এই পর্বে কোবিলকার গবেষণার টেকনিকাল খুটিনাটি বিষয় মূলতঃ উঠে এসেছে। কিছু জিনিস সরাসরি ইংরেজী থেকে অনুবাদ করতে গিয়ে কেমন অসম্পূর্ণ বা অবোধ্য মনে হচ্ছিল। তাই এই পর্বের লেখাটিতে ব্যখা্যা দেয়ার জন্য প্রথম ব্যাকেটের ব্যবহার প্রচুর পরিমানে করা হয়েছে, যেগুলি মূল প্রবন্ধে নেই। দ্বিতীয় পর্ব প্রাসঙ্গিক হবে যদি প্রথম পর্বটি পড়ে নেয়া হয়।
অতিরিক্ত বিনয় কখনো কখনো কোবিলকাকে পিছিয়ে দিয়েছে। ডিউক ছাড়বার পর, সান-ফ্রানসিস্কোতে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজী বিভাগে অধ্যাপক পদের জন্য ইন্টারভিউ দিতে যান কোবিলকা। ঐ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ব্রুনো এ প্রসঙ্গে বলছেনঃ "কোবিলকা এবং আরেকজন প্রার্থী ইন্টারভিউটিতে অংশ নেন। এই বিষয়ে কারও দ্বিমত ছিলনা যে ব্রায়ান (কোবিলকা) অত্যন্ত মেধাবী একজন প্রার্থী। কিন্তু, এক পলকের জন্যেও তাঁর মধ্যে মুগ্ধ হবার মত কিছু দেখিনি। আমি ভাবছিলাম লাজুক, ফ্যাকাসে, স্ক্যান্ডিনাভিয়ান-দের মত দেখতে চেহারার কে এই ভদ্রলোক? সে খুবই অদ্ভূত, বিনীত এবং সল্পভাষী ছিল।"
“স্বাভাবিকভাবেই অন্য প্রার্থীটিকে আমরা নিলাম, আর স্ট্যানফোর্ড (বিশ্ববিদ্যালয়) কোবিলকাকে কব্জা করে নিল।” ব্রুনো শেষে বলছেন, "আমাদের আসলে দুইজনকেই নেওয়া উচিত ছিল।"
ß2AR–র সাফল্যের (সিকোয়েন্স, ফ্যামিলি ইত্যাদি জানা) পর, কোবিলকা ক্রমেই (এ বিষয়ে) আরও আসক্ত হয়ে পড়লেন। এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির মাধ্যমে রিসেপ্টরটির ত্রি-মাত্রিক চেহারা বের করতে চাচ্ছিলেন তিনি; এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি হল একধরনের পদ্ধতি যেখানে প্রোটিন দিয়ে তৈরি ক্রিস্টালে এক্স-রে রশ্মি প্রক্ষেপণ করা হয় এবং এর ফলে যে আলোর বিচ্ছুরণ-নকশা (diffraction pattern) তৈরি হয়- তার মাধ্যমে প্রোটিনের মধ্যে অণুর সজ্জা বের করা যায় (বা প্রোটিনটির ত্রিমাত্রিক গঠন সমাধান করা যায়)। এটি ছিল একটি সাহসী লক্ষ্য। একটি বোধগম্য এক্স-রে বিচ্ছুরণ-নকশা তৈরির জন্য কোবিলকাকে প্রথমে রিসেপ্টরটির একটি ক্রিস্টাল তৈরি করতে হত; প্রোটিন ক্রিস্টালাইজেশান হল এমন একটি উপায় যেখানে লক্ষ লক্ষ হুবহু প্রোটিন অণু এত কাছাকাছি ঘন অবস্থায় প্যাকিং হয়ে থাকে যে এর ফলে একটি কঠিন (solid) বস্তু তৈরি হয়, যেটা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে একটি কাঁচের টুকরার মত দেখতে লাগে। তবে কোন অবস্থা/পরিবেশে একটি প্রোটিন ক্রিস্টাল তৈরি করবে সেটা খুঁজে বের করতে কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে। আর