও আবার হারিয়ে যাচ্ছে, তখন মৃদু ঢেউ খেলানো জলরাশি দেখতে খুব বেশি খারাপ লাগছে না। কয়েকটা কাক বাতাসের বিপরীতে উড়ে চলার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু পারছে না। ঝুঁকে জলের ঢেউয়ের ছন্দ উপভোগ করতে গিয়ে কালো মত কী যেন নজরে আসলো। মরা কাক নাকি? হায়রে এদের জীবন... আচ্ছা আমি যদি মানুষ না হয়ে এই কাক হয়ে জন্মাতাম তবে কী আমিই আজ এই এইখানে এইভাবে মরে পড়ে থাকতে হতো?
আরে নাহ! কিসের মরা কাক, এতো দেখি মানুষের মাথা! মানুষটা এত ছোটো যে প্রথমে বুঝতেই পারি নি এটা মানুষের বাচ্চা। ঢেউয়ের তোড়ে হালকা নড়ছে মরা শিশুটি। উপরে কয়েকটা কাক উড়াউড়ি করছে, হয়ত, কিছুক্ষণ পর শকুনও ভোজের খবরটা পেয়ে যাবে! তারপর কী হবে? আমার ভাবনায় শুধু কয়েকটা চিন্তা বারবার ঘোরাফেরা করছিলো... ঐ বাচ্চাটির জায়গায় যদি আমিও তো হতে পারতাম, তখন নিশ্চয় আজ আর এই লোহার উঁচু ব্রীজটির উপর দাঁড়িয়ে কারো মৃত শরীর দেখা হত না। দেখা হত না, ঠিক এই ব্রীজটির বিপরীতে ঝলমলে আর চমত্‍কার সাজানো গোছানো সার্কিট হাউসটি। কাক আর চিলের খাবার হবার অপেক্ষায় নীলাভ ঢেউয়ের মৃদু কম্পনের সাথে ভাসতে হত এই ব্রীজের নিচে। ভাবতে কষ্ট লাগল, যারা এই কাজটি করেছে, একই আচরণ যদি তাদের বাবা মা তাদের সাথে করত- তবে কীভাবে তারা এই পৃথিবীর আলো বাতাস ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্যবান হত? তাহলে কোন সাহসে তারা, তাদের সন্তানদের জীবনকে যাপনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্তব্ধ করে দেয়?

হয়তো কোনো হোটেলে কিংবা কোন এক ভ্যাপসা গলিতে অথবা দন্ডায়মান বাসের এক চিপায় কয়েক মুহূর্তের চরম আনন্দের তোড়ে ভাসতে গিয়ে মেয়েটি খেয়ালই করেনি এইমাত্র তার মতই জ্বলজ্যান্ত এক মানুষ পৃথিবীতে আসার প্রহর গুনছে; কিংবা, কোন এক অসহায় মুহূর্তের সুযোগে কিছু পুরুষের ভেতরের আদিম অসভ্য এক বর্বরতা জেগে ওঠেছিল। মেয়েটির অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না...
কারণ যেটাই হোক, তাদের এই বর্বতা আমি কোনো যুক্তিতেই মেনে নিতে পারছি না। আর প্রতিদিন ক্লিনিকগুলো যে পরিমাণ মানব শিশুহত্যা করে তার পরিসংখ্যান শিউরে ওঠার মত। শিশুটি যদি মেয়ে হয় তবুও নাকি অনেক দেশের বাবা-মা রা ক্লিনিকের পথে দৌড়ায়! জারজ সন্তান বলে যে কোনো ভিত্তি নেই, ঐসব পৌরাণিক রূপকথা থেকে আমদামি হয়েছে- প্রত্যেকটা জন্মই স্বাভাবিক, এই সাধারণ সমীকরণটা অনেকের মাথায় আজো ঢুকে না। ঢুকলে, আমাদের মত অশিক্ষিত দেশের অনেক তথাকথিত 'জারজ' সন্তানেরা জীবন নামক অপূর্ব এক অভিজ্ঞতার পর্বে প্রবেশ করার আগেই তাদের জীবনবীণা চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যেত না। যে শিশুটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে একদিন বড় হয়ে ওঠত, যার ফোকলা দাঁতের হাসি দেখলে মন জুড়িয়ে যেতো, যার আধো আধো কথা শুনলে আরো কয়েকটা বছর বেশি বাঁচতে ইচ্ছা জাগবে মনে- সে আজ ক্লিনিকের ডাস্টবিনে, নদীর জলে, ক্ষেতের আলে, বাঁশবাগানের কোণে, জঙ্গলের গভীরে- স্তব্ধ হয়ে আছে।

পড়ন্ত বিকেলে নদীটির জলের দিকে তাকিয়ে দেখছি... একেবারে পশ্চিম দিগন্তের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন করছে সূর্য। তার লালাভ আলো জলের বুকের সাথে মিশে গিয়ে জলের সাথে কাঁপছে... দেখতে বেশ লাগছে আর এ পাশে লালচে জলের ঢেউয়ের সাথে কাঁপছে ছোট্ট মৃত প্রাণটি।

সেই লালচে জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিকের মত আমারো বলতে ইচ্ছা করছে,

"আমি কোনদিন মরব না!"

-কিঙ্কর আহসান


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

মরতে তো চাইনারে ভাই আমিও!

অমি-বন্যা

অতিথি লেখক এর ছবি

চলেন আমরা না-মরণ পন্থা আবিষ্কার করে ফেলি দেঁতো হাসি
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ হাসি
-কিঙ্কর

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।