পর্ব চার –ফিরে দেখা
চতুর্থ পর্বের শ্যুটিং শুরুর দুদিন আগেই ঝামেলা শুরু হল। রিহার্সালের জন্য সবাই একবার জড় হয়েছিলেম দুদিন আগে। হঠাত শোনা গেল একজন মূল প্রতিযোগী প্রতিমা পালিত বেঁকে বসেছেন। উনি নাকি বলছেন নাম তুলে নেবেন। ডিরেক্টরের মাথায় হাত।গত তিনটি পর্বের মার্কেট সার্ভে থেকে বোঝা গেছে এই মাসিমাটি ইতিমধ্যেই ঘরে ঘরে মা মাসিদের মন জয় করে ফেলেছেন। তার সাথে প্রবীনা প্রতিমা মাসিমার ‘সাবেকী রান্না’ এবং নবীনা ঝিলামের ‘আধুনিক কুকিং’ এর লড়াই বেশ ভালই জমে উঠেছে। এই অবস্থায় প্রতিমা পালিত নাম তুলে নিলে টি আর পি তলানিতে নেমে যাবে। কাজেই ডিরেক্টরের মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। চড়া গলায় রিমি কে জিজ্ঞেস করলেন “কি চান কি উনি?”
রিমি বলল “উনি বলছিলেন এই পর্বে না কি স্কুলের বাচ্চারা আসবে?...”
রিমির কথা শেষ না করতে দিয়ে ডিরেক্টর বললেন “হ্যাঁ তাতে প্রব্লেম কি? উনি বাচ্চা ভালবাসেন না?”
রিমি বলল “ তা নয় উনি কোথা থেকে খবর পেয়েছেন আমাদের “সেফটি প্রিকশন নাকি ভালো নয়, আমরা নাকি আগুন নেভাবার সব রকম ব্যাবস্থা রাখিনি, এতো গুলো বাচ্চাদের নিয়ে শো হবে উইদাউট এনি সেফটি প্রিকশন, সেটা উনি মেনে নিতে পারবেন না। তাই উনি শো থেকে সরে যেতে চান।“
ডিরেক্টর রাগে গরগর করতে করতে প্রতিমা পালিতের দিকে এগিয়ে গেলেন। বললেন “কি মনে করেছেন কি আপনি? আমি কিভাবে আমার শো চালাব, দমকল ডাকব না পুলিস ডাকব সেটা আমি বুঝব। আপনি রান্না করবেন , প্রাইজ নেবেন, চলে যাবেন।“
প্রতিমা পালিত শান্ত ভঙ্গীতে বললেন “তা হয় না বাবা, এতো গুলো মানুষের বিশেষত বাচ্চাদের প্রাণের ঝুঁকি নেওয়াটা অন্যায়। শো আপনার হলেও দায়িত্ব আমাদের সকলের।“
- “আপনি নাম তুলে নিলে কি সমস্যাটা মিটে যাবে? ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন, আমাদের অত বাজেট নেই।“
- “টাকা না থাকলে প্রাইজমানি কম করুন, অন্য কোথাও কম খরচ করুন, কিন্তু বাচ্চাদের নিয়ে শো করতে গেলে এইটুকু নিরাপত্তার ব্যাবস্থা করতেই হবে। আমি নাম তুলে নিলে সমস্যা হয়ত মিটবে না, কিন্তু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে পাপের ভাগী হতে পারব না। তাছাড়া আপনি উপযুক্ত অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা না করলে আমি বাচ্চাদের স্কুলে গিয়ে অনুরোধ করব তারা যেন এই শোতে বাচ্চাদের না পাঠান।“
- “আমার শো বন্ধ করে আপনার কি লাভ? আমরা আপনাকে এত নাম , যশ , পপুলারিটি পাইয়ে দিলাম, পুরো বেঙ্গলের লোক আপনাকে চেনে, কত ফ্যান পেলেন আপনি, আর আপনি আমাদের শো বন্ধ করে দিতে চাইছেন?”
- “নাম , যশ , পপুলারিটি কোনো কিছুই মানুষের প্রাণের থেকে বড় নয়। তাছাড়া সব নিয়ম মেনে সুষ্ঠ ভাবে শো করলে শো বন্ধ হবে কেন? হয়ত লাভ একটু কম হবে।”
- -“ভুলে যাবেননা আপনিও কিন্তু এই শো-এর অনেক নিয়ম মানেননি। এই যে আমরা প্রথম থেকে বলেছি যে প্রত্যেক প্রতিযোগীকে এপ্রন আর মাথায় টুপি পড়াটা আবশ্যিক, সেকথা আপনি শুনেছিলেন? এখন নিয়ম নিয়ে এই ঘ্যানঘ্যানটা জাস্ট সহ্য করতে পারছিনা।”
- - “দেখো বাবা, দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। তোমার এখন মাথা গরম বলে তর্ক করছ, কিন্তু তুমিও মনে মনে জানো যে একটা শুধু একটা বাহ্যিক ব্যাপার, আর আন্যটা অনেকগুলো জীবন নিয়ে খেলা।”
- - “বাহ্যিক কে বলল? টুপি পড়ার নিয়ম যাতে খাবারে চুল না পড়ে। এইসব বেসিক হাইজিন মেনেই আমাদের শো চালাতে হয়। যদি খাবারে আপনার চুল খেয়ে কারও পেট খারাপ হয় আর আমাদের স্যু করে? সে দায়িত্ত্ব কে নেবে? বলুন? আপনি দায়িত্ত্ব নেবেন?”
- - “দেখো আমাদের দেশে পেট খারাপ হলে স্যু করেনা। ওসব বিলিতি কেতা হয়ত। আর তাছাড়া আমি তো তোমাদের চ্যলেঞ্জ দিয়েছিলাম আমার রান্নায় একটাও চুল বের করে দেখাতে।”
- “দেখুন, আমি আপনার রান্নায় চুল বের করার ঠিকা নিয়ে রাখিনি। আপনিও শো-এর অনেক নিয়ম মানেননি সেটাই কথা। আর শুধু রান্নায় চুল পড়াই নয়, আমি এও দেখেছি আপনি রান্না চলাকালীন দু-মিনিট অন্তর অন্তর চুলে হাত দেন, খোঁপাটা আবার করে বাঁধার জন্য। এটাও যথেষ্ট আন-হাইজিনিক।”
- -“হ্যাঁ, আমার বাবা এটা বরাবরের অভ্যাস। তবে তুমি খোঁপা বাঁধাটা দেখেছ আর প্রত্যেক বার খোঁপায় হাত দেওয়ার পর হাত ধোওয়াটা দেখনি?”