কোষ-আবরণীর প্রোটিন, যেমন GPCR-দের নিয়ে কাজ করা হল- এদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন। এদেরকে (GPCR) অতি-অবশ্যই কোষ-আবরণীর মধ্য থেকে অটুট অবস্থায় বের করে আনতে হয়; কিন্তু সমস্যা হল, আবরণীই এই প্রোটিনগুলিকে সঠিক গঠন দান করতে পারে। আবার, GPCR-রা ক্ষণে ক্ষণে আকার পরিবর্তন করে এবং এদের বেশিরভাগই কোষে খুব অল্প পরিমানে তৈরি হয়। সেজন্যে, কোষের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় যে পরিমান ß2AR এক্সপ্রেস হয় (জিন এক্সপ্রেশান- ডিএনএ [DNA] থেকে এমআরএনএ [mRNA] হয়ে প্রোটিন তৈরি হওয়াকে প্রোটিন বা জিনের এক্সপ্রেশান বলে) তার তুলনায় ১০০ থেকে ১০০০ গুণ বেশি মাত্রায় প্রোটিনটিকে এক্সপ্রেস করাতে হবে। যখনকার কথা বলছি তখনও কোবিলকার দলটি GPCR এর ক্রিস্টাল তৈরি করার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি এবং প্রসঙ্গত, খুব অল্প গবেষণাগারই এই কাজটির চেষ্টা চালাচ্ছিল।
ক্রমেই "রিসেপ্টর ক্রিস্টালাইজেশন"- কোবিলকার নিজস্ব প্রজেক্ট হয়ে দাড়াল- কারণ তারঁ ধারণা ছিল এই ধরণের প্রজেক্ট একজন পোস্ট-ডক্টরেট বা গ্র্যাজুয়েট ছাত্রের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কোবিলকা`র প্রথম পোস্ট-ডক্টরেট মার্ক ভন য্যাস্ট্রো, যিনি বর্তমানে সান-ফ্রানসিস্কোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে GPCR- ট্রাফিকিং নিয়ে গবেষণা করছেন, সেই সময়কার স্মৃতি প্রসঙ্গ বলেছেনঃ "আমরা কোবিলকাকে নিয়ে ঠাট্টা করে বলতাম, তিনি হয়তো ক্লাস বা মিটিং এর মধ্য থেকেই একটি কলাম (column) হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে গবেষণাগারে ছুটে আসবেন এটা দেখবার জন্য যে আগের দিন বাড়ি যাবার আগে তিনি প্রোটিন বিশুদ্ধীকরণের যে বাইন্ডিং পরীক্ষাটি (প্রোটিনের সঙ্গে প্রোটিনের বন্ধনের পরীক্ষা) করছিলেন তার কিছু ফলাফল পাওয়া গেল কিনা!” এছাড়াও প্রতিদিন গবেষণাগারে কোবিলকার কাজে তড়িঘড়ি করার অন্য কারণ ছিল- তাঁর দুটো ছোট্ট বাচ্চা ছিল বাসায়, তং সান তখন ম্যাডিকেল স্কুলে পড়ছেন। তদোপুরি, বাড়ির (মর্টগেজের) জন্য রয়েছে বিশাল দেনা। আর তাই, উপায়ন্ত না দেখে, প্রয়োজন মেটানোর জন্য ছুটির দিনগুলোতে কোবিলকা হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ডাক্তারি শুরু করেন। মার্ক ভন য্যাস্ট্রো বলছেন, “আপাতঃ দৃষ্টিতে নিস্ফল এই `ক্রিস্টালোগ্রাফি প্রজেক্ট` নিয়ে কোবিলকা নিজেই রসিকতা করতেন। তিনি বলতেন, ‘তোমরা দেখো, ক্রিস্টালগুলো একসময় এতই বড় হবে যে আমি তা দিয়ে তং সান কে আংটি গড়ে দিতে পারব!’”
স্ত্রী তং সানকে সঙ্গে নিয়ে নোবেল অর্জনের অনুভূতি প্রকাশ করছেন কোবিলকা
যত দিন যেতে লাগল, ততই ß2AR - কে আরো বিশদভাবে জানার জন্য কোবিলকা`র গবেষণাগার নানা ধরণের প্রাণ-রাসায়নিক (biochemical) এবং প্রাণ-পদার্থিক (biophysical) গবেষণা চালাতে লাগলো; আর একটু একটু করে প্রোটিনটিকে সফলভাবে এক্সপ্রেস এবং বিশুদ্ধিকরণ (purify) করার পথে এগোতে লাগলো। কিন্তু প্রোটিনটির গঠন বের করবার ব্যাপারে তিনি যে এগিয়েছেন সেটা দৃশ্যত মনে হচ্ছিল না। বোর্ন বলছিলেন, “সবার কাছে মনে হচ্ছিল যে তিনি তাঁর কাজটিকে নিখুঁত থেকে নিখুঁততর করার চেষ্টা করছিলেন, এবং বেশকিছু সময় জুড়ে শুধু এরকমই চলছিল। তাঁর ল্যাব থেকে তেমন কোন ভাল জার্নালে প্রকাশনাও হচ্ছিলো না।” কোবিলকার দলটি দেখাতে সক্ষম হয়েছিল যে কোষের বাইরে-ভিতরে উভয় দিকেই নড়াচড়া করে এমন বড় বড় লুপ (প্রোটিনের গঠনের একটি অংশ যা ততটা স্থায়ী আকার ধারণ করেনা এবং যা সাধারনত দুইটি দ্বিতীয় মাত্রার গঠন যেমন আলফা হেলিক্স এবং বেটা স্ট্র্যান্ডকে যুক্ত করে) আছে GPCR-দের মধ্যে, এবং এসব লুপ রিসেপ্টরকে বিভিন্ন মাত্রার কার্যকারিতা (activation) প্রাপ্ত হওয়ার জন্য বিভিন্নরকম মোচড়ানো এবং পাঁক খাওয়ানো আকার নিতে সাহায্য করে। তবে, এই পর্যবেক্ষণ ক্রিস্টালইজেশান বা ক্রিস্টাল তৈরির সম্ভাবনাকে যেন আরও দুরুহ বানিয়ে দিয়েছিল।
ইতিমধ্যে GPCR ক্রিস্টাল তৈরি করা নিয়ে আরও একটি গবেষণার খবর পাওয়া গেল। ২০০০ সালে, সিয়াটলে অবস্থিত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইসটফ পালযেউইস্কি এবং তার একজন পোস্ট ডক্টরেট টেটসুযি ওকাদা রোডপসিনের ক্রিস্টাল গঠন প্রকাশ করলেন। `রোডপসিন` হল চোখের রেটিনার আলোক-সংবেদী GPCR। এটি একটি অসাধারণ অর্জন হলেও কোবিলকার গবেষণায় তেমন কোন সাহায্য করতে পারেনি। রোডপসিন কোষে অনেক বেশি পরিমানে পাওয়া যায়- কসাইখানা থেকে বালতিভর্তি চোখ নিয়ে এসে সেখান থেকেই ক্রিস্টালোগ্রাফির জন্য প্রচুর পরিমানে প্রোটিন তৈরি করা সম্ভব হয়। আবার, অন্যান্য GPCR-দের চেয়ে এই প্রোটিনগুলি অনেক সরল এবং স্থায়ী গঠনের, আর তখন (মানে যখনকার কথা বলা হচ্ছে) রোডপসিনের গঠন GPCR-দের চেয়ে ভিন্ন- এমনটিই ধারনা করা হত।
২০০১ সালের দিকে কোবিলকা এক হতাশাজনক সংবাদ পেলেন। সংবাদটি হলো- ২০০৩ সালে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর শেভি চেইজে (মেরিল্যান্ড) অবস্থিত হাওয়ার্ড হিউয়েস মেডিকেল ইনস্টিটিউট থেকে বরাদ্দ গবেষণার ফান্ডিং আর নবায়ন করা হবেনা। ফলে, কোবিলকার গবেষণাগার প্রচন্ড অর্থ সঙ্কটে পড়লো। বিশেষ করে, ব্যয়বহুল ক্রিস্টালোগ্রাফির গবেষণা চালানোটা হুমকির মুখে পড়ে গেল। কিন্তু এ প্রসঙ্গে কোবিলকা বলছেন, “হেরে যাবো বা কাজটি বন্ধ করে দেব এমন চিন্তা আমার মনে কখনোই আসেনি। স্বীকার করছি যে আমি হতাশাগ্রস্থ হয়েছিলাম, তবে এই চ্যালেঞ্জটা উপভোগও করেছিলাম। তদুপরি, আমি উত্তর (গবেষণার) পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। এই অদম্যতাকে আমার এক বন্ধু সুন্দরভাবে আখ্যা দিয়েছে এভাবে- ‘এ হলো এক অযৌক্তিক প্রত্যাশা!’