- “আপনার যা ইচ্ছে করুন। আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করে সময় নষ্ট করতে চাইনা।” বলে ডিরেক্টর তখনকার মত রেগে চলে গেলেন। কিন্তু কিছুক্ষন পরে রিমি প্রতিমা পালিতকে জানালো ডিরেক্টর জানিয়েছেন উনি উপযুক্ত অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা করবেন। তারপর প্রতিমা পালিত রিহার্সালে গেলেন।
ডিরেক্টর হিসাব করে বুঝলেন একে তো প্রতিমা পালিতের সরে যাওয়াটা বিরাট লস। তারপর উন যদি স্কুলে , স্কুলে গিয়ে জানিয়ে দেন এই শো এর নিরাপত্তা ব্যাবস্থায় ফাঁক আছে তাহলে স্কুল গুলো বাচ্চা তো পাঠাবেই না, উপরন্তু মিডিয়া জানতে পারলে ছিঁড়ে খাবে। শো চালানো অসম্ভব হয়ে যাবে। তার থেকে লাভের অঙ্ক কিছু কম হওয়া ভাল।
ম্যাজিশিয়ান গুপ্তা শুনলেন ঝিলাম অন্য আরেক প্রতিযোগী রঞ্জনা হালদারকে বলছে “নাটকটা দেখলেন একবার, এইসব করে জমি তৈরী করছেন জাজেদের মন ভেজাবার জন্য। তবে লিখে রাখুন আজকালকার বাচ্চাদের মুখে ওনার সেকেলে রান্না রুচবে না।“
নিজের মেয়ের বয়সী বলেই বোধহয় ম্যাজিশিয়ান গুপ্তার ঝিলামকে ভালোই লাগে। উনি বুঝলেন প্রতিমা পালিতের জনপ্রিয়তায় ঝিলামের একটু হিংসা হচ্ছে। এইবয়সের মেয়েরা লাইমলাইটে থাকতে ভালবাসে। ঝিলাম স্মার্ট, সুন্দরী , মর্ডান হওয়া সত্ত্বেও প্রতিমা পালিতের কাছে কোথায় যেন হেরে যাচ্ছে। প্রত্যেক পর্বেই সকলে ঝিলামের রেসিপির তারিফ করে বলছে বাহ্ দারুন। কিন্তু শেষ বাজি মেরে বেরিয়ে যাচ্ছেন প্রতিমা মাসিমা। তাঁর রান্না মুখে দিয়ে সকলে বলছেন আহ্ অপূর্ব! কাজেই ঝিলামের এই প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ম্যাজিশিয়ান গুপ্তার মনে হল ঝিলামের কথাটা ভিত্তিহীন। প্রতিমা পালিতের এই বেঁকে বসা প্রচারের আলোয় থাকবার কৌশল নয়। উনি সত্যি বাচ্চাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।
“স্বাগতম! শাস্রিয়াকাল্! খুশ্আম্দিদ! ওয়েল্কাম! ‘ওস্তাদের মার শেষ পাতে’ শোয়ের সীজন টু-এর চতুর্থ পর্বে আপনাদের সবাইকে সুস্বাগতম্! আমি আপনাদের বন্ধু রিমি আবার আপনাদের সামনে এসে গেছি আপনাদের পছন্দের সেরা শো ‘ওস্তাদের মার শেষপাতে’র সীজন টু-এর চতুর্থ পর্বে বাংলার সেরা পাঁচজন প্রতিযোগী নিয়ে। আজকে আমাদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষিকা শ্রীমতী প্রতিমা পালিত, হোটেল ম্যানেজমেন্টের ছাত্রী ঝিলাম চন্দ্রা, ক্যালকাটা মেডিকাল কলেজের নার্স তনয়া বসু, হোমমেকার রঞ্জনা হালদার।
আমাদের আজকের পর্ব শিশুদিবস। আজকে আমাদের মধ্যে আছে বিভিন্ন স্কুলের দশ থেকে চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলে মেয়েরা। এরা আজ চারটি দলে ভাগ হয়ে চার জন প্রতিযোগীর সাথে থাকবে। প্রতিযোগীরা এদের রেসিপির পরিচয় দেবেন, এদের রান্নার সময় ছোটখাটো কাজে লাগাবেন এবং পরিবেশন করে খাওয়াবেন। ছাত্র ছাত্রীরা খাওয়ার পর প্রতিযোগীদের নম্বর দেবে।জাজেরা দেখবেন খাবারের পুষ্টিমুল্য ঠিক আছে কিনা। সকলে ঠিক মত খেল কিনা ইত্যাদি। ছেলে মেয়েদের পাতে খাবার পড়ে থাকলে বা জাঙ্কফুড খাওয়ালে ছাত্র ছাত্রীরা সর্বোচ্চ নম্বর দিলেও প্রতিযোগী জাজেদের বিচারে শেষকালে ছিটকে যেতে পারেন।“
রিমির ঘোষনার পর ক্যামেরা ঘুরে গেল স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের দলটির দিকে। প্রাথমিক পরিচয়ের পর রিমি তাদের চারটি দলে ভাগ করে দিল। চারটি দল চারজন প্রতিযোগীর চারপাশে গোল হয়ে বসল। আজকের পর্বের উদ্দেশ্য শুধু সুস্বাদু রান্না নয়। শিশুদের কিভাবে সঠিক , পুষ্টিকর খাবারের বিষয়ে মনোযোগী করে তোলা যায় সেই বিষয়টিও প্রতিযোগীদের নজর রাখতে হবে। রান্নার সময়টা তাদের ব্যাপৃত রাখতে হবে নানা কাজে বা গল্পে। যাতে রান্নাটির উপকরন ও তার গুনাগুন সম্পর্কে ছেলে মেয়েরা জানতে পারে।