অবশেষে ২০০৪ সালের দিকে কোবিলকার দলটি কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্রিস্টাল তৈরি করতে সক্ষম হল। তবে, সেগুলি এতই ছোট ছিল যে স্ট্যানফোর্ড সিনক্রোট্রন-এ এর বিশ্লেষণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন কেমব্রিজের মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল গবেষণাগারের একজন ক্রিস্টালোগ্রাফার, গেভার্ড শের্টলার, কোবিলকাকে পরামর্শ দিলেন যে তিনি (কোবিলকা) তার স্যাম্পলটি ফ্রান্সের গ্রেনবলে অবস্থিত ইউরোপিয়ান সিনক্রোট্রন রেডিয়েশান ফ্যাসিলিটি- (ESRF) তে নিয়ে যেতে পারেন, যেখানে সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্যভেদী বীমলাইন থাকার কারনে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্রিস্টালের বিশ্লেষণ করা যায়। “আমাদের টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। একমাত্র আমার গ্রান্টস থেকেই সব হিসাব নিকাশ করতে হচ্ছিল,” বলেলেন শের্টলার, যিনি বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের ভিলিজানের পল শেরার ইনস্টিটিউটে আছেন। ক্রিস্টালগুলির বিচ্ছুরণের রেজোলুশান হল ২০ Å (Å- অ্যাংস্ট্রম, অতি ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্যের একক, এখানে একটি প্রোটিনের গঠনের ছবি কত পরিস্কার হবে তা বিবেচনা করা হয় এর মান দিয়ে। যত ছোট মান, তত পরিস্কার গঠনের ছবি হবে)। যেটা (বিচ্ছুরণের মানটি) এতই বাজে যে এ থেকে কোন ছবি খুঁজে পাওয়া দুস্কর ছিল। প্রোটিনটির একেকটি অণুর সজ্জা দেখার জন্য অন্ততপক্ষে ৪ Å রেজোলুশান দরকার।
অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে লাইসোজাইম নামক একধরনের প্রোটিনের ক্রিস্টাল
কোবিলকা বলছিলেন, "এর পরেও, কাজটি উত্তেজনাকর ছিল। হয়তো আমি ততটা অভিজ্ঞ ছিলামনা বলেই আমার এমন অনুভূতি হচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল আর অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা ৩ Å-এ পৌঁছাতে পারব।" তিনি অবশেষে ক্রিস্টালোগ্রাফি প্রজেক্ট-টির জন্য একজন পোস্ট-ডক্টরেট ছাত্র নেওয়ার ভরসা পেলেন। তার উপর, ২০০৫ সাল নাগাদ, আবার আর্থিক সাহায্য পেলেন- ম্যারিল্যান্ডে অবস্থিত বেথেসডার ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ (US National Institute of Health) - থেকে দুটি ফানডিং পুরষ্কার পেলেন।
কিন্তু হতাশা পিছু ছাড়ল না; গবেষণা দলটি কোন বড় আকৃতির ক্রিস্টাল বানাতে বা ভাল বিচ্ছুরণ ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। রিসেপ্টরটির পরিবর্তনশীল কার্যকারী অবস্থা (activation state) এবং ‘নড়নচড়নক্ষম’ অংশের জন্যে, বিশেষতঃ কোষ-আবরণীর ভিতরে রিসেপ্টরটির একটি অস্থির লুপের কারণে, সব প্রোটিন অণুগুলিকেই একটি অভিন্নরকম কাঠামোতে আনা (ক্রিস্টাল তৈরির জন্য সবগুলি অণু একইরকম হতে হয়) দুরূহ হয়ে পড়েছিল। দলটি বুঝতে পেরেছিল যে তাদের অভিনব কিছু করতে হবে। যেমন, প্রোটিনের মুক্ত অংশটিকে কেটে ফেলে ঐ অংশটিকে একটি এন্টিবডির সাথে যুক্ত করা যায় অথবা ভাল ক্রিস্টাল তৈরি করে এরকম কোনো প্রোটিন ওই মুক্ত অংশ বাদ দিয়ে সেই অবস্থানে লাগিয়ে দেয়া যায়।
পোস্ট-ডক্টরেট সরেন রাসমুসেন প্রথম এই অ্যান্টিবডি প্রজেক্ট টি শুরু করেন। আগের মতই, ক্রিস্টালটি সার্টলার-এর ESRF-কেন্দ্রে নেওয়া হল। সার্টলার বলছিলেন, "এটি একটি চমকপ্রদ ব্যাপার ছিল। ব্রায়ান, আমি এবং আমাদের পুরো দলটি সিনক্রোট্রনে উপস্থিত ছিলাম। বিচ্ছুরণ মানটি পাওয়ার সময়ে আমরা মেশিনটার সামনেই বসে ছিলাম। ৩ Å মানটি যখন পাওয়া গেল, আমরা সবাই আনন্দে লাফ দিয়ে উঠেছিলাম। এরকম মুহুর্তই একজন বিজ্ঞানীর সামনে আগানোর প্রেরণা। এরকম একটি মুহুর্তের জন্যই একজন বিজ্ঞানী প্রতীক্ষা করেন। একটি মুহুর্ত যা একটি নতুন মহাদেশ আবিষ্কারের সমান আনন্দ দেয়।" গঠনটি ছিল রোডপসিনের পর GPCR-এর দ্বিতীয় গঠন, যেটা পরবর্তীতে নেচার (Nature) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
কিন্তু গবেষকদল তাদের সাফল্যগুলি প্রকাশ করা থেকে বিরত ছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না ফিউশান-প্রোটিন প্রজেক্টে সাফল্য আসে। তবে এই গবেষণায় তারা অনেকখানি এগিয়েও গিয়েছিল। পোস্ট-ডক ড্যানিয়েল রোসেনবার্গ রিসেপ্টর প্রোটিনের যে যায়গাটিতে লুপ আছে তাকে সরিয়ে সেখানে বসানোর মত একটি সুবিধাজনক প্রোটিনও পেয়ে গেলেন। এটি হল টি-ফোর লাইসোজাইম (T4L)। অন্যদিকে কোবিলকা, ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোলাতে অবস্থিত স্ক্রিপ্স রিসার্চ ইনস্টিটিউট (Scripps Research Institute) এর রে স্টিভেন্স এবং তাঁর নতুন পোস্ট-ডক ভাদিম শেরেযভ এর সাথে মিলে একটা ফ্যাটি স্ক্যাফোল্ড (যে অংশের মধ্যে কোষ আবরণীতে থাকা প্রোটিনের অংশটি ধরে রাখা যায়) নির্ণয় করবার চেষ্টা করছিলেন যেটা ক্রিস্টালোজাইশেনের সময় মেমব্রেন প্রোটিনকে বন্দী করতে পারবে। T4L এবং ফ্যাটি স্ক্যাফোল্ড একসাথে মিলে হয়ে উঠে একটি সফল সমবায় বা মিলন। নেচার-এ প্রকাশণাটির পর, কোবিলকা আর স্টিভেন্স পর পর দুইটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন সায়েন্স (Science) পত্রিকায়, যেখানে পূনর্গঠিত (engineered) ß2AR এর গঠন ২.৮ Å এ সমাধান করা হয়।
এই প্রবন্ধ তিনটিকে ‘গাঠনিক জীববিজ্ঞান`-এর একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা যায়, আর এদের প্রকাশের ফলে এই দ্রুত বর্ধমান এবং আগ্রাসী বিষয়টিতে বিরাজমান প্রতিদ্বন্দ্বিতাটি আরও প্রখর হয়ে উঠে। স্টিভেন্স এর ল্যাবটি, এই প্রতিদ্বন্দ্বিদের মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছিল এবং অন্য অনেকগুলি GPCR দের গঠন আবিস্কার করে এগিয়ে চলছিল।