আজকের পর্বে বিচারকেদের বিরতির খুব একটা অবকাশ নেই। প্রস্তুতির সময় ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে কোন প্রতিযোগী বাচ্চাদের সাথে কিভাবে মিশছেন। কতটা তাদের রান্নার কাজে ব্যাপৃত রাখছেন ইত্যাদি। ম্যাজিশিয়ান গুপ্তা দেখলেন তনয়া বসু রীতিমত ক্লাস নিচ্ছেন ছাত্র ছাত্রীদের। তিনি বানাবেন যবের খিচুরি। তিনি বোর্ডে ছক কেটে উপকরনের নাম , পুষ্টিমুল্য, ভিটামিন ভ্যালু সমস্ত মুখস্থ লিখে চলেছেন। ছেলে মেয়েরা স্কুলের বাইরে আবার আরেক দফা ক্লাস করতে রাজি নয়। ঐ দলের সকলেই প্রায় অমনোযোগী।
গৃহবধু রঞ্জনা হালদার মাঝবয়সি মহিলা। হয়ত তাঁর নিজের কিশোর বয়সি ছেলে মেয়ে আছে। তিনি বাচ্চাদের নরমে গরমে সামলাচ্ছিলেন। পালকের রুটি আর বীটের তরকারী যে ম্যাগির থেকে অনেক সুস্বাদু সেটা নানা ভাবে প্রমাণ করতে চাইছিলেন। ছেলেমেয়েরা সে কথা মানছে না। তর্কাতর্কি চলছে। কিন্তু ব্যাপারটা জমে উঠেছে ,ছেলে মেয়েরা বেশ উপভোগ করছে, রঞ্জনা তর্কের ফাঁকে বাবা বাছা বলে টুকটাক রান্নার কাজও করিয়ে নিচ্ছেন বাচ্চাদের দিয়ে।
ঝিলাম চন্দ্রার সাথে যে দলটা আছে তারা একেবারে নরক গুলজার করে রেখেছে। ঝিলাম নিজেও অল্প বয়সি, কাজেই ছেলে মেয়েদের সাথে খুব ভাব জমেছে। ম্যাজিসিয়া গুপ্তা শুনলেন ঝিলাম বাচ্চাদের বলছে বড়দের ধারণা বাড়ির খাবার সব পুষ্টিকর আর বাইরের খাবার মাত্রেই জাঙ্কফুড। একেবারেই ভুল ধারণা। আমাদের বাঙ্গালিবাড়ির রোজকার পাতের খাবার বেগুন ভাজা , পাঁপড়ভাজার মত জাংকফুড আর কিছু নেই। বরং পাঞ্জাবী ধাবায় বসে মেথিকা পরোঠা আর সরষঁকে শাক খাও, অনেক বেশী পুষ্টি, অনেক ভিটামিন, খেতেও ভাল।“ বেশীর ভাগ বাচ্চার বেগুন দুচক্ষের বিষ , কাজেই বেগুল ভাজার নিন্দা শুনে সবাই বেশ খুশি হল। ঝিলাম বানাচ্ছে মেক্সিকান ডিস। স্ম্যাসড্ বিনস্ , গুয়াকামল এবং সালসা স্যালাড। স্ম্যাসড্ বিনসের প্রধান উপকরন রাজমা, গুয়াকামল তৈরী হয় অ্যাভোক্যাডো নামের এক সবুজ সুস্বাদু ফল দিয়ে, সালসা স্যালাডে লাগে টাটকা সবজি ,ধনেপাতা লেবু আর টমেটো। সমস্ত উপকরন গুলি পুষ্টিকর। মেক্সিকান রান্নায় তেলে ভাজাভাজি করতে হয়না, কিন্তু সম্পুর্ন অন্য নাম এবং স্বাদের রান্না বাচ্চাদের মন কেড়েছে। ঝিলাম বাচ্চাদের ডেকরেশনের কাজে লাগিয়েছে। তাতে ছেলে মেয়েরা কাজেও আনন্দও পেয়েছে আবার দৃষ্টি নন্দন রান্না দেখে তাদের মনও ভুলেছে। ম্যাজিশিয়ান গুপ্তার মনে হল এই পর্বে ঝিলাম সত্যি অপ্রতিদ্বন্ধী। তারপর তিনি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন শেষ দলটির দিকে।
কাছে গিয়ে শুনলেন প্রতিমা মাসিমা বলছেন “প্রোটীন খুবই ভাল কিন্তু বাবা আমাদের দেশের লোক বেশির ভাগই গরীব, মাছমাংস খেতে পায় না, তাই ঘাসপাতা শাক সব্জির মধ্যেই পুষ্টি খুঁজতে হয়। তোমাদের আমি কাবাব , পোলাও , তন্দুরী সবই খাওয়াতে পারি কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোক যা খায় সেই খাবার খাওয়াই ভাল নয় কি?”
একটি মেয়ে বলল “কিন্তু আমার ভেজিস খেতে ভাল লাগে না।“
প্রতিমা মাসিমা একগাল হেসে বললেন “দূর পাগলি , ভেজিস আবার কি কথা? আমি যদি বলি ক্লাস সিক্সের মেয়েরা কোনো সব্জির নাম জানেনা, সেটা কি একটা কথা হল? বলতে হয় অন্বেশা কোনো সবজি চেনে না।“ অন্য বাচ্চারা হেসে উঠল। প্রতিমা মাসিমা তাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন “এবার বল তোর কি খেতে ভালো লাগে না?”
অন্বেশা বলল “আমার আলু, বেগুন , গাজর , বিনস , বাঁধাকপি , পালংশাক কিচ্ছু খেতে ভাল লাগে না।“।
প্রতিমা মাসিমা বল্লেব “ব্যাস শুধু এই ?”
আরেকটি ছেলে বলল “আমার ঝিঙ্গে ভাল লাগে না।“
এরপর কেউ বলল পটল , কেউ বলল লাউ কেউ কুমড়ো। সবার বলা শেষ হলে প্রতিমা মাসিমা বললেন “এগুলো ছাড়াও আমাদের দেশে অনেক সবজি হয়, তাই খেয়েই আমাদের দেশের গরীব মানুষ প্রোটীন ভিটামিনের চাহিদা মেটায়, মাটি কাটে , পাথর ভাঙ্গে , নৌকা বায় , মেঘনাদ সাহা , রমানুজম হয়ে ওঠে। বাচ্চারা বিস্মিত হয়ে বলল “আর কি সবজি হয়?”
-আরো অনেক রকম।, কল্মী , থানকুনি , পলতা পাতা , পাটশাক , কচুশাক ,ডুমুর , মোচা , সজনে খাড়া,আরো কত। কিনতেও হয়না সবসময়। মাঠে ঘাটে এমনি ফলে থাকে।
অন্বেশা বলল “আমি মোচা চিনি, দিদা বানিয়েছিল একবার , কিন্তু মা বলে খুব কঠিন মোচা রান্না।“
প্রতিমা মাসিমা হেসে বললেন “না জানলেই মনে হয় কঠিন। ক্লাস ফাইভে তুমি তো ভাবতে অঙ্কে সেট থীওরি না জানি কি কঠিন , ক্লাস সিক্সে সেই শিখে গেলে তখন কি আর কঠিন লাগে?”
ম্যাজিশিয়ান গুপ্তা আশ্চর্য হলেন। প্রতিমা মাসিমা সেট থীওরিরও খবর রাখেন?
আর একটি মেয়ে বলল “আমাদের একটা টেস্টি সব্জি রান্না শেখাবে?”
প্রতিমা মাসিমা বললেন “নিশ্চয়ই। আমি তোমাদের আজ যে রান্নাটা শেখাবো সেটা টু-ইন-ওয়ান আইসক্রীমের মত। একসাথে মেনকোর্স এবং সাইডডিস।“
ম্যাজিশিয়ান গুপ্তা আবার চমৎকৃত হলেন প্রতিমা মাসিমার ভাষার ব্যাবহারে। একেবারে একালের বাচ্চাদের মুখের ভাষায় কথা বলছেন তিনি।
প্রতিমা মাসিমা বললেন “এই রান্নাটির নাম থোড়ের মুড়িঘন্ট।“
একটি ছেলে বলল “মুড়িঘন্ট তো মাছের মুড়ো দিয়ে হয়।“
প্রতিমা মাসিমা বললেন “এ হল নিরামিশ মুড়িঘন্ট, আমাদের দেশের রান্না। লাগবে হচ্ছে থোড়। জানো থোড় কোথা থেকে হয়?”
বাচ্চারা মাথা নাড়ল। থোড় বিষয়ক কোনো প্রশ্ন পরিক্ষায় আসেনা। তাই বড়রা এসবশিখিয়ে সময় নষ্ট করেননি।
প্রতিমা মাসিমা বললেন “থোড় হল কলাগাছের কান্ড। জানোতো কলাগাছের কোনো অংশই ফেলা যায় না। ফল খায় তো জানোই , ফুল হল মোচা, কান্ড হল থোড়। যেমন পুষ্টি, তেমন স্বাদ। আয়রন, ভিটামিনে ভরপুর। আজকের রান্নায় থোড়ই আসল, এছাড়া লাগবে গোবিন্দভোগ চাল, বাদাম, ছোট এলাচ, তেল, নুন, চিনি,কাঁচালঙ্কা, আদা, তেজপাতা।“
এরপর প্রতিমা মাসিমা ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন রান্নার যোগাড়ে। সেইসাথে বাচ্চাদের কাজে ব্যাপৃত রাখলেন, গল্পছলে আমাদের দেশজ শাকসব্জির গুণাগুন বর্ণনা করলেন। ম্যাজিশিয়ান গুপ্তা অবাক হয়ে দেখলেন প্রতিমা পালিতের প্রতিটি ছেলে মেয়ের নাম মুখস্থ। ওদের সবার নাম ধরে বলছিলেন এটা কর, ওটা কর। একজনকে দেখালেন থোড় কেটে হাতে কালো দাগ হলে কিভাবে তুলতে হয়, আরেকজন কে সেখালেন কিভাবে অল্পতেলে বাদাম ভাজতে হয়। একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করল “দিদা বাদাম না দিয়ে কাজু বাদাম দিলে বেশী টেস্টি হত?”
প্রতিমা মাসিমা বললেন “তা হয় না, যে রান্নার যা উপকরন, তাছাড়া এসব হল আটপৌড়ে ঘরোয়া রান্না, ধর তোমাদের স্কুলে যাবার সময় তোমাদের মা চট করে বানিয়ে দিলেন বা বাড়িতে কেউ হঠাৎ এসে পড়লে বানিয়ে দেওয়া যায়। তাই ঘরে যা থাকে সেইসব জিনিস ব্যাবহার করাই ভাল।“
রান্না শেষ হলে সব দলের ছেলে মেয়েরা একি সময় খেতে বসল। তনয়া বসুর দলের ছেলে মেয়েরা এমনিতেই বোর হয়ে গিয়েছিল , তনয়া বসুর পরিবেশন করার স্টাইল ও গতানুগতিক , খাবার হিসাবেও যবের খিচুরি সুস্বাদু নয়। কাজেই খাবার পাতে পাতে পড়ে রইল।
রঞ্জনা হালদার পরিবেশনের সময় বেশ জোর করছিলেন, বিচারকরা অনেকেই ভুরু তু্ললেন।
ঝিলাম খুব হইচই করে পরিবেশন করছিল। ছেলে মেয়েরা নতুন স্বাদের খাবার প্রথম দিকে ভালই খাচ্ছিল। কিন্তু কিছুটা খাবার পর অনেকের আর কাঁচা স্যালাড , রাজমা সেদ্ধ মুখে রুচল না। কয়েকজনের খাবার ফেলে উঠে পড়ল।
প্রতিমা পালিত গল্পগুজবের মধ্যে সবাইকে পরিবেশন করে খাওয়াচ্ছিলেন। থোড়ের মুড়িঘন্ট অপূর্ব খেতে হয়েছিল। একটি ছেলে দুবার খেয়ে আবার চাইতে প্রতিমা মাসিমা বললেন “একসাথে বেশী খেও না বাবা। রান্না তো শিখে গেলে, বাড়ি গিয়ে মাকে বলো তৈরী করে দেবেন।“
রিমির এই পর্বে সঞ্চালনার কাজ বেশী ছিল না। মাইক হাতে এদিক ওদিক ঘুরে ছোটখাটো মন্তব্য করছিল। ওকে ডিরেক্টর একফাঁকে পাকড়াও করে বললেন “কি করছ রিমি? এতো গতানুগতিক শো হলে আমরা নেক্সট সীজনে ফিরে আসতে পারব না। কিছু একটা বড়সড় টুইস্ট লাগবে। লাস্ট মোমেন্টে সিকিওরিটির জন্য যা স্পেন্ড করতে হল, মনে হয় না প্রোডিউসার নেক্সট সীজনে টাকা ঢালতে রাজী হবে।“
রিমি একটু ঘাবড়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বলল “কি করব স্যার? প্রবীনা নবীনার ঝগড়াটা একটু উস্কে দেব?”
ডিরেক্টর বললেন “শুধু উস্কে দিও না, ওদের দিয়ে কিছু কন্ট্রোভার্সিয়াল মন্তব্য করাও। আমি ড্যাম সিওর ওরা দুজনেই ফাইনালে কোয়ালিফাই করবে।“
একটু ভেবে বললেন “তুমি এক কাজ কর, তুমি ওই ঝিলামের দিকে একটু ঝোঁকো। দর্শকদের মনে হতে দাও তুমি ঝিলাম কে ফেভার করছ। তাতে প্রতিমা পালিতের উপর সবার সহানুভুতি বাড়বে। ভদ্রমহিলা মাঝবয়সী মহিলাদের রোল মডেল হয়ে উঠেছেন।“
রিমি বুঝতে পারছিল না কি করতে হবে। একটু ইতস্তত করে বলল “ফাইনাল পর্বে কিছু কন্টিনেন্টাল ডিস বানাতে দেব ভাবছি স্যার, ঝিলামের সুবিধা হবে, প্রতিমা মাসিমা একটু ঝামেলায় পড়ে যাবেন।“
-“না না কন্টিনেন্টাল ডিস চাপিয়ে দিলে হবে না। তাতে করে আনফেয়ার কম্পিটিশান হয়ে যাবে। আমাদের আগের সীজনের মতই হোক। ফাইনাল পর্বে একটা মেইন ইনগ্রাডিয়েন্টের নাম বলে দেওয়া হবে। সেটা দিয়ে যে যা পারে বানাবে।”
-“তাহলে স্যার ওই ইনগ্রাডিয়েন্টটাই বিদেশী টাইপের করে দিই। আমাদের দেশী শাক সবজি দিলে প্রতিমা মাসিমা বাজী মেরে বেড়িয়ে যাবেন।“
ইতিমধ্যে বাচ্চাদের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে গেছে। বিচারক আর বাচ্চাদের দেওয়া নাম্বার হিসাব করে দেখা গেল প্রতিবারের মত এবারও প্রথম হয়েছেন প্রতিমা মাসিমা এবং দ্বিতীয় হয়েছে ঝিলাম চন্দ্রা।
রিমি তার স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছল ভঙ্গীতে বলল “প্রতিবারের মত এবারের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে প্রতিমা মাসিমা আর ঝিলামের মধ্যে। মাত্র তিন নম্বর কম পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছে ঝিলাম। দেখা যাক ফাইনালে শেষ হাসি কে হাসবে।“
রিমি ওদের দুজনকে ডাকল দুএক কথা বলার জন্য। প্রতিমা মাসিমা বললেন “সাবেকী বাংলা রান্না বাঙ্গালির রান্নাঘর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ দেখ আজকের শো প্রমাণ করে দিল নতুন প্রজন্মও সাবেকী রান্নার স্বাদ পছন্দ করে। বাংলার হারিয়ে যাওয়া রান্নাগুলি তুলে ধরব বলেই আমার এই শোতে আসা। আশা করি ফাইনালে রকমারি সাবেকী রান্না করার সুযোগ পাব।“ তারপর রিমির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন “ফাইনালের উপকরন তো তোমরা ঠিক করে দেবে, দেখ বাবা হাঁসের ঠ্যাং বা ব্যাং-এর ছাতা রাঁধতে বল না যেন।“
উপস্থিত দর্শক বিচারকরা প্রতিমা মাসিমার কথায় হেসে উঠলেন। শুধু ঝিলামের ভুরু কুঁচকে উঠল। প্রতিবার অল্পের জন্য দ্বিতীয় হতে ওর ভাল লাগছিল না। তাও যদি সেরকম কোনো হাই প্রোফাইল প্রতিদ্বন্ধী হত অত খারাপ লাগত না। এরকম সাধারন সেকেলে মাসিমা টাইপের বিপক্ষের কাছে তার মত আধুনিক, পেশাদার হোটেল ম্যানেজমেন্টের ছাত্রীর হেরে যাওয়া লজ্জাজনক। তাই রিমি যখন তাকে কিছু বলার জন্য ডাকল সে ভেতরে ভেতরে ফুটছিল। মাইক হাতে নিয়েই বলল “কুনালদা প্রথম পর্বেই বলেছিলেন প্রতিটি রেসিপি তার নিজের গুনে অনন্য ,তাই সব দেশের সব রকম রান্নাকে সন্মান করা উচিত। আমার মনে হয় এই কম্পিটিশন একটা প্ল্যাটফর্ম যেখানে দর্শকরা দেশ বিদেশের রান্নার সাথে পরিচিত হতে পারেন। শুধু আমার দেশের রান্না ভাল অন্যদের রান্না হাসি ঠাট্টার জিনিস এই মেন্টালিটি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রতিমা মাসিমা যাকে ব্যাঙ এর ছাতা বলে ঠাট্টা করলেন সেটি আমেরিকার মানুষের প্রিয় খাদ্য মাশরুম। আমাদের সাবেকী খাবার নয় বলেই মাশরুমের ওয়ান্ড ফেমাস প্রিপারেশন গুলো আমরা হেসে উড়িয়ে দিতে পারিনা।“
রিমি কথাটা লুফে নিল। বলল “তুমি ঠিক বলেছ ঝিলাম, আমাদের প্রতিযোগীতার একটা উদ্দেশ্য হল দর্শকরা দেশ বিদেশের রান্নার হদিস দেওয়া। না না আমরা কখনই বলিনি এখানে শুধুমাত্র বাঙ্গালি রান্না করতে হবে। আমাদের ফাইনালের নিয়ম হল একটা প্রধান উপকরন থাকবে, সেটা ব্যাবহার করে স্টার্টার , মেইনকোর্স , ডেজার্ড সমস্ত বানাতে হবে।“ রিমি একটু ভেবে নিয়ে বলল “আচ্ছা যদি ফাইনালের মূল উপকরণটা মাশরুম হয় কেমন হয়?” রিমির হঠাত্ ঘোষনা সকলেই একটু হকচকিয়ে গেল। ঝিলাম খুব পুলকিত হয়ে বলল “দারুন হয়, কন্টিনেন্টাল , চাইনীজ সবরকম প্রিপারেশন করা যাবে।“ প্রতিমা মাসিমা হঠাত এই ঘোষনা শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তবে হইহই করে উঠলেন না। সামান্য বিষন্ন ভঙ্গীতে বললেন “তোমাদের শো, তোমরা যা ঠিক করবে তাই রাঁধতে হবে, সে ব্যাঙ্গের ছাতাই হোক আর কাকের ডিম হোক। আর ব্যাং এর ছাতা এদেশেও হয়, একেবারে বিলিতি জিনিস নয়। আমরা ছোটবেলায় দেশেগ্রামে খেয়েছি। সেইসব তরকারী রাঁধব না হয়।“
এরপর প্রতিদিনের মত আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পর সেদিনের শো শেষ হল। ফাইনাল রাইন্ডে মাশরুমের আগমনে প্রতিমা মাসিমা একটু দমে গেলেন। দর্শকরা রিমির উপর রেগে উঠল, প্রতিমা মাসিমার উপর সকলের দরদ উঠলে উঠল।
রিমি ডিরেক্টরকে ডেকে বললেন “আপনি যা বলেছিলেন ঠিক তাই হয়েছে স্যার। ফাইনাল পর্বে মাশরুমের ডিস রাঁধতে হবে শুনে প্রতিমা মাসিমা মুষড়ে পড়েছেন, আর ঝিলাম দারুন খুশি। মাশরুমের নামটা ঝিলামের মাথায় এসেছিল, আমি ঝট করে কাজে লাগিয়ে দিলাম। ঠিক করেছি ত স্যার?”
ডিরেক্টর রিমির মত উচ্ছসিত হলেন না। বললেন “শুধু ওভাবে হবে না, লাস্ট মোমেন্টে এত বড় খরচ হয়ে গেল, কোনো প্রোডিউসার সীজন থ্রীতে টাকা ঢালতে রাজি হবে না। ওসব ছোটখাটো ঝগড়াঝাটিতে হবে না, ফাইনালে আমার এমন কোনো ঘটনা চাই যাতে আমাদের শো পরের দিনের নিউজ হেডলাইন হয়ে উঠতে পারে। ওই শালা বান্টির কথা শুনে আমি সিকিউরিটিতে খরচ কমিয়ে সেলেব্রিটি আনালাম, এদিকে লাস্ট মোমেন্টে প্রতিমা পালিতের জেদে এতগুলো এক্সট্রা খরচ হয়ে গেল। এখন ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখছি ভদ্রমহিলা কিছু ভুল বলেননি, একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেলে সারাজীবনের মত শো বন্ধ হয়ে যেত। ওই বান্টি যত নষ্টের গোড়া। নিজে লোভী , পাজী , চারিদিকে নষ্টামি করে বেড়ায়, যেকোনও ঝামেলা হলে টাকা দিয়ে মেটাতে চায় , ওর কথা শোনাই ভুল হয়েছে।“
রিমি কি বলবে বুঝতে পারছিল না।
ডিরেক্টর কিছুটা আনমনে বললেন “পরের সীজনে আমাদের ফিরতেই হবে, অ্যাট অ্যানি কস্ট।“
তাঁর চোখের চাহনিতে কি যেন ছিল, রিমি হাল্কা শিউরে উঠল।
ম্যাজিশিয়ান গুপ্তা দূরে বসেছিলেন। তিনি একবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
অরুণ বাসুর ঘরে ভিডিও-প্রিন্ট দেখে আর ম্যাজিশিয়ান গুপ্তার মুখের ফার্স্ট-হ্যান্ড অভিজ্ঞতার কথা শুনে, রনি ম্যাজিশিয়ান গুপ্তাকে বলল, “আচ্ছা কাকু, আপনার কি মনে হয়? কোন শোয়ের ডিরেক্টার তার শো এর টি-আর-পি বাড়ানোর জন্য কোন জাজ বা প্রতিযোগীকে খুন করতে পারে?”
- “এটার উত্তর তোমার বাবা বেশী ভালো দিতে পারবেন”, অরুণ বাসুর দিকে ফিরে ম্যাজিশিয়ান গুপ্তার মন্তব্য।
- “একেবারে খুন করে ফেলবে, এটা হয়ত কষ্টকল্পনা, কিন্তু পরিসংখ্যান কি বলে জানিস রনি? ফর্টি পার্সেন্ট খুন করা হয় না, হয়ে যায়। হয়ত চেষ্টা ছিল একটা ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার, কিন্তু হিসেবে সামান্য গড়বড় হয়ে যাওয়ায় খুন হয়ে যায়। জানিস কিনা জানি না, আত্মহত্যার কেসও তাই। ফিফটি পার্সেন্ট কেসে যে আত্মহত্যা করছে, সে চায়না পুরোপুরি নিজেকে শেষ করে দিতে। চায় তার বাবা-মা-প্রেমিক-প্রেমিকা এরকম কাউকে একটা চরম হুমকি দিতে যে, ‘দেখ, আমি কিন্তু নিজের জীবন শেষ করে দিতে পারি’। কিন্তু অনেকসময় হিসেবের গন্ডগোলে একটু ঘুমের ওষুধের পরিমাণ বা কীটনাশকের পরিমাণ বেশী হয়ে যায় বা গলার ফাঁসটা একটু বেশীই টাইট হয়ে যায়।
সেরকম এক্ষেত্রেও হয়ত ডাইরেক্টার ভেবেছিল বান্টিকে একটু শাস্তি দেবে, কিন্তু কোথাও একটা বড়সড় ভুল হয়ে এই বিভ্রাট। এই সম্ভাবনাটা আমি পুরোপুরি বাদ দিতে পারছিনা”, অরুণ বাসুর অভিজ্ঞ মতামত।
- “হ্যাঁ, এই দিকটা তো ভাবিইনি” তিষ্যা বলে উঠল।
- “আচ্ছা, রাজা বোসের কি এটা লাভ না ক্ষতি?” মিসেস বাসু জানতে চাইলেন।
- “ক্ষতি কেন? শো খবরের শিরোনামে চলে এল এটা তো পুরোটাই লাভ। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!” রনির উত্তর।
- ম্যাজিশিয়ান গুপ্তা বললেন “কিন্তু আমি যতদূর জানি, এই লাইনে অনেক সংস্কার থাকে। সেটে লোক খুন হয়েছে এটা জানলে অনেকেই ওঁর শো-এ নিজেকে জড়াতে চাইবে না। আর শুধু সংস্কারই বা বলছি কেন, ভাব তুমি যা ভাবছ, অন্যেও সেটা ভাবছে। যদি ভাবে যে ‘বাবা, রাজার সাথে ঝগড়া করলে শেষে মেরেও ফেলতে পারে’, এই উপলব্ধিটা খুব একটা লাভজনক নয় রাজার পক্ষে।”
- “হ্যাঁ, জাজ হিসেবে পরের সীজনে আমি বাবাকে আর যেতে দেবনা, এ আমি এখনই বলে দিলাম। সে রাজা জড়িত থাক আর না থাক। কিছুই বলা যায় না। আর অরুণ কাকু তো আরও ভয় পাইয়ে দিলেন।”
- “কেন? নতুন করে আমি কি ভয় খাওয়ালাম?”
- “ওই যে বললেন টাইট দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে খুন? আমি তো আরেকটা সম্ভবনা ভাবছি। আমি ভাবছি যে অন্য কাউকে টাইট দিতে গিয়ে যদি ভুল করে বান্টি খুন হয়ে গিয়ে থাকে? হয়ত রূপাকে খুন করার কোন মোটিভ ছিল কারোর বা কুণালকে, সেটা তো কেউ খতিয়ে দেখেইনি। কিন্তু অসাবধানে খুন হল বান্টি। সেরকম পরের সীজনে আবার অন্য কাইকে টাইট দিতে গিয়ে হয়ত কোন কারণে দেখা গেল বাবার কিছু একটা ভালো-মন্দ হয়ে গেল। ওরে বাবা, নানা, বাবা কিছুতেই সীজন থ্রীতে যাবে না।”
- “আরে তুই থাম। আমার কিস্যু হবে না। যাইহোক, গ্র্যান্ড ফাইনালের প্রিন্টটা দেখা যাক এইবার। এইটা খুব খুঁটিয়ে দেখতে হবে কারণ এইটার সেটেই বান্টি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ওয়েপন, অপর্চুনিটি আর মোটিভের ত্র্যহস্পর্শ এই রাউন্ডেই মিলবে।”
- “অবশ্য যদি এটা খুন হয় তবেই, আর সেটা একেবারে নিশ্চিত করে এখনই বলা যাচ্ছে না যতক্ষন না অটোপ্সি রিপোর্টটা আসছে”, অরুণ বাসুর সাবধানী মন্তব্য।
- “হ্যাঁ, তা তো বটেই”, সব্বাই সায় দিয়ে বলে উঠল।
[ক্রমশঃ]
- ঈপ্সিত আর চম্পাকলি
মন্তব্য
আগের তিন পর্ব এখানেঃ
পর্ব ১ -
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/46479
পর্ব ২ -
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/46554
পর্ব ৩ -
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/46617
- ঈপ্সিত/চম্পাকলি
ছুটির দিনে এমন রোমাঞ্চকর গল্প পড়তে কার না ভাল লাগে! টান টান উত্তেজনাকর এ সিরিজটির জন্য অনেক ধন্যবাদ, ইপ্সিত এবং চম্পাকলি!
কাজি ভাই, অনেক অনেক ধন্যবাদ। ছুটির দিনে পড়তে ভালো লাগবে বলেই আমরা শুক্রবার রাত্রে করে আপ্লোড করি।
সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে বসে ছিলাম ।
যারপরনাই আহ্লাদিত হলাম শুনে, অগ্নির!
সারাদিন নেট ছিলনা । এখন নেটে ঢুকেই এক দৌড়ে সচলে । গোগ্রাসে গিলে ফেললাম । কিন্তু আবারও অপেক্ষা ! পরের শুক্রবার পর্যন্ত কিছুতেই আমার ধৈর্যে কুলাবেনা । আপনারা অসাধারন গল্পকার
পেশেন্স ইজ এ ভার্চু!
সবুরে মেওয়া ফলবে আশা করি। আশা করি শেষে হতাশ করব না আমরা।
এবার শেষ পর্ব
আরে, আবার তাড়াহুড়ো নিশিতা?
হ্যাঁ পরের পর্ব হচ্ছে রীয়্যালিটি শো-এর শেষ পর্ব। তার পরের পর্বে যবনিকা।
আমাদের এফ্-এম্ চ্যানেলের মত করে বলিছি, সঙ্গে থাকুন, পড়তে থাকুন।
দারুন লেখা! দারুন!!
অসংখ্য ধন্যবাদ নুসরাত ভাই।
আপনি অন্য সব প্রতিযোগী দের যেভাবে প্রতি পর্বেই ফেল খাইয়ে দিচ্ছেন, তাতে মাঝে মধ্যে গল্পে ডুবে যাওয়াটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বই পড়লে লেখকের উপস্থিতি মনে থাকেনা। ব্লগে সেই সুযোগ টা নেই। এ জন্য যখন লিখছেন রঞ্জনা হালদারের খাবার শেষ পর্যন্ত হাল পেলনা, তখন মনে আসছে, লেখক আরেকটু ফেভার করলেও ত পারতেন! বড্ড একপেশে হয়ে যাচ্ছে।
একই লেখা বই আকারে পড়লে একই রকম মনে হত কিনা বলতে পারছিনা।
আরে আর বলেন কেন নুসরাত ভাই। শুরু করেছিলাম একটা ছোট খরগোশ বানাব বলে, আর শেষে তৈরি করলাম একটা হাতি। লিখতে লিখতেই ভাবছি বাকি প্রতিযোগীদের নির্মম ভাবে ফেল করিয়ে দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু লেখার টানে তরতর করে এগিয়ে যাওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছিলাম না। তাই বাকিদের বেশী ফুটেজ দিইনি।
যদি কোন্দিন কোন প্রকাশকের দয়া হয় আর গল্পের বই আকারে প্রকাশিত হয় আমাদের লেখা (আশা কম, হাচলই হলাম না এতগুলো লেখার পরেও) তখন রঞ্জনা, সুভদ্রা প্রমুখ চরিত্রদের আরও বেশী করে লাইমলাইটে আনব।
অনেক ধন্যবাদ পড়ে মন্তব্য করার জন্য।
এই পর্বটাও একই রকম ভালো লেগেছে। পরেরটার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।
আর আমি ভাবছিলাম অগ্নির, নিশিতা এরকম দুই একজন পেট্রন ছাড়া আর কেউ পড়ছে না।
পড়ে ভালো লেগেছে বলে আমরা খুব খুশী।
সব গুলো একসাথে পড়তে পারলে বেশি ভালো লাগতো।
চমৎকার লাগছে সিরিজটা!
চলুক চলুক
পশ্চিমবঙ্গে কী বলে জানি না, তবে বাংলাদেশে মোচা = থোড়। যেমন ধানগাছে শীষ আসার আগে যখন গাছের অগ্রভাগ ফুলে ওঠে তখন তাকে 'থোড় আসা' বলে। তাহলে কলাগাছের কান্ডের ভেতরের অংশকে (ধবধবে সাদা, সিলিন্ডার আকারের xylem বাহিকা) কী বলে? তাকে বলে 'ভাড়ালি'।
ভাড়ালি কেউ প্রথমে নুন-জলে সেদ্ধ করে নেয়। তবে এতে আয়রন কমে গিয়ে এর খাদ্যমান পড়ে যায়। আবার কেউ সেদ্ধ না করেই মিহি করে বেটে নেয়। মিহি করে না বাটলে আঁশ থেকে যায়। ভাড়ালি বাটাতে সামান্য ডাল বাটা (মসুর বা খেসারী) যোগ করা হয় যাতে চপগুলো বানানো যায়। কেউ এতে কুঁচো চিংড়ি আস্ত অথবা বেটে যোগ করেন। তারপর ডুবোতেলে ভাজা হলে যা হয় অমন খাবার স্বর্গেও পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। ডাল যোগ না করে চপ না বানিয়ে আস্ত কুঁচো চিংড়ি যোগ করে অল্প তেলে ভেজে হালুয়ার চেহারার একটা জিনিসও বানানো হয়। গরম ভাতের সাথে তার তুলনা হয় না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পশ্চিমবঙ্গে ভাড়ালি থোড় নামে পরিচিত। রেসিপিটা চমৎকার, করে দেখবার ইচ্ছা রইল। তবে মহি করে না বেঁটেও থোড়ের আঁশ ছাড়ানো যায়। বটি দিয়ে থোড় কোটার সময় হাতের আঙ্গুলে আঁশ জড়িয়ে রাখা যায়।
কলার মোচা মনে হয় কেবল যখন কলার কাঁদি গাছ থেকে বের হয়ে আসে, ঘোমটায় প্যাকেট হয়ে সেটাকে বলে। আমার বলি ঘোমটা ঢাকা বউ। উপরের দিকে কলা বের হয়ে যাওয়ার পরও নিচে অনেকখানি অংশ লম্বাটে প্যাকেটের মধ্যে থেকেই যায়। সেটার ভাজা ভাজা ঘণ্টও খুব মজার জিনিস, আমার আম্মা রান্না করত। আর থোড় বোধহয় কলাগাছের ভেতরের লম্বা সাদা অংশটা যেটা আপনি বললেন। আমার বর্তমান বাসার পেছন দিকে বাড়ির বাউন্ডারির মধ্যেই অনেকগুলো কলাগাছ আছে, কলাও হয় প্রচুর, প্রায়ই ভাবি আম্মার কাছ থেকে শুনে নিয়ে একদিন মোচার ঘণ্ট করবো, হয় না। আর গাছ থেকে থোড় বের করতে হলে তো বিশাল মহাভারত সাধ্য করা লাগবে!
আপনার লেখার হাত আসলেই খুব ম্যাচিউর। লিখতে থাকুন, আশা করি আপনার এই রোমাঞ্চকর সিরিজ শীঘ্রই মলাটের ভেতর দেখব!
যেদিন বানাবেন আম্মার থেকে শুনে, সেদিন আমাদের খবর দেবেন? পৌঁছে যাব খেতে।
শেষ টা জানার জন্য উশখুশ করছি। আশা করি হতাশ করবেন না।
অনেক অভিনন্দন।
অনেক ধন্যবাদ। আমরাও আশা করি শেষে হতাশ করব না।
আর বেশী দেরী নেই।
অপেক্ষায় আছি শেষ পর্বের!!
নতুন মন্তব্য করুন