কিন্তু, কোবিলকার লক্ষ্য ছিল অন্য দিকে। GPCR এর যে গঠনটি তাঁরা আবিস্কার করেছিলেন সেটি ছিল প্রোটিনটির নিস্ক্রিয় অবস্থার ছবি। সঠিকভাবে রিসেপ্টরের গঠন বুঝতে হলে গবেষকদের দেখাতে হবে কিভাবে এই রিসেপ্টরগুলি লাইগেন্ড দিয়ে সচল হয় আর G-প্রোটিনকে চালু করে। আগের কাজটির চাইতে এই কাজটি বরং আরও বেশি কঠিন ছিল। প্রোটিনটির ফ্যাটি-স্ক্যাফোল্ড ধরে রাখার জন্যে প্রোটিন-কমপ্লেক্সটির (কয়েকটি প্রোটিন মিলে গঠন) আকার ছিল অনেক বড়; G-প্রোটিনটি বারবার কমপ্লেক্স থেকে পড়ে যাচ্ছিল; আর এইবারে রিসেপ্টরটির কোষ-আবরণীর অংশ ক্রিস্টালাইজেশানের সময় স্থিতি অবস্থায় আসছিল না। কোবিলকার ভাষ্যে- “কাজটি এতই কঠিন ছিল যে তা আদৌ করা সম্ভব কিনা সেটি নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল। মনে হচ্ছিল, এটি হবে আমার অবসর নেয়ার সময়কার প্রজেক্ট।” কিন্তু তিনি এও অবগত ছিলেন যে, অন্যান্য গবেষণাগার, বিশেষ করে যারা রোডপসিন নিয়ে কাজ করছে, তারা তাঁর ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছে!
এই পে্রক্ষিতে, বিভিন্ন বিষয়ের পন্ডিতদের কাছে কোবিলকা পরামর্শ চাচ্ছিলেন। এমনকি অ্যান আর্বার-এ অবস্থিত মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের G-প্রোটিন বিশেষজ্ঞ রজার সুনাহারার কাছেও গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে বিভিন্ন যায়গার বিভিন্ন গবেষণাদল ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে রিসেপ্টরের সাথে G-প্রোটিনকে স্থায়ীত্ব প্রদানের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল। যেমন কোনদল বিভিন্নরকম ডিটারজেন্ট তৈরি বা খুঁজে বের করা, কেউ লিপিড স্ক্যাফোল্ড তৈরি করা যেটা প্রোটিন-কমপ্লেক্সকে (গাঠনিক) সহায়তা দেবে, আর কেউ একটি এন্টিবডি প্রস্তুত করা যেটা এই সবকিছুকে একসাথে ধরে রাখবে এরকম বিভিন্ন গবেষণায় রত ছিল। অপরদিকে রাসমুসেন অদম্যভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন হাজার হাজার ধরনের ক্রিস্টালাইজেশানের পরিবেশ, এবং বিভিন্নভাবে প্রোটিনকে ইঞ্জিনিয়ার (বিভিন্ন পরিবর্তন এনে ক্রিস্টালাইজেশানের উপযোগী করা) করতে।
গত মে মাসের এক সকাল বেলায় কোবিলকা রাসমুসেনের একটি নতুন তৈরি করা ক্রিস্টাল তৈরির প্লেট অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দেখছিলেন (কেমন ক্রিস্টাল তৈরি হল সেটা দেখছিলেন)। তিনি বলছেন, “তারা (ক্রিস্টালগুলি) এরমধ্যেই দেখতে অন্যান্য সব বারের চেয়ে বেশ বড় হয়ে গিয়েছিল। এটি ছিল প্রচন্ড উত্তেজনাকর। আমি তখনও জানতাম না যে এরা ভালভাবে বিচ্ছুরণ ঘটাবে কিনা, কিন্তু আমার মন বলছিল হবে।” কিন্তু আগে থেকেই চীনে যাবার পরিকল্পনা ঠিক থাকায় প্রথম এক্স-রে ছবি দেখার জন্য সেখানে উপস্থিত থাকতে পারলেন না কোবিলকা। “বেইজিং এ হোটেলে পৌঁছাবার সঙ্গে সঙ্গেই সে অনলাইনে ঢুকলো,” বলছেন তং সান। “আর তার দলটির গঠনটি আবিষ্কার করতে পারার খবর শুনে সে তো পুরো আনন্দে আত্মহারা, যেন মেঘে ভেসে বেড়াচ্ছে! আর বুঝতেই পারছেন, সে ফিরে যাবার জন্য কত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।”
নতুন গঠনের ছবিটি ৩.২ Å রেজোলিউশান এ সমাধান করা হয়েছিল। তিনটি অণুর তৈরি একটি ত্রিমাত্রিক ছবিঃ ß2AR, যার একপাশে লাইগেন্ড যুক্ত হয়ে আছে আর অন্যপাশে G-প্রোটিন আটকে আছে। টেনেসি তে অবস্থিত ন্যাশভিল এর ভ্যানডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গাঠনিক জীববিজ্ঞানী চাক স্যান্ডার্স বলেন, “অবশ্যই অনেকের মধ্যেই প্রতিযোগিতা চলছিল (গঠনটি আবিষ্কার করতে পারা নিয়ে)। আর আমার মতে কোবিলকা ছিলেন সবার মধ্যে সেরা। আশা করছি এই বিষয়ে গবেষণা এখন আরও প্রসারিত হবে (যেহেতু সক্রিয় ত্রিমাত্রিক গঠনটি জানা হয়ে গেছে)। গঠনের আবিস্কারটি ছিল পুরস্কার (প্রতিযোগীদের মধ্যে), আর তার সমাধানও হয়ে গেল।”
কোবিলকা অবশ্যই সব কৃতিত্ব দিয়ে দিচ্ছেন তাঁর কোলাবরেটরদের আর তাদের যারা ল্যাবের ‘অলিখিত নায়ক’। তিনি নিশ্চিত করতে চাচ্ছিলেন যেন এই গল্পটিতে অংশগ্রহণকারী সবার নাম উল্লেখিত হয়, কেউ যেন বাদ না যায়। গঠনটির প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল বরাবরের মতই অটল। তিনি বলছেন, “আমরা যতই জানবো (এই প্রোটিনটির ব্যাপারে), ততই জটিল আর কৌতুহলকর হবে এরা।” ইতিমধ্যেই কোবিলকা এই প্রোটিনদের বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন, যেমনঃ সক্রিয় অবস্থায় কি কি বিভিন্ন রূপ রিসেপ্টরটি ধারণ করতে পারে, কেন বিভিন্ন রিসেপ্টর বিভিন্ন G-প্রোটিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, এবং যদি বিভিন্ন ধরনের লাইগেন্ড একই রিসেপ্টরে এসে যুক্ত তবে কি ঘটে ইত্যাদি। এজন্যে তিনি আরও নতুন কিছু পদ্ধতি, যেমন ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপি (electron microscopy, EM) এবং নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স (Nuclear Magnetic Resonance, NMR) এর শরণাপন্ন হচ্ছেন, যেগুলি দিয়ে GPCR-দের নড়াচড়ার মাত্রা এবং উদ্দেশ্য বোঝা যাবে। অসমাপ্ত এবং অজানা এই বিষয়টি নিয়ে তিনি বলছেন, “এ কাজটি এখনও করা হয়নি।”
যদিও এমনটি নাও ঘটতে পারে, তবুও কারও মধ্যে এই সন্দেহের অবকাশ থাকবেনা যে যদি কেউ পরবর্তী লক্ষ্যটিতে পৌঁছুতে পারেন তবে সেটি একমাত্র কোবিলকাই পারবেন। লেফকাউইট্জ বলছেন, “ব্রায়ান শেষপর্যন্ত তার লক্ষ্য অর্জন করেছে। হয়তো এতে ১৫ বছর সময় লেগেছে, কিন্তু সে তো তার লক্ষ্যে পৌঁছেছে!”
(সমাপ্ত)
খান তানজীদ ওসমান
মন্তব্য
লেখা ভালো লেগেছে।
হাত খুলে লিখতে থাকুন।
খুব ভালো লিখেছেন।
ধন্যবাদ
খুব সাবলীল অনুবাদ। খুব ভাল লাগল। চলুক।
ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন